আমীন আল রশীদ : অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম যেদিন (১২ জানুয়ারি) রাজধানীতে একটি অনুষ্ঠানে বললেন যে, ‘এখন গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আছে এবং প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরু করে সবার ক্রিটিসাইজ করা যাবে।’ এর দু’দিন পরই (১৪ জানুয়ারি) নারায়ণগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বললেন, ‘ফ্যাসিবাদের পক্ষে লিখলে কলম ভেঙে দেয়া হবে।’
হাসনাত বলেন, ‘যেসব টক শোজীবী ও বুদ্ধিজীবী এখন আওয়ামী লীগের মানবাধিকারের জন্য সরব হয়েছেন, আপনারাই এতদিন ফ্যাসিবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন। ফ্যাসিবাদের পক্ষে যে কলম লিখবে, আমরা সেই কলম ভেঙে দেব। ফ্যাসিবাদের পক্ষে যেসব মিডিয়া, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী কথা বলবে; আমরা তাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেব।
আমাদের তরুণ প্রজন্মের কথা যদি আপনারা বুঝতে ব্যর্থ হন, তাহলে আওয়ামী লীগের যে পরিণতি হয়েছে; আপনাদেরও একই পরিণতি হবে।’
প্রশ্ন হলো, ফ্যাসিবাদের পক্ষে লেখা বলতে তিনি কী বুঝিয়েছেন এবং কী ধরনের লেখা ও বলাকে তিনি বা তারা ফ্যাসিবাদের পক্ষে বলে মনে করেন? জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের পক্ষে কিংবা অন্তর্বর্তী সরকার ও তাদের অংশীজনদের বিপক্ষে যায় এমন কোনো সংবাদ বা বক্তব্যকেই কি ফ্যাসিবাদের পক্ষে বলে বিবেচনা করা হবে?
গণমাধ্যমের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের কমেন্ট সেকশন এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় জনাব হাসনাতের এই বক্তব্যের পক্ষে যেমন কিছু মন্তব্য আছে, তেমনি অনেক মানুষ এর কড়া সমালোচনাও করেছেন। অনেকেই তার এই বক্তব্যকেও ‘ফ্যাসিবাদী আচরণ’ বলে মন্তব্য করেছেন।
তথ্য উপদেষ্টা ও প্রেস সচিব কী বলছেন: ১২ জানুয়ারি প্রেস সচিব শফিকুল আলম রাজধানীর একটি হোটেলে ডেভলপমেন্ট মিডিয়া ফোরামের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেন, ‘গত পাঁচ মাসে প্রশ্ন করার স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে সরকার। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আছে এখন। প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরু করে সবার ক্রিটিসাইজ করা যাবে।’
অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামও একাধিকবার বলেছেন যে, দেশের গণমাধ্যম এখন যথেষ্ট স্বাধীন। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, আগের মতো এখন আর গণমাধ্যমে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীগুলো ফোন করে অ্যাডভাইস দেয় না বা ভয় দেখায় না।
প্রেস সচিব ও তথ্য উপদেষ্টার এই বক্তব্য নিঃসন্দেহে এটি একটি বড় উত্তরণ। অতীতের কোনো সরকারের মুখপাত্র বা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এরকম বলেননি যে, স্বয়ং সরকার প্রধানের সমালোচনা করা যাবে।
স্মরণ করা যেতে পারে, গত ১৪ নভেম্বর রাজধানীর একটি হোটেলে বিএনপির ‘রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখা: ৩১ দফার আলোকে সংস্কার’ শীর্ষক আলোচনায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছিলেন, তারা ক্ষমতায় এলে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নাগরিকের বাকস্বাধীনতার পূর্ণ নিশ্চয়তা দেয়া হবে। এমনকি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করলেও তার জন্য কাউকে শাস্তি পেতে হবে না। তিনি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য এমন একটি রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তোলা; যেখানে ইউটিউব, ফেসবুক ও অন্যান্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নিজেদের ভাবনা প্রকাশের কারণে কিংবা প্রধানমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিষয়ে মন্তব্যের দায়ে, কাউকে হেনস্তা করা হবে না। সত্য গোপন করতে মেইনস্ট্রিম ও সোশ্যাল মিডিয়া যেমন বাধ্য থাকবে না, তেমনি মিথ্যা তথ্য দিয়ে সেটির প্রচারেও সরকার কাউকে চাপ দেবে না। তবে দেশ গঠনের দায়িত্ব সবার এবং আমরা মিডিয়ার কাছ থেকে নিরপেক্ষ এবং দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রত্যাশা করি।’
