প্রত্যাশা ডেস্ক : গুরুতর কোনো রোগ অথবা দুর্ঘটনায় আঘাতপ্রাপ্ত রোগীদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের কয়েকটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে ব্যবহৃত হচ্ছে ভিডিও গেইম। ‘থ্রিডি মোশন ক্যাপচার’-এর মতো উদ্ভাবনী প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে নিজের দেহকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন দুর্ঘটনার ভুক্তভোগী ও রোগীরা।
তেমনই একজন ইংল্যান্ডের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ২৪ বছর বয়সী বাসিন্দা রুবি ফ্ল্যানাগান। ২০২১ সালের অগাস্ট মাসে গাড়ির ধাক্কায় নিজের ডান পা হারিয়েছেন তিনি। বাম পা’ও অক্ষত নেই। পুনর্বাসনের অংশ হিসেবে কম্পিউটার গেইমভিত্তিক থেরাপি নিচ্ছেন তিনি। পেশায় নার্স ওই নারী এখন স্বপ্ন দেখছেন নিজের সন্তানকে মাটি থেকে তুলে নিজের কোলে নেওয়ার শক্তি পাবেন একদিন। দুর্ঘটনার সময় পাঁচ মাস বয়সী সন্তান লিওনকে নিয়ে কেনাকাটায় বেড়িয়েছিলেন ফ্ল্যানাগান। লিওনকে ধাক্কা দিয়ে বিপদের মুখ থেকে সরাতে পারলেও নিজের বেলায় ভাগ্য তার সহায় ছিল না।
তার ডান পায়ের পুরোটাই কেটে বাদ দিতে হয়েছে। আর কয়েকটি অস্ত্রোপচার করে কার্যত নতুন করে গঠন করতে হয়েছে তার বাম পা। সংঘর্ষে কোমরও ভেঙ্গে গিয়েছিল ফ্ল্যানাগানের। “হাসপাতালের প্রথম কয়েক সপ্তাহ একদমই ঘোলাটে,” বিবিসিকে বলেন ফ্ল্যানাগান।
“জ্ঞান ফেরার স্মৃতি মনে নেই আমর। কে আমাকে বলেছিলে যে আমার একটা পা কেটে ফেলা হয়েছে সেটাও মনে নেই আমার। আমি নিজে ভেবেছিলাম আমি আবার হাঁটতে শিখবো। নকল পা লাগাবো একটা, আর তাতেই হয়ে যাবে।”
“আমি বুঝতে পারিনি, এটা আসলে কতোটা কঠিন হবে।” বর্তমানে ইংল্যান্ডের শেফিল্ডে অবস্থিত বিশেষায়িত পুনর্বাসন কেন্দ্র ‘স্টেপস’-এ চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি। হাইড্রোথেরাপি এবং ফিজিওথেরাপির মতো প্রচলিত চিকিৎসা কৌশলের পাশাপাশি নিয়মিত ‘মাইন্ডপড’ সেশনে সময় দিচ্ছেন ফ্ল্যানাগান। ফ্ল্যানাগান ও তার মতো রোগীদের একটি ভিডিও গেইমের ডলফিন নিয়ন্ত্রণ করতে দেয় ‘মাইন্ডপড’। গেইমের ডলফিনটি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ধীরে ধীরে নিজ দেহের শক্তি, ভারসাম্য এবং দেহের বাকি অঙ্গগুলোর মধ্যে সমন্বয় নতুন করে শিখছেন আঘাতপ্রাপ্তরা। “আমি যখন এখানে প্রথম আসি, আমি কখনোই ভাবিনি যে কঠোর পুনর্বাসন কৌশল ভিডিও গেইম হবে,” বিবিসিকে বলেন ফ্ল্যানাগান। মাইন্ডপডের মনে প্রশান্তি সৃষ্টি করা আলো আর শান্ত প্রকৃতি তাকে তার দেহের সহজাত নড়াচড়ায় সহযোগিতা করছে বলে জানিয়েছেন তিনি। “মাইন্ডপড আমাকে ভারসাম্য ও দেহের কেন্দ্রীয় স্থিতিশীলতার সমন্বয়ে সহযোগিতা করছে।”
“আমি রান্নাঘরে থাকলে যা করতাম, সেই কাজগুলোর অনুকরণ করা হচ্ছে এখানে। যেমন কাবার্ড থেকে কিছু নামানো অথবা নিচ থেকে কিছু ওপরে ওঠানো।”
এ প্রসঙ্গে স্টেপসের থেরাপি বিভাগের প্রধান লুসি মুর বলেন, “মাইন্ডপডে সময় দিয়েছেন এমন রোগীদের কাছ থেকে আমরা অনেক প্রতিক্রিয়া পাচ্ছি যে তাদের মনে হচ্ছে তারা সত্যিই কোনো কাজ করছেন এর ভেতরে। বের হয়ে আসার পর নিরুদ্বেগ অনুভূতি হচ্ছে তাদের, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বিবিসি জানিয়েছে, ভিডিও গেইম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এই অভিনব থেরাপি কৌশল উদ্ভাবন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির কাটা স্টুডিওর ড. ওমার আহমাদ এবং ড. জন ক্রাকাউয়ার।
গেইমটি মোশন সেন্সর এবং ক্যামেরা ব্যবহার করে রোগীর নড়াচড়া পর্যবেক্ষণ করে। আর রোগীরা পর্দায় থাকা ব্যান্ডিট নামের একটি ডলফিনকে দিক নির্দেশনা দেন। ব্যান্ডিটের উদ্ভাবক ড. আহমাদের মতে, ঠিক প্রচলিত অর্থে অ্যানিমেশন বলা চলে না একে। “গেইমের সব নড়চড়াই তাৎক্ষণিকভাবে ঘটছে। নিজ দেহের মোটর-গতিবিদ্যা এবং নড়াচড়ায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রোগী নিজেই যেন ডলফিনে পরিণত হন।”
অর্থাৎ, গেইমের ডলফিনটি ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় ক্রমান্বয়ে নিজ দেহের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে থাকেন রোগী। কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ব্যবহার শেখার পাশাপাশি তার সঙ্গে মানিয়ে নিতে শেখে রোগীর দেহ। এই অভিনব থেরাপি কৌশলকে ‘ডিজিটাল থেরাপিউটিক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন নিউরোলজি এবং নিউরোসায়েন্সের অধ্যাপক ড, ক্রাকাউয়ার। অদূর ভবিষ্যতে প্রেসক্রিপশনে ওষুধের মতো এই সফটওয়্যারটি ব্যবহারের কথাও লিখে দিতে পারেন চিকিৎসক। “এটি শেখার একটি ফিডব্যাক লুপ তৈরি করে। একটা শিশু যেভাবে নিজের হাত নাড়াতে শেখে, তার মতোই এ প্রক্রিয়াটি,” বলেন ড. ক্রাকাউয়ার। এমন আরও কিছু ডিজিটাল থেরাপির কার্যকারীতা গ্লাসগোর স্ট্র্যাথক্লাইড ইউনিভার্সিটিতে পরীক্ষা করে দেখার কথা জানিয়েছে বিবিসি। চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে প্রযুক্তির এই অভিনব ব্যবহার নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির ‘স্যার জুলস থর্ন সেন্টার ফর কো-ক্রিয়েশন অফ রিহ্যাবিলিটেশন টেকনোলজি’-এর প্রধান ড. অ্যান্ড্রু কার বলেন, “দিন শেষে আমরা এমন প্রযুক্তি নির্মাণের চেষ্টা করছি যা কেবল যাদের ক্রয়ক্ষমতা আছে তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। বরং, নিজের বাড়িতে বা স্থানীয় অবসর কেন্দ্র ব্যবহার করা যাবে।” অন্য যে কোনো নতুন প্রযুক্তির মতো এই প্রযুক্তিগুলো সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছাতে কয়েক বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। তবে, তরুণ মা রুবি ফ্ল্যানাগানের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হচ্ছে, “আমি আমার বাচ্চাকে কোলে নিয়ে সিড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে চাই।”
গুরুতর আঘাতপ্রাপ্তদের চিকিৎসায় ভিডিও গেইম!
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