একটি রাষ্ট্রের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু বলা হয় পরিবারকে। এখানে রয়েছে সন্তান লালন-পালন ও লেখাপড়া, রান্না, গৃহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, খাদ্য সংগ্রহ, খাদ্য সংরক্ষণ, খাবার পরিবেশন, প্রবীণদের সেবা, উৎসব আয়োজন, অতিথি আপ্যায়ন, সামাজিক যোগাযোগ ইত্যাদি কাজ। সামাজিক প্রথা অনুসারে এসব কাজ করছেন আমাদের মা-বোন, ঘরের বউ, চাচি-মামি, খালা-ফুফু তথা নারীসমাজ। তারা নীরবে গৃহস্থালির সব কাজ নিপুণভাবে করে চলেছেন। দেশের সিংহভাগ পরিবার দারিদ্র্যকবলিত, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির। আমাদের সংসারে নারীরা কাজ করেন আনন্দচিত্তে। প্রত্যক্ষ কোনো প্রতিদান তারা প্রত্যাশা করেন না; চান শুধু নিজ পরিবারের কল্যাণ। এ বিষয় নিয়েই এবারের নারী ও শিশু পাতার প্রধান ফিচার
নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠায় নানা উদ্যোগের মধ্যে ঘরের ‘গৃহস্থালি কাজ’ নিয়ে নারীর অস্বস্তি কাটেনি। ঘরের কাজের স্বীকৃতি না মেলার কারণে শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নারীরা। নারী অধিকার কর্মীরা বলছেন, ঘরের কাজের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন না থাকায় নারীদের প্রতিনিয়ত হেয় হতে হয় পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছে। আর এই কাজের স্বীকৃতি কীভাবে আসবে প্রশ্নে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিভিন্ন শিক্ষা অনুযায়ী গড় মজুরি কত, সেটি বিবেচনায় নিয়ে ঘণ্টাভিত্তিক বিকল্প মূল্য নির্ধারণ করা যায়। এ কাজটিকে কাজ মনে করতে হবে এটিই প্রধান কথা।
গৃহস্থালি ও কেয়ারগিভিং: পরিবারে গৃহস্থালি ও কেয়ারগিভিং (প্রতিপালন ও সেবা দেওয়া)- এ দুই ধরনের কাজ থাকে। ঘর পরিষ্কার রাখা, টেবিলে যার যার পছন্দ অনুযায়ী খাবার দেওয়া, বাসন মাজা, কাপড় ধোয়া, সন্তানের স্কুল পরীক্ষার কাজগুলোকে গৃহস্থালি কাজ এবং সন্তান লালন-পালন, পশুপাখি দেখভাল ও পরিবারের বয়স্কদের সেবা দেওয়ার কাজকে সেবামূলক কাজ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ দু’কাজকেই নারীর কাজ হিসেবে সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছে। ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের একটি গবেষণা বলছে, ৮১ শতাংশ নারী সরাসরি গৃহস্থালি কাজে নিয়োজিত থাকেন। অন্যদিকে পুরুষ করেন মাত্র ১.৩ শতাংশ। যেখানে ১৯ শতাংশ নারী চাকরির সঙ্গে যুক্ত সেখানে ৯৮ দশমিক ৭ শতাংশ পুরুষ কোনো না কোনো নিয়মিত বা অনিয়মিত চাকরিতে নিয়োজিত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তৈরি পরিসংখ্যান বিষয়ক এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, পুরুষদের তুলনায় সাড়ে তিনগুণ বেশি মজুরিবিহীন কাজ করেন এ দেশের নারীরা।
