প্রযুক্তি ডেস্ক : বিনোদন শিল্পে প্রভাবশালী হওয়ার লক্ষ্যে গত দুই বছরে বিশ্বের বিভিন্ন গেইমিং কোম্পানির মালিকানার অংশ কেনার পেছনে আটশ কোটি ডলারের বেশি খরচ করেছে সৌদি আরব। এইসব চুক্তির কেন্দ্রে ছিল সৌদি সমর্থিত গেইমিং কোম্পানি ‘স্যাভি গেইমস’। এর মধ্যে রয়েছে চীনের ভার্চুয়াল ইস্পোর্টস প্রকল্প ‘ভিএসপিও’, সুইডেনভিত্তিক ‘এমব্রেসার গ্রুপ’-এ বড় অংশীদারিত্ব ও মার্কিন কোম্পানি ‘স্কোপলি’ অধিগ্রহণ। আর এভাবেই রিয়াদ তার পেট্রোডলার নানা সেক্টরে কাজে লাগাচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে ব্রিটিশ সংবাদপত্র ‘ফাইনান্সিয়াল টাইমস’।
২০২২ সালের জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠিত স্যাভি’র পুরো মালিকানা সৌদি আরবের ৬৫ হাজার কোটি ডলারের ‘পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড (পিআইএফ)’-এর অধীনে। এর প্রধান সৌদির ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান। তিনি বলছেন, সাত বছরের মধ্যে তিনি সৌদিকে ‘গেইমিং ও ইস্পোর্টস খাতে সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক হাব’-এ রূপান্তর করতে চান। এই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা পূরণে স্যাভির পেছনে তিন হাজার আটশ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে দেশটি।
“এটি স্রেফ একটি বুলডোজার পদ্ধতি।” -বলেন গবেষণা কোম্পানি ‘অ্যাম্পেয়ার অ্যানালাইসিসি’-এর গেইম বিশ্লেষক পিয়ার্স হার্ডিং-রোলস।
“এই লাইনে সৌদি আরব এখনও নবজাতক: তাদের আক্ষরিক অর্থেই একে শূন্য থেকে গড়ে তুলতে হবে।”
সৌদির লক্ষ্য হলো, ২০৩০ সাল নাগাদ আড়াইশ গেইমিং কোম্পানি ও স্টুডিও স্থাপনের পাশাপাশি ৩৯ হাজার লোকের কর্মসংস্থান করা। ভিএসপিও’র সঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে ইস্পোর্টস বাজারে প্রবেশও এই পরিকল্পনার অংশ যেখান থেকে দেশটির জিডিপি’র এক শতাংশ আসবে। এই পরিকল্পনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আগামিতে এরকম আরও অনেক চুক্তি দেখা যাবে। সূত্রানুসারে, গেইমিং খাতে মনোযোগ দেওয়ার কারণ হচ্ছে দেশটির অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানো। এর ফলে তেলের বাইরেও অন্যান্য আয়ের উৎস তৈরি হবে, যা এক পর্যায়ে দেশটিকে বিদ্যুচ্চালিত যান তৈরির মতো ক্রমবর্ধমান শিল্পের বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের দিকে নিয়ে যাবে।
এই প্রচেষ্টা দেশটির বৈশ্বিক ক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে মিলে যায় বলে প্রতিবেদনে লিখেছে ফাইনান্সিয়াল টাইমস। সম্প্রতি ফুটবল ও গলফের মতো খেলাধুলার পেছনেও প্রচুর অর্থ ব্যয় করছে দেশটি। তবে, সমালোচকরা বলছেন, এটি কেবল দেশটির মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট অপবাদ থেকে মনযোগ সরিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা। সৌদির এই কৌশল গেইমিং শিল্পকে যথেষ্টই নাড়া দিয়েছে। কারণ বিভিন্ন শীর্ষ প্রতিভা ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি অর্জনের লক্ষ্যে টেনসেন্ট, মাইক্রোসফট ও সনির মতো প্রযুক্তি জায়ান্টদের সঙ্গেও লড়াই করছে রিয়াদ। “সামগ্রিকভাবে বৈশ্বিক গেইমিং শিল্পের বিকাশে নিজেদের পদচিহ্ন রাখতে চায় সৌদি আরব।” –বলেন টেনসেন্ট গেইমস-এর বৈশ্বিক প্রকাশনা ও ইস্পোর্টস বিভাগের মহাব্যবস্থাপক ভিনসেন্ট ওয়াং। গেইম সৌদি আরবে বেশ জনপ্রিয়। দেশটির সামগ্রিক জনসংখ্যার (তিন কোটি ৬০ লাখ) ৭০ শতাংশের বয়সই ৩৫ বছরের কম। সৌদির গেইমিং বিষয়ক কর্মকর্তাদের তথ্য অনুসারে, প্রায় একই সংখ্যক নাগরিক গেইমার হিসেবেও বিবেচিত। এমনকি যুবরাজ নিজেও একজন স্বীকৃত গেইমার।
