ঢাকা ০৮:১৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫

গণহত্যা ইস্যুতে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়ে পাকিস্তান নিশ্চুপ কেন?

  • আপডেট সময় : ১০:৪৬:০৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২১
  • ১১৩ বার পড়া হয়েছে

ফারাবী বিন জহির : সভ্যতার ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের নাম ‘গণহত্যা’। মানুষ সভ্যতার ক্রমবিকাশের পথ ধরে নিজেদের যেমন জ্ঞান বুদ্ধিতে নিজেদের সমৃদ্ধ করেছে, উৎকর্ষতার প্রতিটি স্তরে রেখেছে মেধার স্বাক্ষর, ঠিক তেমনি নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি হাসিলের উদ্দেশ্যে অথবা নিজেদের লোভ, হিংসা- ঘৃণা চরিতার্থ করার নিমিত্তে চূড়ান্ত প্রকৃতির পাশবিক কাজ করতেও দ্বিধাবোধ করেনি। এমনই এক পাশবিক কাজের নাম গণহত্যা। মানব সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই দেখবো, ইতিহাসের বিভিন্ন পরিক্রমায় কী নৃশংসভাবে এই গণহত্যা নামক ভয়াবহ খেলায় মেতে উঠেছিল মানুষ! সভ্যতার পথে না গিয়ে বরং গণহত্যা নামক বীভৎস পথে হাঁটতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেনি মানুষরূপী কিছু হায়েনা। তবে স্বস্তির বিষয় হচ্ছে কালের পরিক্রমায় মানুষের মধ্যে বোধোদয় হয়েছে। মানুষ উপলব্ধি করতে পারছে যে যুদ্ধ যেমন কোনও দিন শান্তি আনতে পারে না, তেমনি কোনও সভ্য রাষ্ট্র গণহত্যাকে সমর্থন করতে পারে না। এই ধারাবাহিকতায় বিশ্ব রাজনীতিতে আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। প্রথম ঘটনাটি হলো, জার্মান সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে নেয় যে নামিবিয়ায় তাদের ঔপনিবেশিক শাসনের সময় সেখানে গণহত্যা চালানো হয়েছিল। নামিবিয়ার জনগণ এবং গণহত্যার শিকার মানুষদের উত্তরসূরিদের কাছে ক্ষমা চেয়েছে জার্মান সরকার।
এই ঘটনাটির সূত্রপাত হয়েছিল ১৮৯৪ থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত যখন নামিবিয়া জার্মান ঔপনিবেশিক শাসনে ছিল। তখন ওই দেশের নাম ছিল জার্মান দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকা। ওই সময় যে গণহত্যা সেখানে চালানো হয়, তাকে অনেক ঐতিহাসিক বিংশ শতাব্দীর ‘বিস্মৃত গণহত্যা‘ বলে বর্ণনা করেছেন।
বহুদিন ধরে নামিবিয়ার পক্ষ হতে ওই গণহত্যার অপরাধ স্বীকার করে নিয়ে ক্ষতিপূরণের জন্য জার্মানির ওপর চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছিল। পাঁচ বছর ধরে দুই সরকারের মধ্যে দেনদরবারের পর জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেইকো মাস এক বিবৃতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকারে করে নেন যে নামিবিয়ায় গণহত্যা চালানো হয়েছিল। নামিবিয়া এবং গণহত্যার শিকার মানুষদের উত্তরসূরিদের কাছে জার্মান সরকারের হয়ে ক্ষমা চেয়েছেন তিনি। বিবৃতিতে বলা হয়, “জার্মানি তাদের ঐতিহাসিক এবং নৈতিক দায় স্বীকার করছে এবং নামিবিয়ার জনগণ এবং অপরাধের শিকার মানুষদের উত্তরসূরিদের কাছে ক্ষমা চাইছে”।
শুধু ক্ষমা নয় বরং ওই অপরাধের সময় ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১১০ কোটি ইউরো (১৩৪ কোটি ডলার) ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়েছে জার্মানি। এই টাকা নামিবিয়ার শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়নে খরচ করা হবে। সেই ক্ষতিপূরণের চুক্তি সইয়ের পর জার্মানির প্রেসিডেন্ট নামিবিয়া গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সে দেশের জনগণের কাছে ক্ষমা চাইবেন।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, ফ্রান্স তাদের সাবেক উপনিবেশ রুয়ান্ডায় ১৯৯৪ সালে ভয়াবহ গণহত্যার দায় স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছে। ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডার যে গৃহযুদ্ধে কমপক্ষে আট থেকে ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, যাদের সিংহভাগই টুটসি জাতিগোষ্ঠীর। গত ২৭ বছর ধরে রুয়ান্ডার গণহত্যায় ফ্রান্সের ভূমিকা নিয়ে কোনও ফরাসি সরকার তেমন উচ্চবাচ্য করেনি। প্রায় ২৭ বছর পর ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ রুয়ান্ডার রাজধানী কিগালিতে গিয়ে দায় স্বীকার করেন, দুঃখ প্রকাশ করেন এবং রুয়ান্ডার জনগণের কাছে ক্ষমা চান। কিগালিতে গণহত্যার স্মরণে নির্মিত যে সমাধিস্থলে গণহত্যার নিহত ২৫০,০০০ টুটসিকে কবর দেওয়া হয়েছিল, সেখানে অনুষ্ঠানে মি ম্যাক্রঁ বলেন, “আমাদের দায় স্বীকার করতে আমি এখানে হাজির হয়েছি… আমাদের ক্ষমা করে দিন”।
নিঃসন্দেহে মানব সভ্যতার ইতিহাসে এই দুটি ঘটনা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ঘটনার এত বছর পরে হলেও জার্মানি ও ফ্রান্স উপলব্ধি বোধ হয়েছে যে নিরপরাধ মানুষ হত্যা কখনোই সভ্যতার নিদর্শন হতে পারে না। এই উপলব্ধি বোধ সত্যিই প্রশংসা দাবিদার।

