ঢাকা ০৪:৪২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

গ্যাস বিলের অন্যায্য পদ্ধতি এবং আবারও দাম বাড়ানোর ‘সিদ্ধান্ত’

  • আপডেট সময় : ১২:৫০:৩৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১ জুন ২০২৩
  • ৫৬ বার পড়া হয়েছে

আমীন আল রশীদ : বাজারব্যবস্থার ধর্মই হলো সেখানে বিক্রেতা যে সেবা বা পণ্যটি বিক্রি করবেন, তার বিনিময়ে ক্রেতা মূল্য পরিশোধ করবেন। কিন্তু সেবা বা পণ্য না দিয়েই যদি ক্রেতার কাছ থেকে মূল্য নেওয়া হয় কিংবা ১ টাকার সেবা দিয়ে যদি ১০ টাকা মূল্য নেওয়া হয়, সেটি অন্যায্য। আবাসিক খাতে যারা পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহকৃত গ্যাস ব্যবহার করেন, অনেক দিন ধরেই তারা এই অন্যায্য পদ্ধতির শিকার। তারই মধ্যে শুরু হয়েছে নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ। গণমাধ্যমের খবর বলছে, পাইপলাইনের গ্যাস ব্যবহারকারী গ্রাহকদের চুলার বিল বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে তিতাস। তারা ২ চুলায় মাসিক গ্যাসের বিল ৫১২ টাকা এবং ১ চুলায় মাসে ৩৯০ টাকা বাড়াতে চায়। প্রসঙ্গত, গত বছরের জুনে আবাসিক গ্রাহকদের গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছিল। সেই দাম অনুযায়ী এখন ২ চুলার মাসিক বিল ১ হাজার ৮০ টাকা এবং ১ চুলার বিল ৯৯০ টাকা। কিন্তু এই দামও যথেষ্ট মনে করছে না তিতাস। তারা এখন ২ চুলায় গ্যাসের মাসিক বিল করতে চায় ১ হাজার ৫৯১ টাকা আর ১ চুলায় ১ হাজার ৩৭৯ টাকা। গণমাধ্যমে এই খবর প্রকাশের পর রাজধানীতে এক কর্মশালা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হবে। সরকার এই ২ খাতে আর ভর্তুকি দেবে না। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম নির্ধারণের নীতিমালা প্রণয়নের কাজ চলছে বলেও তিনি জানান। (দ্য ডেইলি স্টার বাংলা, ১৮ মে ২০২৩) প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও ভর্তুকি কমানোর পক্ষে। গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিনিয়োগ ভবনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনকালে তিনি বলেন, ‘এত বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দেওয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়।’ ইংল্যান্ড ১৫০ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা কিন্তু সেই পর্যায়ে যাইনি। গ্যাস-বিদ্যুৎ দেওয়া যাবে ক্রয়মূল্যে। আমরা ভর্তুকি দেব কৃষিতে, খাদ্য উৎপাদনে।’ (প্রথম আলো, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)
তার মানে এটি স্পষ্ট, তিতাস যে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে, সেটি সরকার মেনে নেবে। অর্থাৎ ১ বছরের মাথায় আবারও গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হচ্ছে। তিতাসের প্রস্তাব অনুযায়ী ২ চুলার বিল ৫১২ টাকায় বাড়ানো হবে, নাকি কিছু কম, সেটি এখনো নিশ্চিত নয়। তবে আগে যেমন কোম্পানি ও ভোক্তাদের উপস্থিতিতে গণশুনানি করে দাম বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতো এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি), এখন আর সেই বাধ্যবাধকতা নেই। এখন সরকার চাইলে নির্বাহী আদেশ তথা একটি প্রজ্ঞাপন দিয়েই দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিতে পারে। কেননা গণশুনানি ছাড়াই যাতে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো যায়, সেজন্য গত ২৯ জানুয়ারি এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (সংশোধন) বিল সংসদে পাস হয়েছে। এই আইন প্রণয়নের পরে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন ‘অকার্যকর’ বা ‘নখদন্তহীন বাঘে’ পরিণত হলো কি না—সে প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। তবে আবাসিক খাতের গ্যাস নিয়ে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এর অন্যায্য বিলিং সিস্টেম। দীর্ঘদিন ধরেই নাগরিকদের তরফে এই অভিযোগ রয়েছে যে তারা মাস শেষে যে টাকা সরকারকে দেন, সেই তুলনায় গ্যাস পান না। সকাল ৮টার পরে, আবার কোথাও ৮টার মধ্যে গ্যাস চলে যায়। আসে বিকালে। অর্থাৎ মানুষের রান্নাবান্নার কাজে যখন সবচেয়ে বেশি গ্যাসের প্রয়োজন, তখনই গ্যাস নেই। ফলে বাধ্য হয়ে মধ্য রাতে বা শেষ রাতে ঘুম থেকে উঠে রান্না করতে হয়। এভাবে সবাই এই পথ অনুসরণ করা শুরু করলে দেখা যাবে, এই সময়েও গ্যাসের চাপ কমে যাবে। গ্যাসের এরকম তীব্র হাহাকার থাকলেও পোস্ট পেইড মিটারের গ্রাহকদের ২ চুলার জন্য মাস শেষে ১ হাজার ৮০ টাকা বিল ঠিকই দিতে হচ্ছে। অথচ পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে ৪ জনের একটি পরিবার মাসে এখন হয়তো ৩০০ টাকার গ্যাসও পায় না। প্রিপেইড মিটারের গ্রাহকরা এ ক্ষেত্রে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন। অর্থাৎ গ্যাসের চাপ কম থাকলে বা গ্যাস কম ব্যবহার করলে তাদের বিলও দিতে হয় সেই অনুসারে। কিন্তু পোস্ট পেইড গ্রাহকদের উভয় সংকট। তারা গ্যাস পাচ্ছেন না, উল্টো নিয়মিত বিল দিয়ে যেতে হচ্ছে। এর মধ্যে এখন আবারও দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে—যা সাধারণ গ্রাহকদের জন্য নতুন যন্ত্রণার কারণ হবে। অর্থাৎ পণ্যের খবর নেই, কিন্তু দাম বাড়ছে বছর বছর—যা নিঃসন্দেহে একটি অন্যায্য ব্যবস্থা।
তবে শুধু আবাসিক গ্রাহকরা নন, পর্যাপ্ত গ্যাস না পাওয়ায় ভুগছে শিল্পকারখানাগুলোও। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, গ্যাস সংকটের কারণে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রামের অনেক শিল্পকারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কোথাও কোথাও কারখানা বন্ধও রাখতে হচ্ছে। এতে করে শিল্পকারখানাগুলোকে বিপুল লোকসান দিতে হচ্ছে। সামগ্রিক অর্থনীতিতে নিশ্চয়ই এর প্রভাব পড়বে। আবার গ্যাসের বিকল্প জ্বালানি দিয়ে কল-কারখানা চালু রাখা অনেক ব্যয়বহুল। তাতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। বাসা-বাড়িতে অনেকে বৈদ্যুতিক চুলার ব্যবহার করেন। কিন্তু যখন দিনের একটা বড় সময় বিদ্যুৎ থাকছে না, তখন ওইসব চুলাও ব্যবহার করা যায় না। উপরন্তু বৈদ্যুতিক চুলার ব্যবহার বাড়লে বিদ্যুতে আরও চাপ বাড়বে। গ্রাহকের