ঢাকা ০৮:১৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৩ অগাস্ট ২০২৫

ঘুমাইনি, সারা রাত চুপচাপ বসে ছিলাম…

  • আপডেট সময় : ০২:১৮:২১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ অক্টোবর ২০২১
  • ১১৩ বার পড়া হয়েছে

প্রত্যাশা ডেস্ক : কয়েক দিনের ভ্যাপসা গরমে রংপুরে জনজীবন অতিষ্ঠ। অবশেষে গত সোমবার রাত থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। এতে জনজীবনে স্বস্তি ফিরলেও কষ্টে পড়েছে মাঝিপাড়া গ্রামের বড় করিমপুর এলাকায় হিন্দুপাড়ার শতাধিক মানুষ।
গত রোববার রাতে তাঁদের বসতঘর ভাঙচুর ও আগুনে পুড়িয়ে দেয় উত্তেজিত জনতা। এখন তাঁরা খোলা আকাশের নিচে। বৃষ্টির কারণে ওই সব মানুষের রাত কেটেছে অনেকটা বিনিদ্র। তাঁরা কেউ আশ্রয় নিয়েছিলেন স্থানীয় মন্দিরে, আবার তিনটি পরিবার ছিল অস্থায়ীভাবে রেড ক্রিসেন্টের করা তিনটি তাঁবুতে। এলাকাটি রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নে অবস্থিত। ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে গত রোববার রাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা চালানো হয়।
ওই রাতের ঘটনা সম্পর্কে লক্ষ্মী রাণী (৪২) মঙ্গলবার সকাল সাড়ে নয়টায় বলেন, ‘ওঁরা (উত্তেজিত জনতা) আগে আসি লুটা করছে। তারপর ঘরে আগুন দিয়া ভাগরাম হইছে। তার আগেই ভয়ে বাড়ি ছাড়ি আমি ছেলেকে নিয়া ধানখেতের ভেতর লুকাই থাকি জীবন বাঁচাইছি। ভোরে বাড়িতে আসিয়া দেখি সব শেষ। আমার চারটা ঘর পুড়ি দেছে। ৩টা গরু, ৫টা জাল, ৫০ হাজার টাকা আর টিভিটা লুট করছে। রাত থাকি বৃষ্টি নামছে। এ্যালা থাকার জায়গা নাই। রাতে আমি দেবরের বাড়িতে আর ছেলেটা তার চাচার বাড়িতে ছিল। এখন কী দিয়া ঘর নয়া করি সাজামো তার বুদ্ধি নাই।’
আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন রুপিন চন্দ্র দাস (৬০)। তিনি বলেন, ‘আমাদের তো সব শেষ। এখন বৃষ্টিটায় হইছে যন্ত্রণার। থাকি কোনটে। কীভাবে জেবন চলবে সেটা ভগবান জানে। রাইতে একখানে খাবার রান্না করি সবাইকে দিছে।’
সুমন চন্দ্র বলেন, ‘স্ত্রী ও ছোট দুই সন্তানকে নিয়ে রাতে মন্দিরে ছিলাম। ঘরে চাল নেই। থাকার জায়গা নেই। কী করি? ঘুমাইনি, সারা রাত চুপচাপ বসে ছিলাম। কাল দুপুরে রাতে রান্না করা খাবার দিছে। সেটা খাইছি।’
বৃষ্টির কারণে রাতে মন্দিরে রাত কাটানোর কথা জানান, পলাশ রায় ও রীতা রাণীসহ অন্তত ১০ জন। রীতা রাণী বলেন, ‘বৃষ্টিটায় এ্যালা যন্ত্রণা হইলো। খাবার নাই, ঘর নাই, টেকা নাই, থাকার জায়গাটাও নাই।’ রেড ক্রিসেন্টের পীরগঞ্জ উপজেলার দলনেতা সুমন ম-ল বলেন, বৃষ্টিতে বড় করিমপুর গ্রামের মানুষ দুর্ভোগে পড়েছে। গতকাল রাতে সেখানে তিনটি তাঁবু টাঙানো হয়েছে। আজ আরও দুটি তাঁবু টাঙানো হয়েছে। সেখানে পাঁচটি পরিবার থাকতে পারবে।
