ঢাকা ০৭:২৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫

গল্প : ধূসর মানুষ

  • আপডেট সময় : ০৬:৫৫:২৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৪ অক্টোবর ২০২৪
  • ৫৮ বার পড়া হয়েছে

রোমেলের চার গোষ্ঠীতে একজন মুক্তিযোদ্ধা নেই, রাজাকারও নেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় রোমেলদের বাড়ির নারীরা পালিয়ে পালিয়ে দিন পাড় করেছে। আল্লাহ-আল্লাহ করে করে গলা শুকিয়েছে তাদের। দেশ বাঁচুক, মাটি বাঁচুক; শরীর বাঁচুকÑ এই ছিল তাদের প্রার্থনা। ওদের বাড়ির পুরুষরা রাজাকারদের দেখলে বলেছে, ‘ভাই দ্যাশটারে যারা বাঁচাইতেছে তাগোরে বাঁচাইতে না পার, মাইর না।’
ওদের কথা কে শোনে!
মুক্তিযোদ্ধারা রোমেলদের বাড়িতে কোনো রাতে উঠে এলে ওদের বাড়ির পুরুষরা ফিসফিস করে বাড়ির নারীদের ডেকে বলেছে ‘ঘরে যা আছে ওগো দাও, ওরা ক্ষুধার্ত’। বাড়ির মুরগির খোপ থেকে মুরগি বের করে সেই রাত্রে জবাই করে রান্না করে মুক্তিযোদ্ধাদের খাইয়েছে।
দাদা, বাবাদের যুগ পেরিয়েছে। স্বাধীনতার বয়সও দিনে দিনে বেড়েছে। রোমেল যখন উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ে বিজয় দিবসে গগনবিদারী দেশাত্ববোধক গান শুনে ওর শরীরে কাঁটা দেয়। বাড়ির উঠানে যে গাঁদাফুল ফোটে সেই ফুলের মালা গেঁথে স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। তিল পড়া সাদা শার্টের ভেতর ওর হাত কাঁপে, পকেটের নিচে ওর হৃদয় কাঁপে। মন গেয়ে ওঠে ‘আমরা তোমাদের ভুলব না।’
স্কুল কমিটিতে রোমেলদের বাড়ির কেউ নেই। স্কুলে সে এক বা দুই রোল নম্বরের ছাত্রও কোনোদিন ছিল না। শিক্ষকরা ভালোবাসার ক্ষেত্রে দুইটি দিক নজরে রাখেন, ভালো ছাত্র কিনা, স্কুল কমিটির সদস্যদের আত্মীয়-স্বজন কী না। এর কোনোটিতেই রোমেলদের বাড়ির কেউ নেই। রোমেল এসএসসির টেস্ট পরীক্ষায় তিন বিষয়ে ফেল করে। ওর হয়ে সুপারিশ করার কেউ নেই। দুই বিষয়ে যারা ফেল করেছে তারা পরীক্ষা দিতে পারবে। ও তিন বিষয়ে ফেল করেছে। রোমেল ওর মাকে বোঝানোর চেষ্টা করে, স্কুল কমিটির সাধারণ সম্পাদকের ভাগনে আরও খারাপ ছাত্র সে কিন্তু সব বিষয়ে পাস করেছে। সাধারণ সম্পাদক ইচ্ছা করলে তার পরীক্ষা দেওয়ারও ব্যবস্থা করে দিতে পারবে।
রোমেলের মায়ের প্রশ্ন ‘ওই গাধাটা পারল তুই পারলিনে ক্যান? তোর জন্যি আমার অ্যাহন স্কুল কমিটির সাধারণ সম্পাদকের বাড়ি যাইতে হতিছে’।
মা ছেলেকে পাস করিয়ে আনার গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়। স্কুল কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দারস্থ হয় সে। সাধারণ সম্পাদক আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ব্যস্ত। তার বউ কচুর লতি কাটছে। রোমেলের মা হাতে হাতে কচুর লতি পরিষ্কার করে দেয় আর ছেলেটার একটা বিহিত করার কথা বলে। এই সময় তার বাম কান বেয়ে এক ফোঁটা পানি পড়ে। শাড়ির আঁচল দিয়ে পানি মুছে কানসহ মাথাটা কাঁধের দিকে বাঁকিয়ে দেয় রোমেলের মা। সাধারণ সম্পাদকের বউ নরম মনের মানুষ, কথা দিয়ে কথা রাখে। রোমেল পরীক্ষা দেয়। এই যাত্রায় সাধারণ সম্পাদকের মান সম্মান রাখার দায়িত্ব পড়ে তার কাঁধে। কোনোমতে পাস করে। এই পাস দিয়ে চাকরি হবে না তা ভালো করে জানে রোমেলের বাবা-মা।
বাজার কমিটিতে রোমেলদের বাড়ির কেউ নেই। রোমেলের বাবার সাহস কত! দশ লাখ টাকা দিয়ে বাজারের দুই শতাংশ জমি কেনে। ভাবে ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে আর চিন্তা নাই। ভাবলেইতো হলো না। জমির রেজিস্ট্রি তখনও বাকি। জমি আরও বেশি দামে বিক্রির ব্যবস্থা হয়ে গেল। রোমেলের বাবাও ছেড়ে দেওয়ার লোক না। বাজার কমিটিকে ডেকে এর ন্যায্য সমাধান চাইবে। আগে সভাপতির সঙ্গে জরুরি বৈঠকে বসে। সভাপতি ভরাট গলায় বলেন, ‘যাও মিয়া আর পাঁচ লাখ বাড়ায় দ্যাও গা, জমি তোমার। দেহি আসগরের কেমন কেমন সাহস আছে জমি তোমারে না দিয়া আরেক বেচা দেয়’।
Ñকি বলেন সভাপতি সাব। তাই বলে পাঁচ লাখ।
না পারলে চার দাওগে।
Ñতাও পারব না।
তাইলে বাড়ি যাও।
Ñআপনি আমার মিয়া ভাই। জমি কিনে বড় ভুল হয়ে গেছে। অ্যাহন টাকা কয়ডা উদ্ধার করে দেন।
আমার লাভ?
Ñআপনারে পঞ্চাশ হাজার দিয়া দিমু।
কম হয়ে যায় না?