তারেক রহমানের ওই বক্তব্যটি দারুণভাবে প্রশংসিত হয় এবং আগামীতে বিএনপি ক্ষমতায় এসে যদি সত্যি সত্যিই এই সিদ্ধান্তে অটল থাকে, তাহলে সেটি শুধু বাংলাদেশ নয় বরং সারা বিশ্বের বাকস্বাধীনতা চর্চায় একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।
ভয়ের সংস্কৃতি ও আইনি মারপ্যাঁচ: অতীতে সরকার প্রধান তো দূরে থাক, সরকারের মাঝারি এমনকি তৃণমূল পর্যায়ের কোনো ব্যক্তির সমালোচনা করলেও তার জন্য জেল-জুলুম ছিল অবধারিত। অনলাইন প্লাটফর্মে নাগরিকের কণ্ঠরোধের জন্য প্রথমে তথ্য-প্রযুক্তি আইন, তারপর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং তারপরে সমালোচনার মুখে সেটি বাতিল করে সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হয়েছিল। যদিও সবই ছিল পুরোনো বোতলে নতুন মদ।
কেননা সরকারের ইনটেনশন বা নিয়ত ছিল ক্ষমতার বিরুদ্ধে যেকোনো প্রশ্ন ও চ্যালেঞ্জ প্রতিহত করা। সাইবার দুনিয়ায় নাগরিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলা হলেও এসব আইনের উদ্দেশ্য ছিল মূলত ক্ষমতাকে প্রশ্নহীন রাখা। ফলে আইনের নাম বদলালেও তাতে নাগরিকের এমনকি গণমাধ্যমকর্মীদের হয়রানি মোটেও কমেনি। যে কারণে দেখা গেছে, শুধু ফেসবুকে পোস্ট দেয়ার কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে পর্যন্ত চাকরি হারাতে হয়েছে। জেলে যেতে হয়েছে। পত্রিকা বা টেলিভিশনের ডিজিটাল মাধ্যমে অপরাধবিষয়ক সংবাদ প্রচারের কারণেও সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অসংখ্য সাংবাদিককে জেল খাটতে হয়েছে।
করোনা অতিমারির সময়ে ত্রাণে দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ করেও অনেক সাংবাদিককে হেনস্থা হতে হয়েছে। ফলে তথ্য উপদেষ্টা এবং প্রেস সচিব গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে যা বলেছেন, সেগুলো নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক।
রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীগুলো এখন হয়তো সত্যিই গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোয় ফোন করে না। কিন্তু তার বিপরীতে কী ঘটছে? দেশের প্রধান দুটি জাতীয় দৈনিকের কার্যালয় ঘেরাও করা হয়েছে।
পত্রিকা দুটি বন্ধের দাবি জানানো হয়েছে। কোনো কোনো টেলিভিশন চ্যানেল ও পত্রিকা থেকে আগের সরকারের আমলের সুবিধাভোগী অভিযোগে অনেক সাংবাদিককে বের করে দিতে সরকারের প্রধান স্টেকহোল্ডার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে চাপ দেয়া হয়েছেÑ এমন অভিযোগও আছে। ৫ অগাস্টের পর অনেক টেলিভিশন ও দৈনিক পত্রিকার ভেতরে আরেক ধরনের অভ্যুত্থান হয়েছে— যা এখনও চলছে। ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে।
অনেককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এমনও অনেকে বড় বড় পদে বসে গেছেন যারা ওইসব পদে বসার যোগ্যতা রাখেন না বলে খোদ সাংবাদিকরা মনে করেন।
জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের মধ্য দিয়ে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই সরকারের তরফে বলা হচ্ছিল যে, সাইবার নিরাপত্তা আইনের মতো কালাকানুন দ্রুতই বাতিল করা হবে। কিন্তু দেখা গেল সরকার উল্টো যে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ জারি করেছে, সেটি নিয়ে নতুন করে সমালোচনা শুরু হয়েছে।
গত ২৪ ডিসেম্বর উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদিত হওয়া অধ্যাদেশটির খসড়ায় এমন কিছু বিষয় রাখা হয়েছে, যা স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বাতিল হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইনের ৮(১) ধারার মতো সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের ৮(১) ধারায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুরোধে বিটিআরসিকে যেকোনো কনটেন্ট অপসারণ বা ব্লক করবার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ৮(২) ধারা অনুসারে ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত দেশের বা এর কোনো অংশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলা ক্ষুণ্ন করে বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণার সঞ্চার করে, তাহলে এমন কনটেন্ট অপসারণ বা ব্লক করা যাবে।
