মনজুরুল আলম মুকুল
গণপরিবহন ব্যবস্থার অভাব ও ত্রুটির কারণে ঢাকা শহরে এমনিতেই যানজট নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরপর প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঢাকাবাসীর জীবন দুর্বিষহ করে তুলছে। রাজনৈতিক কর্মসূচি ও দাবি-দাওয়া মানে এখন সড়কে অবস্থান ও সড়ক অবরোধের মাধ্যমে তীব্র যানজট সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষের চরম দুর্ভোগে ফেলা। সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে বিভিন্ন দাবি আদায় করা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের সড়কে অবস্থান করে মিছিল বা জনসভা করা সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকার সড়ক নেটওয়ার্ক অনেক জায়গায় সীমিত ও অপরিকল্পিত। ফলে একটি রাস্তায় সমস্যা হলে বিকল্প রুটসহ প্রধান প্রধান সব সড়ক বন্ধ হয়ে যায়।
গত বছরের জুলাই বিপ্লবের পর দেশের এক টালমাটাল অবস্থায় দেশের হাল ধরেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তবে, তার নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রথম থেকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সংকটসহ নানামুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। তবে, প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় নানা ধরনের দাবি-দাওয়া। অর্থাৎ, নানা মানুষ নানা দাবি। অনেকের দীর্ঘদিনের না পাওয়ার একটা বেদনা রয়েছে। বিপ্লবের পর অনেক বঞ্চিতরা প্রত্যাশা করছে হয়তো এবার তাদের আশা পূরণ হবে। তবে, যৌক্তিক-অযৌক্তিক, সময়-অসময়ের নানা দাবির মুখে সরকার দিশাহারা হয়ে পড়েছে। লক্ষণীয়, মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ গ্রহণের পর বিভিন্ন সরকারি, আধাসারকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও আদালতে চরম অস্থিরতা বিরাজ করে। পদোন্নতি ও সুযোগসুবিধা বঞ্চিতরা একযোগে সবাই মাঠে নেমে পড়ে। সবার এক কথা, এখনই চাই, আর দেরি নয়।
বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের ও অস্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আন্দোলনে নেমে পড়ে এই দাবিতে এখনই তাদের চাকরি জাতীয়করণ করতে হবে ও চাকরি স্থায়ী করতে হবে; এখনই স্বাক্ষর করুন, এখনই প্রজ্ঞাপন জারি করুন। এমনও ঘটনা ঘটেছে, রাতভর সচিবালয়ে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের আটকে রাখা হয়েছে, হাতাহাতি ও সহিংসতার ঘটনাও ঘটেছে। গণহারে পদোন্নতি, নিয়োগের ঘটনা ঘটেছে। অনেক ক্ষেত্রে মেধার বিষয়টি চাপা পড়ে যায়, যা ছিল জুলাই বিপ্লবের প্রধান চেতনা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পরিপন্থী।
প্রথম ধাক্কাটা আসে পুলিশ বাহিনী থেকে। নিরাপত্তাসহ নানা দাবিতে তারা সবাই একযোগে কর্মস্থল ত্যাগ করে। যাই হোক, সরকার তাদের অনেক বুঝিয়ে, কিছু দাবি-দাওয়া পূরণ করে কাজে যোগদান করায়। এরপর দাবি-দাওয়া আদায়ে মাঠে নামলেন গ্রামপুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা। এক সময় গ্রাম পুলিশের সদস্যরা কাজে ফিরলেও, মরিয়া হয়ে উঠে কয়েক হাজার অঙ্গীভূত আনসার সদস্য। তাদের অনেক দাবি সরকার মেনে নিলেও তারা জাতীয়করণের দাবিতে