বিশেষ সংবাদদাতা : খাদ্যদ্রব্যের লাগাতার মূল্যবৃদ্ধির কবলে পড়ে অসহনীয় চাপের মুখে রয়েছেন দেশের প্রায় ১৪ কোটি ৫৩ লাখ ৪৩ হাজার মানুষ, যা মোট জনসংখ্যার ৮৮ ভাগ। সম্প্রতি বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) প্রকাশিত এক জরিপ প্রতিবেদনে এমন তথ্যই উঠে এসেছে। প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, দেশের প্রায় ১১ কোটি ২৩ লাখ মানুষ তিন বেলা খাবার জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছেন। এই সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৬৮ শতাংশ। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগের মানুষ সবচেয়ে বেশি দুরবস্থায় রয়েছেন। আর সিলেটের মানুষ দুরবস্থায় পড়েছেন সাম্প্রতিক বন্যার কারণে।
তবে খাদ্যদ্রব্যের লাগাতার মূল্য বৃদ্ধির কবলে পড়া সাড়ে ১৪ কোটির মধ্যে ৫০ লাখ মানুষ সরকারের খাদ্য সহায়তা কর্মসূচির আওতায় রয়েছে। তারা সরকারিভাবে কম দামে খাদ্য কিনতে পারলেও এ কর্মসূচির বাইরে রয়েছেন বাকি মানুষ। যাদের সরকারি খাদ্য সহায়তা পাওয়া অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এ অবস্থা সামাল দিতে সরকারের পক্ষ থেকে ‘জাতীয় ত্রাণ তহবিল’ গঠনসহ দীর্ঘমেয়াদি খাদ্য সহায়তা চালুর তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) বাংলাদেশের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকটের মুখে বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষকে খাদ্য সহায়তা দিতে অন্তত একবছরের জন্য জরুরি ত্রাণ বা খাদ্য তহবিল গঠন করা প্রয়োজন। একইসঙ্গে ওএমএস বা সরকারের চলমান খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ব্যপ্তি আরও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এদিকে ডব্লিউএফপির ওই প্রতিবেদনে থাকা তথ্য-উপাত্ত ও সুপারিশ বিশ্লেষণ করে করণীয় নির্ধারণে কাজ শুরু করেছে সরকার। স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর চলমান চাপ এবং বিশ্বজুড়ে আসন্ন দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা মাথায় রেখে খাদ্য সহায়তা কার্যক্রম তথা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বৃদ্ধির বিষয়ে ভাবছে সরকার। এ নিয়ে সরকারের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ মূল্যায়ন কমিটি- এফপিএমসির আগামী বৈঠকে সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে জানা গেছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বাধীন এই কমিটির সদস্য, খাদ্যসচিব মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘সরকারের খাদ্য পরিধারণ ও মূল্যায়ন কমিটির সভায় খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়া ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাড়ানোর বিষয়টি তোলা হবে। সেখানে অনুমোদন পেলে গরিব মানুষের জন্য খাদ্যসহায়তা কার্যক্রম আরও বাড়ানো হবে।’
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, খোলাবাজারে কম দামে চাল বিক্রি ও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় দেশের ৫০ লাখ দরিদ্র মানুষকে কম দামে খাদ্যসহায়তা প্রদান কর্মসূচি চলমান রয়েছে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) জরিপভিত্তিক ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দেশের ৬৮ শতাংশ মানুষের কাছে খাবার কেনার অর্থ যোগানো এখন সবচেয়ে বড় দায় হয়ে পড়েছে। খাবার কিনতে সম্পদ বিক্রি করছেন ৬৪ ভাগ মানুষ। এর বড় অংশ খাদ্য কিনতে ঋণ করছেন।
জরিপের বিষয়ে ডব্লিউএফপি জানায়, মানুষের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, বিগত ছয় মাসে তাদের ওপর বড় আঘাত কী। জবাবে ৮৮ শতাংশ মানুষ খাদ্যের চড়া দামকে বড় আঘাত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আরও তিনটি বিষয় বড় আঘাত হিসেবে উঠে এসেছে রোগ ও চিকিৎসা ব্যয়, তেলের দাম ও পরিবহন ব্যয় এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ। খাবার কিনতে হিমশিম খাওয়া মানুষের হার ৬৮ শতাংশ। সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছেন সিলেট ও বরিশাল বিভাগের মানুষ। আর সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আছেন ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম বিভাগের অধিবাসীরা। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির ‘বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তা ও বিপন্নতা পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি করা হয়েছে ১ হাজার ২০০ মানুষের ওপর জরিপ চালিয়ে। গত মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়ে আটটি বিভাগের এসব মানুষের তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সামগ্রিকভাবে দেশের ২২ শতাংশ মানুষ মাঝারি মাত্রায় খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন (আগস্টে)। হারটি আগের মাস জুলাইয়ের চেয়ে কম। ওই মাসে ২৯ শতাংশ মানুষ মাঝারি মাত্রায় খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ছিলেন। আর নি¤œ আয়ের ৪২ শতাংশ পরিবারের জীবনযাত্রা এবং খাদ্য পরিস্থিতির সব ক্ষেত্রে অবনতি হয়েছে। এই পরিস্থিতির জন্য মূলত খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দেওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং রোগ-বালাইয়ের মতো স্বাস্থ্যসমস্যা বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করা হয়েছে।
জরিপে আগস্ট মাসের পরিস্থিতি তুলে ধরতে গিয়ে বলা হয়, ওই মাসে পরিবারের খাদ্য কেনার জন্য ৬৪ শতাংশ মানুষ ঋণ নিয়েছেন। ২৯ শতাংশ পরিবার তাদের সঞ্চয় ভেঙেছে। আবার খাবার কিনতে গিয়ে ১০ শতাংশ পরিবার তাদের গত ১২ মাসের সব সঞ্চয় ভেঙে ফেলেছে। সবচেয়ে চাপে আছেন সিলেট ও বরিশাল বিভাগের মানুষ, হার ৭৫ শতাংশ।
সিলেট ও বরিশালে সংকট বেশি কেন, সেই ব্যাখ্যাও দেওয়া হয় প্রতিবেদনে। বলা হয়, সিলেট বিভাগের মানুষ এখনো বন্যার ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেননি। চলতি বছরের মে মাসের ওই বন্যায় সিলেট বিভাগের তিন চতুর্থাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। বিপুল পরিমাণ ধান নষ্ট হয়। বোরো মৌসুমের ওই ধান হচ্ছে দেশের হাওরপ্রধান সিলেট বিভাগের কৃষকদের বছরের একমাত্র ফসল।
অন্যদিকে বরিশাল বিভাগের দারিদ্রের হার বেশি। খাদ্যপণ্য ও জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ার আঘাত সেখানকার মানুষের ওপরে সবচেয়ে বেশি পড়েছে। সেই সঙ্গে অনাবৃষ্টির কারণে ফসল নষ্ট হওয়া ওই সংকটকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রতিবেদনে বলা হয়, নি¤œ ও মধ্যম আয়ের পরিবারগুলো নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়াসহ নানা ধরনের চাপ সামলাতে পারছে না। এসব সমস্যা তাদের ভবিষ্যতের বড় সংকট মোকাবিলার সামর্থ্য কমিয়ে দিচ্ছে। তবে ধনী ও সচ্ছল পরিবারগুলো খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়াসহ অন্যান্য সমস্যায় তেমন কোনো অসুবিধায় পড়েনি।
খাদ্যসংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের নেওয়া নানা উদ্যোগের চিত্র তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, বেসরকারি খাতে চালের সরবরাহ বাড়াতে ও দাম কমাতে সরকার আমদানি শুল্ক কমিয়ে দিয়েছে। বেসরকারি খাতের মাধ্যমে ১২ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সরকারিভাবে রাশিয়া ও ভিয়েতনাম থেকে গম ও চাল আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ৫০ লাখ গরিব মানুষের জন্য বিশেষ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি শুরু করেছে সরকার। সরকারের নেওয়া এতসব উদ্যোগের পরেও চাল ও গমের দাম যেমন বেড়েছে, তেমনি সবজি, ডিম, ডাল, মাছ, চিনি, পেঁয়াজ, আদা, রসুন ও হলুদের দাম নিয়মিতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। জুলাই ও আগস্টে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। মূল্যস্ফীতির ওই চাপ সামলাতে নি¤œবিত্ত ও মধ্যম আয়ের মানুষ খাদ্য কেনার পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছেন।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, নি¤œ আয়ের পরিবারগুলো খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়া এবং আয় কমে যাওয়ায় নানাভাবে সাশ্রয়ের চেষ্টা করছে। যেমন অন্য সবজির দাম বেড়ে যাওয়ায় বেশির ভাগ মানুষ আলু খাওয়ার পরিমাণ বাড়িয়েছেন। ঢাকার বাইরের বেশির ভাগ বিভাগের অধিবাসীরা স্থানীয়ভাবে কিছুটা হলেও মাছ ও সবজি সংগ্রহ করতেন (আবাদ ও মুক্ত জলাশয় থেকে সংগ্রহ)। এ বছর বৃষ্টি কম হওয়ায় এবং চরম আবহাওয়া থাকায় সেই সুযোগ কম ছিল।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশনা অনুযায়ী, আট ধরনের প্রাণিজ আমিষে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে পুষ্টিকর উপাদান আছে। ওই নির্দেশনা তলে ধরে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রতিবেদন বলছে- মাছ, মাংস, সামুদ্রিক খাবারসহ পুষ্টিকর উপাদানসমৃদ্ধ খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে পারছে মাত্র ১৭ শতাংশ পরিবার। বাকিরা পারছে না। সাধারণভাবে শিশু, গর্ভবতী মা ও অপুষ্টিতে ভোগা নারীদের এ ধরনের পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিত। এই খাবারগুলো তাদের নিয়মিতভাবে না পাওয়া আশঙ্কাজনক।
খাদ্য মূল্যবৃদ্ধির চাপে সাড়ে ১৪ কোটি মানুষ
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