Ñআর কতা কইয়েন না মিয়া ভাই। নিজে যা গোছাইছিলাম সব দিয়া এই জমি কিনছি।
আইচ্ছা, আইচ্ছা। যাও দেহি কি করা যায়।
পঞ্চাশ হাজার টাকা খুইয়েও বাজার কমিটির সভাপতির কাছে আজন্মের জন্য ঋণী হয়ে থাকে রোমেলের বাবা। রোমেলও বাপের সঙ্গে থেকে থেকে দেখে আর শেখে। মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা রোমেলের শরীরে বাড়ে, মন ছোট হয়। ওদের থেকে অর্থে-বিত্তে বড় কাউকে দেখলে বলে, ‘এগুলো শুয়োরের ঘরের শুয়োর, মানুষ না’।
রোমেলের বাবা দা নিয়ে রোমেলরে কোপাইতে আসে। ‘তোর বাপ শুয়োর। কারে কী বলতে হয় সেখ। নাইলে জীবনে বাঁচতে পাররি না।’
‘আব্বা আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি তো মনে মনে কয়ছি।’
‘মনে মনেও কয়তে পারবি না। এই মনে মনে কওয়ার কারণে তুই একদিন বিপদে পড়বি’।
কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে রোমেলের মধ্যে পরিবর্তন আসে। সে নিয়মিত ক্লাসে যায়। স্বপ্না নামের একটি মেয়ে ওর সঙ্গে পড়ে। এই স্বপ্নাকে নিয়ে নানা রকম স্বপ্ন দেখতে ভালো লাগে রোমেলের। সে বুঝতেই পারেনি যে স্বপ্না আরেকজনের সঙ্গে প্রেম করে। না জেনে, না বুঝে একদিন পথ আগলে বুকের সবটুকু সাহস সঞ্চয় করে বলে দেয় ‘আমি তোমাকে বউ বানাতে চাই।’ স্বপ্নাকে মুচকি হাসতে দেখে পরবর্তীতে কী হতে চলেছে বুঝতে পারেনি রোমেল। তারপরের দিনই কলেজ শেষে ওর পথ আগলে দাঁড়ায় কলেজের কয়েকজন ছাত্র।
Ñএই ভাইরে দেখ।
ভাই কে?
Ñআরে তুই তো ভাইকেই চিনিস না। আমাদের কলেজের অধ্যক্ষের ভাতিজা। যাইহোক, মানে যা দাঁড়াল তুই যা করেছিস তা না বুঝে করেছিস। স্বপ্নার দিকে আরেকবার তাকালে তোর কলিজা কাইটা ফালামু।
Ñপ্রেম কখনো কিছু বলে ভয় পায় না।
হায় হায় ও বলে কী! এই ওর একটা হাত ভাইঙা দে।
উরাধুরা কিল ঘুসি যা দেওয়ার রোমেলকে দেওয়া হলো। অধক্ষ্যের ভাতিজা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে দেখে আগে আগে হেঁটে চলে গেল। বাড়ি ফিরে মায়ের দিকে তাকিয়ে মিথ্যাটা খুব আবেগ দিয়ে বলে রোমেল। ‘মা ছোট্ট একটা অ্যাকসিডেন্ট হইছিল। হাসপাতালে গেলাম। ব্যান্ডেজ করে দিছে।’
Ñদেখেশুনে চলাফেরা করতে পারিস নে?
দেখেশুনে চলব মা।
মায়ের যে কানের ব্যথা বেড়েছে সেই কথাটা বলার সুযোগটুকুও পায় না। কান দিয়ে টুপ টুপ পানি পড়ছে। ‘আমারেও একটু ডাক্তারের কাছে নে। কানের ব্যথাতো সহ্য করতে পারতেছিনে। তোর বাপ আমার কানে ব্যথার কথাতো কানেই তুলতেছে না। ওই গোয়াড়টার জন্যি আমি মরে যাব। আমার কাছে কয়ডা টাকা আছে। ব্যাল বেচা টাকা।’
রোমেল মাকে ডাক্তারের কাছে নেয়। ডাক্তার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানায় কানের ভেতর টিউমার হয়েছে। টিউমার বড় হয়ে ঘা হয়ে গেছে। ঘা অনেকদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। দ্রুত অপারেশন করাতে হবে। এই অপারেশন উপজেলা শহরে হবে না। রাজধানীতে নিতে হবে।
–রাজধানীতে কোথায়?
পিজিতে?
Ñপিজি মানে?
আরে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল ইউনিভার্সিটি।
রোমেলের বাবার শপথ, জমি কিনতে গিয়ে যে টাকা ঘরে ফেরত আসছে সেই টাকায় জমিই কিনতে হবে। এ ছাড়া রোমেলের বাবার সম্পদ বলতে বাড়ি আর বাড়ির আঙিনায় সবজির ক্ষেত। ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে সেখানে নানা রকম সবজি ফলায়। বাড়িতে আছে নানা রকম ফলের গাছ। এগুলোর মধ্যে চারটি বেল গাছ। বেল বিক্রি করে ভালো টাকা পায় সে। সেই বেলগাছগুলো বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয় রোমেলের বাবা। কিন্তু কথায় কথায় মসজিদ কমিটির সভাপতিকে রোমেলের বাবা একদিন জানিয়েছিল, ‘ব্যালগাছগুলো আমার সংসারে অনেক দিছে, একটা ব্যালগাছ আমি মসজিদে দেব।’
গাছ বিক্রির চেষ্টা চলছে শুনে সভাপতি বাড়িতে হাজির। ‘শোনো আল্লাহর ঘরে দিবা বলে যে নিযত করছ, নিয়তের দুই কইরো না’। ‘না করব না। একটা নিয়া যান।’
কমিটির সব লোকজন এসে আলোচনা সাপেক্ষে একটা গাছ বেছে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে একটি গাছ ত্রিশ হাজার টাকায় বিক্রি! রোমেলের বাবার পরাণে পানি আসে। তাহলে তিনটা গাছ বিক্রি করে সে ভালোই টাকা পাবে। মসজিদের গাছ বলে এত টাকায় বিক্রি হয়েছে। যে কিনেছে সে সওয়াবের আশায় ভালো টাকা দিয়েছে। বাকি তিনটি গাছের দাম ওই একটি গাছের দাম ছাড়াতে কষ্টকর হয়ে গেল। এদিকে রোমেলের মায়ের চিৎকারে বাড়ি টিকে থাকা দায়। কানের ভেতর যখন তখন ব্যথা শুরু হয় তার। দরদাম যা উঠেছে তাতেই বিক্রি করে মাকে নিয়ে রাজধানীতে যায় রোমেল। বাবাও সঙ্গেই আছে। সুখে না হোক, দুঃখ হলেও রাজধানী দেখা হল ওদের। ভোরে রওনা দিয়ে দুপুরের আগেই পৌঁছাল ঢাকায়। একেবারে শেষ সময় আরেকটু দেরি হলে আউটডোরে দশ টাকার টিকেট কেটে ডাক্তার দেখাতে পারত না। ‘বাবারে বাবা কত বড় বড় ডাক্তার বসেন এখানে। টিকেট মাত্র দশ টাকা, দেখছ আব্বা? আরে আমাগের বাজারে ফার্মেসিতে যে পল্লী ডাক্তার বসে সেওতো পঞ্চাশ টাকা ভিজিট নেয়’।
Ñতরুণী এক ডাক্তার খুব যত্ন নিয়ে রোমেলের মায়ের কান দেখল। তারপর বলল, ‘এখানে আবারও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হবে। এই রিপোর্টে হবে না।’
পরীক্ষা-নিরীক্ষা আবারও করাতে দিয়ে জানতে পারল রিপোর্ট নিতে হবে আরও একদিন পরে। রোমেলের মা এই তরুণী ডাক্তারকে দেখে সাহস করে বলেই ফেলল, ‘মারে আমরা কানের ব্যথা সহ্য হতেছে না। তাড়াতাড়ি বাঁচাও।’
ডাক্তারও বলল, ‘মাগো আমরা নতুন ডাক্তার। চাইলেই সব কিছু করতে পারি না। আপনার হাসপাতালে ভর্তি হওয়া জরুরি। যদি সে রকম কোনো ক্ষমতাবান লোক থাকে তাকে দিয়ে ফোন করান। তাড়াতাড়ি সিট পাবেন।’
তন্ন তন্ন করে খুঁজেও নিজেদের মধ্যে ওরকম কাউকে পেলো না রোমেলের বাবা। রোগীদের জন্য একদিন, দুইদিন কিংবা আরও বেশি দিনের জন্য বাসা ভাড়া নেওয়ার সুযোগ আছে। সেরকম একটা বাসা ভাড়া করল আপাতত একদিনের জন্য। পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়ার পরে আরেকজন বড় ডাক্তারকে দেখাতে হল। ডাক্তার তেমন কথা বলেন না। রোমেলের মা এই ডাক্তারকে তেমন কিছু বলার সাহসও পেল না। তবে ওদের ভাগ্য ভালো রাজনৈতিক নেতা-টেতার ফোন বা সুপারিশ ছাড়াই ওরা সিট পেলো, জরুরি ভিত্তিতে অপারেশন করতে হবে জানালেন ডাক্তার। রোমেল ওর বাবার চোখের দিকে তাকায়। বাবাও নিরুপায়। রোমেল বলে, ‘আল্লা যা করে ভালোর জন্য করে। জমি পরেও কিনা যাবি, মা গেলে মা কনে পাব?’
অপারেশন হল। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠল রোমেলের মা। হবে না, হবে না করেও এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে দিল রোমেল। ওর মনে হলো সংসারের জন্য এবার কিছু করা দরকার। একটা কাজের খোঁজে স্থানীয় জুটমিলে গেল। কিন্তু তখন লোক দরকার ছিল না মিলে।
মিল থেকে বের হয়ে এক বেকারির ভ্যানওয়ালার সঙ্গে দেখা হলো ওর। কথায় কথায় সব জানালো। সে কাজ দিতে চায়ল। বেকারির মালিক লোক খুঁজছে। ভ্যানওয়ালার সঙ্গে গিয়ে চাকরির প্রস্তাব পেলো রোমেল। ভ্যানের সঙ্গে যেতে হবে। দোকানে দোকানে বিস্কুট পৌঁছে দিতে হবে। বেতন প্রতি সপ্তাহেরটা সপ্তাহে দেওয়া হবে। টার্গেট ফিলআপ করতে পারলে বাড়তি টাকা পাবে।
রোমেলে বাবা শুনেই রাগ করল, ‘তাই বলে তুই ভ্যান চালাবি?’
না আব্বা, ভ্যানের সাথে সাথে থাকব।’
Ñও আচ্ছা।
কাজে এতো খাটুনি হবে কল্পনাও করতে পারেনি রোমেল। যার আন্ডারে কাজ করে সে বলে, ‘গতর খাটুনির কাজ। বিয়েটা করে ফেল। এই কাজে শরীর পুষে রাখা যায় না।’
Ñএহন না। সংসারের হাল ভালো না।
কিন্তু কয়দিন যেতে না যেতেই রোমেলের মত পরিবর্তন হয়। ‘ওস্তাদ আপনি ঠিক কথা বলছেন। আমার আব্বার সঙ্গে কথা কন।’
Ñ‘আচ্ছা কাম-কাজ আরও মন দিয়ে কর। বেতনটা আরেটটু বাড়াইয়া নাও।’
‘একমুখে মানুষ কত কথা বলে রে।’ মনে মনে বলে রোমেল। হঠাৎ একটি ভিন্ন ধরনের বাক্স রোমেলের হাতে দিয়ে একটি ঠিকানায় যেতে বলল ওস্তাদ। রোমেল জানতেও চাইল না ‘ভেতরে কী?’
যার হাতে পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল তার হাতে সেই বাক্সটি পৌঁছে দেওয়ার পরে এক হাজার টাকা টিপস পেল। ফিরে এসে রোমেল জানতে চাইল ‘ওস্তাদ বাক্সের ভেতরে কী ছিল?’
Ñবিস্কুট ডেলিভারি করি, বাক্সে বিস্কুটই ছিল। এত প্রশ্ন না করে কাজ কর।
কিন্তু সে তো আমাকে এক হাজার টাকা দিল।
Ñবল কী? আমাকে পাঁচশ দাও?
আরে না ওস্তাদ আমি আপনাকে মিথ্যা কথা বলছি।
Ñতাইলে এবার বিয়েটা?