সহিংসতার পথ বেছে নেয়। দেখা যায়, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা, ধর্মীয় সম্প্রদায়, গোষ্ঠী ও পেশার লোকজন বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে সচিবালয়, প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ও শাহবাগে অবস্থান নেওয়া শুরু করে। মেট্রোরেল, বিদ্যুৎ বিভাগ, এনবিআর ও সচিবালয়ের অভ্যন্তরেও অনেক ঝামেলা চলছে। ঢাকা ছাড়াও দাবি-দাওয়া নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকা বিশেষ করে গাজীপুর, নরসিংদী, সাভারসহ অনেক শিল্পাঞ্চল অস্থির হয়ে উঠে। অসন্তোষ ও সহিংসতার কারণে বন্ধ হয়ে যায় অনেক ফ্যাক্টরি।
ঢাকা শহরের বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য বেপরোয়া হতে দেখা যায়। তাদের দেওয়া বিভিন্ন কর্মসূচি ও সড়ক অবরোধের কারণে সাধারণ মানুষের অনেক ভোগান্তি হয়েছে। ইভ টিজিং ও কথা কাটাকাটির মতো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের ছাত্রদের মধ্যে প্রায়ই ভয়াবহ সংঘর্ষ এবং সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। মধ্যযুগীয় এমন ঘটনা ও কর্মকাণ্ড ঢাকাবাসীর জীবন অনেক সময় দুর্বিষহ করে তুলেছে।
সম্প্রতি বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণার রায়কে কেন্দ্র করে ও একজন ছাত্রদল নেতা দুর্বৃত্তদের হামলায় নিহত হওয়ার ঘটনায় বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা আন্দোলন-অবরোধ করেছে বেশ কয়েক দিন। যে কারণে তীব্র যানজটে ও অবর্ণনীয় ভোগান্তিতে পড়ে সাধারণ মানুষ। এ নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করেছে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক ক্ষোভও উগরে দিয়েছে ভুক্তভোগীরা। অত্যন্ত উদ্বেগজনক বিষয় এই যে, সম্প্রতি সময়ে দেশে মব কালচারের উন্মাদনা দেখা দিয়েছে। গুজবের ভিত্তিতে সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী আইন হাতে তুলে নিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর হামলা, সহিংসতায় জড়ানোসহ বিভিন্ন ধরনের অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে। হঠাৎ করে এক শ্রেণির কিছু লোক সামাজিক বা রাজনৈতিক ইস্যুতে দাবি আদায়ের জন্য রাস্তায় নেমে অবরোধ করছে, যানবাহন চলাচল বন্ধ করে সহিংসতা করে জনদুর্ভোগ বাড়িয়ে তুলছে। দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে অনেকেই মনে করছে সুদূর অতীত কাল থেকে একটা প্রবাদ বাক্যে প্রচলিত আছে বাংলা হল ‘বালঘাকখানা’ অর্থাৎ গোলযোগের আবাস ভূমি। তাই বাংলায় বসবাস করতে হলে এসব বিষয়গুলো আমাদের মেনে নিতে হবে।
বাংলা ও বাঙালির রাজনৈতিক চরিত্র নিয়ে অনেকে অনেক তত্ত্ব, দৃষ্টিভঙ্গি ও ধারণা দিয়েছেন, মন্তব্যও করেছেন। তবে দূরদৃষ্টি সম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, তত্ত্ব, কাঠামোবদ্ধ বা দার্শনিক ধারণা যায় বলুন, সেটা প্রথমে এসেছিল ১৫৭৯ সালে মোঘল সম্রাট আকবারের প্রধান উপদেষ্টা আবুল ফজল আল্লামির নিকট থেকে। প্রায় ৫০০ বছর আগে আবুল ফজলের অবাক করা, বোমা ফাটানো অভিনব তত্ত্ব ও কথাগুলো ঘিরেই যেন আজও বাংলার রাজনীতি পরিচালিত হয়। বিচক্ষণ আবুল ফজল আগে তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করতেন এবং সবকিছুই একজন ভালো পর্যবেক্ষকের মতো যৌক্তিক চোখে দেখতেন ও তারপরই সেসব তথ্য তার গ্রন্থে যুক্ত করতেন। জানা যায় মোঘল সম্রাজের ১২টি প্রদেশের অন্যত্তম বাংলা না এসে বাংলার অতীত অনেক তথ্য প্রমাণ ও ইতিহাস সংগ্রহ করেন এবং তা থেকেই থেকেই এই সিদ্ধান্ত ও ব্যাখ্যাই উপনীত হন।
আবুল ফজল আল্লামি লিখেছিলেন, ‘বাংলা নামের দেশটি এমন একটি অঞ্চল, যেখানে আবহাওয়ার কারণে অসন্তোষের ধুলা সবসময় উড়তেই থাকে। মানুষের শয়তানিতে এখানকার পরিবার ও জনপদগুলো ধবংস হয়ে যায়। আবুল ফজলের মতে, স্নায়ু বিকলকারী আবহাওয়া মানুষকে কলুষিত করে ও কলুষিত মানুষ সার্বভৌম শাসনকে ধবংস করে। যে কারণে বহিরাগতদের বদ্বীপতে শক্তিশালী হওয়ার পথ সুগম করে। “বাংলায় এমন পরিবেশ বিদ্যমান থাকে যেখানে কেউ গেলে বা যারা বসবাস করে স্বাভাবিকভাবে সবাই সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ভূমিকা পালনের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। স্থানীয়দের (বাঙালি) মধ্যে সহজে বিভেদ সৃষ্টি হয়। নিজেদের স্বার্থের বিষয়টি সবার কাছে প্রধান থাকে। ব্যক্তিস্বার্থের কারণে তারা সার্বভৌম শাসন ও সবার জন্য মঙ্গলকর (জাতীয় স্বার্থ) বিষয়সমূহ ধবংস করা তাদের কাছে কোন ব্যাপার না। যে কারণে তিনি লিখেছিলেন ‘এদেরকে স্বার্থ দেখিয়ে বিভেদ সৃষ্টি কর আর সুবিধা নাও’। আবুল ফজলের পরে শেখ শাহ নিয়ামত উল্লাহ ফিরোজপুরি (মৃত-১৬৬৯) বাংলার রাজনীতি সম্পর্কে বিতৃষ্ণ হয়ে ৪ লাইনে লিখে ছিলেন। ‘বাংলা একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত ও বিরসভূমি; মৃতদের জন্য প্রার্থনা করো, দেরি করো না। সেখানে ভূমি বা পানি কিছুই শান্তিতে থাকে না; হয় বাঘের থাবায়, নয়তো কুমিরের মুখে পড়তে হবে।’ আবুল ফজল সামাজিক ও রাজনৈতিক অভিনব তত্ত্বটি শুধু দিয়েই যাননি, মোঘলরা অক্ষরে অক্ষরে তার বাস্তবায়ন করে এবং সফলতা পায়।
অনেকের জানা, বাংলায় মোঘল শাসন হঠাৎ করে শুরু হয়নি। অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে তারা বাংলা শাসনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ছিল। ১৫৭৪ সালে মোঘল বাহিনীর বাংলার রাজধানী টাণ্ডায় প্রবেশের ঘটনা ফয়সালা সূচক মনে হলেও বিষয়টি সম্পন্ন হতে প্রকৃত পক্ষে পৌনে একশ বছর লেগে যায়। ১৫৩৭ সালে এটি শুরু হয়ে ১৬১২ সাল পর্যন্ত চলে। বিষয়টি লক্ষণীয় যে, মোঘলদের বাংলা বিজয় ও নিয়ন্ত্রণের পিছনে শুধু তরবারি, বারুদ, কামান বা সামরিক শক্তিই প্রধান ছিল না। স্থানীয় ও শত্রুদের মধ্যে বিভেদের বীজবপন, ঘুষ ও সুযোগসুবিধা প্রদান, কূটনীতি, ভয়ভীতি দেখানো ও মুলা ঝুলানো কৌশলের দিকে বেশি নজর ছিল।
বাংলার মানুষের অধপতনের এই অভিনব তত্ত্বটি ব্রিটিশ, ডাচ, পর্তুগিজ, ফরাসি সবাই জানত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ও পরবর্তীতে ব্রিটিশ উপনিবেশিক কর্মকর্তারা এই তত্ত্বটি জোরালোভাবে গ্রহণ করে ছিল। রবার্ট ক্লাইভ জেনেশুনে বা তত্ত্বটি ভালভাবে রপ্ত করে চক্রান্তের জাল বিস্তার করে ছিল। পরিবেশ সবই বিদ্যমান ছিল তিনি শুধু খেলাটা চালিয়ে গিয়েছিলেন। ক্লাইভ এই ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে চক্রান্তের ফল নিশ্চিত। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশী যুদ্ধে রবার্ট ক্লাইভের মাত্র ৩২০০ সৈন্যের কাছে বাংলার শেষ নবাব
সিরাজউদ্দৌলার ৫০ হাজারের চৌকস বাহিনীর অভাবনীয় পরাজয় ঘটে। বিজয়ের পর রবার্ট ক্লাইভ ও তার বাহিনী যেদিন রাজধানী মুর্শিদাবাদে এসেছিলেন, সেদিন রাজধানীতে যত মানুষ জড়ো হয়েছিল, তারা যদি ঢিলও ছুড়ত; এমনকি শোরগোল বা চিল্লাচিল্লি করত, তাহলে ইংরেজরা পরাজিত হয়ে যেত। দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী নবাব সিরাজউদ্দৌলা দ্রুত রাজধানী মুর্শিদাবাদে ফিরে এসে রাজকোষ উন্মুক্ত করে দেন এবং সবাইকে দেশ রক্ষার আহ্বান করেছিলেন। পলাশী যুদ্ধের আগে ও পরে আরো অনেক সুযোগ এসেছিল। কিন্তু ব্যাক্তি স্বার্থ আর একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস এমন স্থানে নিজেরাই নিজেদের ধবংস ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। আর ইংরেজরা প্রায় দুই শত বছর এর সফল বাস্তবায়ন করে গেছে।
পাকিস্তান আমলেও ব্যাক্তি স্বার্থ, ষড়যন্ত্র আর চক্রান্ত অব্যাহত থাকে। আমাদের এক জাতীয় নেতা শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের সেই বিখ্যাত উক্তিটি স্মরণ করা যেতে পারে ‘মুসার সময় মুসা আর ঈসার সময় ঈসা’। আসলে আমরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের কথা বলি, ভোল পাল্টায় ও ডিগবাজি দেয়, আর স্বার্থটাই থাকে প্রধান। আর যে জন্য পুরো জাতিকে খেসারত দিয়ে হয়। আশা করা হয়েছিল, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার এদেশের মানুষ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু এই সুবিধাবাদী চরিত্র বদলানোর পরিবর্তে আরো চরম আকারে চর্চা শুরু করে। তাইতো গবেষক ও সৃজনশীল লেখক আহমদ ছফাকে লিখতে হয়েছিল ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ নামে এক প্রবন্ধ। মুসলমান শব্দ আছে বলে এটাকে অনেকে সাম্প্রদায়িক ধরণের কিছু মনে করেন। কিন্তু আহমদ ছফা ছিলেন অসাম্প্রদায়িক এবং তার লেখায় সাম্প্রদায়িকতার কিছু পাওয়া যায়না। বাংলার মুসলমানরা যেহেতু বাঙালি সমাজের অংশ। অতএব তাদের চরিত্র দেখালে বাঙালির চরিত্র অনেকটা ফুটে ওঠে এমনটাই তার প্রবন্ধে পাওয়া যায়।
আহমদ ছফার মতে, বাঙালি মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত ও বুদ্বিজীবি সমাজ চরম স্বার্থপর। এরা স্বার্থের বাইরে কিছু চিন্তা করতে পারেনা। এদের কথা শুনলে দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। এদের কথা শুনলে দেশ স্বাধীন হত না। ৭১ সালে দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন সরকারি অফিসে বাঙালি উপস্থিতির হার ছিল প্রায় শতভাগ অর্থাৎ তখনো তারা বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারেনি। আবার দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সাথে সাথে তারা তাদের চরিত্র পাল্টে ফেলে। এ ভাবেই সুবিধাবাদী নীতিই তাদের কাছে সবসময় প্রধান্য থাকে। অনেকের মতে, দেশে বিগত দিনে অনেক ঘটনার কারণ মূলত সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব। কার্যকর সংসদ ও বিরোধী দল থাকলে এমনটা নাও হতে পারত। স্বচ্ছ প্রতিষ্ঠান না গড়ে, সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চা না করে, দেশে অসন্তোষ রেখে উন্নয়ন করলে তা কখনো টেকসই হয় না। জনতার বিক্ষোভের প্রবল আঘাতে এক সময় তাসের ঘরের মতো ভেস্তে যায়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
স্বাধীনতার এত বছর পর স্বচ্ছ ও প্রশ্নহীন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে না পারাটাই জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। শুধু নিয়োগ প্রতিষ্ঠান নয়, সবক্ষেত্রে- পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, নির্বাচন কমিশন সবখানে একই অবস্থা। কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপর এদেশের মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস ছিল না। বিগত দিনে লক্ষণীয়, কিছু মানুষ অতি দ্রুত সময়ে দুর্নীতি আর অপকর্ম করে অঢেল ধনসম্পদ ও টাকা-পয়সার মালিক হয়েছে, আবার অনেকে বিদেশে পাচার করেছে। ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের মূল ভূমিকায় ছিল ছাত্র ও তরুণ সমাজ। কোটা আন্দোলন ও পরবর্তী গণঅভ্যুত্থানকে ঘিরে প্রায় ১৪০০ লোক নিহত হয়েছে। নিহতদের বেশিরভাগ ছাত্র, চাকরিপ্রত্যাশী, তরুণ ও শিশু-কিশোর। তারা আজ পৃথিবীতে নেই। তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমে তাদের ঋণ পরিশোধ করা সময়ে দাবি।
বাতাসে যখন লাশের গন্ধ, চারদিকে বিশৃঙ্খলা- এমন অবস্থায় কিছু লোক চাঁদাবাজি, লুটপাট ও মাঠ-ঘাট দখলে কম করেনি। কেউ কেউ নীরবে, নিভৃতে প্রশাসন, বিচার বিভাগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব জায়গায় নিজেদের লোক বসানোর কাজে ব্যস্ত। অনেকে অবৈধ আয়ের খাতগুলো দখলে নিয়েছে। সবার প্রত্যাশা, প্রয়োজনীয় সংস্কার করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে দেশে একটি গণতান্ত্রিক ও ক্ষমতা হস্তান্তরের সুস্থ ধারার যাত্রা শুরু করা। সবার উচিত এই আসল কাজটি করতে দেওয়া, তা না হলে বাংলাদেশ অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হলে আমাদের আর কিছুই করার থাকবে না। কিন্তু এমন সময় দেশের দায়িত্বশীল লোকদের নানা ধরনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কে কোন দিকে খেলছে আর কে কোন দেশের এজেন্ট হয়ে কাজ করছে সেটা নিয়ে অনেকের সন্দেহ আছে।
দেশের এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক ব্যক্তি, প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী সর্বোপরি শিক্ষিত মানুষের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, আসলে আমাদের ভূমিকা কি? আমরা কোন দিকে দেশকে নিয়ে যেতে চায়? বাঙালির চরিত্র নিয়ে অনেক কিছু তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য ও মন্তব্য রয়েছে রয়েছে যেগুলো আমাদের জন্য ক্ষতিকর। নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলো আরো ফুটে ওঠা জাতির জন্য কোনোমতেই মঙ্গলকর নয়। এই চরিত্র বদলানোর পথ যে একেবারে বন্ধ এমনটাও নয়। প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছার, অন্যের মতামতকে মূল্যায়ন করা, ব্যক্তি স্বার্থের পরিবর্তে সার্বভৌম শাসন, সবার জন্য মঙ্গলকর ও জাতীয় স্বার্থকে প্রধান্য দেওয়া।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