গৃহস্থালি কাজেরও দরকার স্বীকৃতি: মা কী করেন জানতে চাইলে ঘরের বাইরে কাজ করেন না- এমন মায়েদের সন্তানদের উত্তর থাকে ‘কিছু করেন না’। অথচ তার মা গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি তার পড়ালেখার যাবতীয় দায়িত্ব পালন করছেন। ফলে গৃহস্থালি কাজ যে কাজ সেই স্বীকৃতিাই সবার আগে দরকার বলে মনে করছেন নারী অধিকার নেত্রী ও উই ক্যানের সমন্বয়ক জিনাত আরা হক। তিনি বলেন, স্বীকৃতি নেই সেটি একটা কারণ, তবে এটাই একমাত্র কারণ নয়। মনে করা হয় গৃহস্থালি কাজ মেয়েদের কাজ, সেই জায়গা থেকে সরে আসতে হবে। এটি এমন একটি কাজ যেটি আনন্দদায়ক না, বেতন পান না, সম্মানও পান না। সেটা যখন নারী করতে বাধ্য হচ্ছে তখন অবশ্যই হেয় বোধ করবে। নির্যাতনের বড় কারণ সিস্টেমের মধ্যে এটা এমনভাবে রেখে দেওয়া হয়েছে, মেয়েটা চাইলেও তার সামনে ‘বিকল্প’ নেই। কেবল গৃহস্থালি কাজ বলছি বটে, এর সঙ্গে বাসার শিশু ও বয়স্কদের দেখভালের কাজটিও আছে। ছেলেরা বাড়ির কাজ না করে দিব্যি বাইরে চলে যেতে পারে। কিন্তু নারী তার ঘর, ঘরের শিশু, বৃদ্ধ মানুষ, পশুপাখি ফেলে রেখে যুদ্ধেও যেতে পারেননি। যদি তার ঘরের কাজকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নেওয়া হয় তাহলে সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সম্মানের সঙ্গে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। এমনকি স্বামীর সঙ্গে যৌনসম্পর্ক নিয়েও সে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) অর্থনীতি গবেষক নাজনীন আহমেদ বলেন, এ কাজে নারী পুরুষের অংশগ্রহণের অসমতা আছে, সেটি চিহ্নিত করতে হবে। কাজটি দুজনেরই করা কর্তব্য। যে কাজটি নারীরা করেন, সেটি যদি তিনি বাইরে করতেন; তাহলে এটি থেকে মোট কত আয় হতো, ওই হিসাব ধরে সার্বিক হিসাব পাওয়া সম্ভব। তবে সেটি জিডিপিতে যোগ করার সুযোগ নেই।
গৃহস্থালি কাজ মূল্যায়নের বিকল্প পথ: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘টাইম ইউজড সার্ভে’ মতে, ১৫ বছরের বেশি বয়সী কর্মজীবীদের মধ্যে ঘরের বিভিন্ন কাজে পুরুষ দৈনিক ১ দশমিক ৪ ঘণ্টা এবং নারী ব্যয় করেন ৩ দশমিক ৬ ঘণ্টা। কর্মজীবী না হলে গড়ে নারীরা দিনে ৬ দশমিক ২ ঘণ্টা এবং পুরুষ ১ দশমিক ২ ঘণ্টা এ ধরনের কাজে ব্যয় করেন। এই কাজের বিকল্প মূল্যায়ন দরকার কিন্তু জিডিপিতে সেটি যুক্ত করার বাস্তবতা নেই উল্লেখ করে বিআইডিএসের গবেষক নাজনীন আহমেদ বলেন, জিডিপির সংজ্ঞায় আছে, এমন এমন সেবা অন্তর্ভুক্ত যেগুলো টাকার মাধ্যমে লেনদেন হয়। গৃহস্থালি কাজ তেমন না। তবে মজুরিহীন গৃহস্থালি কাজকে অবশ্যই স্বীকৃতি দিতে হবে। এবং সেটার বিকল্প মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। তিনি বলেন, আনপেইড ফ্যামিলি ওয়ার্কের ৮০ শতাংশই মেয়েরা করে ঠিকই কিন্তু স্বীকৃতি চাওয়ার সময় কখনোই বলবে না নারীর কাজের স্বীকৃতি দিতে হবে। স্বীকৃতি পাবে কীভাবে প্রশ্নে তিনি বলেন, বিকল্প মূল্যায়ন পদ্ধতি নির্ধারণ দরকার। সেটি ঘণ্টাভিত্তিক মূল্যায়ন হতে পারে। গৃহস্থালি কাজে কত ঘণ্টা সময় যায়। সেই শ্রমঘণ্টাটা যদি ব্যক্তি বাইরের উৎপাদনশীল কাজে দিতেন তাহলে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী কত আয় হতো সেটি নির্ণয় সম্ভব। একজনের সঙ্গে আরেকজনেরটা তুলনা হবে না। কেননা, শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে তার আয় কত হতো সেটা ঠিক করা হবে।
