ঢাকা ০৫:৫৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০১ জুন ২০২৫

গুজব নাকি সত্য- যাচাই করে প্রচার করা উচিত

  • আপডেট সময় : ১০:২০:১৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ জুলাই ২০২৪
  • ৬৫ বার পড়া হয়েছে

ড. সুলতান মাহমুদ রানা : বাঙালিরা যে হুজুগে জাতি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কোনো একটি বিশেষ ইস্যু সামনে পেলে আমরা সবাই মেতে উঠি তা নিয়ে। সত্য মিথ্যা যাচাই করার প্রয়োজনও অনুভব করি না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেকোনো একটি মিথ্যা সংবাদকেও ভাইরালে পরিণত করতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না। কয়েকদিন আগে ফেসবুকে একটি পোস্ট চোখে পড়লো। কোটা সংস্কার আন্দোলনের ইস্যুতে একজন ছাত্রী নিজেই তার ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানিয়েছেন যে তিনি বেঁচে আছেন। কারণ এর আগে ওই ছাত্রীর ছবি দিয়ে প্রচার করে দেয়া হয় যে তিনি কোটা আন্দোলনের সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন। গুজবের মাত্রা কোথায় পৌঁছালে একজন জীবিত মানুষকেও মৃত হিসেবে প্রতিষ্ঠত করা যায়। আবার সেই খবরটি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকেই সত্য-মিথ্যা প্রমাণ করতে হচ্ছে।
আমরা অনেকেই ভেবে দেখি না যে, আমরা কী প্রচার করছি, কেন করছি। কী নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছি কিংবা কীসে মেতে উঠছি। যে বিষয়ে আমরা মেতে উঠছি তা কি সমাজকে আদৌ ভালো কিছু শেখাচ্ছে? নাকি সমাজকে আরো কলুষিত করে তুলছে? এমন ভাবনা আমাদের আসে না বললেই চলে। আমরা নিজেরা আমাদের বাচ্চাদেরকে পড়াশোনার পাশাপাশি নানাভাবে সমাজিক আচার-আচরণ, কৃষ্টি-কালচার শিক্ষা দিয়ে থাকি। এসব ক্ষেত্রে অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ইদানীং সামাজিক যোগোযোগ মাধ্যমের উপর বেশি নির্ভর করছি। আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে অনেক সময় সতর্ক হই, আবার অনেক সময় উৎসাহিত হই। মাঝে মধ্যে এমন কিছু খবর প্রচার হয় যাতে সর্বসাধারণের সতর্ক হওয়ার বিষয়টি প্রাধান্য পায়। কিন্তু ক্ষেত্র বিশেষে দেখা যায়, গুজব আমাদের সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের সুযোগকেও নষ্ট করে দেয়। প্রকৃতপক্ষে সত্য-মিথ্যা যাচাই ছাড়াই আমরা মেতে উঠি। অনেক সময় আমাদের এমন মেতে উঠার বিষয়টি গোটা সমাজকে নেতিবাচকভাবে উৎসাহিত করে থাকে।