অবশ্যই মানব সভ্যতার ইতিহাসে এই ক্ষমা এক মাইলফলক হয়ে থাকবে। ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে আরেকবার প্রমাণিত হলো নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষ হত্যা কখনোই কোনও সুস্থ এবং সভ্য সমাজে কাম্য হতে পারে না। অপরদিকে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, ১৯৭১ সালে ভয়াবহ এবং নৃশংস হত্যাকা- সংঘটিত করার পরও পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ক্ষমা তো চায়নি, বরং আরও ধৃষ্টতা ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ প্রকাশ করে যাচ্ছে। আমরা যদি একটু গভীরভাবে লক্ষ করি, তাহলে দেখবো রাজনৈতিক পটভূমি এবং নৃশংসতার বিচারে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যা ছিল অনেক বেশি নিষ্ঠুর এবং বর্বর। রাজনৈতিক পটভূমি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের পাকিস্তানিরা আমাদের ওপর যে বর্বর আক্রমণ চালায়, তা কোনোভাবেই কোনও বিচ্ছিন্নতাবাদী দমনের আক্রমণ ছিল না, বরং তা ছিল গণতন্ত্র হরণের আক্রমণ, তা ছিল ১৯৭০ সালে জনগণ যে ম্যান্ডেট দিয়েছিল তা স্তব্ধ করার আক্রমণ। সর্বোপরি পাকিস্তানিদের সেই আক্রমণ ছিল গণতন্ত্রের কবর রচনা করার।
যদি নৃশংসতার দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করি তাহলে দেখি ১৯৮১ সালের ইউএনএইচআরসি (ইউনাইটেড ন্যাশনস হিউম্যান রাইটস কমিশন) রিপোর্ট অনুযায়ী মানব সভ্যতার ইতিহাসে যত গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, তাতে অল্প সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে। প্রতিদিন গড়ে ৬ হাজার থেকে ১২ হাজার মানুষকে তখন হত্যা করা হয়েছিল বাংলাদেশে।
গণহত্যার ইতিহাসে এটাই সর্বোচ্চ গড়। তবে এখানে উল্লেখ্য, অপারেশন সার্চলাইটের প্রথম রাতের প্রাণহানির সংখ্যাই ছিল কমপক্ষে ৩৫ হাজারের মতো। চুকনগর গণহত্যায় প্রাণহানি ঘটেছিল ১০ হাজারের ওপরে।
১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ প্রকাশিত নিউ ইয়র্ক টাইমসের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২৭ মার্চে প্রাণহানির সংখ্যা ১০ হাজার। ১৯৭১ সালের সিডনি মরর্নিং হেরাল্ডের রিপোর্ট অনুযায়ী মার্চের ২৫ থেকে ২৯ মার্চ পর্যন্ত (৫ দিনে) প্রাণহানির সংখ্যা প্রায় ১ লাখ। এতে দেখা যায় দিনপ্রতি প্রাণহানির সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। এমনকি রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র ‘প্রাভদা’ ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসেই বাংলাদেশে ৩০ লাখ শহীদের বিষয়টি প্রকাশ করে। এই প্রাভদার ইংরেজি সংস্করণে উল্লেখ করা হয়, ‘ঙাবৎ ৩০ ষধশয ঢ়বৎংড়হং বিৎব শরষষবফ ঃযৎড়ঁমযড়ঁঃ ইধহমষধফবংয নু ঃযব চধশরংঃধহর ড়পপঁঢ়ধঃরড়হ ভড়ৎপবং ফঁৎরহম ঃযব ষধংঃ হরহব সড়হঃযং’। প্রাভদা পত্রিকাটির ১৯৭২ সালের ৫ জানুয়ারির বাংলা সংস্করণে শিরোনাম হয় ‘দখলদার বাহিনী বাংলাদেশে ৩০ লক্ষাধিক মানুষ হত্যা করেছে।’
বিষয়টি একেবারেই স্পষ্ট যে রাজনৈতিক পটভূমি এবং নৃশংসতার বিচার যেভাবেই দেখা হোক না কেন, পাকিস্তান কর্তৃক সংঘটিত ১৯৭১ সালের হত্যাকা- ছিল পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম জঘন্য ও বর্বর গণহত্যা । তবু পাকিস্তান নামক অসভ্য রাষ্ট্রটির বোধোদয় হয়নি। তারা এই গণহত্যার প্রশ্নে নিশ্চুপ এবং নির্বিকার। উপরন্তু পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি তাদের দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পেইড এজেন্টের মাধ্যমে গণহত্যার বিষয়ে অবিরাম মিথ্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে।
তাই সময় এসেছে ধর্মান্ধতা ও জঙ্গিবাদে নিমজ্জিত পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা। সে জন্য সরকারি, বেসরকারি এমনকি ব্যক্তিপর্যায়েও বিশ্বের বিভিন্ন ফোরাম এবং গণমাধ্যমে পাকিস্তানিদের বর্বরতার কথা তুলে ধরতে হবে। বিশ্ববাসীর মধ্যে এই ভাবনার উদ্রেক ঘটাতে হবে যে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি যত দিন পর্যন্ত ১৯৭১ সালের কৃত গণহত্যার জন্য ক্ষমা না চাইবে, ততদিন মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক কলঙ্কময় দেশ হিসেবে পরিচিত হবে।
লেখক: অ্যাকটিভিস্ট