আপনার কথা বলা লাগবে না। আমি আব্বাকে বলছি। মা অসুস্থ তার এখন একজন মানুষের সাহায্য দরকার। পরিবার থেকে মেয়ে দেখছে।
রোমেলের বিয়েটা হয়ে গেল। মেয়েটার সঙ্গে স্বপ্নার কিছুটা মিল আছে। পা টিপে টিপে হাঁটে। মানুষ যা চাই তার কিছু না কিছু পায়। স্বপ্নার সঙ্গে মেয়েটার অমিল হচ্ছে স্বপ্না আস্তে কথা বলে আর এই মেয়েটা জোরে কথা বলে। হা হা করে হাসে। এতো জোরে হাসার জন্য ওর সঙ্গে কথা বলে শান্তি পায় না রোমেল। পাশের ঘরে বাবা মা থাকে। কিছু বললেই হাসে। আবার ভাবে, এও ভালো দিনশেষে ঘরে ফিরে একটি হাসি মুখের দেখা পাওয়া যায়।
ওদিকে ওস্তাদ ছোট ছোট বাক্স ডেলিভারির কাজ বাড়িয়েছে। ওই একবারই টিপস পেয়েছিল রোমেল। তারপর কত বাক্স ডেলিভারি দিয়েছে সে, এক আনা পাইও কেউ টিপস দেয়নি। প্রতিবার ভেবেছে ‘আজ টিপস পাব’। কিন্তু না। একদিন কৌতূহলবসত একটি বাক্স খোলে সে। র্যাপিং পেপারদিয়ে মোড়ানো উপহারের বাক্স। বাক্সটি ভরা বিস্কুট। আরও ভেতরে কয়েক সারি সিগারেট। পুরো বাক্সে কেমন যেন গন্ধ ছড়ানো। বাক্সটি যেমন ছিল তেমন ঠিক করার চেষ্টা করে রোমেল। তাও সব আগের মতো হয় না।
বাক্সটি ডেলিভারি করে দিয়ে ফিরে আসে। ওস্তাদ ওর হাতে একহাজার টাকা দেয়। আর বলে, ‘আজকের পর থেকে প্রতিটি বাক্স ডেলিভারির জন্যি এক হাজার টাকা পাবি। বেতনের সঙ্গে এর কোনো হিসাব নাই।’
Ñনা এই কাজ আমি করব না।
তাহলে বাক্স খুলছিস ক্যান?
Ñআমার জানা দরকার যে আমি কী ডেলিভারি করতেছি।
শালার পুত কত মানুষ প্রতিদিন নিজে না খাইয়া-দাইয়া ব্যাগভর্তি খাবার নিয়ে ছুটতেছে তারা কী বাক্স খুলে দেখে। দেখলে চাকরি থাকে?
Ñকিন্তু ওরা জানে যে ব্যাগভর্তি খাবার। আমি কিছুই জানি না। আমারে দিয়া তুমি অন্যায় কাজ করাইছ।
চুপ চাপ করে যা।
Ñনা করলে কী করবা?
তুই ভাবতে থাক, কী কী করাতে পারি।
কথা শুনে মেজাজ হারায় রোমেল। সজোরে ওস্তাদের মুখে চড় কষে। ওস্তাদ ঠান্ডা মেজাজে বসা। ঠোঁটের কোণে হাসি। তারপর বলে, আমার ভাগ্য ভালো তুই আমারে মারছিস কিন্তু কেউ দেখে নাই। এই জন্য এখন তরে কিছুই বলব না। যা সংসার কর। ঘর সাজা। বাবা-মায়েরে দেখ। মাইরটা তোর পাওনা রইল। আমি যখন তরে মারব মানুষ, সমাজ, দ্যাশ দেখব। যা মারার আগে তোকে একটা সুযোগ দেই। সামনে থেকে সরে যা। পালা… ।
রোমেল ভয়ে ভয়ে বাড়ি ফিরে। বেলগাছগুলো কেটে নেওয়ার পরে সেখানে আরও চারটি বেল গাছ লাগানো হয়। সেগুলো এতো দ্রুত বড় হতে থাকে যে চারিদিকে এই নিয়ে গল্প ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ গাছগুলো দেখতে আসে। রোমেলের কাছে মনে হয় সবকিছু খুব দ্রুত ঘটে যাচ্ছে। ঘুমাতে গেলেই মনে হয় এই রাতই তার জন্য শেষ রাত। হয়ত সে সকালেই মার খাবে, রক্তাক্ত হবে। মানুষের সামনে মার খেয়ে অপমানে মরে যাবে। তার আগেই মানুষ বলতে শুরু করল, ‘কী এমন পাপ করেছে রোমেলের বাপ মা যে, গাছগুলো এমন রাক্ষুসে গাছ হয়ে গ্যালো।’
রোমেলের বাবা মনে মনে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়। গাছগুলোকে ধীরে বাড়তে বলে। গাছগুলোর গোড়ায় বসে আল্লাহকে ডাকে, ‘আল্লা রহম কর। গাছগুলোকে ধীরে বড় কর।’
প্রতিদিন মানুষ আসে। এই গাছের পাতা ছিঁড়ে নিয়ে যায়। গাছের ছবি তুলে নেয়। কেউ কেউ গাছের ভিডিও করে। ওই অবস্থা থেকে বাঁচতে এক রাতে একটা গাছ কেটে ফেলে রোমেলের বাবা। ছেলের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে গাছটা নিয়ে দূরে ফেলে দিয়ে আসে। কিন্তু সকালে সেই কাটা গাছ নিজেদের উঠানে পায়।
গাছ কে কাটল, তা কেউ জানে না। এই নিয়ে ভিন্ন গল্প তৈরি হয়। তবু দমে না রোমেলের বাবা। ছেলেও বাবার হাত শক্ত করে ধরে। আরেক রাতে দ্বিতীয় গাছটি কেটে ফেলে। পরের রাতে তৃতীয় গাছটি কেটে ফেলে। চোখের সামনে গাছগুলোর শেকড়ের মাটি শুকিয়ে ঝরে পড়ে।
চতুর্থ গাছটি কাটতে গেলে, রোমেলের মা হু হু করে কেঁদে ওঠে। রোমেলের বউ ঘরে কপাট দেয়। গাছটির গোড়াসহ খুড়ে তুলে অন্য জায়গায় লাগায় রোমেল আর ওর বাবা। এরপরে গাছটি বাঁচে, ধীরে বাড়তে থাকে। ওরাও শান্তি পায়। রোমেলের বাবা সকাল হলেই বেল গাছটির কাছে গিয়ে দেখে, খুব বেশি বড় হয়ে গেছে নাকি গাছটি। রোমেল স্বস্তি পায় না, প্রায়ই তার শুধু কানে বাজে ‘পালা…।’ তখনই তার রং পাল্টে যায়।

লেখক: স্বরলিপি

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

গল্প : ধূসর মানুষ

আপডেট সময় : ০৬:৫৫:২৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৪ অক্টোবর ২০২৪

রোমেলের চার গোষ্ঠীতে একজন মুক্তিযোদ্ধা নেই, রাজাকারও নেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় রোমেলদের বাড়ির নারীরা পালিয়ে পালিয়ে দিন পাড় করেছে। আল্লাহ-আল্লাহ করে করে গলা শুকিয়েছে তাদের। দেশ বাঁচুক, মাটি বাঁচুক; শরীর বাঁচুকÑ এই ছিল তাদের প্রার্থনা। ওদের বাড়ির পুরুষরা রাজাকারদের দেখলে বলেছে, ‘ভাই দ্যাশটারে যারা বাঁচাইতেছে তাগোরে বাঁচাইতে না পার, মাইর না।’
ওদের কথা কে শোনে!
মুক্তিযোদ্ধারা রোমেলদের বাড়িতে কোনো রাতে উঠে এলে ওদের বাড়ির পুরুষরা ফিসফিস করে বাড়ির নারীদের ডেকে বলেছে ‘ঘরে যা আছে ওগো দাও, ওরা ক্ষুধার্ত’। বাড়ির মুরগির খোপ থেকে মুরগি বের করে সেই রাত্রে জবাই করে রান্না করে মুক্তিযোদ্ধাদের খাইয়েছে।
দাদা, বাবাদের যুগ পেরিয়েছে। স্বাধীনতার বয়সও দিনে দিনে বেড়েছে। রোমেল যখন উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ে বিজয় দিবসে গগনবিদারী দেশাত্ববোধক গান শুনে ওর শরীরে কাঁটা দেয়। বাড়ির উঠানে যে গাঁদাফুল ফোটে সেই ফুলের মালা গেঁথে স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। তিল পড়া সাদা শার্টের ভেতর ওর হাত কাঁপে, পকেটের নিচে ওর হৃদয় কাঁপে। মন গেয়ে ওঠে ‘আমরা তোমাদের ভুলব না।’
স্কুল কমিটিতে রোমেলদের বাড়ির কেউ নেই। স্কুলে সে এক বা দুই রোল নম্বরের ছাত্রও কোনোদিন ছিল না। শিক্ষকরা ভালোবাসার ক্ষেত্রে দুইটি দিক নজরে রাখেন, ভালো ছাত্র কিনা, স্কুল কমিটির সদস্যদের আত্মীয়-স্বজন কী না। এর কোনোটিতেই রোমেলদের বাড়ির কেউ নেই। রোমেল এসএসসির টেস্ট পরীক্ষায় তিন বিষয়ে ফেল করে। ওর হয়ে সুপারিশ করার কেউ নেই। দুই বিষয়ে যারা ফেল করেছে তারা পরীক্ষা দিতে পারবে। ও তিন বিষয়ে ফেল করেছে। রোমেল ওর মাকে বোঝানোর চেষ্টা করে, স্কুল কমিটির সাধারণ সম্পাদকের ভাগনে আরও খারাপ ছাত্র সে কিন্তু সব বিষয়ে পাস করেছে। সাধারণ সম্পাদক ইচ্ছা করলে তার পরীক্ষা দেওয়ারও ব্যবস্থা করে দিতে পারবে।
রোমেলের মায়ের প্রশ্ন ‘ওই গাধাটা পারল তুই পারলিনে ক্যান? তোর জন্যি আমার অ্যাহন স্কুল কমিটির সাধারণ সম্পাদকের বাড়ি যাইতে হতিছে’।
মা ছেলেকে পাস করিয়ে আনার গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়। স্কুল কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দারস্থ হয় সে। সাধারণ সম্পাদক আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ব্যস্ত। তার বউ কচুর লতি কাটছে। রোমেলের মা হাতে হাতে কচুর লতি পরিষ্কার করে দেয় আর ছেলেটার একটা বিহিত করার কথা বলে। এই সময় তার বাম কান বেয়ে এক ফোঁটা পানি পড়ে। শাড়ির আঁচল দিয়ে পানি মুছে কানসহ মাথাটা কাঁধের দিকে বাঁকিয়ে দেয় রোমেলের মা। সাধারণ সম্পাদকের বউ নরম মনের মানুষ, কথা দিয়ে কথা রাখে। রোমেল পরীক্ষা দেয়। এই যাত্রায় সাধারণ সম্পাদকের মান সম্মান রাখার দায়িত্ব পড়ে তার কাঁধে। কোনোমতে পাস করে। এই পাস দিয়ে চাকরি হবে না তা ভালো করে জানে রোমেলের বাবা-মা।
বাজার কমিটিতে রোমেলদের বাড়ির কেউ নেই। রোমেলের বাবার সাহস কত! দশ লাখ টাকা দিয়ে বাজারের দুই শতাংশ জমি কেনে। ভাবে ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে আর চিন্তা নাই। ভাবলেইতো হলো না। জমির রেজিস্ট্রি তখনও বাকি। জমি আরও বেশি দামে বিক্রির ব্যবস্থা হয়ে গেল। রোমেলের বাবাও ছেড়ে দেওয়ার লোক না। বাজার কমিটিকে ডেকে এর ন্যায্য সমাধান চাইবে। আগে সভাপতির সঙ্গে জরুরি বৈঠকে বসে। সভাপতি ভরাট গলায় বলেন, ‘যাও মিয়া আর পাঁচ লাখ বাড়ায় দ্যাও গা, জমি তোমার। দেহি আসগরের কেমন কেমন সাহস আছে জমি তোমারে না দিয়া আরেক বেচা দেয়’।
Ñকি বলেন সভাপতি সাব। তাই বলে পাঁচ লাখ।
না পারলে চার দাওগে।
Ñতাও পারব না।
তাইলে বাড়ি যাও।
Ñআপনি আমার মিয়া ভাই। জমি কিনে বড় ভুল হয়ে গেছে। অ্যাহন টাকা কয়ডা উদ্ধার করে দেন।
আমার লাভ?
Ñআপনারে পঞ্চাশ হাজার দিয়া দিমু।
কম হয়ে যায় না?
Ñআর কতা কইয়েন না মিয়া ভাই। নিজে যা গোছাইছিলাম সব দিয়া এই জমি কিনছি।
আইচ্ছা, আইচ্ছা। যাও দেহি কি করা যায়।
পঞ্চাশ হাজার টাকা খুইয়েও বাজার কমিটির সভাপতির কাছে আজন্মের জন্য ঋণী হয়ে থাকে রোমেলের বাবা। রোমেলও বাপের সঙ্গে থেকে থেকে দেখে আর শেখে। মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা রোমেলের শরীরে বাড়ে, মন ছোট হয়। ওদের থেকে অর্থে-বিত্তে বড় কাউকে দেখলে বলে, ‘এগুলো শুয়োরের ঘরের শুয়োর, মানুষ না’।
রোমেলের বাবা দা নিয়ে রোমেলরে কোপাইতে আসে। ‘তোর বাপ শুয়োর। কারে কী বলতে হয় সেখ। নাইলে জীবনে বাঁচতে পাররি না।’
‘আব্বা আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি তো মনে মনে কয়ছি।’
‘মনে মনেও কয়তে পারবি না। এই মনে মনে কওয়ার কারণে তুই একদিন বিপদে পড়বি’।
কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে রোমেলের মধ্যে পরিবর্তন আসে। সে নিয়মিত ক্লাসে যায়। স্বপ্না নামের একটি মেয়ে ওর সঙ্গে পড়ে। এই স্বপ্নাকে নিয়ে নানা রকম স্বপ্ন দেখতে ভালো লাগে রোমেলের। সে বুঝতেই পারেনি যে স্বপ্না আরেকজনের সঙ্গে প্রেম করে। না জেনে, না বুঝে একদিন পথ আগলে বুকের সবটুকু সাহস সঞ্চয় করে বলে দেয় ‘আমি তোমাকে বউ বানাতে চাই।’ স্বপ্নাকে মুচকি হাসতে দেখে পরবর্তীতে কী হতে চলেছে বুঝতে পারেনি রোমেল। তারপরের দিনই কলেজ শেষে ওর পথ আগলে দাঁড়ায় কলেজের কয়েকজন ছাত্র।
Ñএই ভাইরে দেখ।
ভাই কে?
Ñআরে তুই তো ভাইকেই চিনিস না। আমাদের কলেজের অধ্যক্ষের ভাতিজা। যাইহোক, মানে যা দাঁড়াল তুই যা করেছিস তা না বুঝে করেছিস। স্বপ্নার দিকে আরেকবার তাকালে তোর কলিজা কাইটা ফালামু।
Ñপ্রেম কখনো কিছু বলে ভয় পায় না।
হায় হায় ও বলে কী! এই ওর একটা হাত ভাইঙা দে।
উরাধুরা কিল ঘুসি যা দেওয়ার রোমেলকে দেওয়া হলো। অধক্ষ্যের ভাতিজা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে দেখে আগে আগে হেঁটে চলে গেল। বাড়ি ফিরে মায়ের দিকে তাকিয়ে মিথ্যাটা খুব আবেগ দিয়ে বলে রোমেল। ‘মা ছোট্ট একটা অ্যাকসিডেন্ট হইছিল। হাসপাতালে গেলাম। ব্যান্ডেজ করে দিছে।’
Ñদেখেশুনে চলাফেরা করতে পারিস নে?
দেখেশুনে চলব মা।
মায়ের যে কানের ব্যথা বেড়েছে সেই কথাটা বলার সুযোগটুকুও পায় না। কান দিয়ে টুপ টুপ পানি পড়ছে। ‘আমারেও একটু ডাক্তারের কাছে নে। কানের ব্যথাতো সহ্য করতে পারতেছিনে। তোর বাপ আমার কানে ব্যথার কথাতো কানেই তুলতেছে না। ওই গোয়াড়টার জন্যি আমি মরে যাব। আমার কাছে কয়ডা টাকা আছে। ব্যাল বেচা টাকা।’
রোমেল মাকে ডাক্তারের কাছে নেয়। ডাক্তার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানায় কানের ভেতর টিউমার হয়েছে। টিউমার বড় হয়ে ঘা হয়ে গেছে। ঘা অনেকদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। দ্রুত অপারেশন করাতে হবে। এই অপারেশন উপজেলা শহরে হবে না। রাজধানীতে নিতে হবে।
–রাজধানীতে কোথায়?
পিজিতে?
Ñপিজি মানে?
আরে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল ইউনিভার্সিটি।
রোমেলের বাবার শপথ, জমি কিনতে গিয়ে যে টাকা ঘরে ফেরত আসছে সেই টাকায় জমিই কিনতে হবে। এ ছাড়া রোমেলের বাবার সম্পদ বলতে বাড়ি আর বাড়ির আঙিনায় সবজির ক্ষেত। ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে সেখানে নানা রকম সবজি ফলায়। বাড়িতে আছে নানা রকম ফলের গাছ। এগুলোর মধ্যে চারটি বেল গাছ। বেল বিক্রি করে ভালো টাকা পায় সে। সেই বেলগাছগুলো বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয় রোমেলের বাবা। কিন্তু কথায় কথায় মসজিদ কমিটির সভাপতিকে রোমেলের বাবা একদিন জানিয়েছিল, ‘ব্যালগাছগুলো আমার সংসারে অনেক দিছে, একটা ব্যালগাছ আমি মসজিদে দেব।’
গাছ বিক্রির চেষ্টা চলছে শুনে সভাপতি বাড়িতে হাজির। ‘শোনো আল্লাহর ঘরে দিবা বলে যে নিযত করছ, নিয়তের দুই কইরো না’। ‘না করব না। একটা নিয়া যান।’