এ প্রসঙ্গে কবি শামসুর রহামানের কথা মনে পড়ে যায়। তিনি তাঁর পণ্ডশ্রম কবিতায় লিখেছিলেন, ‘এই নিয়েছে ঐ নিল যাঃ! কান নিয়েছে চিলে, চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে। দিন দুপুরে জ্যান্ত আহা, কানটা গেল উড়ে, কান না পেলে চার দেয়ালে মরব মাথা খুড়ে।’ প্রকৃতপক্ষে কান চিলে নিয়েছে কিনা, তা পরীক্ষা না করেই চিলের পিছে দৌড়ে বেড়ানোর স্বভাবটা আমাদের একটু বেশি।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অফিসিয়ালি বন্ধ রাখা হয়েছে। কিন্তু আমরা লক্ষ করছি, এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই বন্ধ রাখার খবরটি প্রচার হচ্ছে। দেশের প্রায় সকল সচেতন ব্যক্তিই ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অ্যাক্টিভ রয়েছেন। সেখানে আমরা প্রতিনিয়ত কোটা সংস্কার আন্দোলনের ইস্যুতে নানা ধরনের খবর পাচ্ছি। কোনটা সঠিক আর কোনটা ভুল সেটি যাচাই না করেই আমরা অনেকেই প্রচার চালিয়ে দিচ্ছি। এমনকি অনেক খবরই গুজব আকারে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে দেশের আপামর জনসাধারণের কাছে। আমরা জানি, একটি সংবাদ প্রচারে পর কারও মানহানি হলে পরবর্তীতে যদি সেটি মিথ্যা প্রমাণিত হয় তবুও তিনি পরবর্তীতে তার মান-মর্যাদা ফিরে পান না।
আমাদের সমাজে প্রচারিত অনেক ঘটনাই পরবর্তীতে মিথ্যা, ভিত্তিহীন কিংবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে প্রমাণিত হয়। কিন্তু যেভাবে খবর প্রকাশিত হয়ে থাকে, পরবর্তীতে সেটি মিথ্যা প্রমাণিত হলে সেভাবে আর প্রকাশ করা পায় না। মিথ্যা অভিযোগ হলেও একবার তা প্রকাশ পেলে পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির যে মান ও মর্যাদারহানি ঘটে তা কোনোভাবেই পুরণযোগ্য হয় না।
অনেক সময় কোনো বিষয় প্রচার করতে গিয়ে ভালো-মন্দ বিচারের হিতাহিত জ্ঞান আমরা হারিয়ে ফেলি। বিশেষ করে কেউ কোনো ভালো কাজ করলে সেটি যতটা না প্রচার পায় কোনো খারাপ কাজ তার চেয়ে অনেক বেশি দ্রুত প্রচার পায়। লেখার শুরুতেই আমি কিছু সামাজিকতা ও কৃষ্টি-কালচারের কথা বলেছি। কিন্তু যেভাবে একটি সংবাদকে ভাইরাল করা হয় তা থেকে আমরা সমাজকে কী শিক্ষা দিচ্ছি?
কবি শামসুর রাহমানের ভাষায়, ঝাকের কই ঝাকে মিশে যাবার মতোন ব্যাপার-স্যাপার। যা এক কথায় আত্মঘাতি। এমন আত্মঘাতী প্রবণতা আমাদের ঘাড়ে চেপে বসলে সামনের দিনগুলোতে কিছু সংকট তৈরি হওয়াটা কি স্বাভাবিক নয়? এতে কোমল-মতি শিশুরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