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

লক্ষ্মীপুরে যাত্রীবাহী বাস খালে পড়ে নিহত ৫

গণহত্যা ইস্যুতে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়ে পাকিস্তান নিশ্চুপ কেন?

আপডেট সময় : ১০:৪৬:০৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২১

ফারাবী বিন জহির : সভ্যতার ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের নাম ‘গণহত্যা’। মানুষ সভ্যতার ক্রমবিকাশের পথ ধরে নিজেদের যেমন জ্ঞান বুদ্ধিতে নিজেদের সমৃদ্ধ করেছে, উৎকর্ষতার প্রতিটি স্তরে রেখেছে মেধার স্বাক্ষর, ঠিক তেমনি নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি হাসিলের উদ্দেশ্যে অথবা নিজেদের লোভ, হিংসা- ঘৃণা চরিতার্থ করার নিমিত্তে চূড়ান্ত প্রকৃতির পাশবিক কাজ করতেও দ্বিধাবোধ করেনি। এমনই এক পাশবিক কাজের নাম গণহত্যা। মানব সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই দেখবো, ইতিহাসের বিভিন্ন পরিক্রমায় কী নৃশংসভাবে এই গণহত্যা নামক ভয়াবহ খেলায় মেতে উঠেছিল মানুষ! সভ্যতার পথে না গিয়ে বরং গণহত্যা নামক বীভৎস পথে হাঁটতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেনি মানুষরূপী কিছু হায়েনা। তবে স্বস্তির বিষয় হচ্ছে কালের পরিক্রমায় মানুষের মধ্যে বোধোদয় হয়েছে। মানুষ উপলব্ধি করতে পারছে যে যুদ্ধ যেমন কোনও দিন শান্তি আনতে পারে না, তেমনি কোনও সভ্য রাষ্ট্র গণহত্যাকে সমর্থন করতে পারে না। এই ধারাবাহিকতায় বিশ্ব রাজনীতিতে আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। প্রথম ঘটনাটি হলো, জার্মান সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে নেয় যে নামিবিয়ায় তাদের ঔপনিবেশিক শাসনের সময় সেখানে গণহত্যা চালানো হয়েছিল। নামিবিয়ার জনগণ এবং গণহত্যার শিকার মানুষদের উত্তরসূরিদের কাছে ক্ষমা চেয়েছে জার্মান সরকার।
এই ঘটনাটির সূত্রপাত হয়েছিল ১৮৯৪ থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত যখন নামিবিয়া জার্মান ঔপনিবেশিক শাসনে ছিল। তখন ওই দেশের নাম ছিল জার্মান দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকা। ওই সময় যে গণহত্যা সেখানে চালানো হয়, তাকে অনেক ঐতিহাসিক বিংশ শতাব্দীর ‘বিস্মৃত গণহত্যা‘ বলে বর্ণনা করেছেন।