বিদ্যুতের বিলও বাড়বে। সব মিলিয়ে পুরো গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাত নিয়ে মানুষকে এখন একদিকে অনেক টাকা খরচ করতে হচ্ছে, আবার সেই টাকা খরচ করেও তারা কাঙ্ক্ষিত সেবাও পাচ্ছে না। তিতাস কেন ১ বছরের মাথায় আবারও গ্যাসের দাম বাড়াতে চায়? তাদের দাবি, মিটারবিহীন আবাসিক গ্যাস ব্যবহারকারীরা বিইআরসি নির্ধারিত সীমার চেয়ে অতিরিক্ত গ্যাস ব্যবহার করেন। তারা গৃহস্থালি রান্নাবান্নার কাজ ছাড়াও পানি ফুটানো এবং বিভিন্ন শিল্পাঞ্চল অধ্যুষিত এলাকায় কলকারখানার শ্রমিক এবং বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় সাবলেট ভাড়াটিয়ারা একাধিক পরিবারের রান্নার জন্য পালাক্রমে গ্যাস ব্যবহার করেন। এতে বেশি গ্যাস ব্যবহৃত হয়। তিতাসের এই বক্তব্য অযৌক্তিক নয়। যদি হয় তাহলে প্রশ্ন হলো, সব গ্রাহকের বাসায় কেন প্রিপেইড মিটার বা বিদ্যুতের মতো যতটুকু ব্যবহার ততটুকু বিল—এই পদ্ধতি চালু করা হচ্ছে না? এটি হলে গ্রাহকদেরও সুবিধা। তারা তখন নিজেদের স্বার্থেই হিসাব করে গ্যাস ব্যবহার করবেন। আর সংকটের কারণে যদি তারা সঠিক সময়ে সঠিক চাপে গ্যাস না পান, তাহলে ওই মাসে তাদের বিলও কম আসবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেউ কেউ বেশি ব্যবহার করেন বলে তার দায় কম ব্যবহারকারীরা কেন নেবেন? একজন ১০০ টাকা দিয়ে ৩০০ টাকার সুবিধা নেন বলে যিনি প্রকৃতই ১০০ টাকার সুবিধা নেন, তাকেও কেন ৩০০ টাকা গুণতে হবে? অর্থাৎ একটি পরিবার মাসে ৩০০ টাকার সমপরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করে মাসে বিল দেবে ১ হাজার ৮০ টাকা, অথচ আরেকটি পরিবার ১ হাজার ৫০০ টাকার সমপরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করেও ওই একই বিল দেবে, তা হয় না।
সরকার বলছে ভর্তুকি কমাবে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সেবা খাত থেকে ভর্তুকি তুলে নেওয়া মানে হলো স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনযাপন আরও কঠিন হবে। ভর্তুকি তুলে দেওয়া মানে এখন যাকে মাসে গ্যাসের জন্য ১ হাজার ৮০ টাকা খরচ করতে হয়, তাকে খরচ করতে হবে ১ হাজার ৫০০ টাকা। এখন যাকে মাসে বিদ্যুৎ বিল দিতে হয় ১ হাজার টাকা, তাকে হয়তো বিল দিতে হবে ১ হাজার ৫০০ বা ২ হাজার টাকা। এভাবে অন্যান্য খাতেও ভর্তুকি কমানোর ফলে যদিও সেইসব পণ্য ও সেবার মূল্য বেড়ে যায়, তাহলে সাধারণ মানুষ সেগুলো কীভাবে সামলাবে? যে হারে নিত্যপণ্য এবং রাষ্ট্রীয় সেবার মূল্য বাড়ছে, সেই তুলনায় মানুষের আয় কি বাড়ছে? যদি আয় না বাড়ে এবং বিপরীতে সেবার মূল্য বৃদ্ধি পায়, তাহলে মানুষ কোন খাতে খরচ কমাবে? সন্তানের পড়ালেখার খরচ সে কমাতে পারবে না। ওষুধের খরচও কমানো যাবে না। সে খরচ কমাবে বিনোদনে। খরচ কমাবে পোশাকে। সর্বোপরি খরচ কমাবে খাবারে। এখন যে ব্যক্তি সপ্তাহে ১ দিন মাংসে কেনেন, তিনি তখন মাংস কিনবেন মাসে ১ দিন। তার পাত থেকে ডিম উঠে যাবে বা কমে যাবে। এভাবে খরচের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে সাধারণ মানুষ আপস করবে স্বাস্থ্য ও পুষ্টির সঙ্গে। ভর্তুকি