গাজীপুর প্রতিনিধি : গাজীপুরে গাড়ি কম থাকায় এবং ভাড়া বেশি নেওয়ায় কর্মস্থলে যেতে ভোগান্তির শিকার শ্রমিকরা বিক্ষোভ দেখিয়েছে।
গতকাল সোমবার সকাল ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত জেলার শ্রীপুর পৌর এলাকায় ২ নম্বর সিঅ্যান্ডবি বাজারে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে তারা এই বিক্ষোভ দেখায়। মাওনা হাইওয়ে থানার ওসি কামাল হোসেন জানান, বিক্ষোভের সময় মহাসড়কের দুই পাশে প্রায় দুই কিলোমিটারে যানজট সৃষ্টি হয়। পরে পুলিশ গিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করে। প্রায় এক ঘণ্টা পর ৯টার দিকে শ্রমিকরা রাস্তা ছেড়ে দিলে আবার যান চলাচল শুরু হয়। শ্রমিকদের অভিযোগ, কারখানা খোলা হলেও রাস্তায় গাড়ি কম। আবার ভাড়া কয়েকগুণ বেশি। এতে তাদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। ওই এলকার ইয়াছমিন স্পিনিং মিলের শ্রমিক আল আমিন বলেন, “গড়গড়িয়া মাস্টারবাড়ি থেকে কারখানা পর্যন্ত অটোরিকশার ভাড়া ২০ টাকা। আজ ৫০ টাকা দিয়েও আটোরিকশা পাওয়া যাচ্ছে না।
“দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেও অটোরিকশা না পেয়ে হেঁটে কারখানার উদ্দেশে রওনা হই। কারখানায় গিয়ে দেখি অনেকেরই একই অবস্থা। তাই সকলে এ ভোগান্তি ও ভাড়া কমানোর দাবিতে সমবেত হয়েছি।”
রেহানা আক্তার নামে একজন শ্রমিক জানান, তার বাসা কারখানা থেকে আট কিলোমিটার দূরে। স্বাভাবিক সময়ে লোকাল বাসের ভাড়া ১০ থেকে ১৫ টাকা ছিল। আজ বাস না চলায় ৮০ টাকা দিয়ে অটোরিকশায় করে যেতে হয়েছে তাকে। দুর্ভোঘ লাঘবে শ্রমিকরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।
করোনাভাইরাস মহামারী রুখতে সরকার লকডাউন ঘোষণা করার পর রোববার থেকে লকডাউনের মধ্যেই কলকারখানা খোলার অনুমতি দেয়। সেই থেকে অনুমোদন ছাড়া কিছু গাড়িও রাস্তায় নামছে। কিন্তু গাড়ির সংখ্যা খুব কম হওয়ায় সারা দেশ থেকে শ্রমিকরা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় কাজে যোগ দিতে যাওয়ার পথে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।
কয়েক গুণ বেশি ভাড়ায় গন্তব্যে শ্রমিকেরা : সদরঘাটে গতকাল সোমবার সকাল ১০টা পর্যন্ত ৩৮টি লঞ্চ এসে পৌঁছেছে। ঢাকা থেকে ছেড়ে গেছে ১১টি লঞ্চ। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এ তথ্য জানিয়েছে। লঞ্চে আসা শ্রমিকদের সদরঘাট থেকে কয়েক গুণ বেশি ভাড়া দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে হচ্ছে।
ইলিয়াস আকন নামের এক ব্যক্তি গাজীপুরের চৌরাস্তার একটি তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে তিনি ওই এলাকাতেই বসবাস করেন। পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে কঠোর বিধিনিষেধ শিথিল করা হলে তিনি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার বড় মাছুয়ার গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন। কারখানা খোলার খবর পেয়ে লঞ্চে করে রাজধানীর সদরঘাটে পৌঁছান। জানালেন, সদরঘাট থেকে গাজীপুরের চৌরাস্তায় যাওয়ার কোনো উপায় তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন।
