ঢাকা ০২:১৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রভাব এবং কিছু প্রস্তাব

  • আপডেট সময় : ১০:১৫:২৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১২ জুন ২০২২
  • ১১৪ বার পড়া হয়েছে

মর্তুজা হাসান সৈকত : বিভিন্ন সংগঠনের বিরোধিতা সত্ত্বেও ভোক্তা পর্যায়ে সব ধরনের গ্যাসের দাম গড়ে ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ বাড়িয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। গত ৫ জুন বিকেলে ভার্চুয়াল সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে গ্যাসের নতুন এ দাম ঘোষণা করেছেন বিইআরসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আবু ফারুক। প্রাথমিক ও মৌলিক জ্বালানি বলে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির এই প্রভাব পড়বে তৈরি পোশাক, শিল্প উৎপাদন, বিদ্যুৎ থেকে শুরু করে জনজীবনের প্রায় সর্বত্র।
গত নভেম্বরে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিকে কারণ দেখিয়ে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বাড়িয়েছিল সরকার। গত ছয় মাসে মাসে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির এই বিরূপ প্রভাব হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে সাধারণ মানুষ। কারণ, সেই মূল্য বৃদ্ধি শুধু জ্বালানি তেলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, গণপরিবহনসহ বাজারের সব নিত্যপণ্যের ওপর গিয়ে পড়েছে। এই অবস্থার মধ্যে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে উঠতে পারে। কারণ, যখন শিল্পকারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে গ্যাসের অভাবে, অনেক বাসাবাড়িতে গ্যাসের অভাবে বিকল্প ব্যবস্থায় রান্নার কাজ চলছে, পূর্ব ইউরোপীয় দুই দেশের যুদ্ধের প্রভাবে বাংলাদেশের বাজারে খাদ্যশষ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে- তখনই এলো দাম বাড়ানোর এই ঘোষণা ।
অন্যদিকে, গ্যাসের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। গত মার্চ মাসে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির তোড়জোড়ের মধ্যেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর দাবি জানিয়ে রেখেছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এ ক্ষেত্রে তারা বলছে, গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে বিদ্যুতের পাইকারি দামও বাড়াতে হবে। কারণ, দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় গ্যাস থেকে। ফলে, গ্যাসের দাম বাড়লে বিদ্যুতের দামও বাধ্য হয়েই বাড়াতে হবে। তদুপরি, সারও উৎপাদন করা হয় গ্যাস পুড়িয়ে। সেখানে ২৫৯ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়েছে। তাহলে সমীকরণ বলছে দাম বাড়বে সারেরও। যার প্রভাব গিয়ে পড়বে কৃষিতে।
কিছুদিন আগে এমনিতেই ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতে এক দফা দুর্ভোগের শিকার হয়েছে সাধারণ মানুষ। এ অবস্থায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো মানে হলো- তা সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনে আরেকটি বড় ধাক্কা আসা। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, এই দাম বৃদ্ধিতে শুধু সাধারণ মানুষের দুর্ভোগই কিন্তু বাড়বে না, দেশের শিল্প-কারখানা তথা শিল্পক্ষেত্রেও পড়বে এর নেতিবাচক প্রভাব। এই মূল্যবৃদ্ধি উচ্চবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত কিংবা ধনিক শ্রেণির জীবনমানে তেমন প্রভাব ফেলবে না হয়তো; কিন্তু মধ্যবিত্ত, নি¤œবিত্ত, সীমিত ও স্বল্প আয়ের মানুষকে যে দুর্ভোগের মধ্যে পড়বে, তা বলাই বাহুল্য। এ পরিস্থিতিতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়া উৎপাদন-বণ্টনসহ মানুষের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তুলবে। তার পরিবর্তে এই বিতরণ কোম্পানিগুলোর মধ্যে থাকা দুর্নীতি-অনিয়ম