মুশকিল হলো, কনটেন্ট অপসারণ বা ব্লক করার যে কারণগুলো এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, তা অস্পষ্ট। এগুলোর অতিরিক্ত ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রয়োগের সুযোগ রয়েছে। আগের আইনগুলোর মতোই এখানেও ‘ধর্মীয় মূল্যবোধ’ বা ‘দেশের সংহতি’র মতো বিষয়গুলোর পরিষ্কার ব্যাখ্যা না থাকায় আইন প্রয়োগকারীদের পক্ষে এগুলো নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী ব্যাখ্যার সুযোগ রয়েছে।
দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন টিআইবি এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত জাতীয় নাগরিক কমিটিও এই অধ্যাদেশের সমালোচনা করেছে। এই আইনের অপব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতীয় নাগরিক কমিটি অধ্যাদেশটির পুনর্বিবেচনা করে এটিকে স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রণয়ন করার আহ্বান জানিয়েছে।
সংগঠনটি মনে করে, প্রস্তাবিত সাইবার আইনে ‘ধর্মীয় অনুভূতি বা মূল্যবোধ’ এবং ‘অশ্লীল’-এর মতো শব্দগুলোর অন্তর্ভুক্তি কার্টুনিস্ট, শিল্পী এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করা অ্যাক্টিভিস্টদের জন্য একটি বড় হুমকি তৈরি করে; যা সৃজনশীলতা, ভিন্নমত প্রকাশ এবং গঠনমূলক সমালোচনাকে দমন করতে পারে।
বাস্তবতা হলো, অন্তর্বর্তী সরকার একাধিকবার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা সাইবার নিরাপত্তা আইনের কোনো মামলা বাতিল বা নিষ্পত্তি করা হয়নি।
প্রেস সচিবের অভয়ের বিপরীতে: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব যদিও বলছেন যে, প্রধান উপদেষ্টাসহ যে কারও সমালোচনা করা যাবে— কিন্তু তার বিপরীতে সরকারের প্রধান স্টেকহোল্ডার বলে পরিচিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে এমন সব হুমকি দেয়া হচ্ছে, যার ফলে কেউ সরকার বা তার অংশীদারদের সমালোচনার সাহস করবে কি না— সেটি বিরাট প্রশ্ন।
প্রেস সচিব বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। কিন্তু তার বিপরীতে দেশের গণমাধ্যমের ইতিহাসে এমন সব ঘটনা ঘটেছে; যা শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং সম্ভবত সারা বিশ্বেই বিরল।
যেমনÑ একসঙ্গে দেশের দেড় শতাধিক সাংবাদিক হত্যা মামলার আসামি। এটি পৃথিবীর কোথাও হয়েছে কি না সন্দেহ আছে। সরকার এই মামলার সরাসরি অংশ নয়, এটা ঠিক। কিন্তু মামলাগুলো হয়েছে এই সরকারের আমলেই। অতীতে যেসব সরকারকে ফ্যাসিস্ট বা স্বৈরাচার বলে অভিহিত করা হতো, তাদের আমলেও একসঙ্গে দেশের এত সাংবাদিক হত্যা মামলার আসামি হননি। বাস্তবতা হলো, কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধেই হত্যার অভিযোগ প্রমাণ করা যাবে না।
কেননা একজন সাংবাদিক যতই দলবাজ কিংবা অতীতের সরকারের সুবিধাভোগী হন না কেন, তাদের কেউ হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন বা হত্যা করেছেনÑ এটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। সম্প্রতি অনেক সাংবাদিকের ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে। বেশ কয়েকজনের অ্যাকাউন্ট জব্দও করা হয়েছে। দেশের ইতিহাসে এ রকম ঘটনাও এই প্রথম। তবে টাকা-পয়সার হিসাব-নিকাশ চাওয়া হতেই পারে। কেননা সাংবাদিক মাত্রই ধোয়া তুলসী পাতাÑ এমন ভাবার কারণ নেই।
বাস্তবতা হলো, জুলাই অভ্যুত্থান চলাকালীন অনেক সাংবাদিক সরকারি ভাষ্য প্রচার করেছেন বা করতে বাধ্য হয়েছেন। তার অর্থ এই নয় যে, তারা হত্যা করেছেন বা হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন। অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, যেসব সাংবাদিককে হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে, তার অধিকাংশ বাদীই সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকদের চেনেন না। চেনার কথাও নয়। বরং এই সাংবাদিকদের নাম মামলায় অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের একটি অংশই ভূমিকা রেখেছেন— এরকমও শোনা যায়। যার পেছনে রয়েছে সাংবাদিকদের মধ্যে অনৈক্য, দলাদলি, প্রেস ক্লাব ও ইউনিয়নের রাজনীতি এবং কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত শত্রুতা, এমনকি ঈর্ষাও।