স্বীকৃতির অভাবে নারীর মানসিক-শারীরিক নির্যাতন: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জরিপ বলছে, ৬৫ শতাংশ নারী স্বামীর মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতন, ৩৬ শতাংশ যৌন নির্যাতন, ৮২ শতাংশ মানসিক এবং ৫৩ শতাংশ স্বামীর মাধ্যমে অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। জরিপে আরও বলা হয়, অধিকাংশ নারীকেই তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বামীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক গড়তে বাধ্য হতে হয়েছে।
ব্র্যাকের নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধী উদ্যোগ প্রকল্পের পরিচালক নবনীতা চৌধুরী বলেন, এই যে সংসারের শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলের খাবার, ওষুধ, কাপড়চোপড় ঠিক করে রাখা থেকে সবাইকে ঠিক সময়ে ঘুম থেকে উঠিয়ে ঠিক সময়ে তৈরি করে ঘর থেকে বের করা- এই যে একটি মানুষ একা এতগুলো মানুষের সব দায়িত্ব একা হাতে সামলাচ্ছেন, এই বিশ্রাম এবং বিরামহীন উদয়াস্ত পরিশ্রমটাই একটা মানসিক নির্যাতন। তার ওপর এই কাজের ভাগ যেমন কেউ নেয় না, তেমনি এর কোন স্বীকৃতি দেওয়ারও কেউ প্রয়োজন বোধ করেন না, এমনকি ধন্যবাদটুকুও নয়। মায়েরা করেছেন, তাই বোনেরাও করবেন, স্ত্রীরাও করবেন, বিষয়টা এমন আর কী। আর বাড়ির বাকি সদস্যরা শুধু ডিম পোচের কুসুম কেন ভাঙল, শার্টের কলারে ময়লা কেন থাকলো, ওই বাসার ভাবি নিয়মিত দাওয়াত খাওয়ান, আমাদের বাড়িতে কেন হয় না এসব অভিযোগ করতে থাকবেন।
সবার জন্য পাঠ্যসূচিতে আসুক গৃহব্যবস্থাপনা: কেবল নারীদের জন্য গার্হস্থ্য শিক্ষা স্কুল পর্যায় থেকে শুরু করার ফলে ওই সময়ে ছেলেদের মানসিকতায় রোপণ হয়- ঘরের কাজ মেয়েদের। ছোটকাল থেকেই যদি শেখানোর ধরন ভিন্ন হয় তাহলে দ্রুত পরিবর্তন সম্ভব বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষক নাজনীন আহমেদ বলেন, গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ ছেলেদের জন্য নেই। যেটা করা দরকার, ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে গার্হস্থ্য অর্থনীতি গৃহব্যবস্থাপনা নাম দিয়ে ছেলেমেয়ে উভয়কে পড়াতে হবে। ছোটবেলা থেকে এসব নারীদের কাজ হিসেবে আলাদা করে শিখিয়ে, মাঝবয়সে এসে এই কাজ সবার বললে তা কে শুনবে।
ব্র্যাকের নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধী উদ্যোগ প্রকল্পের পরিচালক নবনীতা চৌধুরী বলেন, সংসারের কাজ ভাগ করে নিলে যে শুধু নারীর নয়, পুরো পরিবারের মানসিক শান্তি বাড়ে, সেটাও এখন আবার অনেকে বুঝতে পারছেন। কারণ তখন ওই কাজগুলো করার কষ্ট আর গুরুত্বটা বোঝা যায়। নারী এই কাজগুলোর ভার একা বয়ে বেড়ানোর কষ্ট বা তার কষ্ট কেউ বুঝতে পারছেন না এই মানসিক বেদনা থেকে মুক্ত হন। পুরো পরিবারের একসঙ্গে কাটানোর মতো ‘কোয়ালিটি টাইম’ বাড়ে। কিন্তু, দুঃখের বিষয়, এখনও আমরা সেই সুখের ব্যবস্থা না করে সব কাজ একজনকে দিয়ে করিয়ে বরং যিনি করছেন তার ভুল আর খুঁত ধরতে ব্যস্ত থাকছি। তাতে একজনকে মানসিক নির্যাতন করছি। কিন্তু আসলে পুরো পরিবারের মানসিক শান্তি আর বিশ্বাস-ভালোবাসার সম্পর্কটাও নষ্ট করছি।
নারীদের ঘরের ‘অবৈতনিক’ কাজে কোটি কোটি টাকা হারাচ্ছে বাংলাদেশ
গৃহস্থালির পরিচর্যা পরিষেবাগুলোয় ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগ স্থানীয় ও বিশ্বব্যাপী উভয় ক্ষেত্রেই কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে পারে, যার ফলস্বরূপ লিঙ্গ সমতা বৃদ্ধি, শ্রম বাজার ও অর্থনীতির বিকাশ ঘটানো সম্ভব। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) আয়োজিত ‘নীতি প্রণয়ন এবং বিশ্লেষণে গৃহস্থালি অর্থনীতির একীকরণ’ শীর্ষক ওয়েবিনারে বক্তারা এ কথা বলেন।
দেশের জনসংখ্যাবিষয়ক বৈষম্য অনুসারে প্রাপ্তবয়স্ক নারীরা দিনে আট ঘণ্টা বেতনহীন কাজ করেন, যেখানে পুরুষরা করেন দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। যার অর্থ নারীরা তাদের বেশিরভাগ সময় অ-বিপণনযোগ্য চাকরি যেমন গৃহস্থালির কাজ বা পরিষেবার কাযে ব্যয় করেন।
সরকারি তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বক্তারা বলেন, এ ধরনের কাজকে মজুরি প্রদান করে, এমনভাবে কাঠামোর আওতায় আনতে হবে যেন শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো যেতে পারে। তারা বলেন, এর মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে পুরুষরা যেন এ ধরনের পরিচর্যা কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে উপার্জনে জড়িত হতে পারেন। অন্যদিকে নারীরা অন্য চাকরিতে যুক্ত হয়ে অর্থনীতিতে ভিন্নভাবে অবদান রাখতে পারেন।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, নারীদের গৃহস্থালির ‘অদৃশ্য কাজ’ মোট জিডিপির প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ অবদান রাখে; যা অর্থনীতির আকারকে দ্বিগুণ করতে এবং নারীদের আয় প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি করতে পারে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) অনুসারে বিশ্বব্যাপী অবৈতনিক গৃহস্থালির দায়ভার নারী ও মেয়েদের ওপর অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে তাদের শিক্ষা, অবসর, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, বেতনভুক্ত কাজ এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য কম সময় থাকে। এ ধরনের কাজের বেশিরভাগই পরিবারের সদস্যদের যত্ন নেওয়া এবং ঘরোয়া কাজ করার জন্য নিবেদিত। বেশিরভাগ দেশেই পরিচর্যার কাজ নারীদের জীবনের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সময় নিয়ে নেয়, বিশেষ করে যেখানে অবকাঠামো দুর্বল এবং সর্বজনীনভাবে দেওয়া পরিষেবা সীমিত বা অনুপস্থিত।
