আব্দুল বায়েস
অপব্যয় বা অপচয়েরও কিন্তু একটা অর্থনীতি আছে। তথাকথিত অপচয়ের শুধু অপকারিতা নয়, উপকারিতাও আছে। ধরা যাক যে কেউ গর্ত খোঁড়ার কাজ করছে। শুধু শুধু গর্ত খোঁড়ার কাজটিকে ভালো চোখে দেখবে এমন মানুষ নিশ্চয়ই ১০০ জনের মধ্যে ১ জনও নেই। এর পেছনে জনসমর্থনের প্রকট অভাবের মধ্যেও বিশ্ব বিখ্যাত ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জন মেইনার্ড কেইনস ত্রিশ দশকের মহামন্দার সময় সামান্য এই গর্ত খোঁড়ার কাজের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক মন্দায় ন্যুব্জ একটা অর্থনীতির সোজা হয়ে দাঁড়াবার পথ দেখেছেন। তাঁর নিজের এবং অনুসারীদের বক্তব্য হচ্ছে, অর্থনৈতিক মন্দার সময় উৎপাদন হ্রাস পায়, বেকারত্ব বাড়ে এবং চাহিদা সংকুচিত হয়ে পড়ে। এই সময়টিতে সরকারের বাড়তি ব্যয় আপাতদৃষ্টে অপচয় মনে হলেও দিনের শেষে সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য শুভও হতে পারে।
দুই.
যেমন- যদি বেকার সমস্যা প্রকট থাকে এবং কর্মসংস্থানেরও কোনো ভালো প্রকল্প না থাকে সেক্ষেত্রে সরকার বেকারদের গর্ত খোঁড়ার কাজে লাগাতে পারেন। অর্থের বিনিময়ে গর্ত খোঁড়া কর্মজীবীর আয় বাড়িয়ে চাহিদা বাজার পণ্যের সৃষ্টি করে। চাহিদা সৃষ্টি হলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায় আর এই অতিরিক্ত উৎপাদনের সুবাদে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। দেখা গেল যে, সরকার হয়তো গর্ত খোড়ায় নিয়োজিত ব্যক্তিকে ১০০ টাকা দিয়েছে কিন্তু গুণকের প্রভাবে তা বাজারে ৫০০ টাকার চাহিদা সৃষ্টি করে ফেললো।
ধরা যাক যে এক টাকা আয় বৃদ্ধি পেলে একজন ব্যক্তি ৬০ পয়সা খরচ করে (ভোগের প্রান্তিক প্রবণতা ০.৬) এবং ৪০ পয়সা সঞ্চয় করে রাখে। তা হলে পূর্বের সূত্র ধরে গুণক হচ্ছে (১/১-০.৬ = ২.৫)। অর্থাৎ সরকার যদি ১ টাকা ক্রয় বৃদ্ধি বা বেশি ব্যয় করে তাহলে ভারসাম্য আয় উঠবে ২.৫০ টাকায়। এবার ধরা যাক যে, সরকার ১০০ কোটি টাকা দিয়ে স্কুলের জন্য কম্পিউটার ও সেনাবাহিনীর জন্য ট্যাংক কিনলো। এক্ষেত্রে স্বল্পকালীন সময়ে সুদের হার অথবা বিনিময় হার পরিবর্তন না ঘটলে, জিডিপি বাড়বে যত খরচ তার আড়াইগুণ। তবে মনে রাখতে হবে যে এক্ষেত্রে সমস্যাটা হচ্ছে, উৎপাদন ও মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি সাপেক্ষে সুদের হার বৃদ্ধি পেলে বিনিময় হার অতিমূল্যায়িত হবার সম্ভাবনা থাকে যা দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বিতাড়িত (ক্রাউড আউট) করতে পারে। এরপরও দেখা যায় যে, কেইনস ও তার অনুসারীদের এ ব্যাপারে অবস্থান আরো অনমনীয়।
যদি নতুন গর্ত খুঁড়েও যথেষ্ট কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হয়, তাহলে পুরনো গর্তগুলো ভর্তি করতে হবে এবং এইভাবে নতুন গর্ত খুঁড়তে ও ভর্তি করতে হবে। এক সময় দেখা যাবে যে, গুণকের যাদুর স্পর্শে অর্থনৈতিক মন্দা অতীতের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং, আপাতত অপচয় মনে হলেও মন্দা মোকাবেলায় গর্ত খোঁড়া একটা ‘মহৌষধ’ হিসাবে উপস্থিত হয়ে অর্থনীতিতে নতুন প্রাণ সঞ্চারিত করবে। এমনি করে আবার বসবে মেলা হাটতলা, বটতলা।
তিন.
কথায় বলে গুরু মারা বিদ্যা। একবার কেইনসের অনুগামী নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ পল ক্রগম্যানকে ২০০৮-২০১২ সময়কালের অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠার সম্ভাব্য পদক্ষেপ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তাঁর সোজাসাপটা উত্তর ছিল, মন্দা দূর করতে হলে বিপুল পরিমাণে সরকারি ব্যয় বাড়াতে হবে। এর পরের প্রশ্নটি ছিল খুবই স্পর্শকাতর- ‘এ ব্যয়ের পেছনে যদি জনসমর্থন না থাকে তাহলে কী করতে হবে?’ ক্রগম্যান পরামর্শ দিলেন, ‘সারা পৃথিবীতে গুজব রটিয়ে দিন যে মহাশূন্য থেকে আজব জীবেরা পৃথিবী আক্রমণ করতে আসছে এবং এই আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য কোটি কোটি প্রহরীর প্রয়োজন। এই অজুহাতে একবার চাকরি সৃষ্টি করলে মন্দা কেটে যাবে। যখন ভোটাররা বুঝতে পারবে যে এই গুজব অর্থহীন, ততদিন মন্দা থাকবে না।’
কেইনস নিজেই লিখেছেন- পিরামিড নির্মাণ, ভূমিকম্প এমনকী যুদ্ধও সম্পদ সৃষ্টি করতে পারে। এখানে লক্ষণীয় যে, শিষ্য ক্রগম্যান ও গুরু কেইনস উভয়ই যুদ্ধের ধ্বংসের মধ্যে ‘সৃষ্টি’ দেখেছেন অর্থাৎ, উভয়ই মন্দা থেকে মুক্তি দেখেছেন চাহিদা চাঙ্গা হবার মাধ্যমে-কেইনস সেটি দেখেছেন প্রকৃত যুদ্ধের মাধ্যমে আর ক্রগম্যান দেখেছেন, এমনকি ভুয়া যুদ্ধের মাধ্যমে।
ব্যয় আর অপব্যয় যেন মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। ব্যয়ের বেড়ার ফাঁকে অপব্যয় যেন উঁকি মারে। কেইনস বা ক্রগম্যান সরকারি ব্যয়ের যে ‘মাহাত্ম্য’ বর্ণনা করেছেন, ওই মাহাত্ম্য বিবর্ণ হয়ে পড়ে- যখন পরিকল্পিত কর্মসূচিকে অপব্যয় বা অপচয় গ্রাস করে। সারা পৃথিবীতে এই অপব্যয় নিয়ে এখন হই চই চলছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো- যেসব উন্নত দেশ উন্নয়নশীল দেশকে অর্থের অপচয় বন্ধ করে উন্নয়ন ঘটাতে উপদেশ দেয়, ওই দেশগুলোয় অপচয়ের প্রকৃতি ও মাত্রা দেখে রীতিমতো স্তম্ভিত হতে হয়; এমনকি অপচয়ের ক্ষেত্রে কোথাও তারা উন্নয়নশীল দেশ ছাড়িয়ে যায়।
অপচয় আর দুর্নীতির ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত দেওয়া যায় এবং শুধু উন্নয়নশীল সমাজে নয়, এই অপচয় আর দুর্নীতির কথা শোনা যায় উন্নত বিশ্বেও ৬ প্রকার অপচয় ও অপ্রয়োজনীয় ব্যয় চিহ্নিত করা চলে; প্রথম ৪টি আপেক্ষিক মূল্যায়ন হতে পারে। তবে শেষের দুটো ভালোভাবেই শনাক্ত করা সম্ভব।
১. যে কর্মসূচি ব্যক্তিখাত অপেক্ষাকৃত ভালোভাবে পরিচালন করতে পারে অথচ সরকারি খাত ধরে রেখেছে।
২. সরকারি সাহায্য পাবার যোগ্য নয় এমন গোষ্ঠীকে সুযোগ দেওয়া।
৩. অপ্রয়োজনীয় ও সময়োত্তীর্ণ প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ।
৪. একই কর্মসূচির পুনরাবৃত্তি।
৫. অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা ও জালিয়াতি।
চার.
