ঢাকা ০২:৪০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৫ জুন ২০২৫
দ্য ইকোনমিস্ট-এর প্রতিবেদন

গুজরাট মডেলে ভারত চালাতে চাচ্ছেন মোদী

  • আপডেট সময় : ০৬:৪১:০২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩ জুন ২০২৫
  • ১৪ বার পড়া হয়েছে

প্রত্যাশা ডেস্ক: ২০ শতকে দক্ষিণ এশিয়ায় দুই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেন মোহনদাস গান্ধী ও মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। তারা দুজনেই গুজরাটি। ভারত ও পাকিস্তানের জাতির পিতা হিসেবে পরিচিত এই দুই নেতা ছাড়াও গুজরাটি ছিলেন ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার বল্লভভাই প্যাটেল।

আজকের ভারতেও গুজরাটিদের প্রভাব অপরিসীম। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তার সহযোগী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজেপির মুখ্য কৌশলবিদ অমিত শাহও গুজরাটের। আর ব্যবসায়ী জগতের শীর্ষ ব্যক্তি মুকেশ আম্বানি ও গৌতম আদানি। যাদের শিল্পগোষ্ঠী বন্দর থেকে শুরু করে টেলিকম পর্যন্ত নানা খাতে আধিপত্য বিস্তার করছে। ২০১৪ সালে মোদী যখন প্রধানমন্ত্রী হন তখন আদানির ব্যক্তিগত জেটে চড়ে দিল্লি যান, যা তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রমাণ।

তবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তির ক্ষেত্রেও এগিয়ে থাকলেও, সাংস্কৃতিক দিক থেকে গুজরাটিরা অনেকটা পিছিয়ে ছিল। স্বাধীনতার পর ভারতের আত্মপরিচয় মূলত তৈরি করেছিল এক ইংরেজিভাষী ও বাঙালি-প্রধান বুদ্ধিজীবী শ্রেণি। গুজরাটিরা প্রচলিত ছকের মতো মূলত ব্যবসা-বাণিজ্যে মন দিয়েছিল। তারা মুম্বাইয়ের শেয়ারবাজারে অবদান রাখেন, পূর্ব আফ্রিকায় ব্যবসা করেন, আবার ইউরোপ-আমেরিকায় হীরা বাণিজ্যের নেতৃত্বেও রয়েছেন। এমনকি ব্রিটেনেও গুজরাটি দোকানদারদেরই অন্যতম শক্তিশালী গোষ্ঠী হিসেবে দেখা হয়।

ব্যবসার বাইরে গুজরাটিদের কথা সাধারণত মনে পড়ে তাদের নিরামিষভোজিতা ও রাজ্যের মদ নিষিদ্ধ করার কারণে। কেউ কেউ ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার কথাও মনে করিয়ে দেন, যেখানে প্রায় এক হাজার নিহত হন। যাদের বেশিরভাগই ছিলেন মুসলমান। কেউ কেউ বলেন, গুজরাটে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ইতিহাস বহু পুরোনো।

মোদী ২০১৪ সালের নির্বাচনী প্রচারে বলেছিলেন, তিনি গোটা ভারতকে গুজরাট বানাতে চান। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ১৩ বছরে তিনি গুজরাটকে কার্যকর প্রশাসন, ব্যবসা বান্ধব পরিবেশ, উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও অবকাঠামো উন্নয়নের প্রতীক বানিয়েছিলেন। দাঙ্গার বিষয়টিকে অনেকে ভুলে গেছেন, কেউ কেউ তো এটাকেই মোদীর কঠোর নেতৃত্বের নিদর্শন হিসেবে দেখেছেন।

যারা গুজরাটি ভাষায় কথা বলেন, গুজরাটে থাকেন বা সেখান থেকে আসেন তারাই গুজরাটি। শুধুই হিন্দু নয়, জৈন, পারসি, দলিত, উপজাতি ও নানা প্রকার মুসলমানরাও এর অন্তর্ভুক্ত। গুজরাটি ভাষায় আছে হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি, ফারসি ও আরবি শব্দের প্রভাব, যা রাজ্যের প্রাচীন বাণিজ্য ইতিহাসের সাক্ষ্য।