টয়লেট থেকে দেখছিলাম ঘরে আগুন দিচ্ছে : ‘আমাদের টয়লেট বাঁশঝারের ভিতর। আমি টয়লেটের ভিতর থেকে দেখছি ১৫-২০ জন মানুষ আমাদের বাড়িতে হামলা চালাচ্ছে। বাড়িতে আগুন দিচ্ছে। আমি সেখান থেকে বের হতে পারছি না।’
রংপুরের পীরগঞ্জের মাঝিপাড়ার রতন কুমার সেদিনের দেখা নিজের বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে। ফেসবুকে কথিত ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগ তুলে রোববার পীরগঞ্জের রামনাথপুর ইউনিয়নের বড় করিমপুর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে একদল লোক। এই তা-বে রতন কুমারের বাড়িঘরসহ সঞ্চিত সব সম্পদ পুড়ে শেষ হয়ে গেছে।
এই গ্রামের স্বর্ণবালার ছেলে রতন কুমার বলেন, ‘আমি বের হলে যদি তারা আমাকে মেরে ফেলে – তাই আমি বের হই নাই। আমি সেখান থেকে রাত ১২টার পর বের হই। বাড়িতে এসে দেখি গরু বিক্রি করা ১ লক্ষ ২০ টাকাসহ সবকিছু লুট করে নিয়ে গেছে তারা।’
তারা ‘আল্লাহু আকবার, নারায়ে তকবির’ শ্লোগান দিতে দিতে আসে উল্লেখ করে রতন কুমার তাদের বিচার দাবি করেছেন। তিল তিল করে গড়া সারা জীবনের সঞ্চয়সহ বসতঘর নিমেষেই পুড়ে শেষ হয়ে গেছে স্বর্ণবালার। তার একমাত্র সন্তান রতন কুমার। ছেলেকে বাঁচাবার জন্য বাড়ি সংলগ্ন বাঁশঝাড়ে লুকিয়ে রাখেন। সব সঞ্চয় হারিয়ে স্বর্ণবালা এখন নিঃস্ব। কেউ সান্ত¡না দিতে গেলে হাউ-মাউ করে কাঁদছেন।
স্বর্ণবালা সেই রাতের হামলার বিবরণ দিতে গিয়ে হাউ-মাউ করে কাঁদতে থাকেন। ‘বাবা হামরা গ্রামত থাকি। হামরা সন্ধ্যা হলে ভাত খাওয়াদাওয়া শেষে শুয়ে পড়ি। সেই সন্ধ্যার পর প্রতিদিনের মতো আমার একমাত্র ছেলেকে নিয়ে আঙ্গিনায় ভাত খাইতে বসছি। আর সবাই এসে হামার বাড়িত হামলা চালায়।’
তখন ছেলে রতনকে তিনি বাড়ির পাশের বাঁশঝাড়ে শৌচাগারে লুকিয়ে রাখেন। ‘ভাত খাওয়া ছেড়ে আমার ছেলে রতন কুমারকে টয়লেটে লুকিয়ে রাখি রাত ১২টা পর্যন্ত। আমার একটা ছেলে; আর আমার কেউ নাই। যদি আমার ছেলেকে তারা মেরে ফেলে, আমি কাকে নিয়ে বাঁচবো?’ পুলিশ আসার পর তার ছেলে টয়লেট থেকে বের হন বলে তিনি জানান। দুর্গাপূজার মধ্যে কুমিল্লার ঘটনার পর রোববার রাতে পীরগঞ্জের এক হিন্দু তরুণের ফেইসবুকে ইসলাম অবমাননার কথিত অভিযোগ তুলে রামনাথপুর ইউনিয়নে জেলেপল্লীর হিন্দু পরিবারের উপর হামলা হয়। হামলাকারীরা ঘর ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি লুটপাটও করে।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

