নিজস্ব প্রতিবেদক: জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদের লাশের ‘ত্রুটিপূর্ণ’ সুরতহাল প্রতিবেদন দিতে ‘বাধ্য করা হয়েছে’ বলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন একজন পুলিশ সদস্য। তিনি বলেছেন, আবু সাঈদের মাথার পিছনে গুলির আঘাত ছিল। কিন্তু গুলিতে মৃত্যুর কথা না লিখতে তাকে ‘বাধ্য করা হয়’।
মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এসআই মো. তরিকুল ইসলামের সাক্ষ্য গ্রহণ করে। তরিকুল অভ্যুত্থানের সময় রংপুর মহানগরীর কোতোয়ালি থানায় কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে তিনি কর্মরত আছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের ভাষানটেক থানায়। সরকারি চাকরির কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই রংপুরে পুলিশের গুলিতে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ নিহত হন।
সেদিন দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকা আবু সাঈদকে পুলিশের গুলি করার ভিডিও সংবাদ মাধ্যমে প্রচার হলে ছাত্র-জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। পরদিন থেকে সারা দেশে ডাকা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন করা হয়। এরপর বিক্ষোভে দমন-পীড়ন আর সহিংসতার মধ্যে ১৯ জুলাই কারফিউ দিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি শেখ হাসিনা সরকার। তুমুল গণ-আন্দোলনের মধ্যে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান।
অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই অভ্যুত্থানে দমন-পীড়নকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের উদ্যোগ নেয়। এরপর আবু সাঈদের মামলাও ট্রাইব্যুনালে আসে। এসআই তরিকুল বলেন, সে দিন রংপুর কোতোয়ালি থানা এলাকায় দায়িত্ব পালনকালে বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে বেতার বার্তায় শুনতে পান রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি লাশ আছে, তার সুরতহাল করতে হবে। পরে থানার কনস্টেবল লিটন দেবনাথসহ মেডিকেলে গিয়ে জানিতে পারেন তাজহাট থানাধীন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পুলিশের গুলিতে এক ছাত্র নিহত হয়েছেন, নাম আবু সাঈদ। তিনি বলেন, তখন হাসপাতালে অনেক শিক্ষার্থী জড়ো হন এবং সেখানে উত্তেজনা বিরাজ করছিল এবং সেখানে অনেক পুলিশ সদস্য কর্তব্যরত ছিলেন।
এই পুলিশ সদস্য ট্রাইব্যুনালে বলেন, সন্ধ্যা ৭টার দিকে রংপুর মহানগর পুলিশের কোতোয়ালি জোনের সহকারী কমিশনার মো. আরিফুজ্জামান তার (সাক্ষী তরিকুল) কাছে যান এবং জিজ্ঞেস করেন তিনি লাশ দেখেছেন কিনা। এরপর তিনি দেখেননি বলে জানালে তাকে লাশ দেখে আসতে বলেন। লাশ দেখে এসে আমি জানাই, লাশে অসংখ্য ছররা গুলির আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। লাশের মাথার পিছনে আঘাতের চিহ্ন ও ক্ষত স্থান থেকে রক্ত ঝরে স্ট্রেচারে মাখামাখি হয়ে গেছে। তখন তিনি সুরতহাল প্রতিবেদনে মৃত্যু গুলির কারণে হয়েছে বলে লিখা যাবে না বলে জানান। তরিকুল বলেন, তার এ কথার সঙ্গে আমি একমত না হলে তিনি আমাকে গালাগাল দেন। এক পর্যায়ে বাবা-মা নিয়ে গাল দেন। এছাড়া আমাকে হুমকি দেন যে- ‘তুই জামাতের দালাল, তোর চাকরি খেয়ে দেব, মামলা দিয়ে চালান করে দেব।’ এরপর আমি ভয় পাই।
উপর থেকে তার উপর চাপ ছিল বলে আরিফুজ্জামান তাকে জানান, বলেন তিনি। তরিকুল বলেন, রাত সাড়ে ১০টার দিকে সহকারী কমিশনার আরিফুজ্জামান একজন মহানগর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদ সাদাতসহ আসেন এবং পুনরায় তার কথামতো সুরতহাল প্রতিবেদন লিখতে বলেন। আমি উপায়ান্তর না দেখে ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদ সাদাতের উপস্থিতিতে ছররা গুলির কথা বাদ দিয়ে অসংখ্য ছোট ছোট ক্ষতচিহ্ন লিখে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করি।
সাক্ষ্য নেওয়ার সময় প্রসিকিউটর এম এইচ তামিম, বি এম সুলতান মাহমুদসহ অন্য প্রসিকিউটররা উপস্থিত ছিলেন। পরে আসামির আইনজীবীরা তাকে জেরা করেছেন।
ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রতিবেদনে আবু সাঈদ হত্যার সঙ্গে ৩০ জনের সম্পৃক্ততার বিষয় উঠে আসে। গত ৩০ জুন অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল। একইসঙ্গে পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। ১৩ জুলাই আবু সাইদ হত্যা মামলায় পলাতক ২৪ আসামির বিরুদ্ধে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে আসামিদের হাজির করার নির্দেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। পলাতক থাকা এই ২৪ আসামির জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে চারজন আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা অভিযোগ গঠনের শুনানিতে অংশ নিয়েছেন। ৬ আগস্ট ৩০ আসামির বিচার শুরুর আদেশ দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।