বন্ধ করাসহ সিস্টেম লস কমিয়ে সম্পদের সঠিক ব্যবহার করে কীভাবে ভর্তুকির চাপ কমানো যায়, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়ার সময় এসেছে। কারণ, খোদ রাজধানীর অনেক এলাকেই বৈধ সংযোগের চেয়ে অবৈধ সংযোগের সংখ্যা অনেক বেশি। অভিযোগ রয়েছে, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তিতাসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মদদেই এসব অবৈধ সংযোগ দেওয়া হয়। রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তিতাসের কোনো বৈধ সংযোগ না থাকলেও এখানকার প্রতিটি ঘরেই জ্বলে গ্যাসের চুলা। কেবল বাসা নয়, বস্তির দোকান আর রেস্তোরাঁগুলোতেও রয়েছে তিতাসের এই অবৈধ চুলার সংযোগ। বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর এসেছে, তিতাসের লোকজনের মাধ্যমেই পাওয়া যায় এই সংযোগ। শুধু কড়াইল বস্তি নয় রাজধানী এবং এর আশপাশে জালের মতো ছড়িয়ে আছে অবৈধ গ্যাস সংযোগ। দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করতে না পারলে গ্যাসের বার বার বাড়িয়েও লাভ নেই।

যদিও পেট্রোবাংলা বিশ্ববাজারে এলএনজির দামের ঊর্ধ্বগতিকে অজুহাত হিসেবে খাড়া করছে। কিন্তু গ্যাসের এই দাম বৃদ্ধির বিষয়ে বিইআরসির একজন সদস্যের বরাত দিয়ে কিছুদিন আগে গণমাধ্যমে খবর এসেছে, পেট্রোবাংলা বর্তমানে সিস্টেমে যে ৩০৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করছে, তার মধ্যে এলএনজি থেকে পাওয়া যাচ্ছে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এগুলো আসছে কাতার আর ওমান থেকে। দেশ দুটির সাথে এলএনজি আমদানির দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির শর্তানুসারে আগামী ৮-১০ বছরে এটার দাম খুব একটা ওঠানামা করার কথা না। আর ২৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস নিজস্ব উৎস থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে, যেটা বেশ সস্তা। অনেক কম খরচেই উৎপাদন করা হয়। আর বাকী থাকা ১৫০ মিলিয়নের মতো গ্যাস স্পট মার্কেট থেকে কেনা হয়, যেটার দাম তিন থেকে চারগুণ বেড়েছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, ৭০ শতাংশ দেশিয় উৎসের সহজলভ্য গ্যাস থাকার পরও এই দুর্মূল্যের বাজারেও এভাবে দাম বৃদ্ধি করতে হলো কেনো?
তাছাড়া গ্যাস নিয়ে যদি সংকট সৃষ্টি হয়-ই তবে দাম না বাড়িয়েও সংকট সমাধানের আরও পথ খোলা আছে। প্রথমত দেশে নতুন যেসব গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে কিন্তু উত্তোলন শুরু হয়নি সেগুলো থেকে উত্তোলনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। তাছাড়া বন্ধ হয়ে যাওয়া খনি ও কূপগুলোর আরও গভীরে অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে উন্নত প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে দেশের হাইপ্রেশার জোনগুলোতে অনুসন্ধান ও উত্তোলন কূপ খনন করা। দ্বিতীয়ত, গ্যাস খাতের চুরি ও অপচয় কমিয়ে এনে রাজস্ব বাড়ানো। সরকার ঢাকা শহরে বাসাবাড়িতে প্রিপেইড মিটার সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছিল। ওইসময়ে মাত্র ১০ শতাংশ বাসাবাড়িতে প্রিপেইড মিটার সরবরাহ করার পর অদৃশ্য কারণে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যদিও কার্যক্রমটি পুনরায় চালু হয়েছে। এবার এক লাখ প্রিপেইড মিটার সরবরাহ করা হবে। গ্যাসের চুরি ও অপচয় বন্ধে এই কার্যক্রমটিকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে। সবখানে প্রিপেইড মিটার চালু হলে কেবল সরকারের রাজস্বই বাড়বে না, গ্রাহকদেরও সাশ্রয় হবে।
বঙ্গোপসাগরের নিচে ব্যাপক গ্যাস ও তেলসম্পদ আবিষ্কার ইতিমধ্যেই ভারত ও মিয়ানমারকে বিশ্বের বড় বড় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানীদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। এ ক্ষেত্রে পেছনে পড়ে রয়েছে বাংলাদেশ। অথচ দেশ দু’টির সঙ্গে দীর্ঘদিনের সমুদ্রসীমানা বিরোধ নিষ্পত্তি করে সমুদ্রজয় ছিল বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের একটি বড় অর্জন। এই সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছে। সার্বিক অবকাঠামো উন্নয়নে সমগ্র বিশ্বের নজর কেড়েছে। সমুদ্রজয় তাদের বড় একটি সাফল্য হলেও এখনও সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারেনি। ফলে ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে গিয়ে সরকার গ্যাস আমদানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। অথচ, দেশের জ্বালানি খাতকে স্বনির্ভর করতে এবং সংকট থেকে রক্ষা করতে সাগরের গ্যাসই হতে পারে রক্ষাকবচ। আগামী বছর জাতীয় নির্বাচন। এখন এ পরিস্থিতিতে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগে সরকারের নীতিনির্ধারকদের উচিত ছিল নির্বাচনকেও বিবেচনায় নেওয়া। কারণ, এই অবস্থায় গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আবারো যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ে, তাহলে এ চাপ সাধারণ মানুষের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে। জনজীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে নি¤œমধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্ত মানুষের জীবনমানের ধারাকে অবনমন করবে। তাই এ ক্রান্তিকালে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত থেকে সরকার যদি সরে আসে তাহলে দেশের অর্থনীতি ও জনগণ লাভবান হবে।
লেখক : আইনে পড়াশোনা করেছেন। কবি ও লেখক।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

দগ্ধ ফায়ারকর্মীদের সর্বোচ্চ মানের চিকিৎসা নিশ্চিত করা হবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রভাব এবং কিছু প্রস্তাব

আপডেট সময় : ১০:১৫:২৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১২ জুন ২০২২

মর্তুজা হাসান সৈকত : বিভিন্ন সংগঠনের বিরোধিতা সত্ত্বেও ভোক্তা পর্যায়ে সব ধরনের গ্যাসের দাম গড়ে ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ বাড়িয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। গত ৫ জুন বিকেলে ভার্চুয়াল সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে গ্যাসের নতুন এ দাম ঘোষণা করেছেন বিইআরসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আবু ফারুক। প্রাথমিক ও মৌলিক জ্বালানি বলে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির এই প্রভাব পড়বে তৈরি পোশাক, শিল্প উৎপাদন, বিদ্যুৎ থেকে শুরু করে জনজীবনের প্রায় সর্বত্র।
গত নভেম্বরে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিকে কারণ দেখিয়ে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বাড়িয়েছিল সরকার। গত ছয় মাসে মাসে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির এই বিরূপ প্রভাব হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে সাধারণ মানুষ। কারণ, সেই মূল্য বৃদ্ধি শুধু জ্বালানি তেলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, গণপরিবহনসহ বাজারের সব নিত্যপণ্যের ওপর গিয়ে পড়েছে। এই অবস্থার মধ্যে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে উঠতে পারে। কারণ, যখন শিল্পকারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে গ্যাসের অভাবে, অনেক বাসাবাড়িতে গ্যাসের অভাবে বিকল্প ব্যবস্থায় রান্নার কাজ চলছে, পূর্ব ইউরোপীয় দুই দেশের যুদ্ধের প্রভাবে বাংলাদেশের বাজারে খাদ্যশষ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে- তখনই এলো দাম বাড়ানোর এই ঘোষণা ।
অন্যদিকে, গ্যাসের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। গত মার্চ মাসে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির তোড়জোড়ের মধ্যেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর দাবি জানিয়ে রেখেছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এ ক্ষেত্রে তারা বলছে, গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে বিদ্যুতের পাইকারি দামও বাড়াতে হবে। কারণ, দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় গ্যাস থেকে। ফলে, গ্যাসের দাম বাড়লে বিদ্যুতের দামও বাধ্য হয়েই বাড়াতে হবে। তদুপরি, সারও উৎপাদন করা হয় গ্যাস পুড়িয়ে। সেখানে ২৫৯ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়েছে। তাহলে সমীকরণ বলছে দাম বাড়বে সারেরও। যার প্রভাব গিয়ে পড়বে কৃষিতে।
কিছুদিন আগে এমনিতেই ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতে এক দফা দুর্ভোগের শিকার হয়েছে সাধারণ মানুষ। এ অবস্থায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো মানে হলো- তা সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনে আরেকটি বড় ধাক্কা আসা। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, এই দাম বৃদ্ধিতে শুধু সাধারণ মানুষের দুর্ভোগই কিন্তু বাড়বে না, দেশের শিল্প-কারখানা তথা শিল্পক্ষেত্রেও পড়বে এর নেতিবাচক প্রভাব। এই মূল্যবৃদ্ধি উচ্চবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত কিংবা ধনিক শ্রেণির জীবনমানে তেমন প্রভাব ফেলবে না হয়তো; কিন্তু মধ্যবিত্ত, নি¤œবিত্ত, সীমিত ও স্বল্প আয়ের মানুষকে যে দুর্ভোগের মধ্যে পড়বে, তা বলাই বাহুল্য। এ পরিস্থিতিতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়া উৎপাদন-বণ্টনসহ মানুষের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তুলবে। তার পরিবর্তে এই বিতরণ কোম্পানিগুলোর মধ্যে থাকা দুর্নীতি-অনিয়ম বন্ধ করাসহ সিস্টেম লস কমিয়ে সম্পদের সঠিক ব্যবহার করে কীভাবে ভর্তুকির চাপ কমানো যায়, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়ার সময় এসেছে। কারণ, খোদ রাজধানীর অনেক এলাকেই বৈধ সংযোগের চেয়ে অবৈধ সংযোগের সংখ্যা অনেক বেশি। অভিযোগ রয়েছে, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তিতাসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মদদেই এসব অবৈধ সংযোগ দেওয়া হয়। রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তিতাসের কোনো বৈধ সংযোগ না থাকলেও এখানকার প্রতিটি ঘরেই জ্বলে গ্যাসের চুলা। কেবল বাসা নয়, বস্তির দোকান আর রেস্তোরাঁগুলোতেও রয়েছে তিতাসের এই অবৈধ চুলার সংযোগ। বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর এসেছে, তিতাসের লোকজনের মাধ্যমেই পাওয়া যায় এই সংযোগ। শুধু কড়াইল বস্তি নয় রাজধানী এবং এর আশপাশে জালের মতো ছড়িয়ে আছে অবৈধ গ্যাস সংযোগ। দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করতে না পারলে গ্যাসের বার বার বাড়িয়েও লাভ নেই।

যদিও পেট্রোবাংলা বিশ্ববাজারে এলএনজির দামের ঊর্ধ্বগতিকে অজুহাত হিসেবে খাড়া করছে। কিন্তু গ্যাসের এই দাম বৃদ্ধির বিষয়ে বিইআরসির একজন সদস্যের বরাত দিয়ে কিছুদিন আগে গণমাধ্যমে খবর এসেছে, পেট্রোবাংলা বর্তমানে সিস্টেমে যে ৩০৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করছে, তার মধ্যে এলএনজি থেকে পাওয়া যাচ্ছে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এগুলো আসছে কাতার আর ওমান থেকে। দেশ দুটির সাথে এলএনজি আমদানির দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির শর্তানুসারে আগামী ৮-১০ বছরে এটার দাম খুব একটা ওঠানামা করার কথা না। আর ২৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস নিজস্ব উৎস থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে, যেটা বেশ সস্তা। অনেক কম খরচেই উৎপাদন করা হয়। আর বাকী থাকা ১৫০ মিলিয়নের মতো গ্যাস স্পট মার্কেট থেকে কেনা হয়, যেটার দাম তিন থেকে চারগুণ বেড়েছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, ৭০ শতাংশ দেশিয় উৎসের সহজলভ্য গ্যাস থাকার পরও এই দুর্মূল্যের বাজারেও এভাবে দাম বৃদ্ধি করতে হলো কেনো?