আকবর আলি খানের বিখ্যাত এক বই থেকে এবার উদাহরণ টেনে অর্থনীতিতে অপব্যয়-মার্কিন স্টাইল সম্পর্কে কিছু লোমহর্ষক (এবং একই সাথে ‘চিত্তাকর্ষক’) তথ্য তুলে ধরা যায়। বলে নেওয়া ভালো যে, এগুলোর কোনোটির সাথে দুর্নীতির জড়িত থাকতে পারে অথবা নাও থাকতে পারে। তবে এগুলো যে, নিতান্তই অপব্যয় এ ব্যাপারে সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই।
(১) আমেরিকার নেব্রাস্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের পশু চিকিৎসা বিভাগে গবাদিপশুর মূত্রত্যাগের অভ্যাস নিয়ে গবেষণা পরিচালনার জন্য তিন মিলিয়ন ডলার (২৫ কোটি টাকা) অনুদান দেওয়া হয়। গবেষকরা জানতে চান, গরু নদী পার হওয়ার সময়, না নদীতে নামার আগে প্রস্রাব করে না নদী পার হওয়ার পর করে।
অধিকাংশ গবেষক গরুগুলি কখন নীরবে মূত্রত্যাগ করে তা ঠাহর করতে পারেন নি। এই ব্যর্থতা নিয়ে নিন্দুকদের কাছে বেড়িয়ে এসেছে যে পর্যবেক্ষকদের অনেকে বান্ধবীদের নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে গরু কী করছিল সেটা বেমালুম ভুলে গেছেন। যাই হোক, ২০০৮ সালে এই প্রকল্পটি সিনেটর প্রপস্মায়ার পুরস্কার লাভ করে তবে সরকারি অপচয়ের নিকৃষ্টতম উদাহরণ হিসাবে।
(২) ২০০৫ সালে প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় ক্যাটরিনা যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টিক উপকূলে আঘাত হানে। ২৫ লাখ দুর্গতকে সাহায্য দেওয়া হয় যার মধ্যে ৯ লাখ ছিল ভুয়া যারা ২ বিলিয়ন ডলার বা ১৬ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছ। ত্রাণের অর্থ দিয়ে অনেকে বিদেশে প্রমোদ ভ্রমণে গিয়েছেন; এমনকি ত্রাণের পয়সায় একজন অস্ত্রোপচার করে লিঙ্গ পরিবর্তন করছেন।
(৩) সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর যে সাহায্য দেওয়া হয়েছিল তার পরিমাণ ২১ বিলিয়ন ডলার চুরি বা খোয়া গেছে যা বাংলাদেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের প্রায় দ্বিগুণ।
(৪) যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট দক্ষিণ চীনে পতিতাদের কীভাবে দায়িত্বের সঙ্গে স্বল্পমাত্রায় মদ্যপান করতে হয় সে সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ২.৬ মিলিয়ন ডলার বা ১৮৩ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, চীনের গবেষণালব্ধ ফলাফল পরিবর্তনকালে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহার করা সম্ভব হতে পারে।
(৫) যুক্তরাষ্ট্রে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে যে-সব সরকারি কেনাকাটা করা হয় তার প্রায় অর্ধেক ভুয়া ও প্রতারণামূলক। দেখা গেছে যে, সরকারি ক্রেডিট কার্ড দেখিয়ে জুয়া খেলার দেনা শোধ করা হয়েছে, মদ কেনা হয়েছে এবং (বান্ধবীদের) সোনার অলংকারের দাম পরিশোধ করা হয়েছে।
(৬) যারা কৃষি পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখার জন্য সরকারের নির্দেশে কৃষি জমি পতিত রাখে, তাদের ১৩০০ কোটি ডলারের ভরতুকি দেওয়া হয়। উপশহরে যারা লনে ঘাস লাগায়নি তারাও এই সুবিধা দাবি করে ভরতুকি পেয়েছে। সরকারি ব্যয়ের প্রায় অর্ধেক অপচয় হয় বলে আমেরিকার তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি আলগোর মনে করতেন।
(৭) ওয়াশিংটন ডিসিতে সিকিউরিটিজ ও এক্সচেঞ্জ কমিশন ৩.৯ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে শুধু ডেস্ক ও অফিস সাজাতে।
(৮) সব খামারের জন্য নির্ধারিত ভর্তুকি অর্ধেকের বেশি পায় ঐ সব বাণিজ্যিক খামার যাদের বার্ষিক গড়পড়তা আয় ২ লক্ষ ডলার।
(৯) স্বাস্থ্য খাতে জালিয়াতির কারণে করদাতাদের বছরে ৬০ বিলিয়ন ডলার বেশি দিতে হয়।
(১০) ফেডারেল সরকারের ৫০ হাজার খালি বাড়ি রয়েছে।
(১১) ওয়াশিংটন সৈকতে বালু ফেলার জন্য ৩ বিলিয়ন ডলারে খরচ করেছে যদিও নতুন বালু আবার সমুদ্রে গিয়ে মিশেছে।
(১২) প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় অব্যাহত বিমান টিকিটে খরচ করেছে ১০০ মিলিয়ন ডলার যদিও এই অর্থ ফিরে পেতে পারতো।
সুতরাং অপব্যয়ের অর্থনীতি শুধু উন্নয়নশীল দেশের ব্যাপার নয়, উন্নত বিশ্বেও অপব্যয় অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে সাহায্য করে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ, কলামিস্ট ও সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)
আজকের প্রত্যাশা/ কেএমএএ


