কমিটির সব লোকজন এসে আলোচনা সাপেক্ষে একটা গাছ বেছে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে একটি গাছ ত্রিশ হাজার টাকায় বিক্রি! রোমেলের বাবার পরাণে পানি আসে। তাহলে তিনটা গাছ বিক্রি করে সে ভালোই টাকা পাবে। মসজিদের গাছ বলে এত টাকায় বিক্রি হয়েছে। যে কিনেছে সে সওয়াবের আশায় ভালো টাকা দিয়েছে। বাকি তিনটি গাছের দাম ওই একটি গাছের দাম ছাড়াতে কষ্টকর হয়ে গেল। এদিকে রোমেলের মায়ের চিৎকারে বাড়ি টিকে থাকা দায়। কানের ভেতর যখন তখন ব্যথা শুরু হয় তার। দরদাম যা উঠেছে তাতেই বিক্রি করে মাকে নিয়ে রাজধানীতে যায় রোমেল। বাবাও সঙ্গেই আছে। সুখে না হোক, দুঃখ হলেও রাজধানী দেখা হল ওদের। ভোরে রওনা দিয়ে দুপুরের আগেই পৌঁছাল ঢাকায়। একেবারে শেষ সময় আরেকটু দেরি হলে আউটডোরে দশ টাকার টিকেট কেটে ডাক্তার দেখাতে পারত না। ‘বাবারে বাবা কত বড় বড় ডাক্তার বসেন এখানে। টিকেট মাত্র দশ টাকা, দেখছ আব্বা? আরে আমাগের বাজারে ফার্মেসিতে যে পল্লী ডাক্তার বসে সেওতো পঞ্চাশ টাকা ভিজিট নেয়’।
Ñতরুণী এক ডাক্তার খুব যত্ন নিয়ে রোমেলের মায়ের কান দেখল। তারপর বলল, ‘এখানে আবারও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হবে। এই রিপোর্টে হবে না।’
পরীক্ষা-নিরীক্ষা আবারও করাতে দিয়ে জানতে পারল রিপোর্ট নিতে হবে আরও একদিন পরে। রোমেলের মা এই তরুণী ডাক্তারকে দেখে সাহস করে বলেই ফেলল, ‘মারে আমরা কানের ব্যথা সহ্য হতেছে না। তাড়াতাড়ি বাঁচাও।’
ডাক্তারও বলল, ‘মাগো আমরা নতুন ডাক্তার। চাইলেই সব কিছু করতে পারি না। আপনার হাসপাতালে ভর্তি হওয়া জরুরি। যদি সে রকম কোনো ক্ষমতাবান লোক থাকে তাকে দিয়ে ফোন করান। তাড়াতাড়ি সিট পাবেন।’
তন্ন তন্ন করে খুঁজেও নিজেদের মধ্যে ওরকম কাউকে পেলো না রোমেলের বাবা। রোগীদের জন্য একদিন, দুইদিন কিংবা আরও বেশি দিনের জন্য বাসা ভাড়া নেওয়ার সুযোগ আছে। সেরকম একটা বাসা ভাড়া করল আপাতত একদিনের জন্য। পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়ার পরে আরেকজন বড় ডাক্তারকে দেখাতে হল। ডাক্তার তেমন কথা বলেন না। রোমেলের মা এই ডাক্তারকে তেমন কিছু বলার সাহসও পেল না। তবে ওদের ভাগ্য ভালো রাজনৈতিক নেতা-টেতার ফোন বা সুপারিশ ছাড়াই ওরা সিট পেলো, জরুরি ভিত্তিতে অপারেশন করতে হবে জানালেন ডাক্তার। রোমেল ওর বাবার চোখের দিকে তাকায়। বাবাও নিরুপায়। রোমেল বলে, ‘আল্লা যা করে ভালোর জন্য করে। জমি পরেও কিনা যাবি, মা গেলে মা কনে পাব?’
অপারেশন হল। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠল রোমেলের মা। হবে না, হবে না করেও এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে দিল রোমেল। ওর মনে হলো সংসারের জন্য এবার কিছু করা দরকার। একটা কাজের খোঁজে স্থানীয় জুটমিলে গেল। কিন্তু তখন লোক দরকার ছিল না মিলে।
মিল থেকে বের হয়ে এক বেকারির ভ্যানওয়ালার সঙ্গে দেখা হলো ওর। কথায় কথায় সব জানালো। সে কাজ দিতে চায়ল। বেকারির মালিক লোক খুঁজছে। ভ্যানওয়ালার সঙ্গে গিয়ে চাকরির প্রস্তাব পেলো রোমেল। ভ্যানের সঙ্গে যেতে হবে। দোকানে দোকানে বিস্কুট পৌঁছে দিতে হবে। বেতন প্রতি সপ্তাহেরটা সপ্তাহে দেওয়া হবে। টার্গেট ফিলআপ করতে পারলে বাড়তি টাকা পাবে।
রোমেলে বাবা শুনেই রাগ করল, ‘তাই বলে তুই ভ্যান চালাবি?’
না আব্বা, ভ্যানের সাথে সাথে থাকব।’
Ñও আচ্ছা।
কাজে এতো খাটুনি হবে কল্পনাও করতে পারেনি রোমেল। যার আন্ডারে কাজ করে সে বলে, ‘গতর খাটুনির কাজ। বিয়েটা করে ফেল। এই কাজে শরীর পুষে রাখা যায় না।’
Ñএহন না। সংসারের হাল ভালো না।
কিন্তু কয়দিন যেতে না যেতেই রোমেলের মত পরিবর্তন হয়। ‘ওস্তাদ আপনি ঠিক কথা বলছেন। আমার আব্বার সঙ্গে কথা কন।’
Ñ‘আচ্ছা কাম-কাজ আরও মন দিয়ে কর। বেতনটা আরেটটু বাড়াইয়া নাও।’
‘একমুখে মানুষ কত কথা বলে রে।’ মনে মনে বলে রোমেল। হঠাৎ একটি ভিন্ন ধরনের বাক্স রোমেলের হাতে দিয়ে একটি ঠিকানায় যেতে বলল ওস্তাদ। রোমেল জানতেও চাইল না ‘ভেতরে কী?’
যার হাতে পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল তার হাতে সেই বাক্সটি পৌঁছে দেওয়ার পরে এক হাজার টাকা টিপস পেল। ফিরে এসে রোমেল জানতে চাইল ‘ওস্তাদ বাক্সের ভেতরে কী ছিল?’
Ñবিস্কুট ডেলিভারি করি, বাক্সে বিস্কুটই ছিল। এত প্রশ্ন না করে কাজ কর।
কিন্তু সে তো আমাকে এক হাজার টাকা দিল।
Ñবল কী? আমাকে পাঁচশ দাও?
আরে না ওস্তাদ আমি আপনাকে মিথ্যা কথা বলছি।
Ñতাইলে এবার বিয়েটা?