ইলিয়াসকে মাছুয়া থেকে কয়েক গুণ বেশি ভাড়া দিয়ে বরিশালের নথুল্লাবাদ বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত আসতে হয়েছে। সেখান থেকে রিকশায় তিনি লঞ্চঘাটে গেছেন। লঞ্চেও ৬০ শতাংশ বেশি ভাড়া দিতে হয়েছে। পা ফেলার জায়গা ছিল না লঞ্চে। মানা হয়নি ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি। ইলিয়াসের পরিবারের অন্য সদস্যরা যাত্রাপথের দুর্ভোগ সহ্য করেছেন। তবে পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য দুই বছরের ইয়াছিন কিছুতেই স্থির থাকছে না। কোনো গণপরিবহন না পেয়ে তাঁরা সড়কের পাশেই ব্যাগ ও মালামালভর্তি বস্তা রেখে বাহাদুর শাহ পার্কের কর্নারের বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছিলেন। ইলিয়াস চেষ্টা করছিলেন বিকল্প কোনো পরিবহন ঠিক করার।
স্ত্রী মারুফা বেগম জানান, গত রোববার বেলা একটার সময় বাড়ি থেকে রওনা দিয়েছি। লঞ্চে উঠতে পারলেও বসারও জায়গা ছিল না। খুবই কষ্ট হয়েছে। হালকা খাবার খেলেও রাতের খাবার খাওয়া সম্ভব হয়নি।
সকাল নয়টার দিকে যখন মারুফার সঙ্গে কথা হয়, তখন তাঁরা বিকল্প যানবাহন ভাড়া করার চেষ্টা করছিলেন। কোনো রিকশাই এক হাজার টাকার কমে যেতে রাজি হচ্ছিল না। কিন্তু পরিবারের চার সদস্য এবং সঙ্গে থাকা ব্যাগ ও বস্তা নিয়ে একটি রিকশায় স্থানসংকুলান হবে না। তাই রিকশায় যাওয়ার চিন্তা বাদ দিলেন তাঁরা।
কীর্তনখোলা-২ লঞ্চটি সদরঘাটে পৌঁছায় সকাল সাড়ে সাতটার দিকে। এরপর প্রায় আড়াই ঘণ্টা অপেক্ষার পর একটি ভ্যান ঠিক করেন ইলিয়াস। বেলা ১১টার সময় ইলিয়াস যখন মুঠোফোনে এই প্রতিবেদকের সঙ্গেল কথা বলছিলেন, তখন তাঁদের বহনকারী ভ্যানটি বারিধারা পার হচ্ছিল। তিনি বলেন, ‘এক হাজার টাকা চুক্তিতে ভ্যানটি আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত যেতে রাজি হয়েছে। সেখানে নেমে অন্য কোনো যানবাহনে বাসা পর্যন্ত যেতে হবে। কখন বাসায় পৌঁছাতে পারব, তা জানি না।’ ইলিয়াস প্রশ্ন করেন, সরকার লঞ্চ ছাড়ল, কিন্তু সড়কে গণপরিবহন নেই। লঞ্চে আসা যাত্রীরা গন্তব্য পৌঁছাবে কীভাবে।
কোনো পরিবহন না পেয়ে একই স্থানে অপেক্ষা করছিলেন ভোলার লালমোহন থেকে কর্ণফুলী-১৩ লঞ্চে আসা জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, মূল ঘাট মঙ্গল শিকদার থেকে ছাড়ার সময়ই লঞ্চটি কানায় কানায় পরিপূর্ণ ছিল। এরপরও হাকিমুদ্দিন, দৌলতখান ও বাংলাবাজার ঘাট ধরেছিল। পা ফেলার জায়গা ছিল না। তিনি আরও জানান, সকালে লঞ্চটি সদরঘাটে আসার পর তিনি বাসস্ট্যান্ডে এসে গাজীপুরগামী চারটি বাস দেখতে পান। কিন্তু যাত্রীতে ঠাসা কোনো বাসেই ওঠার সুযোগ পাননি। সকাল ১০টা পর্যন্ত বাসস্ট্যান্ডে বসে বিকল্প যানবাহনের অপেক্ষা করছিলেন তিনি। বেলা ১১টার দিকে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তাঁর ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
গাড়ি কম, ভাড়া বেশি, শ্রমিক বিক্ষোভ
জনপ্রিয় সংবাদ