গুজব নাকি সত্য- যাচাই করে প্রচার করা উচিত

আপডেট সময় : ১০:২০:১৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ জুলাই ২০২৪

ড. সুলতান মাহমুদ রানা : বাঙালিরা যে হুজুগে জাতি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কোনো একটি বিশেষ ইস্যু সামনে পেলে আমরা সবাই মেতে উঠি তা নিয়ে। সত্য মিথ্যা যাচাই করার প্রয়োজনও অনুভব করি না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেকোনো একটি মিথ্যা সংবাদকেও ভাইরালে পরিণত করতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না। কয়েকদিন আগে ফেসবুকে একটি পোস্ট চোখে পড়লো। কোটা সংস্কার আন্দোলনের ইস্যুতে একজন ছাত্রী নিজেই তার ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানিয়েছেন যে তিনি বেঁচে আছেন। কারণ এর আগে ওই ছাত্রীর ছবি দিয়ে প্রচার করে দেয়া হয় যে তিনি কোটা আন্দোলনের সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন। গুজবের মাত্রা কোথায় পৌঁছালে একজন জীবিত মানুষকেও মৃত হিসেবে প্রতিষ্ঠত করা যায়। আবার সেই খবরটি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকেই সত্য-মিথ্যা প্রমাণ করতে হচ্ছে।
আমরা অনেকেই ভেবে দেখি না যে, আমরা কী প্রচার করছি, কেন করছি। কী নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছি কিংবা কীসে মেতে উঠছি। যে বিষয়ে আমরা মেতে উঠছি তা কি সমাজকে আদৌ ভালো কিছু শেখাচ্ছে? নাকি সমাজকে আরো কলুষিত করে তুলছে? এমন ভাবনা আমাদের আসে না বললেই চলে। আমরা নিজেরা আমাদের বাচ্চাদেরকে পড়াশোনার পাশাপাশি নানাভাবে সমাজিক আচার-আচরণ, কৃষ্টি-কালচার শিক্ষা দিয়ে থাকি। এসব ক্ষেত্রে অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ইদানীং সামাজিক যোগোযোগ মাধ্যমের উপর বেশি নির্ভর করছি। আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে অনেক সময় সতর্ক হই, আবার অনেক সময় উৎসাহিত হই। মাঝে মধ্যে এমন কিছু খবর প্রচার হয় যাতে সর্বসাধারণের সতর্ক হওয়ার বিষয়টি প্রাধান্য পায়। কিন্তু ক্ষেত্র বিশেষে দেখা যায়, গুজব আমাদের সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের সুযোগকেও নষ্ট করে দেয়। প্রকৃতপক্ষে সত্য-মিথ্যা যাচাই ছাড়াই আমরা মেতে উঠি। অনেক সময় আমাদের এমন মেতে উঠার বিষয়টি গোটা সমাজকে নেতিবাচকভাবে উৎসাহিত করে থাকে।
এ প্রসঙ্গে কবি শামসুর রহামানের কথা মনে পড়ে যায়। তিনি তাঁর পণ্ডশ্রম কবিতায় লিখেছিলেন, ‘এই নিয়েছে ঐ নিল যাঃ! কান নিয়েছে চিলে, চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে। দিন দুপুরে জ্যান্ত আহা, কানটা গেল উড়ে, কান না পেলে চার দেয়ালে মরব মাথা খুড়ে।’ প্রকৃতপক্ষে কান চিলে নিয়েছে কিনা, তা পরীক্ষা না করেই চিলের পিছে দৌড়ে বেড়ানোর স্বভাবটা আমাদের একটু বেশি।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অফিসিয়ালি বন্ধ রাখা হয়েছে। কিন্তু আমরা লক্ষ করছি, এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই বন্ধ রাখার খবরটি প্রচার হচ্ছে। দেশের প্রায় সকল সচেতন ব্যক্তিই ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অ্যাক্টিভ রয়েছেন। সেখানে আমরা প্রতিনিয়ত কোটা সংস্কার আন্দোলনের ইস্যুতে নানা ধরনের খবর পাচ্ছি। কোনটা সঠিক আর কোনটা ভুল সেটি যাচাই না করেই আমরা অনেকেই প্রচার চালিয়ে দিচ্ছি। এমনকি অনেক খবরই গুজব আকারে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে দেশের আপামর জনসাধারণের কাছে। আমরা জানি, একটি সংবাদ প্রচারে পর কারও মানহানি হলে পরবর্তীতে যদি সেটি মিথ্যা প্রমাণিত হয় তবুও তিনি পরবর্তীতে তার মান-মর্যাদা ফিরে পান না।
আমাদের সমাজে প্রচারিত অনেক ঘটনাই পরবর্তীতে মিথ্যা, ভিত্তিহীন কিংবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে প্রমাণিত হয়। কিন্তু যেভাবে খবর প্রকাশিত হয়ে থাকে, পরবর্তীতে সেটি মিথ্যা প্রমাণিত হলে সেভাবে আর প্রকাশ করা পায় না। মিথ্যা অভিযোগ হলেও একবার তা প্রকাশ পেলে পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির যে মান ও মর্যাদারহানি ঘটে তা কোনোভাবেই পুরণযোগ্য হয় না।
অনেক সময় কোনো বিষয় প্রচার করতে গিয়ে ভালো-মন্দ বিচারের হিতাহিত জ্ঞান আমরা হারিয়ে ফেলি। বিশেষ করে কেউ কোনো ভালো কাজ করলে সেটি যতটা না প্রচার পায় কোনো খারাপ কাজ তার চেয়ে অনেক বেশি দ্রুত প্রচার পায়। লেখার শুরুতেই আমি কিছু সামাজিকতা ও কৃষ্টি-কালচারের কথা বলেছি। কিন্তু যেভাবে একটি সংবাদকে ভাইরাল করা হয় তা থেকে আমরা সমাজকে কী শিক্ষা দিচ্ছি?
কবি শামসুর রাহমানের ভাষায়, ঝাকের কই ঝাকে মিশে যাবার মতোন ব্যাপার-স্যাপার। যা এক কথায় আত্মঘাতি। এমন আত্মঘাতী প্রবণতা আমাদের ঘাড়ে চেপে বসলে সামনের দিনগুলোতে কিছু সংকট তৈরি হওয়াটা কি স্বাভাবিক নয়? এতে কোমল-মতি শিশুরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।