তাছাড়া গ্যাস নিয়ে যদি সংকট সৃষ্টি হয়-ই তবে দাম না বাড়িয়েও সংকট সমাধানের আরও পথ খোলা আছে। প্রথমত দেশে নতুন যেসব গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে কিন্তু উত্তোলন শুরু হয়নি সেগুলো থেকে উত্তোলনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। তাছাড়া বন্ধ হয়ে যাওয়া খনি ও কূপগুলোর আরও গভীরে অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে উন্নত প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে দেশের হাইপ্রেশার জোনগুলোতে অনুসন্ধান ও উত্তোলন কূপ খনন করা। দ্বিতীয়ত, গ্যাস খাতের চুরি ও অপচয় কমিয়ে এনে রাজস্ব বাড়ানো। সরকার ঢাকা শহরে বাসাবাড়িতে প্রিপেইড মিটার সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছিল। ওইসময়ে মাত্র ১০ শতাংশ বাসাবাড়িতে প্রিপেইড মিটার সরবরাহ করার পর অদৃশ্য কারণে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যদিও কার্যক্রমটি পুনরায় চালু হয়েছে। এবার এক লাখ প্রিপেইড মিটার সরবরাহ করা হবে। গ্যাসের চুরি ও অপচয় বন্ধে এই কার্যক্রমটিকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে। সবখানে প্রিপেইড মিটার চালু হলে কেবল সরকারের রাজস্বই বাড়বে না, গ্রাহকদেরও সাশ্রয় হবে।
বঙ্গোপসাগরের নিচে ব্যাপক গ্যাস ও তেলসম্পদ আবিষ্কার ইতিমধ্যেই ভারত ও মিয়ানমারকে বিশ্বের বড় বড় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানীদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। এ ক্ষেত্রে পেছনে পড়ে রয়েছে বাংলাদেশ। অথচ দেশ দু’টির সঙ্গে দীর্ঘদিনের সমুদ্রসীমানা বিরোধ নিষ্পত্তি করে সমুদ্রজয় ছিল বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের একটি বড় অর্জন। এই সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছে। সার্বিক অবকাঠামো উন্নয়নে সমগ্র বিশ্বের নজর কেড়েছে। সমুদ্রজয় তাদের বড় একটি সাফল্য হলেও এখনও সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারেনি। ফলে ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে গিয়ে সরকার গ্যাস আমদানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। অথচ, দেশের জ্বালানি খাতকে স্বনির্ভর করতে এবং সংকট থেকে রক্ষা করতে সাগরের গ্যাসই হতে পারে রক্ষাকবচ। আগামী বছর জাতীয় নির্বাচন। এখন এ পরিস্থিতিতে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগে সরকারের নীতিনির্ধারকদের উচিত ছিল নির্বাচনকেও বিবেচনায় নেওয়া। কারণ, এই অবস্থায় গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আবারো যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ে, তাহলে এ চাপ সাধারণ মানুষের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে। জনজীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে নি¤œমধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্ত মানুষের জীবনমানের ধারাকে অবনমন করবে। তাই এ ক্রান্তিকালে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত থেকে সরকার যদি সরে আসে তাহলে দেশের অর্থনীতি ও জনগণ লাভবান হবে।
লেখক : আইনে পড়াশোনা করেছেন। কবি ও লেখক।