“দেশটি আমাদের জন্য এক রোমাঞ্চকর বাজার এবং একইসঙ্গে পার্টনার।” –বলেন ভিএসপিও’র আর্থিক ও বৈশ্বিক পরিকল্পনা প্রধান ড্যানি ট্যাং।
“এই খাতে সৌদি অত্যন্ত তরুণ দেশ, যেখানে বেশ সম্পৃক্ত গেইমিং কমিউনিটি আছে।” স্যাভির সঙ্গে চুক্তির উদ্দেশ্যে আলাদাভাবে নিনটেনডোর আট শতাংশ মালিকানা কিনেছে পিআইএফ। জাপানি কোম্পানিটির সবচেয়ে বড় বিদেশী বিনিয়োগকারী হয়ে ওঠার পাশাপাশি অ্যাক্টিভিশন ব্লিজার্ড ও ইউবিসফট থেকেও মালিকানার অংশ কিনেছে দেশটি। দেশটির কর্মকর্তারা বলছেন, গেইমিং খাতে বড় অংশীদারিত্ব তৈরির লক্ষ্যে তারা নিজেদের আর্থিক প্রভাবকে কাজে লাগাতে চায়। গেইম বিশ্লেষক সাইট ‘নিউজু’র তথ্য অনুসারে, এই সেক্টরের আর্থিক মূল্য প্রায় ২০ হাজার কোটি ডলার। গত বছর বিনিয়োগ কোম্পানি ‘পিডব্লিউসি’র প্রকাশিত অনুমানে উঠে আসে, ২০২৬ সাল নাগাদ ভিডিও গেইম খাতের বৈশ্বিক আয় ৩০ হাজার কোটি ডলার ছাড়ানোর পাশাপাশি বিনোদন ও গণমাধ্যম খাতে এখান থেকে ১০ শতাংশের বেশি যাবে।
কয়েকজন বিশ্লেষক ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, বিনোদনে প্রতিদিনকার অভ্যাস বদলের মানে হচ্ছে, আসন্ন বছরগুলোয় এই খাতে আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস হয়ে উঠবে গেইমিং। এমনকি প্রচলিত টেলিভিশন দেখার অভ্যেসকেও ছাড়িয়ে যাবে এটি।
“এই অঞ্চলের গেইমার সংখ্যা আমাদের জন্য অনুকূল।” –বলেন স্যাভির প্রধান নির্বাহী ব্রায়ান ওয়ার্ড।
“যখন আপনি জাতীয় পরিকল্পনার অংশ হয়ে ওঠার পাশাপাশি তেল ও গ্যাসের বাইরেও নিজস্ব অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যময় করার ইচ্ছাকে বিবেচনায় নেবেন, তখন সৌদি আরবের গেইমিংয়ের পেছনে ব্যপক বিনিয়োগ স্বাভাবিকই মনে হবে।”
এই খাতের প্রতিভা আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে দীর্ঘকাল ধরেই ট্যাক্স সুবিধা, স্টার্টআপে অর্থায়ন ও অন্যান্য প্রণোদনা ব্যবহার করে আসছে বিশ্বের বিভিন্ন আঞ্চলিক ও জাতীয় সরকার। পাশাপাশি, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতার একটি ‘চমকপ্রদ মিশেল’ পান নীতিনির্ধারকরা। তবে, অভিজ্ঞরা বলছেন, স্যাভি তার দলে চাইবে এমন গেইম নির্মাতাদের টানতে কেবল নগদ অর্থে কাজ হবে না। এই খাতের কেউ কেউ বলছেন, স্কোপলি কেনার পেছনে পাঁচশ কোটি ডলার লেনদেন থেকে ইঙ্গিত মেলে বিভিন্ন চুক্তি জিততে স্যাভিকে অতিরিক্ত অর্থও খরচ করা লাগতে পারে। “তারা যে অর্থ পেয়েছে, তা কেউই বিশ্বাস করতে পারেনি।” –বলেন এই খাতের অভিজ্ঞ এক ব্যক্তি। তিনি আরও যোগ করেন, স্কোপলি বেশ কিছুদিন ধরেই কোনো অধিগ্রহণের মাধ্যমে বা শেয়ার বাজারে আইপিও ছাড়ার মাধ্যমে এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির পথ খুঁজছিল। “তারা এই বিষয়ে খুবই উচ্ছসিত। তার তাদের সঙ্গে সবকিছুই প্রিমিয়াম মানের হতে হয়।” তিনি আরও যোগ করেন, বাজারের চেয়ে বেশি মুল্যে কেনা সৌদিদের জন্য কোনো বিষয়ই নয়। আর লোকজন তো লোভনীয় নৈশজীবনের জন্য রিয়াদ বা জেদ্দায় যাবে না, তাই না?”