ঘুমাইনি, সারা রাত চুপচাপ বসে ছিলাম…

আপডেট সময় : ০২:১৮:২১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ অক্টোবর ২০২১

প্রত্যাশা ডেস্ক : কয়েক দিনের ভ্যাপসা গরমে রংপুরে জনজীবন অতিষ্ঠ। অবশেষে গত সোমবার রাত থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। এতে জনজীবনে স্বস্তি ফিরলেও কষ্টে পড়েছে মাঝিপাড়া গ্রামের বড় করিমপুর এলাকায় হিন্দুপাড়ার শতাধিক মানুষ।
গত রোববার রাতে তাঁদের বসতঘর ভাঙচুর ও আগুনে পুড়িয়ে দেয় উত্তেজিত জনতা। এখন তাঁরা খোলা আকাশের নিচে। বৃষ্টির কারণে ওই সব মানুষের রাত কেটেছে অনেকটা বিনিদ্র। তাঁরা কেউ আশ্রয় নিয়েছিলেন স্থানীয় মন্দিরে, আবার তিনটি পরিবার ছিল অস্থায়ীভাবে রেড ক্রিসেন্টের করা তিনটি তাঁবুতে। এলাকাটি রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নে অবস্থিত। ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে গত রোববার রাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা চালানো হয়।
ওই রাতের ঘটনা সম্পর্কে লক্ষ্মী রাণী (৪২) মঙ্গলবার সকাল সাড়ে নয়টায় বলেন, ‘ওঁরা (উত্তেজিত জনতা) আগে আসি লুটা করছে। তারপর ঘরে আগুন দিয়া ভাগরাম হইছে। তার আগেই ভয়ে বাড়ি ছাড়ি আমি ছেলেকে নিয়া ধানখেতের ভেতর লুকাই থাকি জীবন বাঁচাইছি। ভোরে বাড়িতে আসিয়া দেখি সব শেষ। আমার চারটা ঘর পুড়ি দেছে। ৩টা গরু, ৫টা জাল, ৫০ হাজার টাকা আর টিভিটা লুট করছে। রাত থাকি বৃষ্টি নামছে। এ্যালা থাকার জায়গা নাই। রাতে আমি দেবরের বাড়িতে আর ছেলেটা তার চাচার বাড়িতে ছিল। এখন কী দিয়া ঘর নয়া করি সাজামো তার বুদ্ধি নাই।’
আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন রুপিন চন্দ্র দাস (৬০)। তিনি বলেন, ‘আমাদের তো সব শেষ। এখন বৃষ্টিটায় হইছে যন্ত্রণার। থাকি কোনটে। কীভাবে জেবন চলবে সেটা ভগবান জানে। রাইতে একখানে খাবার রান্না করি সবাইকে দিছে।’
সুমন চন্দ্র বলেন, ‘স্ত্রী ও ছোট দুই সন্তানকে নিয়ে রাতে মন্দিরে ছিলাম। ঘরে চাল নেই। থাকার জায়গা নেই। কী করি? ঘুমাইনি, সারা রাত চুপচাপ বসে ছিলাম। কাল দুপুরে রাতে রান্না করা খাবার দিছে। সেটা খাইছি।’
বৃষ্টির কারণে রাতে মন্দিরে রাত কাটানোর কথা জানান, পলাশ রায় ও রীতা রাণীসহ অন্তত ১০ জন। রীতা রাণী বলেন, ‘বৃষ্টিটায় এ্যালা যন্ত্রণা হইলো। খাবার নাই, ঘর নাই, টেকা নাই, থাকার জায়গাটাও নাই।’ রেড ক্রিসেন্টের পীরগঞ্জ উপজেলার দলনেতা সুমন ম-ল বলেন, বৃষ্টিতে বড় করিমপুর গ্রামের মানুষ দুর্ভোগে পড়েছে। গতকাল রাতে সেখানে তিনটি তাঁবু টাঙানো হয়েছে। আজ আরও দুটি তাঁবু টাঙানো হয়েছে। সেখানে পাঁচটি পরিবার থাকতে পারবে।
টয়লেট থেকে দেখছিলাম ঘরে আগুন দিচ্ছে : ‘আমাদের টয়লেট বাঁশঝারের ভিতর। আমি টয়লেটের ভিতর থেকে দেখছি ১৫-২০ জন মানুষ আমাদের বাড়িতে হামলা চালাচ্ছে। বাড়িতে আগুন দিচ্ছে। আমি সেখান থেকে বের হতে পারছি না।’
রংপুরের পীরগঞ্জের মাঝিপাড়ার রতন কুমার সেদিনের দেখা নিজের বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে। ফেসবুকে কথিত ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগ তুলে রোববার পীরগঞ্জের রামনাথপুর ইউনিয়নের বড় করিমপুর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে একদল লোক। এই তা-বে রতন কুমারের বাড়িঘরসহ সঞ্চিত সব সম্পদ পুড়ে শেষ হয়ে গেছে।
এই গ্রামের স্বর্ণবালার ছেলে রতন কুমার বলেন, ‘আমি বের হলে যদি তারা আমাকে মেরে ফেলে – তাই আমি বের হই নাই। আমি সেখান থেকে রাত ১২টার পর বের হই। বাড়িতে এসে দেখি গরু বিক্রি করা ১ লক্ষ ২০ টাকাসহ সবকিছু লুট করে নিয়ে গেছে তারা।’
তারা ‘আল্লাহু আকবার, নারায়ে তকবির’ শ্লোগান দিতে দিতে আসে উল্লেখ করে রতন কুমার তাদের বিচার দাবি করেছেন। তিল তিল করে গড়া সারা জীবনের সঞ্চয়সহ বসতঘর নিমেষেই পুড়ে শেষ হয়ে গেছে স্বর্ণবালার। তার একমাত্র সন্তান রতন কুমার। ছেলেকে বাঁচাবার জন্য বাড়ি সংলগ্ন বাঁশঝাড়ে লুকিয়ে রাখেন। সব সঞ্চয় হারিয়ে স্বর্ণবালা এখন নিঃস্ব। কেউ সান্ত¡না দিতে গেলে হাউ-মাউ করে কাঁদছেন।
স্বর্ণবালা সেই রাতের হামলার বিবরণ দিতে গিয়ে হাউ-মাউ করে কাঁদতে থাকেন। ‘বাবা হামরা গ্রামত থাকি। হামরা সন্ধ্যা হলে ভাত খাওয়াদাওয়া শেষে শুয়ে পড়ি। সেই সন্ধ্যার পর প্রতিদিনের মতো আমার একমাত্র ছেলেকে নিয়ে আঙ্গিনায় ভাত খাইতে বসছি। আর সবাই এসে হামার বাড়িত হামলা চালায়।’
তখন ছেলে রতনকে তিনি বাড়ির পাশের বাঁশঝাড়ে শৌচাগারে লুকিয়ে রাখেন। ‘ভাত খাওয়া ছেড়ে আমার ছেলে রতন কুমারকে টয়লেটে লুকিয়ে রাখি রাত ১২টা পর্যন্ত। আমার একটা ছেলে; আর আমার কেউ নাই। যদি আমার ছেলেকে তারা মেরে ফেলে, আমি কাকে নিয়ে বাঁচবো?’ পুলিশ আসার পর তার ছেলে টয়লেট থেকে বের হন বলে তিনি জানান। দুর্গাপূজার মধ্যে কুমিল্লার ঘটনার পর রোববার রাতে পীরগঞ্জের এক হিন্দু তরুণের ফেইসবুকে ইসলাম অবমাননার কথিত অভিযোগ তুলে রামনাথপুর ইউনিয়নে জেলেপল্লীর হিন্দু পরিবারের উপর হামলা হয়। হামলাকারীরা ঘর ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি লুটপাটও করে।