আপনার কথা বলা লাগবে না। আমি আব্বাকে বলছি। মা অসুস্থ তার এখন একজন মানুষের সাহায্য দরকার। পরিবার থেকে মেয়ে দেখছে।
রোমেলের বিয়েটা হয়ে গেল। মেয়েটার সঙ্গে স্বপ্নার কিছুটা মিল আছে। পা টিপে টিপে হাঁটে। মানুষ যা চাই তার কিছু না কিছু পায়। স্বপ্নার সঙ্গে মেয়েটার অমিল হচ্ছে স্বপ্না আস্তে কথা বলে আর এই মেয়েটা জোরে কথা বলে। হা হা করে হাসে। এতো জোরে হাসার জন্য ওর সঙ্গে কথা বলে শান্তি পায় না রোমেল। পাশের ঘরে বাবা মা থাকে। কিছু বললেই হাসে। আবার ভাবে, এও ভালো দিনশেষে ঘরে ফিরে একটি হাসি মুখের দেখা পাওয়া যায়।
ওদিকে ওস্তাদ ছোট ছোট বাক্স ডেলিভারির কাজ বাড়িয়েছে। ওই একবারই টিপস পেয়েছিল রোমেল। তারপর কত বাক্স ডেলিভারি দিয়েছে সে, এক আনা পাইও কেউ টিপস দেয়নি। প্রতিবার ভেবেছে ‘আজ টিপস পাব’। কিন্তু না। একদিন কৌতূহলবসত একটি বাক্স খোলে সে। র্যাপিং পেপারদিয়ে মোড়ানো উপহারের বাক্স। বাক্সটি ভরা বিস্কুট। আরও ভেতরে কয়েক সারি সিগারেট। পুরো বাক্সে কেমন যেন গন্ধ ছড়ানো। বাক্সটি যেমন ছিল তেমন ঠিক করার চেষ্টা করে রোমেল। তাও সব আগের মতো হয় না।
বাক্সটি ডেলিভারি করে দিয়ে ফিরে আসে। ওস্তাদ ওর হাতে একহাজার টাকা দেয়। আর বলে, ‘আজকের পর থেকে প্রতিটি বাক্স ডেলিভারির জন্যি এক হাজার টাকা পাবি। বেতনের সঙ্গে এর কোনো হিসাব নাই।’
Ñনা এই কাজ আমি করব না।
তাহলে বাক্স খুলছিস ক্যান?
Ñআমার জানা দরকার যে আমি কী ডেলিভারি করতেছি।
শালার পুত কত মানুষ প্রতিদিন নিজে না খাইয়া-দাইয়া ব্যাগভর্তি খাবার নিয়ে ছুটতেছে তারা কী বাক্স খুলে দেখে। দেখলে চাকরি থাকে?
Ñকিন্তু ওরা জানে যে ব্যাগভর্তি খাবার। আমি কিছুই জানি না। আমারে দিয়া তুমি অন্যায় কাজ করাইছ।
চুপ চাপ করে যা।
Ñনা করলে কী করবা?
তুই ভাবতে থাক, কী কী করাতে পারি।
কথা শুনে মেজাজ হারায় রোমেল। সজোরে ওস্তাদের মুখে চড় কষে। ওস্তাদ ঠান্ডা মেজাজে বসা। ঠোঁটের কোণে হাসি। তারপর বলে, আমার ভাগ্য ভালো তুই আমারে মারছিস কিন্তু কেউ দেখে নাই। এই জন্য এখন তরে কিছুই বলব না। যা সংসার কর। ঘর সাজা। বাবা-মায়েরে দেখ। মাইরটা তোর পাওনা রইল। আমি যখন তরে মারব মানুষ, সমাজ, দ্যাশ দেখব। যা মারার আগে তোকে একটা সুযোগ দেই। সামনে থেকে সরে যা। পালা… ।
রোমেল ভয়ে ভয়ে বাড়ি ফিরে। বেলগাছগুলো কেটে নেওয়ার পরে সেখানে আরও চারটি বেল গাছ লাগানো হয়। সেগুলো এতো দ্রুত বড় হতে থাকে যে চারিদিকে এই নিয়ে গল্প ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ গাছগুলো দেখতে আসে। রোমেলের কাছে মনে হয় সবকিছু খুব দ্রুত ঘটে যাচ্ছে। ঘুমাতে গেলেই মনে হয় এই রাতই তার জন্য শেষ রাত। হয়ত সে সকালেই মার খাবে, রক্তাক্ত হবে। মানুষের সামনে মার খেয়ে অপমানে মরে যাবে। তার আগেই মানুষ বলতে শুরু করল, ‘কী এমন পাপ করেছে রোমেলের বাপ মা যে, গাছগুলো এমন রাক্ষুসে গাছ হয়ে গ্যালো।’
রোমেলের বাবা মনে মনে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়। গাছগুলোকে ধীরে বাড়তে বলে। গাছগুলোর গোড়ায় বসে আল্লাহকে ডাকে, ‘আল্লা রহম কর। গাছগুলোকে ধীরে বড় কর।’
প্রতিদিন মানুষ আসে। এই গাছের পাতা ছিঁড়ে নিয়ে যায়। গাছের ছবি তুলে নেয়। কেউ কেউ গাছের ভিডিও করে। ওই অবস্থা থেকে বাঁচতে এক রাতে একটা গাছ কেটে ফেলে রোমেলের বাবা। ছেলের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে গাছটা নিয়ে দূরে ফেলে দিয়ে আসে। কিন্তু সকালে সেই কাটা গাছ নিজেদের উঠানে পায়।
গাছ কে কাটল, তা কেউ জানে না। এই নিয়ে ভিন্ন গল্প তৈরি হয়। তবু দমে না রোমেলের বাবা। ছেলেও বাবার হাত শক্ত করে ধরে। আরেক রাতে দ্বিতীয় গাছটি কেটে ফেলে। পরের রাতে তৃতীয় গাছটি কেটে ফেলে। চোখের সামনে গাছগুলোর শেকড়ের মাটি শুকিয়ে ঝরে পড়ে।
চতুর্থ গাছটি কাটতে গেলে, রোমেলের মা হু হু করে কেঁদে ওঠে। রোমেলের বউ ঘরে কপাট দেয়। গাছটির গোড়াসহ খুড়ে তুলে অন্য জায়গায় লাগায় রোমেল আর ওর বাবা। এরপরে গাছটি বাঁচে, ধীরে বাড়তে থাকে। ওরাও শান্তি পায়। রোমেলের বাবা সকাল হলেই বেল গাছটির কাছে গিয়ে দেখে, খুব বেশি বড় হয়ে গেছে নাকি গাছটি। রোমেল স্বস্তি পায় না, প্রায়ই তার শুধু কানে বাজে ‘পালা…।’ তখনই তার রং পাল্টে যায়।

লেখক: স্বরলিপি