কমালে সচ্ছল ও ধনীদের সমস্যা হবে না। কিন্তু একটি কল্যাণরাষ্ট্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হলো সবচেয়ে কম আয়ের মানুষটিও যাতে খেয়েপরে ভালো মতো বেঁচে থাকতে পারে—সেটি নিশ্চিত করা। সুতরাং, ভর্তুকি কমানোর পক্ষে যতই যুক্তি দেওয়া হোক না কেন—সাধারণ মানুষ তার ভিকটিম হচ্ছে কি না—সরকারকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সেইসঙ্গে রাষ্ট্রের যে সেবা নাগরিকরা পয়সার বিনিময়ে গ্রহণ করে, সেখানে কোনো বৈষম্য বা অন্যায্যতা আছে কি না—সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা এবং থাকলে সেখানে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করে নাগরিকদের স্বস্তি নিশ্চিত করা দরকার। বিদ্যুতের মতো যতটুকু খরচ ততটুকু বিল—গ্যাস খাতেও এই পদ্ধতি চালু হচ্ছে না কেন? কিছু গ্রাহকের বাসায় প্রিপেইড মিটার বসানো হয়েছে। সেখানে খরচ কম। যেহেতু দিনের বিরাট সময় গ্যাস থাকেই না এবং যখন থাকে তখন নাগরিকরাও প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত গ্যাস ব্যবহার করেন না, ফলে তাদের খরচ কম হয়। সুতরাং শুধু গ্যাস খাতে অন্যায্য বিলিং সিস্টেমের মধ্য দিয়ে নাগরিকদের কাছ থেকে বাড়তি পয়সা আদায় বন্ধ করাই নয়, বরং যখন গ্যাস থাকে, সেই সময়েও কেউ যাতে গ্যাসের অপব্যবহার বা অতিরিক্ত ব্যবহার না করে সেজন্যও এর বিলিং সিস্টেম বিদ্যুতের মতো করা দরকার। এতে নাগরিকদের অসন্তোষ যেমন কমবে, তেমনি রাষ্ট্রীয় সম্পদ গ্যাসও সাশ্রয় হবে।

 

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার লার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

গ্যাস বিলের অন্যায্য পদ্ধতি এবং আবারও দাম বাড়ানোর ‘সিদ্ধান্ত’

আপডেট সময় : ১২:৫০:৩৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১ জুন ২০২৩

আমীন আল রশীদ : বাজারব্যবস্থার ধর্মই হলো সেখানে বিক্রেতা যে সেবা বা পণ্যটি বিক্রি করবেন, তার বিনিময়ে ক্রেতা মূল্য পরিশোধ করবেন। কিন্তু সেবা বা পণ্য না দিয়েই যদি ক্রেতার কাছ থেকে মূল্য নেওয়া হয় কিংবা ১ টাকার সেবা দিয়ে যদি ১০ টাকা মূল্য নেওয়া হয়, সেটি অন্যায্য। আবাসিক খাতে যারা পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহকৃত গ্যাস ব্যবহার করেন, অনেক দিন ধরেই তারা এই অন্যায্য পদ্ধতির শিকার। তারই মধ্যে শুরু হয়েছে নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ। গণমাধ্যমের খবর বলছে, পাইপলাইনের গ্যাস ব্যবহারকারী গ্রাহকদের চুলার বিল বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে তিতাস। তারা ২ চুলায় মাসিক গ্যাসের বিল ৫১২ টাকা এবং ১ চুলায় মাসে ৩৯০ টাকা বাড়াতে চায়। প্রসঙ্গত, গত বছরের জুনে আবাসিক গ্রাহকদের গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছিল। সেই দাম অনুযায়ী এখন ২ চুলার মাসিক বিল ১ হাজার ৮০ টাকা এবং ১ চুলার বিল ৯৯০ টাকা। কিন্তু এই দামও যথেষ্ট মনে করছে না তিতাস। তারা এখন ২ চুলায় গ্যাসের মাসিক বিল করতে চায় ১ হাজার ৫৯১ টাকা আর ১ চুলায় ১ হাজার ৩৭৯ টাকা। গণমাধ্যমে এই খবর প্রকাশের পর রাজধানীতে এক কর্মশালা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হবে। সরকার এই ২ খাতে আর ভর্তুকি দেবে না। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম নির্ধারণের নীতিমালা প্রণয়নের কাজ চলছে বলেও তিনি জানান। (দ্য ডেইলি স্টার বাংলা, ১৮ মে ২০২৩) প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও ভর্তুকি কমানোর পক্ষে। গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিনিয়োগ ভবনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনকালে তিনি বলেন, ‘এত বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দেওয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়।’ ইংল্যান্ড ১৫০ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা কিন্তু সেই পর্যায়ে যাইনি। গ্যাস-বিদ্যুৎ দেওয়া যাবে ক্রয়মূল্যে। আমরা ভর্তুকি দেব কৃষিতে, খাদ্য উৎপাদনে।’ (প্রথম আলো, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)
তার মানে এটি স্পষ্ট, তিতাস যে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে, সেটি সরকার মেনে নেবে। অর্থাৎ ১ বছরের মাথায় আবারও গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হচ্ছে। তিতাসের প্রস্তাব অনুযায়ী ২ চুলার বিল ৫১২ টাকায় বাড়ানো হবে, নাকি কিছু কম, সেটি এখনো নিশ্চিত নয়। তবে আগে যেমন কোম্পানি ও ভোক্তাদের উপস্থিতিতে গণশুনানি করে দাম বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতো এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি), এখন আর সেই বাধ্যবাধকতা নেই। এখন সরকার চাইলে নির্বাহী আদেশ তথা একটি প্রজ্ঞাপন দিয়েই দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিতে পারে। কেননা গণশুনানি ছাড়াই যাতে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো যায়, সেজন্য গত ২৯ জানুয়ারি এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (সংশোধন) বিল সংসদে পাস হয়েছে। এই আইন প্রণয়নের পরে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন ‘অকার্যকর’ বা ‘নখদন্তহীন বাঘে’ পরিণত হলো কি না—সে প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। তবে আবাসিক খাতের গ্যাস নিয়ে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এর অন্যায্য বিলিং সিস্টেম। দীর্ঘদিন ধরেই নাগরিকদের তরফে এই অভিযোগ রয়েছে যে তারা মাস শেষে যে টাকা সরকারকে দেন, সেই তুলনায় গ্যাস পান না। সকাল ৮টার পরে, আবার কোথাও ৮টার মধ্যে গ্যাস চলে যায়। আসে বিকালে। অর্থাৎ মানুষের রান্নাবান্নার কাজে যখন সবচেয়ে বেশি গ্যাসের প্রয়োজন, তখনই গ্যাস নেই। ফলে বাধ্য হয়ে মধ্য রাতে বা শেষ রাতে ঘুম থেকে উঠে রান্না করতে হয়। এভাবে সবাই এই পথ অনুসরণ করা শুরু করলে দেখা যাবে, এই সময়েও গ্যাসের চাপ কমে যাবে। গ্যাসের এরকম তীব্র হাহাকার থাকলেও পোস্ট পেইড মিটারের গ্রাহকদের ২ চুলার জন্য মাস শেষে ১ হাজার ৮০ টাকা বিল ঠিকই দিতে হচ্ছে। অথচ পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে ৪ জনের একটি পরিবার মাসে এখন হয়তো ৩০০ টাকার গ্যাসও পায় না। প্রিপেইড মিটারের গ্রাহকরা এ ক্ষেত্রে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন। অর্থাৎ গ্যাসের চাপ কম থাকলে বা গ্যাস কম ব্যবহার করলে তাদের বিলও দিতে হয় সেই অনুসারে। কিন্তু পোস্ট পেইড গ্রাহকদের উভয় সংকট। তারা গ্যাস পাচ্ছেন না, উল্টো নিয়মিত বিল দিয়ে যেতে হচ্ছে। এর মধ্যে এখন আবারও দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে—যা সাধারণ গ্রাহকদের জন্য নতুন যন্ত্রণার কারণ হবে। অর্থাৎ পণ্যের খবর নেই, কিন্তু দাম বাড়ছে বছর বছর—যা নিঃসন্দেহে একটি অন্যায্য ব্যবস্থা।
তবে শুধু আবাসিক গ্রাহকরা নন, পর্যাপ্ত গ্যাস না পাওয়ায় ভুগছে শিল্পকারখানাগুলোও। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, গ্যাস সংকটের কারণে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রামের অনেক শিল্পকারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কোথাও কোথাও কারখানা বন্ধও রাখতে হচ্ছে। এতে করে শিল্পকারখানাগুলোকে বিপুল লোকসান দিতে হচ্ছে। সামগ্রিক অর্থনীতিতে নিশ্চয়ই এর প্রভাব পড়বে। আবার গ্যাসের বিকল্প জ্বালানি দিয়ে কল-কারখানা চালু রাখা অনেক ব্যয়বহুল। তাতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। বাসা-বাড়িতে অনেকে বৈদ্যুতিক চুলার ব্যবহার করেন। কিন্তু যখন দিনের একটা বড় সময় বিদ্যুৎ থাকছে না, তখন ওইসব চুলাও ব্যবহার করা যায় না। উপরন্তু বৈদ্যুতিক চুলার ব্যবহার বাড়লে বিদ্যুতে আরও চাপ বাড়বে। গ্রাহকের বিদ্যুতের বিলও বাড়বে। সব মিলিয়ে পুরো গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাত নিয়ে মানুষকে এখন একদিকে অনেক টাকা খরচ করতে হচ্ছে, আবার সেই টাকা খরচ করেও তারা কাঙ্ক্ষিত সেবাও পাচ্ছে না। তিতাস কেন ১ বছরের মাথায় আবারও গ্যাসের দাম বাড়াতে চায়? তাদের দাবি, মিটারবিহীন আবাসিক গ্যাস ব্যবহারকারীরা বিইআরসি নির্ধারিত সীমার চেয়ে অতিরিক্ত গ্যাস ব্যবহার করেন। তারা গৃহস্থালি রান্নাবান্নার কাজ ছাড়াও পানি ফুটানো এবং বিভিন্ন শিল্পাঞ্চল অধ্যুষিত এলাকায় কলকারখানার শ্রমিক এবং বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় সাবলেট ভাড়াটিয়ারা একাধিক পরিবারের রান্নার জন্য পালাক্রমে গ্যাস ব্যবহার করেন। এতে বেশি গ্যাস ব্যবহৃত হয়। তিতাসের এই বক্তব্য অযৌক্তিক নয়। যদি হয় তাহলে প্রশ্ন হলো, সব গ্রাহকের বাসায় কেন প্রিপেইড মিটার বা বিদ্যুতের মতো যতটুকু ব্যবহার ততটুকু বিল—এই পদ্ধতি চালু করা হচ্ছে না? এটি হলে গ্রাহকদেরও সুবিধা। তারা তখন নিজেদের স্বার্থেই হিসাব করে গ্যাস ব্যবহার করবেন। আর সংকটের কারণে যদি তারা সঠিক সময়ে সঠিক চাপে গ্যাস না পান, তাহলে ওই মাসে তাদের বিলও কম আসবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেউ কেউ বেশি ব্যবহার করেন বলে তার দায় কম ব্যবহারকারীরা কেন নেবেন? একজন ১০০ টাকা দিয়ে ৩০০ টাকার সুবিধা নেন বলে যিনি প্রকৃতই ১০০ টাকার সুবিধা নেন, তাকেও কেন ৩০০ টাকা গুণতে হবে? অর্থাৎ একটি পরিবার মাসে ৩০০ টাকার সমপরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করে মাসে বিল দেবে ১ হাজার ৮০ টাকা, অথচ আরেকটি পরিবার ১ হাজার ৫০০ টাকার সমপরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করেও ওই একই বিল দেবে, তা হয় না।
সরকার বলছে ভর্তুকি কমাবে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সেবা খাত থেকে ভর্তুকি তুলে নেওয়া মানে হলো স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনযাপন আরও কঠিন হবে। ভর্তুকি তুলে দেওয়া মানে এখন যাকে মাসে গ্যাসের জন্য ১ হাজার ৮০ টাকা খরচ করতে হয়, তাকে খরচ করতে হবে ১ হাজার ৫০০ টাকা। এখন যাকে মাসে বিদ্যুৎ বিল দিতে হয় ১ হাজার টাকা, তাকে হয়তো বিল দিতে হবে ১ হাজার ৫০০ বা ২ হাজার টাকা। এভাবে অন্যান্য খাতেও ভর্তুকি কমানোর ফলে যদিও সেইসব পণ্য ও সেবার মূল্য বেড়ে যায়, তাহলে সাধারণ মানুষ সেগুলো কীভাবে সামলাবে? যে হারে নিত্যপণ্য এবং রাষ্ট্রীয় সেবার মূল্য বাড়ছে, সেই তুলনায় মানুষের আয় কি বাড়ছে? যদি আয় না বাড়ে এবং বিপরীতে সেবার মূল্য বৃদ্ধি পায়, তাহলে মানুষ কোন খাতে খরচ কমাবে? সন্তানের পড়ালেখার খরচ সে কমাতে পারবে না। ওষুধের খরচও কমানো যাবে না। সে খরচ কমাবে বিনোদনে। খরচ কমাবে পোশাকে। সর্বোপরি খরচ কমাবে খাবারে। এখন যে ব্যক্তি সপ্তাহে ১ দিন মাংসে কেনেন, তিনি তখন মাংস কিনবেন মাসে ১ দিন। তার পাত থেকে ডিম উঠে যাবে বা কমে যাবে। এভাবে খরচের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে সাধারণ মানুষ আপস করবে স্বাস্থ্য ও পুষ্টির সঙ্গে। ভর্তুকি কমালে সচ্ছল ও ধনীদের সমস্যা হবে না। কিন্তু একটি কল্যাণরাষ্ট্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হলো সবচেয়ে কম আয়ের মানুষটিও যাতে খেয়েপরে ভালো মতো বেঁচে থাকতে পারে—সেটি নিশ্চিত করা। সুতরাং, ভর্তুকি কমানোর পক্ষে যতই যুক্তি দেওয়া হোক না কেন—সাধারণ মানুষ তার ভিকটিম হচ্ছে কি না—সরকারকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সেইসঙ্গে রাষ্ট্রের যে সেবা নাগরিকরা পয়সার বিনিময়ে গ্রহণ করে, সেখানে কোনো বৈষম্য বা অন্যায্যতা আছে কি না—সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা এবং থাকলে সেখানে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করে নাগরিকদের স্বস্তি নিশ্চিত করা দরকার। বিদ্যুতের মতো যতটুকু খরচ ততটুকু বিল—গ্যাস খাতেও এই পদ্ধতি চালু হচ্ছে না কেন? কিছু গ্রাহকের বাসায় প্রিপেইড মিটার বসানো হয়েছে। সেখানে খরচ কম। যেহেতু দিনের বিরাট সময় গ্যাস থাকেই না এবং যখন থাকে তখন নাগরিকরাও প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত গ্যাস ব্যবহার করেন না, ফলে তাদের খরচ কম হয়। সুতরাং শুধু গ্যাস খাতে অন্যায্য বিলিং সিস্টেমের মধ্য দিয়ে নাগরিকদের কাছ থেকে বাড়তি পয়সা আদায় বন্ধ করাই নয়, বরং যখন গ্যাস থাকে, সেই সময়েও কেউ যাতে গ্যাসের অপব্যবহার বা অতিরিক্ত ব্যবহার না করে সেজন্যও এর বিলিং সিস্টেম বিদ্যুতের মতো করা দরকার। এতে নাগরিকদের অসন্তোষ যেমন কমবে, তেমনি রাষ্ট্রীয় সম্পদ গ্যাসও সাশ্রয় হবে।