আন্তর্জাতিক ডেস্ক: গাজা উপত্যকার আল-শিফা হাসপাতালের বাইরে স্থাপিত এক তাঁবুতে ইসরায়েলি হামলায় আল জাজিরার পাঁচ সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। রোববার (১০ আগস্ট) গভীর রাতে হাসপাতালের প্রধান ফটকের বাইরে থাকা ওই তাঁবুতে হামলা চালায় ইসরায়েলি বাহিনী। এতে আল জাজিরার প্রধান সাংবাদিক আনাস আল-শরীফসহ সাতজন নিহত হন।
কাতারভিত্তিক সম্প্রচার মাধ্যমটি জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে আরো রয়েছেন আল জাজিরার সংবাদদাতা মোহাম্মদ কুরেইকেহ এবং ক্যামেরাপার্সন ইব্রাহিম জাহের, মোহাম্মদ নুফাল ও মুয়ামেন আলিওয়া। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি ও আল জাজিরা এ খবর জানিয়েছে। আল জাজিরা জানায়, রোববারের এই ‘টার্গেটেড অ্যাসাসিনেশন’ ছিল গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর আরেকটি নগ্ন ও পূর্বপরিকল্পিত হামলা।’
হামলার কিছুক্ষণের মধ্যেই ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) টেলিগ্রামে পোস্ট দিয়ে নিশ্চিত করে যে তারা আনাস আল-শরীফকে লক্ষ্যবস্তু করেছিল। তাদের দাবি, আনাস হামাসের একটি সন্ত্রাসী সেলের প্রধান হিসেবে কাজ করছিলেন। আইডিএফ নিহত অন্য সাংবাদিকদের নাম উল্লেখ করেনি।
মোট সাতজন ওই হামলায় নিহত হয়েছেন বলে আল জাজিরা জানায়। শুরুতে সংস্থাটি চার কর্মীর মৃত্যুর কথা জানালেও কয়েক ঘণ্টা পরে সংখ্যা সংশোধন করে।
আল জাজিরার ম্যানেজিং এডিটর মোহাম্মদ মোয়াওয়াদ বিবিসিকে বলেন, আল-শরীফ একজন অনুমোদিত সাংবাদিক ছিলেন। যিনি ‘গাজা উপত্যকার ভেতরে কী ঘটছে, তা জানার জন্য বিশ্বের একমাত্র কণ্ঠস্বর’ ছিলেন।
পুরো যুদ্ধকাল জুড়ে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের গাজায় স্বাধীনভাবে প্রবেশ করে প্রতিবেদন করার অনুমতি দেয়নি। ফলে অনেক সংবাদমাধ্যম ভেতরের খবরের জন্য স্থানীয় সাংবাদিকদের ওপর নির্ভর করছে। মোয়াওয়াদ বলেন, “তারা তাঁবুর ভেতরে ছিলেন, ফ্রন্টলাইন থেকে কভারেজ করছিলেন না।”
তিনি আরো বলেন, “বাস্তবতা হলো, ইসরায়েলি সরকার গাজার ভেতর থেকে যে কোনো ধরনের সংবাদ কাভারেজ বন্ধ করতে চায়। আধুনিক ইতিহাসে আমি এমন কিছু দেখিনি।”
২৮ বছর বয়সী সুপরিচিত আনাস আল-শরীফ আল জাজিরা আরবি সংবাদদাতা হিসেবে উত্তর গাজা থেকে ব্যাপকভাবে প্রতিবেদন প্রকাশ করতেন।
মৃত্যুর ঠিক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এক পোস্ট দিয়েছেন তিনি। সেখানে তিনি লিখেছেন, গাজা সিটির পূর্ব ও দক্ষিণ অংশে তীব্র ও কেন্দ্রীভূত বোমাবর্ষণ চালিয়েছে ইসরায়েল। এই হামলা ফায়ার বেল্ট নামেও পরিচিত।
তার শেষ ভিডিওতে শোনা যায় ইসরায়েলের তীব্র ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ, আর অন্ধকার আকাশ হঠাৎ কমলা আভায় আলোকিত হয়ে উঠছে।
বিবিসির যাচাই করে নিশ্চিত করা হামলার পরের দুটি ভয়াবহ ভিডিওতে দেখা যায়, নিহতদের মরদেহ বহন করছেন কয়েকজন পুরুষ। কারো কারো মুখে শোনা যায় কুরেইকেহ-এর নাম। আর একজন মিডিয়া ভেস্ট পরা ব্যক্তি বলেন, মৃতদেহগুলোর একটি আল-শরীফের।
৬ এপ্রিল আনাসের লেখা এক প্রতিবেদন প্রস্তুত ছিল। মৃত্যুর পর তার বন্ধু সেটি প্রকাশ করে। শেষ বার্তায় তিনি বলেন, “আমাদের শিশু ও নারীদের বিকৃত দেহও তাদের হৃদয় নাড়াতে পারেনি বা দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে আমাদের জনগণের ওপর চালানো হত্যাযজ্ঞ থামাতে পারেনি।” স্ত্রী বায়ানকে রেখে আসায় এবং তার ছেলে সালাহ ও মেয়ে শামের বড় হয়ে ওঠা দেখতে না পারায় এই সংবাদদাতা গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন।
গত মাসে আল জাজিরা মিডিয়া নেটওয়ার্ক, জাতিসংঘ এবং কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) আলাদা বিবৃতিতে সতর্ক করেছিল যে আল-শরীফের জীবন ঝুঁকিতে রয়েছে এবং তার সুরক্ষা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছিল।
সিপিজে’র প্রধান নির্বাহী জোডি গিন্সবার্গ বিবিসিকে বলেন, ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ যেসব সাংবাদিককে হত্যা করেছে, তাদের সন্ত্রাসী হিসেবে প্রমাণ করার জন্য কোনো তথ্য-প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
তিনি বলেন, “এটি আমরা ইসরায়েলের কাছ থেকে বারবার দেখেছি — শুধু বর্তমান যুদ্ধে নয়, গত কয়েক দশক ধরেই — যেখানে সাধারণত ইসরায়েলি বাহিনী একজন সাংবাদিককে হত্যা করে এবং পরে বলে যে তারা সন্ত্রাসী, কিন্তু সেই দাবির পক্ষে খুব সামান্যই প্রমাণ দেয়।”
এটি প্রথম নয় যে আইডিএফ গাজায় আল জাজিরার সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করে হত্যা করেছে। গত বছরের আগস্টে ইসমাইল আল-ঘৌল গাড়িতে বসা অবস্থায় বিমান হামলায় নিহত হন। হামলায় ক্যামেরাপার্সন রামি আল-রিফি এবং পাশ দিয়ে সাইকেলে যাচ্ছিলেন এমন এক কিশোরও নিহত হন।
আল-ঘৌলের ক্ষেত্রে, আইডিএফ দাবি করেছিল যে তিনি ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের ইসরায়েলবিরোধী হামলায় অংশ নিয়েছিলেন, যা আল জাজিরা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিল।
সিপিজে’র তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১৮৬ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন।
এসি/