প্রত্যাশা ডেস্ক : গাজীপুরের পর এবার বরিশাল ও খুলনা সিটি করপোরেশনে নির্বাচনি পরীক্ষায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। একই সঙ্গে জনপ্রিয়তা প্রমাণের লড়াইয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
এ দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আজ ভোট গ্রহণ। এর মধ্য দিয়ে ইসি ও সরকারি দলের গ্রহণযোগ্যতা কতটা তা অনেকটাই ফুটে উঠবে। যদিও দুই সিটি করপোরেশনেই মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ভালো অবস্থানে আছেন।
বিএনপি অংশ না নেওয়ায় দুই সিটিতেই সরকারি দলের প্রার্থীর সামনে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। তবে বরিশালে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কোন্দলে নৌকার প্রার্থী আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ (খোকন সেরনিয়াবাত) চাপের মুখে আছেন।
অপরদিকে খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অনেকটাই নির্ভার তালুকদার আব্দুল খালেক। তিনি ছাড়া মেয়র পদে শক্তিশালী প্রার্থী না থাকায় এ সিটিতে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার আশঙ্কা স্থানীয়দের মধ্যে। যদিও প্রচারণার শেষ দুদিনে কাউন্সিলর প্রার্থীদের তৎপরতায় এ নির্বাচনে ভোটারদের মধ্যে আগ্রহ অনেকটাই বেড়েছে।
খুলনা ও বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গত শনিবার মধ্যরাতে প্রচার শেষ হয়েছে। গত ২৬ মে থেকে শনিবার পর্যন্ত ১৬ দিন টানা প্রচার চালিয়েছেন প্রার্থীরা। শেষ দিনে দুই নগরীই প্রচারে জমজমাট হয়ে ওঠে। শেষ দিনে বিশাল জনসমাগম করার মধ্য দিয়ে অনেক প্রার্থী তাদের অবস্থান জানান দেন।
এদিন দুই সিটিতেই আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় সরব ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেটরাও। আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে দুই সিটিতেই বেশ কয়েকজন প্রার্থীকে জরিমানা করা হয়।
এদিকে প্রচার শেষ হওয়ার পর ভোটাররা এখন ভোট দেওয়ার অপেক্ষায় আছেন। দুই সিটিতেই ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট গ্রহণ করা হবে। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে বসানো হয়েছে সিসি ক্যামেরা। নির্বাচন ভবন থেকে সিসি ক্যামেরায় সরাসরি ভোটগ্রহণ কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করবে নির্বাচন কমিশন। পাশাপাশি ভোটগ্রহণ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে নিজস্ব পর্যবেক্ষক পাঠিয়েছে ইসি। তারাও সরাসরি কমিশনকে পরিস্থিতি জানাবে।
সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তাদের দপ্তর সূত্র জানিয়েছে, বরিশাল সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে সাতজন ও খুলনায় পাঁচজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। দুই সিটিতে আওয়ামী লীগ ছাড়াও জাতীয় পার্টি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও জাকের পার্টির প্রার্থী রয়েছেন। বিএনপি এ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। তবে দুই সিটিতে তাদের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী কাউন্সিলর পদে ভোট করছেন।
দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় তাদের দল থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। পাঁচ লাখ ৩৫ হাজার ৫২৯ জন ভোটারের খুলনা সিটি করপোরেশনে ৩১টি সাধারণ ও ১০টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড রয়েছে। সাধারণ ওয়ার্ডে ১৩৬ জন ও সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ৩৯ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। যদিও এ সিটিতে দুজন সাধারণ কাউন্সিলর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আগেই জয়ী হয়েছেন।
খুলনায় সিটিতে ২৮৯টি ভোটকেন্দ্র ও ১৭৩২টি ভোটকক্ষ রয়েছে। অপর দিকে দুই লাখ ৭৬ হাজার ২৯৮ জন ভোটার অধ্যুষিত বরিশাল সিটি করপোরেশনে ৩০টি সাধারণ ওয়ার্ডে ১১৮ জন ও ১০টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ৪২ জন প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছেন। এ সিটিতে একজন সাধারণ কাউন্সিলর বিনা ভোটে জয়ী হয়েছেন। এখানে ১২৬টি ভোটকেন্দ্র ও ৮৯৪টি ভোটকক্ষ রয়েছে।
প্রচারের শেষ দিনে খুলনায় আচরণবিধি লঙ্ঘন: প্রচার-প্রচারণার শেষ দিনে প্রার্থীদের পক্ষে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিভিন্ন ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থীদের মিছিল, সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পালটাধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় কয়েকজনকে জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। দিনভর নগরীতে পুলিশ-বিজিবি-র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের টহল ছিল চোখে পড়ার মতো। সরেজমিন দেখা গেছে, শনিবার সকাল থেকে প্রার্থীদের পক্ষে কর্মী-সমর্থকরা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে মিছিল করেন।
এসব মিছিল পুলিশ লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। শনিবার নগরীর ৫নং ওয়ার্ড এলাকা থেকে মিছিল বের করেন হাতপাখা প্রতীকের মেয়র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা। এসময় দৌলতপুর থানা পুলিশ তাদের লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে তিন হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
এছাড়া নগরীর ৪নং ওয়ার্ডেও প্রার্থী কবির হোসেন কবু মোল্লা এবং জামিরুল ইসলামকে মিছিল বের করার অপরাধে তিন হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়। সোনাডাঙ্গা থানা এলাকার মধ্যে ১৭নং ওয়ার্ডে হাফিজুর রহমান হাফিজকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় মোবাইল কোর্টে। ৬নং ওয়ার্ডে মিজানুর রহমান তরফদার এবং শামসুদ্দিন আহমেদ প্রিন্সকে একই অপরাধে তিন হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
অন্যদিকে নগরীর ১৬নং ওয়ার্ডে নিউ মার্কেটের পেছনের রাস্তায় কাউন্সিলর প্রার্থী আনিসুর রহমান বিশ্বাস এবং হাসান ইফতেখার চালুর কর্মী-সমর্থকের মধ্যে ধাওয়া-পালটাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। গতকাল বিকালে এ দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা যায়।
এ বিষয়ে আনিসুর রহমান বিশ্বাস বলেন, চালুর লোকজন ভোটারদের টাকা দিচ্ছিল। এ বিষয়ে আমার লোকজন বাধা দিতে গেলে তারা আমার কর্মী-সমর্থকের ওপর চড়াও হয়। ইফতেখার চালু বলেন, পরিকল্পিতভাবে আমার কর্মীদের ওপর হামলা চালায় আনিসের লোকজন। সেখানে ভোটারদের কোনো টাকা দেওয়া হচ্ছিল না। কেসিসি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দিন বলেন, প্রার্থীদের মধ্যে আইন ভাঙার প্রবণতা রয়েছে। আমরা এগুলো কঠোরভাবে দমন করছি। কোথাও কোনো অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে যা প্রয়োজন তাই করা হবে। কেএমপি পুলিশ কমিশনার মো. মাসুদুর রহমান ভূঞা জানান, আজ রোববার সকাল ৮টা থেকে ১২ জুন পূর্ণাঙ্গভাবে এবং ১৩ জুন আংশিকভাবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হবে। পুলিশের চার হাজার ৮২০ জন, আনসার সদস্য তিন হাজার ৪৬৮ জন, ১৬ প্লাটুন বিজিবিতে ৩২০ জন, সাদা পোশাকে ১৯৫ জন, ডিবি পুলিশের আটটি টিম, র্যাবের ১৬টি টিমে ১০৭ জন মাঠে থাকবে। তিনি আরও বলেন, সব ওয়ার্ডে সমান গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তবে বেশ কিছু ওয়ার্ডে কয়েকজন কাউন্সিলর প্রার্থীকে সংশ্লিষ্ট থানায় ডেকে নিয়ে পরিবেশ সুষ্ঠু রাখার বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
