নিজস্ব প্রতিবেদক: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, যদি কাউকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হতো– আমরা অবশ্যই বিষয়টি নিয়ে কাজ করতাম। কিন্তু এই পুরো বিষয়টি অনেকগুলো ইস্যুর সঙ্গে জড়িত। এই বিষয়ের সঙ্গে হাসিনার গত ১৫ বছরের পুরো সাংবাদিকতা জড়িত। আপনি এটাকে কীভাবে এড়িয়ে যাবেন!
সম্প্রতি তিনটি গণমাধ্যমে সাংবাদিককে চাকরিচ্যুতির ঘটনার পেছনে মবের হুমকি এবং তা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার, স্বৈরাচারের দোসর ট্যাগ করে কারও বিরুদ্ধে ‘মব’ (দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা) তৈরি হলে সরকার ঠেকাবে কিনা- প্রশ্ন করা হলে তিনি এ কথা বলেন।
শনিবার (৩ মে) রাজধানীর আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য ঢাকার অডিটরিয়ামে বিদেশি গণমাধ্যমে কর্মরত বাংলাদেশি সাংবাদিকদের সংগঠন বিজেআইএম আয়োজিত বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। প্রশ্নটি করেন কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাহেদ উর রহমান।
জবাবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, আপনি যাকে ‘মব’ বলছেন তার এই প্রতিবাদ করার অধিকার আছে কিনা। যে ছেলেগুলোর বিরুদ্ধে তারা প্রশ্ন তুলছে, সাংবাদিক যারা প্রশ্ন করলো তাদের বিষয়ে বলা হচ্ছে, যারা জুলাই-আগস্টে মারা গেছেন তাদের মৃত্যু নিয়ে এমন প্রশ্ন করা ঠিক হচ্ছে কিনা- তারা এটার প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। সেটাকে আসলে আপনি কি বলবেন?
তিনি বলেন, এখানে সরকার কি করতে পারে! প্রথম আলো, ডেইলি স্টারের ক্ষেত্রে আমরা পুলিশ পাঠিয়েছি। আমরা প্রত্যেক জায়গায় স্টেপ নিয়েছি। আমরা প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা জিজ্ঞেস করেছি, তারা অনিরাপদ বোধ করছেন কিনা। শফিকুল আলম বলেন, কেউ যদি বলে আমরা মার্চ করবো– এটাকে কীভাবে ক্রিমিনালাইজ করবেন।
জাহেদ উর রহমান বলেন, একটা প্রতিষ্ঠানকে হুমকি দেওয়া কি ফৌজদারি অপরাধ নয়? কারণ একটা আল্টিমেটাম দিয়েছে, আল্টিমেটাম দিয়ে আপনি তার ওপর চাপ তৈরি করছেন ক্রিমিনালাইজ করাসহ।
প্রেস সচিব বলেন, আমরা এটা নিয়ে ভেবেছি। এটা যদি এমন হতো একজনকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হচ্ছে– এরকম হলে অবশ্যই আমরা কাজ করবো। সরকার এখানে গুরুত্ব সহকারে ইস্যুগুলো দেখবে। কিন্তু এই পুরো বিষয় অনেকগুলো লিগ্যাসি ইস্যুর সঙ্গে জড়িত। এই পুরো বিষয়ের সঙ্গে হাসিনার গত ১৫ বছরের পুরো সাংবাদিকতা জড়িত। আপনি এটাকে কীভাবে এড়িয়ে যাবেন!
শফিকুল আলম বলেন, আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে— গত ১৬ বছর আমরা কী সাংবাদিকতা করেছি, এই সাংবাদিকতা আসলে আমাদের নিজেরা কিছু রিভিউ করা উচিত ছিল। আমাদের নতুন করে শুরু করা উচিত ছিল কিন্তু আমি তো সেটা করি নাই। ফলে এই ‘মব’ তৈরি হচ্ছে, কেউ এক ধরনের মার্চ করতে চাচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে যেখানে হুমকির বিষয় আসছে আমরা প্রত্যেক জায়গায় কাজ করছি। আমরা ফোন দিয়ে বলছি, কিছুদিন আগে একজন সাংবাদিককে আমি ব্যক্তিগতভাবে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করেছি— অনিরাপদ বোধ করছে কিনা। কোনও মিডিয়া বা পত্রিকা যদি মনে করে যে তাদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার প্রয়োজন আছে আমরা অবশ্যই লোক পাঠাচ্ছি। ৫ আগস্টের পর আমরা কোনও প্রতিষ্ঠান বন্ধ করি নাই, এটা আমাদের মূলনীতি। কোনও প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করেও আমরা কিছু বলিনি। আমরা বলেছি যে আমাদের সাংবাদিকতায় গত ১৬ বছরে ব্যর্থতা ছিল।
নিরাপত্তার জন্য যদি সরকারের ওপর নির্ভর করে থাকতে হয়, তাহলে আপনাদের কাছে থেকে নিরাপত্তা সুবিধা নিয়ে সেই বাহিনীর কিংবা কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহি করার জায়গা থাকবে কিনা- এমন প্রশ্নের প্রেক্ষিতে প্রেস সচিব বলেন, এই প্রশ্নের উত্তর আসলে কীভাবে দেবো। আপনারা অবশ্যই আমাদের জবাবদিহি করবেন। ধরেন অনেকগুলো মার্ডার হয়েছে। এটাকে কীভাবে থামাবো! আমাদের অনেক আইনি ম্যাকানিজম, আমার হাতে যন্ত্রপাতি নাই। এই জায়গায় যদি বলেন, এটা আমাদের ব্যর্থতা– আমি বলবো, হ্যাঁ। অনেকের ক্ষেত্রেই আমরা জানি একজন ভালো সাংবাদিক, তার বিরুদ্ধেও হত্যা মামলা দিয়ে দিচ্ছে একজন। একজন লোক সংক্ষুব্ধ হয়ে ২৬০-২৭০ লোকের বিরুদ্ধে একটা মামলা করে দিচ্ছে, সেক্ষেত্রে আমাদের পুরো পুলিশ প্রশাসন বা আমাদের পুরো আইনি কাঠামোতে এমন কোনও প্রক্রিয়া রাখতে পারছি না যে মামলা করা থেকে তাকে আটকায় রাখতে পারবো। এগুলো নিয়ে আরও বড় আলাপ-আলোচনার দরকার আছে। আমাদের বিচারিক ব্যবস্থার মধ্যে সর্ষের ভূত আছে। সেটাকে আমাদের ঠিক করতে হবে।
উদাহরণ দিয়ে প্রেস সচিব বলেন, একজন অধিকার কর্মীর বিরুদ্ধে একটা মামলা হয়েছিল। আমি এবং আমার কলিগ সারা রাত বসে কাজ করেছি যে কেন মামলা হলো তার বিরুদ্ধে। যিনি মামলা দিয়েছেন আমরা তাকে ধরে নিয়ে এসেছি। দেখলাম উনি একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত। জানতে চাইলাম, ব্যক্তিগতভাবে তাকে চিনেন কিনা, উনি চিনতে পারেন নাই কিন্তু নাম দিয়ে দিয়েছে হয়তো, সাজানো একটা মামলাৃ এখন কিছু কিছু উৎসাহী আছেন যারা এই পরিস্থিতির ফায়দা নিতে চাচ্ছেন। সুযোগের ফায়দা নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিপদে ফেলেছে। এটাকে অন্তর্বর্তী সরকার কীভাবে মোকাবিলা করবে, আমরা যেটা করতে পারছি আমরা কাউকে হয়রানি করছি না, গ্রেফতার করছি না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মামলাগুলো হয়েছে। তবে আমার কাছে মনে হয়— এই পুরো বিষয়গুলোর বীজ ছিল গত ১৬ বছরে আমাদের সাংবাদিকতার ব্যর্থতায়।
এর আগে সংবাদকর্মীদের চাকরি খেয়ে দেওয়ার মতো সমস্যা, পাওনা বেতন নিরসনে সরকার ভূমিকা রাখবে কিনা- প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের সরকারের একটা অন্যতম নীতি হচ্ছে এসব বিষয়ে কোনও প্রকার ইনফ্লুয়েন্স না করা। কারও চাকরি পাওয়া কিংবা চাকরি খাওয়ার পেছনে যদি আমাদের কারও মদত পাওয়া যায়, আমাদের নিয়ে লিখতে পারেন, আমরা স্বাগত জানাই। সম্প্রতি যে ৩ জন সাংবাদিক চাকরি হারালেন, কেন হারালেন, কোন প্রেক্ষিতে হারালেন– আমরা এখানে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করার জন্য সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি। এটা জানা উচিত সবার, কারণ এখানে বারবার আমাদের নাম টেনে আনা হচ্ছে। আমরা বলছি যে, এর সঙ্গে আমরা জড়িত না, এর মধ্যে আমরা যাই না। আমার কারণে কারও চাকরি চলে যাক— এটা আমি চাই না।