বহুদিন ধরে নামিবিয়ার পক্ষ হতে ওই গণহত্যার অপরাধ স্বীকার করে নিয়ে ক্ষতিপূরণের জন্য জার্মানির ওপর চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছিল। পাঁচ বছর ধরে দুই সরকারের মধ্যে দেনদরবারের পর জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেইকো মাস এক বিবৃতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকারে করে নেন যে নামিবিয়ায় গণহত্যা চালানো হয়েছিল। নামিবিয়া এবং গণহত্যার শিকার মানুষদের উত্তরসূরিদের কাছে জার্মান সরকারের হয়ে ক্ষমা চেয়েছেন তিনি। বিবৃতিতে বলা হয়, “জার্মানি তাদের ঐতিহাসিক এবং নৈতিক দায় স্বীকার করছে এবং নামিবিয়ার জনগণ এবং অপরাধের শিকার মানুষদের উত্তরসূরিদের কাছে ক্ষমা চাইছে”।
শুধু ক্ষমা নয় বরং ওই অপরাধের সময় ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১১০ কোটি ইউরো (১৩৪ কোটি ডলার) ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়েছে জার্মানি। এই টাকা নামিবিয়ার শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়নে খরচ করা হবে। সেই ক্ষতিপূরণের চুক্তি সইয়ের পর জার্মানির প্রেসিডেন্ট নামিবিয়া গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সে দেশের জনগণের কাছে ক্ষমা চাইবেন।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, ফ্রান্স তাদের সাবেক উপনিবেশ রুয়ান্ডায় ১৯৯৪ সালে ভয়াবহ গণহত্যার দায় স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছে। ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডার যে গৃহযুদ্ধে কমপক্ষে আট থেকে ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, যাদের সিংহভাগই টুটসি জাতিগোষ্ঠীর। গত ২৭ বছর ধরে রুয়ান্ডার গণহত্যায় ফ্রান্সের ভূমিকা নিয়ে কোনও ফরাসি সরকার তেমন উচ্চবাচ্য করেনি। প্রায় ২৭ বছর পর ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ রুয়ান্ডার রাজধানী কিগালিতে গিয়ে দায় স্বীকার করেন, দুঃখ প্রকাশ করেন এবং রুয়ান্ডার জনগণের কাছে ক্ষমা চান। কিগালিতে গণহত্যার স্মরণে নির্মিত যে সমাধিস্থলে গণহত্যার নিহত ২৫০,০০০ টুটসিকে কবর দেওয়া হয়েছিল, সেখানে অনুষ্ঠানে মি ম্যাক্রঁ বলেন, “আমাদের দায় স্বীকার করতে আমি এখানে হাজির হয়েছি… আমাদের ক্ষমা করে দিন”।
নিঃসন্দেহে মানব সভ্যতার ইতিহাসে এই দুটি ঘটনা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ঘটনার এত বছর পরে হলেও জার্মানি ও ফ্রান্স উপলব্ধি বোধ হয়েছে যে নিরপরাধ মানুষ হত্যা কখনোই সভ্যতার নিদর্শন হতে পারে না। এই উপলব্ধি বোধ সত্যিই প্রশংসা দাবিদার।