শেষ দিনে শোডাউনের নগরী বরিশাল: প্রচারণার শেষ দিনে শনিবার নগরবাসীর ভোট টানতে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন প্রার্থীরা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভোটারদের মন জয়ে চালিয়েছেন নানান কর্মসূচি। লিফলেট নিয়ে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে করেছেন ভোট প্রার্থনা। তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের (নৌকা) প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাত বরিশাল নগরীর বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ করেছেন। বিকালে নৌকার পক্ষে নগরীতে বিশাল শোডাউন করেছেন ১৪ দলের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা।
জাতীয় পার্টির (লাঙ্গল) প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার ইকবাল হোসেন তাপস নগরীতে বিশাল শোডাউন করেন। ইসলামী আন্দোলনের (হাতপাখা) প্রার্থী মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীমের সমর্থকরাও অশ্বিনী কুমার হলের সামনে শোডাউনে অংশ নেন। প্রচার-প্রচারণার শেষ দিনে বরিশাল শোডাউনের নগরীতে পরিণত হয়। শনিবার দুপুরে নগরীর নবগ্রাম রোডে গণসংযোগ করেন নৌকার প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাত। এ সময় খোকন বলেন, বরিশালের সার্বিক উন্নয়নের জন্য নৌকা মার্কার বিকল্প নেই। নির্বাচনে বিজয়ী হলে বরিশালকে স্মার্ট নগরী হিসাবে গড়ে তোলা হবে। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট বলরাম পোদ্দার, বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি অ্যাডভোকেট আফজালুল করীম প্রমুখ। বিকালে নগরীর সদর রোডে বিশাল শোডাউন করেন জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপস। এর আগে নগরীর ভাটারখাল এলাকায় গণসংযোগকালে তাপস সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচন নিয়ে সংশয় কাটেনি। শুক্রবার রাতে ১নং ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদককে হুমকি দিয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা বলেছেন, ‘কেন্দ্রে গেলে মেরে ফেলব। খবর পেয়েছি আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে রসুলপুরের বাসিন্দাদের দুই হাজার টাকা করে দিচ্ছে। নৌকার পক্ষে সরকারের কয়েকটি বিভাগ কাজ করছে। আওয়ামী লীগের প্রার্থীই চান না বরিশালে সুষ্ঠু ভোট হোক।’ এসময় তাপসের সঙ্গে ছিলেন অ্যাডভোকেট মহসিন উল ইসলাম হাবুল, কেন্দ্রীয় নেতা এসএম রহমান পারভেজ প্রমুখ।
এদিকে ভোটের মাঠের পরিবেশ সুষ্ঠু ও সুন্দর রয়েছে বলে জানিয়েছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম। স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল আহসান রুপন দুপুরে বরিশাল প্রেস ক্লাবে ৩০ দফা ইশতেহার ঘোষণা করেছেন। ইশতেহারে তিনি বরিশালের বিভিন্ন উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ সময় তিনিও নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
র্যাবের কঠোর হুঁশিয়ারি: নির্বাচনে সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে যে কোনো অপতৎপরতা কঠোরভাবে দমন করার হুঁশিয়ারি দিয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-৮)। শনিবার দুপুরে বরিশাল নগরের রূপাতলীর র্যাব-৮ এর সদর দপ্তরে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এ হুঁশিয়ারি দেন অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাহামুদুল হাসান। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী শনিবার সকাল ৬টা থেকে র্যাব-৮ এর সদস্যরা স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসাবে দায়িত্ব পালন করছে। নির্বাচনে নগরের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে ১৬টি টিম থাকবে। এছাড়া শহরে প্রবেশ ও বাইরের পথসহ বিভিন্ন স্থানে র্যাবের চেকপোস্ট স্থাপন করা হয়েছে। সাদা পোশাকে গোয়েন্দারা কাজ করছে। যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি রয়েছে।
পাঁচ জামায়াত নেতা আটক: বরিশাল নগরী থেকে জামায়াতের ৫ নেতাকে আটক করেছে পুলিশ। শুক্রবার দিনগত গভীর রাতে তাদের আটক করা হয় বলে মহানগর পুলিশের কাউনিয়া থানার ওসি জানিয়েছেন।