মোহাম্মদ বিন সালমান নানারকম সামাজিক সংস্কার করলেও মানবাধিকারের প্রশ্নে নিজেদের কুখ্যাতি এড়াতে পারেনি সৌদি। এমনকি নারীদের গাড়ি চালানো ও নারী-পুরুষের উপস্থিতিতে কনসার্ট আয়োজনের সুযোগ দেওয়ার পরও ২০১৮ সালে সৌদি সংবাদিক জামাল খাশোগজির হত্যাকা-ের পর বিভিন্ন কোম্পানি রিয়াদ থেকে ব্যবসা গুটিয়েছে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র দাবি, প্রিন্স সালমান নিজেই খাশোগজিকে ‘হয় বন্দি নয়তো খুনের’ আদেশ দিয়েছেন । তবে, সেটা কখনই স্বীকার করেননি তিনি। পরবর্তীতে অবশ্য সৌদি ও বাইরের দেশগুলোয় পিআইএফ-এর কোটি কোটি ডলার খরচের সুবাদে রিয়াদে বিভিন্ন ব্যবসা ফিরেছে। তবে, সমালোচকদের কণ্ঠরোধের অভিযোগে মানবাধিকার কর্মীদের ক্রমাগত আক্রমণের মুখে পড়ছে দেশটির সরকার। এমনকি বিনোদন খাতে খরচ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও।
বিশেষভাবে খেলাধূলার পেছনে ব্যপক বিনিয়োগ করেছে পিআইএফ। উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ফুটবল ক্লাব নিউক্যাসল ইউনাইটেড কেনার পেছনে সাড়ে ৩০ কোটি ইউরো (প্রায় ৩৩ কোটি ডলার) খরচ। এ ছাড়া, গত সপ্তাহে সৌদির ‘লাইভ গলফে’র সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘পিজিএ ট্যুরে’র মধ্যে প্রায় তিনশ কোটি ডলারের চুক্তির ঘোষণাও দিয়েছে দেশটি। “আমি মনে করি না, বেশিরভাগ গেইমিং স্টুডিও’র সম্ভাব্য ক্রেতা হিসাবে তারা কাঙ্ক্ষিত।” –বলেন এক বিনিয়োগকারী। “তাদের কেনা বিভিন্ন কোম্পানি কতটা কাজের পরিবেশ পাবে, সেটি নিয়েও আমার সন্দেহ আছে।”
ফাইনান্সিয়াল টাইমস বলছে, সৌদির কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি সম্ভবত গুরুত্বপূর্ণ এক সময়ে এল। কারণ, গেইমিং খাত বৃদ্ধির গতিতে ভাটা পড়ার পাশাপাশি বাজার খরচও বেড়েছে। এমনকি স্মার্টফোনের সাফল্যও এটি তেমন কাজে লাগাতে পারছে না, যেখান থেকে এই শিল্পের অর্ধেক আয় আসে। তবে, শেয়ার বাজারে যাওয়ার তুলনামূলক জটিল উপায়ের চেয়ে স্যাভিও’র কাছে বিক্রি হতে আগ্রহী হতে পারে বিভিন্ন প্রাইভেট গেইম স্টুডিও। সৌদি শাসনের সঙ্গে ব্যবসায় নৈতিকতার প্রশ্ন থাকার পরও।