অবশ্যই মানব সভ্যতার ইতিহাসে এই ক্ষমা এক মাইলফলক হয়ে থাকবে। ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে আরেকবার প্রমাণিত হলো নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষ হত্যা কখনোই কোনও সুস্থ এবং সভ্য সমাজে কাম্য হতে পারে না। অপরদিকে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, ১৯৭১ সালে ভয়াবহ এবং নৃশংস হত্যাকা- সংঘটিত করার পরও পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ক্ষমা তো চায়নি, বরং আরও ধৃষ্টতা ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ প্রকাশ করে যাচ্ছে। আমরা যদি একটু গভীরভাবে লক্ষ করি, তাহলে দেখবো রাজনৈতিক পটভূমি এবং নৃশংসতার বিচারে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যা ছিল অনেক বেশি নিষ্ঠুর এবং বর্বর। রাজনৈতিক পটভূমি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের পাকিস্তানিরা আমাদের ওপর যে বর্বর আক্রমণ চালায়, তা কোনোভাবেই কোনও বিচ্ছিন্নতাবাদী দমনের আক্রমণ ছিল না, বরং তা ছিল গণতন্ত্র হরণের আক্রমণ, তা ছিল ১৯৭০ সালে জনগণ যে ম্যান্ডেট দিয়েছিল তা স্তব্ধ করার আক্রমণ। সর্বোপরি পাকিস্তানিদের সেই আক্রমণ ছিল গণতন্ত্রের কবর রচনা করার।
যদি নৃশংসতার দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করি তাহলে দেখি ১৯৮১ সালের ইউএনএইচআরসি (ইউনাইটেড ন্যাশনস হিউম্যান রাইটস কমিশন) রিপোর্ট অনুযায়ী মানব সভ্যতার ইতিহাসে যত গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, তাতে অল্প সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে। প্রতিদিন গড়ে ৬ হাজার থেকে ১২ হাজার মানুষকে তখন হত্যা করা হয়েছিল বাংলাদেশে।
গণহত্যার ইতিহাসে এটাই সর্বোচ্চ গড়। তবে এখানে উল্লেখ্য, অপারেশন সার্চলাইটের প্রথম রাতের প্রাণহানির সংখ্যাই ছিল কমপক্ষে ৩৫ হাজারের মতো। চুকনগর গণহত্যায় প্রাণহানি ঘটেছিল ১০ হাজারের ওপরে।
১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ প্রকাশিত নিউ ইয়র্ক টাইমসের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২৭ মার্চে প্রাণহানির সংখ্যা ১০ হাজার। ১৯৭১ সালের সিডনি মরর্নিং হেরাল্ডের রিপোর্ট অনুযায়ী মার্চের ২৫ থেকে ২৯ মার্চ পর্যন্ত (৫ দিনে) প্রাণহানির সংখ্যা প্রায় ১ লাখ। এতে দেখা যায় দিনপ্রতি প্রাণহানির সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। এমনকি রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র ‘প্রাভদা’ ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসেই বাংলাদেশে ৩০ লাখ শহীদের বিষয়টি প্রকাশ করে। এই প্রাভদার ইংরেজি সংস্করণে উল্লেখ করা হয়, ‘ঙাবৎ ৩০ ষধশয ঢ়বৎংড়হং বিৎব শরষষবফ ঃযৎড়ঁমযড়ঁঃ ইধহমষধফবংয নু ঃযব চধশরংঃধহর ড়পপঁঢ়ধঃরড়হ ভড়ৎপবং ফঁৎরহম ঃযব ষধংঃ হরহব সড়হঃযং’। প্রাভদা পত্রিকাটির ১৯৭২ সালের ৫ জানুয়ারির বাংলা সংস্করণে শিরোনাম হয় ‘দখলদার বাহিনী বাংলাদেশে ৩০ লক্ষাধিক মানুষ হত্যা করেছে।’
বিষয়টি একেবারেই স্পষ্ট যে রাজনৈতিক পটভূমি এবং নৃশংসতার বিচার যেভাবেই দেখা হোক না কেন, পাকিস্তান কর্তৃক সংঘটিত ১৯৭১ সালের হত্যাকা- ছিল পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম জঘন্য ও বর্বর গণহত্যা । তবু পাকিস্তান নামক অসভ্য রাষ্ট্রটির বোধোদয় হয়নি। তারা এই গণহত্যার প্রশ্নে নিশ্চুপ এবং নির্বিকার। উপরন্তু পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি তাদের দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পেইড এজেন্টের মাধ্যমে গণহত্যার বিষয়ে অবিরাম মিথ্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে।
তাই সময় এসেছে ধর্মান্ধতা ও জঙ্গিবাদে নিমজ্জিত পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা। সে জন্য সরকারি, বেসরকারি এমনকি ব্যক্তিপর্যায়েও বিশ্বের বিভিন্ন ফোরাম এবং গণমাধ্যমে পাকিস্তানিদের বর্বরতার কথা তুলে ধরতে হবে। বিশ্ববাসীর মধ্যে এই ভাবনার উদ্রেক ঘটাতে হবে যে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি যত দিন পর্যন্ত ১৯৭১ সালের কৃত গণহত্যার জন্য ক্ষমা না চাইবে, ততদিন মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক কলঙ্কময় দেশ হিসেবে পরিচিত হবে।
লেখক: অ্যাকটিভিস্ট