রেজানুর রহমান : ভয়ংকর একটা গল্প আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করি। যদিও আমার কাছে যেটা ভয়ংকর অন্যদের কাছে সেটা ভয়ংকর নাও হতে পারে। তবু ভয়ংকর গল্পটা বলি। তার আগে ফিরে যেতে চাই ৮০ অথবা ৯০-এর দশকে। শ্রমজীবী, খেটে খাওয়া মানুষ একটুখানি বিনোদনের আশায় সন্ধ্যার পর অথবা রাতে ছুটতো সিনেমা হলের দিকে। সিনেমা ছিল মধ্যবিত্ত, নি¤œ মধ্যবিত্ত এমনকি ছিন্নমূল মানুষেরও প্রধান বিনোদন। দলবেঁধে সিনেমা দেখতে যেতো অনেকে। এখন আর ওই মানুষগুলো অর্থাৎ ওই স্ট্যাটাসের মানুষেরা সন্ধ্যার পর সিনেমা হলে যায় না। তাহলে তারা যায় কোথায়? হ্যাঁ, এটাই ভয়ংকর তথ্য। মানুষগুলো যায় কোথায়? মানুষগুলো কোথাও যায় না। নিজের এলাকায় রাস্তার মোড়ে, ঘুপচি গলিতে, ভাঙা বাড়ির ছাদে, নির্মাণাধীন ভবনের অস্বাস্থ্যকর কক্ষে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা জমায়। তারা কী করে আড্ডায়? অনেকে দলবেঁধে নেশা করে। মোবাইল ফোনে অশ্লীল সিনেমা দেখে আর মোবাইলে জুয়া খেলে। প্রতিদিন ঢাকা শহরসহ দেশের বিভিন্ন উপজেলাভিত্তিক শহরেও প্রকাশ্যে ক্ষতিকর এই আড্ডা জমে প্রতিদিন। মধ্যবিত্ত, নি¤œ আয়ের মানুষের পাশাপাশি এসব আড্ডায় শিক্ষিত বেকার তরুণদেরও দেখা যায় আজকাল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এসব বিতর্কিত আড্ডার খবর জানে। কিন্তু উপরি আয়ের আশায় কাউকে কিছু বলে না। শহরের মতো গ্রামাঞ্চলেও এসব বিতর্কিত অশোভন আড্ডা জমজমাট। স্কুল, কলেজের উন্মুক্ত মাঠ, বাস টার্মিনালের অপেক্ষাকৃত অন্ধকার স্থান এসব আড্ডার জন্য উপযুক্ত। মফস্বল শহরের গলিতে গলিতে অন্ধকার জগতের আড্ডা চলে অনেকটা প্রকাশ্যে।
ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ প্রায় প্রতিটি উদ্যান অথবা মাঠে নেশাবাজ ও মোবাইল বাজদের দৌরাত্ম্যই বেশি। নেশাবাজ শব্দটি পরিচিত। কিন্তু মোবাইলবাজ শব্দের প্রকৃত অর্থ হয়তো অনেকে জানে না। মোবাইলবাজ মানে কী সারাক্ষণ মোবাইলে বুদ হয়ে থাকে? ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইলে কথা বলে? না, সে এই গল্পের মোবাইলবাজ নয়, এই গল্পের মোবাইলবাজ হলো অশ্লীল অশোভন কনটেন্টের আবিষ্কারক। তার কাজই হলো ইন্টারনেট ঘেঁটে ঘেঁটে মহিলাদের গোপন ছবি সংগ্রহ করা। পরকীয়ার গল্প জাতীয় ভিডিও খুঁজে বের করা এবং তা বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে দেখা। এটাই যেন তাদের বিনোদন। ঢাকার প্রায় প্রতিটি বাস টার্মিনালে প্রকাশ্যে জুয়ার আড্ডা বসে প্রতিদিন। কয়েকদিন আগে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে গিয়েছিলাম একটা কাজে। সেখানেই দেখলাম গোপন আড্ডার ছবি। একদল মানুষ গোল হয়ে কিছু একটা দেখছেন। কৌতূহল মেটাতে এগিয়ে গেলাম। একটি মোবাইল ফোনে ভিডিও ফুটেজ দেখছে সবাই। নর-নারীর অশ্লীল দৃশ্য দেখছে বিপুল উৎসাহে। একজন অশ্লীল মন্তব্য করলো– ‘মাইয়ার বডি দেখছোস, য্যান আগুনের গোলা… এই মাইয়ারে পাইলে…’।
রুচিতে বাধলো, আমি সরে এলাম। পাশেই দেখি মোবাইলে জুয়ার আসর বসিয়েছে আরেক দল মানুষ। পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দু’জন সদস্য। তারা দেখেও না দেখার ভান করলেন।