যেসব সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে বা যাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তলব করা হয়েছে, তাদের সবাই নির্দোষ বা তারা কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত নন, সে কথা বলার সুযোগ নেই।
তাদের অনেকেই বিগত সরকারের সুবিধাভোগী। সাংবাদিকতার পরিচয় ভাঙিয়ে এবং গণভবন তথা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সখ্য থাকার সুযোগ নিয়ে অনেকেই বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন। কিন্তু এটি হত্যা মামলার মতো অপরাধ নয়। বরং হত্যা মামলাগুলো প্রমাণিত না হলে তাদের অন্য অপরাধও আড়াল হয়ে যাবে।
সম্প্রতি দেশের গণমাধ্যমে আরেকটি বিরল ঘটনা ঘটেছে। সেটি হলো প্রথমে তিন ধাপে ১৬৭ জন সাংবাদিকের প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করা হয় এবং গত ২৫ ডিসেম্বর গভীর রাতে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুন লাগার পরে নিরাপত্তার কথা বলে সকল সাংবাদিকের প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করা হয়।
পরে অবশ্য সচিবালয়ের সংবাদ কাভার করার জন্য আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের কাউকে কাউকে অস্থায়ী পাশ দেয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড হচ্ছে একজন পেশাদার সাংবাদিকের জন্য সরকারের স্বীকৃতির সনদ। এ কার্ড দেখিয়েই সচিবালয়, সংসদসহ রাষ্ট্রীয় এমন সব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় সাংবাদিকরা প্রবেশ করতে পারেন, যেখানে সাধারণ মানুষকে বিশেষ অনুমতিপত্র বা পাস নিয়ে ঢুকতে হয়।
এই ধরনের পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে যদি প্রকারান্তরে গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মীদের ভয় দেখানো তথা চাপে রাখার চেষ্টা করা হয়; যদি সবার কার্ড বাতিল করে নতুন করে আবেদন নিয়ে ওই আবেদন যাচাই বাছাইয়ের নামে ‘নিজস্ব লোকদেরকেই’ কেবল এই কার্ড দেয়া হয় এবং নতুন করে পুলিশি ভেরিফিকেশনের নামে হয়রানি করা হয়; কালক্ষেপণ করা হয়— তাহলে সেটি আরেকটি খারাপ দৃষ্টান্ত তৈরি করবে।
চাপে রাখাই লক্ষ্য: অনেকে মনে করেন একদিকে হত্যা মামলা, অন্যদিকে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট স্থগিত ও তলব এবং অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিলের মধ্য দিয়ে বস্তুত পুরো গণমাধ্যমকেই চাপে রাখা হচ্ছে। অর্থাৎ সরকার বা সরকারের কোনো গোয়েন্দা বাহিনী আগের মতো কোনো গণমাধ্যমপ্রতিষ্ঠানে ফোন করে আদেশ নির্দেশ বা ভয়ভীতি না দেখালেও এমন পরিস্থিতি তৈরি করে রাখা হচ্ছে যাতে সবাই একরকম ভয়ের মধ্যে থাকে। যাতে তারা আগের মতোই একধরনের সেলফ সেন্সরশিপ বা স্বনিয়ন্ত্রণ আরোপ করে রাখেন। উপরন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও যখন অব্যাহতভাবে গণমাধ্যমকে নানাভাবে হুমকি দেন বা সতর্ক করেন— সেটি যে ইস্যুতেই হোক না কেন, গণমাধ্যমের ওপর আরেক ধরনের চাপ তৈরি করে। ফলে এ চাপের মধ্যে থেকে কার সাহস হবে স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টার সমালোচনা করার?
প্রেস সচিব নিজেই একজন সাংবাদিক। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন এএফপির মতো আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থায়। সরকারি দায়িত্ব পালন শেষে তিনি হয়তো আবার সাংবাদিকতায় ফিরে যাবেন। ফলে তিনি সাংবাদিকদের সংকট ও মনবেদনা অন্য যে কারোর চেয়ে ভালো বোঝেন— তা নিয়ে সন্দেহ নেই। ফলে দেশের গণমাধ্যম তথা সাংবাদিকরা নির্ভয়ে, আনবায়াসড থেকে, বস্তুনিষ্ঠ তথ্য প্রচার করবে— এটি হয়তো তার আন্তরিক চাওয়া।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, গণমাধ্যমের ওপর যদি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কোনো চাপ তৈরি করে রাখা হয়; পক্ষে বললেই গণতান্ত্রিত আর বিপক্ষে গেলে ফ্যাসিবাদ— এইধরনের বয়ান দেয়া হয়, তাহলে সেই পরিবেশে একজন সাংবাদিককে যতই অভয় দেয়া হোক না কেন, তার পক্ষে হাত খুলে লেখা বা মন খুলে কথা বলা সম্ভব নয়। লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ এবং খণ্ডকালীন শিক্ষক, মিডিয়া ও জার্নলিজম ভিভাগ, ইউল্যাব, ঢাকা