‘গ্রামীণ পরিবেশে এবং বয়স্ক সমাজে যত্নের কাজের বোঝা বিশেষভাবে তীব্র’ উল্লেখ করে আইএমএফ জানিয়েছে, এই বোঝার কারণে নারীদের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপে যুক্ত হওয়ার পথ সীমিত হচ্ছে। তাদের কম বেতনের, অনানুষ্ঠানিক বা গৃহভিত্তিক কাজে মনোনিবেশ করতে হচ্ছে। কম বেতন ও অনানুষ্ঠানিক কাজে নারীদের ‘অসমান’ প্রতিনিধিত্ব লিঙ্গ মজুরি বৈষম্যতে অবদান রাখছে; যা নারীদের শ্রমকে অবমূল্যায়ন করে দরিদ্র শ্রমজীবীদের সংখ্যা বৃদ্ধি করে।
ওয়েবিনার সঞ্চালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান এবং সানেমের গবেষণা পরিচালক অধ্যাপক সায়মা হক মূল বক্তব্য রাখেন। এ সময় সায়মা হক নারীদের কাজের স্বীকৃতি, দায়িত্ব হ্রাস এবং নারীদের গৃহস্থালি কাজ পুনর্বণ্টন করার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, দেশের ১৫-২৯ বছর বয়সী নারীরা দিনের উল্লেখযোগ্য কতগুলো ঘণ্টা অবৈতনিক গৃহস্থালি কাজে ব্যয় করেন। এই অবৈতনিক কাজের স্বীকৃতি ও নারীদের উপর থেকে কাজের চাপ হ্রাস করা আর্থিক মূল্য নির্ধারণের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
ঘরের কাজ নারীর কাজ
যে কোনো শিশুকেও যদি জিজ্ঞেস করা হয় তোমার বাবা কী করেন? সে হয়তো বলবে, কৃষিকাজ করেন, ব্যবসা বা চাকরি করেন ইত্যাদি। যদি জিজ্ঞেস করা হয়, তোমার মা কী করেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উত্তর হবে– কিছু করেন না, ঘরের কাজ করেন। শিশুরা এটা শিখেছে আর বড়রা এসব শিখিয়েছেন যুগ যুগ ধরে। এখন প্রশ্ন হলো– এই যে গৃহস্থালি কাজগুলো আমাদের কাছে দৃশ্যমান হয় না। সেটি কেন? এর পেছনে অন্যতম একটি কারণ– এই কাজগুলো করে কোনো টাকা উপার্জন হয় না। এ জন্য এসব কাজের স্বীকৃতি নেই।
একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন মিতু (ছদ্মনাম)। তার স্বামী সরকারি চাকরিজীবী। মিতুর শ্বশুর তাদের সঙ্গেই থাকেন। মিতু প্রতিদিন সকাল ৬টায় উঠে বাসার সবার জন্য নাশতা তৈরি করেন। নিজের ও স্বামীর দুপুরের খাবার তৈরি করে শ্বশুরের খাবার ও ওষুধ গুছিয়ে দেন। মিতুর অফিস ছুটি হয় সন্ধ্যা ৬টায়। বেসরকারি ব্যাংক হওয়ায় ৭টাও বাজে। বাসা থেকে অফিস এক ঘণ্টার পথ। মাঝে মধ্যে ট্রাফিকের কারণে দেড় ঘণ্টাও লাগে। অফিস থেকে ফিরে মিতু ফ্রেশ হয়ে আবার চলে যান সংসারের কাজ করতে। ঘর গোছানো, সবার জন্য নাশতা তৈরি, রাতের রান্না, পরের দিন অফিসের খাবার তৈরি করা– সব মিলিয়ে দম ফেলার সময় থাকে না তার। রাজীব মাঝে মধ্যে অভিযোগ করেন মিতুকে, তিনি আর আগের মতো সময় দেন না।
মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে ময়না (ছদ্মনাম)। পরিবারের পছন্দে বিয়ে করেন সাব্বিরকে। তাদের ছয় বছরের একটি মেয়ে আছে। সাব্বিরের মা-বাবা আর ভাই আছেন। ময়না পুরোদস্তুর গৃহিণী। সকাল ৬টায় শুরু হয় তার ঘরের কাজ করা। ঘর পরিষ্কার, নাশতা তৈরি, এর পর সাব্বিরের অফিসের দুপুরের খাবার দেওয়া। মেয়েকে স্কুলের জন্য প্রস্তুত করা। কাজের লোক এসে কাপড় পরিষ্কার করে এবং ঘর মুছে যায়। এর পর দুপুরের রান্নার প্রস্তুতি নেওয়া। সাব্বিরদের বাসায় রান্না হয় দুই ধরনের। শ্বশুর খান কম তেলে মসলা ছাড়া রান্না। বাকিদের জন্য অন্য ধরনের রান্না হয়। দুপুরের খাবারের পর আবার সব পরিষ্কার করা লাগে। ময়নার দুপুরের খাবার খেতে বেজে যায় ৪টা। সন্ধ্যা ৬টায় আবার সবার জন্য নাশতা তৈরি। সাব্বির যখন অফিস থেকে ফেরেন, তখন তাকে সময় দেওয়া, আবার রাতের খাবারের প্রস্তুতি নেওয়া। এই হলো ময়নার নিত্যদিনের গল্প। সকাল ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত কাজ করে চলেন তিনি।
এখন প্রশ্ন উঠছে এবং উত্তর খোঁজা হচ্ছে, নারীরা ঘরে যে কাজ করেন, তা কি জাতীয় অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে না? যদি জাতীয় উৎপাদনে এর প্রভাব থাকে, তবে গৃহস্থালি কাজের স্বীকৃতি নেই কেন? এর আর্থিক মূল্য কি নির্ধারণ করা সম্ভব নয়? বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, মজুরিবিহীন কাজে পুরুষের চেয়ে নারীর অংশগ্রহণ দিনে ৬ দশমিক ৪৬ ঘণ্টা বেশি। ২০১২ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর টাইম ইউজড সার্ভে রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ১৫ বছরের বেশি কর্মজীবীদের মধ্যে ঘরের বিভিন্ন কাজে পুরুষ দৈনিক ১ দশমিক ৪ ঘণ্টা এবং নারী ব্যয় করেন ৩ দশমিক ৬ ঘণ্টা। কর্মজীবী না হলে গড়ে নারীরা দিনে ৬ দশমিক ২ ঘণ্টা এবং পুরুষ ১ দশমিক ২ ঘণ্টা এ ধরনের কাজে ব্যয় করেন। এর পরের রিপোর্ট প্রকাশিত হলেও নিশ্চয়ই এর খুব একটা তারতম্য হবে না। অবৈতনিক কাজের মূল্যের একটা ছায়া হিসাব করেছিল গবেষণা সংস্থা সানেম। তাদের তথ্য অনুযায়ী, যদি গৃহস্থালি কাজের আর্থিক মূল্য হিসাব করা যায়, তাহলে তা দাঁড়াবে নারীর ক্ষেত্রে জিডিপির ৩৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ এবং পুরুষের ক্ষেত্রে ৯ শতাংশ। সানেমের পক্ষ থেকে বলা হয়, নারীর কর্মসংস্থানে ১ শতাংশ বৃদ্ধি কার্যকরভাবে সামগ্রিক অর্থনৈতিক বৃদ্ধি করতে পারে শূন্য দশমিক ৩১ শতাংশ।
সিপিডির (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) গবেষণায় দেখা গেছে, নারীর কাজের ৭৮ থেকে ৮৭ শতাংশই অর্থনৈতিক হিসাবে আসে না- কাপড় ধোয়া, রান্না করা, ঘর পরিষ্কার করা ইত্যাদি। এ তো গেল আর্থিক হিসাব, এবার আসি আরেকটি প্রশ্নে। এই গৃহস্থালি কাজ নারীকেই করতে হবে, এটি কি সহজাত বা প্রকৃতিপ্রদত্ত কোনো নিয়ম? না, এটি আমাদের সমাজের নিয়ম। প্রকৃতপক্ষে নারীর কাজ বা পুরুষের কাজ বলে কিছু নেই। যে কোনো কাজ, যে কেউ করতে পারে। গৃহস্থালি কাজে টাকার মূল্যায়ন থাকে না; অথচ কাজগুলো অত্যাবশ্যকীয়। পরিবারের এ কাজগুলো একত্রে করা হলে সময় যেমন কম লাগে, তেমনি এ কাজ করলে পরিবারের সদস্যের মধ্যে সহমর্মিতা বাড়ে।
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