এটা তো গেলো রাজধানীর চিত্র। রাজধানীর বাইরের চিত্র কেমন? কয়েক দিন আগে সৈয়দপুরে গিয়েছিলাম। রেলের শহর সৈয়দপুর। বাঙালি-বিহারি মিলে মিশ্র এক সাংস্কৃতিক পরিবেশ এই শহরে বিরাজমান। একটা সময়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে ব্যস্ত থাকতো শহরের তরুণ সমাজ। এখন সাংস্কৃতিক কর্মকা- নেই বললেই চলে। একদল তরুণের ঝোঁক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর। ইউটিউব চ্যানেলের মালিক হয়েছেন কেউ কেউ। আবার অনেকের কোনও কাজ নাই। শহরের বিভিন্ন এলাকায় তারা গোপন আড্ডা দেয়। রেল স্টেশনের পাশে একটি ভাঙাঘরে তাসের আড্ডা দিচ্ছিল একদল তরুণ। তাস খেলার নামে জুয়া খেলা। শহরের বাঁশবাড়ি এলাকায় দেখলাম বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে অন্ধকারেও মোবাইল ফোনে ভিডিও দেখছে দলে দলে বিভক্ত মানুষেরা। নারীর নগ্ন শরীর নিয়ে মেতে উঠেছে তারা।
শহরের রেল লাইনের ধারে প্রকাশ্যে নেশাবাজদের আড্ডা চলে। একদল তরুণকে দেখলাম গোল হয়ে মোবাইলে জুয়া খেলছে। পাশ দিয়ে পুলিশ বাহিনীর দু’জন সদস্য হেঁটে গেলেন। কিছুই বললেন না।
একটা কাজে নীলফামারীর ডালিয়ায় তিস্তা ব্যারাজ দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানেও দেখলাম নেশাবাজদের ভিড়। বেড়াতে এসে অনেকেই জুয়া খেলায় মত্ত হয়ে উঠেছে। ডালিয়া থেকে রংপুর যাওয়ার পথেও বিভিন্ন স্থানে একই দৃশ্য দেখলাম। মোবাইলে জুয়ায় মত্ত তরুণেরা তাদের পাশ দিয়ে কে আসছে কে যাচ্ছে মোটেও গুরুত্ব দিচ্ছে না। জুয়া নিয়েই মেতে আছে তারা।
আমাদের দেশে তরুণদের একটা অংশ তথ্যপ্রযুক্তি বিদ্যায় বেশ জ্ঞান অর্জন করেছে। গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে থেকেও তথ্য প্রযুক্তির জ্ঞান বিলিয়ে অর্থ আয় করছেন অনেক তরুণ-তরুণী। কিন্তু এই তথ্যগুলো তেমন আলোচিত হয় না। ‘ব্যাড নিউজ ইজ গুড নিউজ’ এই ধারণায় ভালো খবর মূলত আড়ালেই থেকে যায়। খারাপ নিউজই প্রতিদিন প্রচার মাধ্যমে প্রায়োরিটি পায়।
দেশে রাস্তার মোড়ে মোড়ে, মার্কেটের গোপন জায়গায়, পরিত্যক্ত বাড়ির ছাদে, স্কুল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে অথবা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ধারে-কাছেই প্রতিদিন বিপৎগামী তরুণেরা ভয়ংকর আড্ডা জমাচ্ছে। এই আড্ডার খবর প্রশাসন জানে, বাবা-মা জানে, আত্মীয়-স্বজন জানে, সামাজিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও জানেন। কিন্তু প্রায় সবাই জেনেও না জানার ভান করেন। অনেকটা সেই দুই অলস ব্যক্তির কাহিনির মতো। ঘরে আগুন লেগেছে। ঘরের ভেতর শুয়ে থাকা দুই অলসের একজন অন্যজনকে বললো, গরম লাগে কেন? মনে হয় সূর্য আজ বেশ কড়া রোদ দিচ্ছে। যা তো জানালাটা বন্ধ করে দিয়ে আয়। দ্বিতীয় অলস ব্যক্তি বললো, আমি পারবো না। তুই যা, জানালা বন্ধ করে দিয়ে আয়। দু’জনের মধ্যে বাদানুবাদ চলতেই থাকলো। বলা বাহুল্য, আগুনে পুড়ে মারা যায় দুই অলস ব্যক্তি।
এই গল্পের মাজেজা কে কতটুকু বুঝলেন জানি না। তবে সবাই নিশ্চয়ই এটা বুঝেছেন আমাদের তরুণ প্রজন্মের একটা অংশ অন্ধকারে ডুবতে বসেছে। তাদের ফেরানো দরকার। কে নিবে এই দায়িত্ব? প্রথমে পরিবার। তারপর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং অবশ্যই সামাজিকভাবে নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিবর্গের ভূমিকাও এ ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। শুভ কামনা সবার জন্য।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো।