নিজস্ব প্রতিবেদক : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি (জাপা) অংশ নিলেও ভোটে নেই দলটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ। জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের সঙ্গে আসন নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে তার ‘অনুসারী’ হিসেবে চিহ্নিতরা এবার নির্বাচনে নেই। দলের ভেতরে কোণঠাসা হয়ে পড়া রওশন আনুষ্ঠানিকভাবে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তিনি এবার ভোট করছেন না। এ সময় জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে আসন দখলেরও অভিযোগ করেন তিনি। একইসঙ্গে জি এম কাদেরের সঙ্গে জোট না করতেও প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন রওশন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, রওশন এরশাদ নির্বাচনে না এলেও বিরোধী দল জাতীয় পার্টি তো ভোটে আছে। এরপর জি এম কাদেরের নেতৃত্বে হাফ ডজন নেতাকে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এবং দলটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করতে দেখা যায়। তবে এ বিষয়ে কোনও দলের পক্ষ থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। জাতীয় পার্টির ওপর ‘নিয়ন্ত্রণ হারানো’ এবং নির্বাচনে না আসা রওশন এরশাদও এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। গতকাল মঙ্গলবার (১২ ডিসেম্বর) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে নিজের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত কয়েকজন নেতাকে নিয়ে গণভবনে যান তিনি। এসময় সঙ্গে ছিলেন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা, রওশনের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ, কাজী মামুনুর রশীদ, সাদ এরশাদ ও তার স্ত্রীসহ আরও কয়েকজন নেতা।
বৈঠকের বিষয়ে মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, রওশন এরশাদ প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, যারা এরশাদের অনুসারী, দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় পার্টি করেন, তাদের মনোনয়ন দেওয়া হয়নি, আমাকেও মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। তারা বাসায় মনোনয়ন ফরম পৌঁছে দেওয়ার কথা বললেও তা করেনি। আমাদের যেসব লোক মনোনয়ন পায়নি, স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছে, তাদের জাতীয় পার্টি হিসেবে গ্রহণ করে তাদের সঙ্গে জোট করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবো। সাদ এরশাদ বলেন, আমরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে এবং দলীয় ব্যাপারে কথা বলতে গিয়েছি। দলের মধ্যে যে বোঝাপড়া নেই, দলকে যে ভাগ করা হয়েছে এটা প্রকাশ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এটা শুনে মনোক্ষুণ্ন হয়েছেন, কষ্ট পেয়েছেন। তিনি বলেন, জি এম কাদের ও মুজিবুল হক চুন্নু গণমাধ্যমের সামনে আমার মা ও আমাকে নিয়ে যেভাবে বক্তব্য রাখেন তা ঠিক না। এটা সবাই দেখেছেন। আমার মায়ের ‘চ্যাপ্টার ক্লোজ হয়ে গেছে’ এটাও বলেছেন। এটা কোনও নেতার বলা ভালো দেখা যায় না।
সাদ বলেন, পার্টিকে ভাগ করে ফেলেছেন জি এম কাদের। যেখানে মা বেঁচে আছে, আমিও সুস্থ। আমি রংপুর-৩ আসনের বর্তমান এমপি। আমাকে মনোনয়ন না দিয়ে উনি দাঁড়িয়েছেন। এটা ঠিক করেন নাই। প্রধানমন্ত্রী আমাদের কথা শুনেছেন। নিজেদের ‘জাতীয় পার্টির মূল’ দাবি করে তিনি বলেন, রওশন এরশাদ ও সাদ এরশাদ যদি না থাকে তাহলে জাতীয় পার্টি কোথায়? তাহলে তো জি এম কাদেরের কাছে চলে যাবে। রওশন এরশাদের নেতৃত্বে থাকা নেতাদের পরবর্তী পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে সাদ বলেন, দল গোছাবো, জনগণের সঙ্গে থাকবো। জাতীয় পার্টি কি সম্মেলন করবে–এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা সময় হলে দেখা যাবে। গণভবন থেকে বেরিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে রওশন এরশাদ বলেছেন, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেননি। আমার ছেলের জায়গায় উনি ইলেকশন করছেন। ওর কথা তার মনে নাই। জাতীয় পার্টির নেতাদের প্রতি সমর্থনের বিষয়ে জানতে চাইলে রওশন বলেন, আমাদের ইচ্ছা করে বাদ দিয়েছে। কেন সমর্থন থাকবে? এর আগে গত ১৯ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন রওশন এরশাদ। এরপর জি এম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেয়। তবে দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত রওশনপন্থি নেতাদের সেভাবে সক্রিয় হতে দেখা যায়নি। এর মধ্যেই গত ৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবনে যান জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের, কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। ৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আবারও গণভবনে যান জি এম কাদের, আনিসুল ইসলাম মাহমুদসহ ছয়জন কো-চেয়ারম্যান ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। ওই দিন আওয়ামী লীগের এক নেতার গুলশানের বাসায় দলটির হাফ ডজন নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন জাতীয় পার্টির দুই নেতা। আওয়ামী লীগের সভাপতি ও দলটির নেতাদের সঙ্গে জাতীয় পার্টির নেতাদের বৈঠক নিয়ে সরাসরি কিছু জানায়নি দল দুটি। তবে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় পার্টির নেতাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল নির্বাচনে আসন ছাড় বা সমঝোতা চাওয়া। কিন্তু আওয়ামী লীগের কাছ থেকে এ ব্যাপারে কোনও নিশ্চয়তা মেলেনি। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অংশগ্রহণ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীদের বিপক্ষে জিতে আসতে বলা হয়েছে। জাতীয় পার্টির সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে ৬ ডিসেম্বর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, রাজনীতির ভিন্নমত থাকাটাই হচ্ছে গণতন্ত্র। একমত হতে না পারাটাও গণতন্ত্র। ১৪ দলের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, দুই-একদিনের মধ্যে আসনের বিষয়টি ঠিক হবে। আর জাতীয় পার্টি একসময় আমাদের মহাজোটে ছিল। তারা নির্বাচন করছে। সুতরাং আলোচনা হওয়ার আগে কিছু বলা সম্ভব নয়। এর আগের দিন মঙ্গলবার জোটগতভাবে নির্বাচন কথা জানিয়ে ১৪ দলের মুখপাত্র ও সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু বলেছিলেন, জাতীয় পার্টির সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে ১৪ দলের শরিকদের আসন ভাগাভাগি নির্ধারিত হবে। জোটের আসন বিন্যাস ও প্রার্থী চূড়ান্ত করতে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।