গুজরাটের বহুজাতিক চরিত্র ছিল বাণিজ্যিক মানসিকতারই ফসল। প্রতিকূল আবহাওয়ায় শাসকরা ব্যবসার প্রসারে উদ্বুদ্ধ করতেন। ব্যবসা করতেও দরকার ছিল সহনশীলতা ও মিশ্র সংস্কৃতির গ্রহণযোগ্যতা। ২০২১ সালের এক সরকারি জরিপে দেখা যায়, ৪০ শতাংশ গুজরাটি মাংস খান। যদিও বাস্তবে সংখ্যাটি আরো বেশি। মদ চোরাচালানও গোপনে চলতে থাকে। তবে গুজরাটের সেই কসমোপলিটান চেহারা আজ অনেকটাই হারিয়ে গেছে। আহমেদাবাদ এখন দেশের সবচেয়ে ধর্মীয়ভাবে বিভক্ত শহর। নিরামিষভোজিরা তাদের খাদ্যাভ্যাস অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেন, এমনকি ডেলিভারি কর্মীদেরও তাড়িয়ে দেন। রাজ্যের ১০ শতাংশ মুসলমান হলেও ১৯৮৯ সালের পর থেকে কেউই সংসদে নির্বাচিত হননি। বিজেপি ১৯৯৮ সাল থেকে একটানা ক্ষমতায় সেখানে।

মোদী এখন প্রায় যতদিন গুজরাট চালিয়েছেন, ততদিন ধরেই ভারত চালাচ্ছেন। তিনি আয় বাড়িয়েছেন, অবকাঠামো উন্নত করেছেন। যদিও ব্যবসার পরিবেশ এখনো কঠিন, প্রশাসনিক সংস্কার প্রায় অবহেলিত। কিন্তু যে জায়গায় ভারত সবচেয়ে বেশি গুজরাটের মতো হয়ে উঠেছে, তা হলো সাম্প্রদায়িক বিভাজন, ধর্মীয় উত্তেজনা, খাদ্য নিয়ে আগ্রাসন, এবং বহুত্ববাদী মনোভাবের ওপর আঘাত। সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

দ্য ইকোনমিস্ট-এর প্রতিবেদন

গুজরাট মডেলে ভারত চালাতে চাচ্ছেন মোদী

আপডেট সময় : ০৬:৪১:০২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩ জুন ২০২৫

প্রত্যাশা ডেস্ক: ২০ শতকে দক্ষিণ এশিয়ায় দুই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেন মোহনদাস গান্ধী ও মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। তারা দুজনেই গুজরাটি। ভারত ও পাকিস্তানের জাতির পিতা হিসেবে পরিচিত এই দুই নেতা ছাড়াও গুজরাটি ছিলেন ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার বল্লভভাই প্যাটেল।

আজকের ভারতেও গুজরাটিদের প্রভাব অপরিসীম। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তার সহযোগী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজেপির মুখ্য কৌশলবিদ অমিত শাহও গুজরাটের। আর ব্যবসায়ী জগতের শীর্ষ ব্যক্তি মুকেশ আম্বানি ও গৌতম আদানি। যাদের শিল্পগোষ্ঠী বন্দর থেকে শুরু করে টেলিকম পর্যন্ত নানা খাতে আধিপত্য বিস্তার করছে। ২০১৪ সালে মোদী যখন প্রধানমন্ত্রী হন তখন আদানির ব্যক্তিগত জেটে চড়ে দিল্লি যান, যা তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রমাণ।

তবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তির ক্ষেত্রেও এগিয়ে থাকলেও, সাংস্কৃতিক দিক থেকে গুজরাটিরা অনেকটা পিছিয়ে ছিল। স্বাধীনতার পর ভারতের আত্মপরিচয় মূলত তৈরি করেছিল এক ইংরেজিভাষী ও বাঙালি-প্রধান বুদ্ধিজীবী শ্রেণি। গুজরাটিরা প্রচলিত ছকের মতো মূলত ব্যবসা-বাণিজ্যে মন দিয়েছিল। তারা মুম্বাইয়ের শেয়ারবাজারে অবদান রাখেন, পূর্ব আফ্রিকায় ব্যবসা করেন, আবার ইউরোপ-আমেরিকায় হীরা বাণিজ্যের নেতৃত্বেও রয়েছেন। এমনকি ব্রিটেনেও গুজরাটি দোকানদারদেরই অন্যতম শক্তিশালী গোষ্ঠী হিসেবে দেখা হয়।

