অর্থনৈতিক প্রতিবেদক : নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে লিটল গ্রুপের ইন্টিমেট স্পিনিং মিলে দিনে ১০ হাজার পাউন্ড সুতা উৎপাদনের সক্ষমতা আছে। গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ জেনারেটরের মাধ্যমে ২ হাজার ৮৫০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা রয়েছে তাদের। সঙ্গে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে আছে পল্লি বিদ্যুতের ৯০০ কিলোওয়াটের সংযোগ। গত ১০ দিন ধরে সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত গ্যাসের চাপ প্রায় থাকছেই না। তাতে সক্ষমতার মাত্র ৪০ শতাংশ উৎপাদন হচ্ছে কারখানাটিতে। একই শিল্পগোষ্ঠীর আরেকটি স্পিনিং মিল আছে সাভারে। লিটল স্টার নামের সেই কারখানা গ্যাস-সংকটের কারণে কয়েক মাস ধরেই ভুগছে। সেখানেও গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ জেনারেটর রয়েছে। তবে সকাল ছয়টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত থাকছে না গ্যাসের চাপ। তাতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। লিটল গ্রুপের চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, দিনের বেশির ভাগ সময় গ্যাসের চাপ থাকছে না। পাশাপাশি বিদ্যুতের লোডশেডিং চলছে। এতে একদিকে কমছে উৎপাদন, অন্যদিকে যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে। ফলে দুই দিক থেকেই লোকসান বাড়ছে। গত ১০ বছরে আমাদের এমন কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাবে কারখানাগুলো। তাতে কিছু কারখানা বন্ধও হয়ে যেতে পারে। কারণ, সবার পক্ষে বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার করে উৎপাদন সচল রাখা সম্ভব হবে না।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ,গবেষণা পরিচালক, সিপিডি লিটল গ্রুপের দুই কারখানার মতো ইস্পাত, সিরামিক, গ্লাসসহ গ্যাসনির্ভর অধিকাংশ শিল্পই গ্যাস-সংকটে ভুগছে। মিলছে না নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎও। ফলে অধিকাংশ কারখানায় সক্ষমতার চেয়ে অনেক কম পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। এদিকে গত দুই-তিন সপ্তাহে কোনো কোনো এলাকার শিল্পকারখানায় গ্যাসের সংকট তীব্র হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের প্লামি ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক বলেন, দিনের বড় একটি সময়ই গ্যাসের চাপ থাকছে না। এতে কাপড় রং করতে সমস্যা হচ্ছে। উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় স্পেনভিত্তিক এক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের ক্রয়াদেশের পণ্য নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রস্তুত করা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। পোশাক ও বস্ত্র খাতের চেয়েও গ্যাস–সংকটে বেশি ভুগছে সিরামিক কারখানা। সম্প্রতি সিরামিক কারখানাগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টাকে চিঠি দেয় বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) সভাপতি সিরাজুল ইসলাম মোল্লা। চিঠিতে বিসিএমইএ সভাপতি বলেন, ঢাকার সাভার ও ধামরাই; নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও মেঘনাঘাট; গাজীপুরের কাশিমপুর, ভবানীপুর, ভাওয়াল মির্জাপুর, শ্রীপুর, মাওনা; নরসিংদীর পাঁচদোনা; ময়মনসিংহের ভালুকা ও ত্রিশাল এবং হবিগঞ্জের মাধবপুর ও বাহুবলের ২৫টি সিরামিক তৈজসপত্র, টাইলস ও স্যানিটারিওয়্যার কারখানায় তীব্র গ্যাস-সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এসব কারখানায় ১৫ দিন ধরে সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত একটানা ১২ ঘণ্টা গ্যাস থাকছে না। বিসিএমইএর সাধারণ সম্পাদক ইরফান উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত সপ্তাহে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে বৈঠকের পর গাজীপুরের হোতাপাড়ায় আমাদের ফার সিরামিকের কারখানায় গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে।’ সিরামিকশিল্প গ্যাসনির্ভর হলেও ইস্পাতশিল্পে সবচেয়ে বেশি দরকার হয় বিদ্যুৎ। চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ না পাওয়ায় এ খাতটিরও উৎপাদন এখন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। যেসব ইস্পাত কারখানা গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, তারা পড়েছে সবচেয়ে বেশি বিপাকে। রাজধানীর কোনাপাড়ায় শাহরিয়ার স্টিল মিলসে দিনে ৩০০ থেকে ৪০০ টন রড উৎপাদন করা হয়। এ জন্য তাদের ২৪ মেগাওয়াটের বিদ্যুতের প্রয়োজন। তার মধ্যে ডিপিডিসির ২০ মেগাওয়াটের লাইন আছে তাদের। বাকিটা আসে গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ জেনারেটরের মাধ্যমে। বেশ কিছুদিন ধরেই দিনের বেলায় গ্যাসের চাপ থাকছে না। ফলে ক্যাপটিভ জেনারেটর চালাতেও সমস্যা হচ্ছে। এ বিষয়ে শাহরিয়ার স্টিল মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মাসাদুল আলম বলেন, গ্যাসের সংকট ইদানীং আরও তীব্র হয়েছে। এতে আমরা আমাদের উৎপাদন সক্ষমতার ৫০ শতাংশের নিচে উৎপাদন করছি। মোস্তফা হাকিম গ্রুপের চট্টগ্রামের সীতাকু- ও কর্ণফুলীতে দুটি ইস্পাত কারখানা রয়েছে। গ্রুপটির পরিচালক মোহাম্মদ সরওয়ার আলম বলেন, গ্যাস-বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে পণ্যের উৎপাদন খরচ কেবল বাড়ছেই। এদিকে গ্যাস–সংকটের সমাধান চেয়ে বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী গত বৃহস্পতিবার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রীকে চিঠি দেন। চিঠিতে তিনি বলেন, এত দিন সরকারের নানা পদক্ষেপের কারণে গাজীপুর, শ্রীপুর ও ভালুকা শিল্পাঞ্চলে কারখানাগুলোতে গ্যাস সরবরাহ মোটামুটি ভালো ছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এ সংকট তীব্র হয়েছে। দ্রুত পরিস্থিতির উন্নতি না হলে পর্যায়ক্রমে বস্ত্রকলগুলো রুগ্ন হয়ে পড়বে। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের কারণে শিল্প খাতে প্রভাবের বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাবে কারখানাগুলো। তাতে কিছু কারখানা বন্ধও হয়ে যেতে পারে। কারণ, সবার পক্ষে বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার করে উৎপাদন সচল রাখা সম্ভব হবে না। তিনি আরও বলেন, চাপের মুখে সরকার এলএনজি আমদানি করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে এলএনজির চেয়ে ভালো বিকল্প হচ্ছে, অভ্যন্তরীণ প্রাকৃতিক গ্যাস।
গ্যাস-বিদ্যুতের স্বল্পতা শিল্পে সংকট আরও বেড়েছে
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