ব্যবসার বাইরে গুজরাটিদের কথা সাধারণত মনে পড়ে তাদের নিরামিষভোজিতা ও রাজ্যের মদ নিষিদ্ধ করার কারণে। কেউ কেউ ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার কথাও মনে করিয়ে দেন, যেখানে প্রায় এক হাজার নিহত হন। যাদের বেশিরভাগই ছিলেন মুসলমান। কেউ কেউ বলেন, গুজরাটে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ইতিহাস বহু পুরোনো।

মোদী ২০১৪ সালের নির্বাচনী প্রচারে বলেছিলেন, তিনি গোটা ভারতকে গুজরাট বানাতে চান। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ১৩ বছরে তিনি গুজরাটকে কার্যকর প্রশাসন, ব্যবসা বান্ধব পরিবেশ, উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও অবকাঠামো উন্নয়নের প্রতীক বানিয়েছিলেন। দাঙ্গার বিষয়টিকে অনেকে ভুলে গেছেন, কেউ কেউ তো এটাকেই মোদীর কঠোর নেতৃত্বের নিদর্শন হিসেবে দেখেছেন।

যারা গুজরাটি ভাষায় কথা বলেন, গুজরাটে থাকেন বা সেখান থেকে আসেন তারাই গুজরাটি। শুধুই হিন্দু নয়, জৈন, পারসি, দলিত, উপজাতি ও নানা প্রকার মুসলমানরাও এর অন্তর্ভুক্ত। গুজরাটি ভাষায় আছে হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি, ফারসি ও আরবি শব্দের প্রভাব, যা রাজ্যের প্রাচীন বাণিজ্য ইতিহাসের সাক্ষ্য।

গুজরাটের বহুজাতিক চরিত্র ছিল বাণিজ্যিক মানসিকতারই ফসল। প্রতিকূল আবহাওয়ায় শাসকরা ব্যবসার প্রসারে উদ্বুদ্ধ করতেন। ব্যবসা করতেও দরকার ছিল সহনশীলতা ও মিশ্র সংস্কৃতির গ্রহণযোগ্যতা। ২০২১ সালের এক সরকারি জরিপে দেখা যায়, ৪০ শতাংশ গুজরাটি মাংস খান। যদিও বাস্তবে সংখ্যাটি আরো বেশি। মদ চোরাচালানও গোপনে চলতে থাকে। তবে গুজরাটের সেই কসমোপলিটান চেহারা আজ অনেকটাই হারিয়ে গেছে। আহমেদাবাদ এখন দেশের সবচেয়ে ধর্মীয়ভাবে বিভক্ত শহর। নিরামিষভোজিরা তাদের খাদ্যাভ্যাস অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেন, এমনকি ডেলিভারি কর্মীদেরও তাড়িয়ে দেন। রাজ্যের ১০ শতাংশ মুসলমান হলেও ১৯৮৯ সালের পর থেকে কেউই সংসদে নির্বাচিত হননি। বিজেপি ১৯৯৮ সাল থেকে একটানা ক্ষমতায় সেখানে।

মোদী এখন প্রায় যতদিন গুজরাট চালিয়েছেন, ততদিন ধরেই ভারত চালাচ্ছেন। তিনি আয় বাড়িয়েছেন, অবকাঠামো উন্নত করেছেন। যদিও ব্যবসার পরিবেশ এখনো কঠিন, প্রশাসনিক সংস্কার প্রায় অবহেলিত। কিন্তু যে জায়গায় ভারত সবচেয়ে বেশি গুজরাটের মতো হয়ে উঠেছে, তা হলো সাম্প্রদায়িক বিভাজন, ধর্মীয় উত্তেজনা, খাদ্য নিয়ে আগ্রাসন, এবং বহুত্ববাদী মনোভাবের ওপর আঘাত। সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট