ঢাকা ১০:৩৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫

খাদ্যবর্জ্যও পরিবেশদূষণের কারণ

  • আপডেট সময় : ০৮:০৯:১৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫
  • ৪ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগৃহীত

মৃত্যুঞ্জয় রায়

প্রতি বছর খাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিতরণ, বিপণন, প্রস্তুত, পরিবেশন ও ভোগের ক্ষেত্রে বিশ্বে মোট উৎপাদিত খাদ্যের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ খাদ্য নষ্ট হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী বার্ষিক খাদ্য অপচয়ের পরিমাণ নিরূপিত হয়েছে প্রায় ৯৩১ মিলিয়ন টন, যা মাথাপিছু ১২১ কেজি খাদ্যের সমান। প্রধানত তিনটি পর্যায়ে খাদ্যের অপচয় ঘটছে- গৃহস্থালি পর্যায়ে ৬১ শতাংশ, খাদ্য পরিষেবা বা ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে ২১ শতাংশ ও খুচরা বিক্রির পর্যায়ে ১৩ শতাংশ। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য পরিমাণে খাদ্যের অপচয় ঘটছে খাওয়ার সময় বা পরে। খাদ্যের অপচয় ও খাদ্য-আবর্জনা বা বর্জ্য থেকে ঘটছে পরিবেশদূষণ। এ থেকে বছরে প্রায় ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নির্গত হয়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে মিশছে। কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে বৃদ্ধির অর্থ হলো বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে বিশ্বের জলবায়ুর ওপর। এ দেশে এত দীর্ঘ সময় ধরে কখনো বৃষ্টি দেখা যায়নি; যা হচ্ছে ওই জলবায়ু পরিবর্তনেরই প্রভাব।
গত বছর রয়্যাল সোসাইটি অব কেমিস্ট্রির সাসটেইনেবল ফুড টেকনোলজি জার্নালের একটি সংখ্যায় খাদ্যের অপচয় যে পরিবেশের ওপর কতা প্রভাব ফেলছে, সে সম্পর্কে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। সে গবেষণাপত্রটির শীর্ষ লেখক ও গবেষক ছিলেন কীর্তিকা কোহলিসহ আরও পাঁচজন। সাম্প্রতিক সে গবেষণায় তারা দেখেছেন যে প্রতি বছর শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই প্রায় ১০৮ বিলিয়ন পাউন্ড খাদ্যের অপচয় হয়; যার মূল্য প্রায় ৪০৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং যা দেশটির মোট বার্ষিক খাদ্য উৎপাদনের প্রায় ৪০ শতাংশ। শুধু যুক্তরাষ্ট্রের রেস্তোরাঁগুলোতেই বছরে ২২ থেকে ৩৩ বিলিয়ন পাউন্ড খাদ্যের অপচয় হয়। একই সময়ে সে দেশে ৩৮ মিলিয়ন মানুষ ক্ষুধায় ভুগছে। এসব খাদ্যবর্জ্য যায় কোথায়? সে দেশে এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ যায় ভূমি ভরাটে। মোট ভূমি ভরাটের প্রায় ২৪ শতাংশ ভরাট করা হয় এসব খাদ্যবর্জ্য দিয়ে; যেখান থেকে নির্গমন ঘটে মিথেন গ্যাসের। আর একটি অংশকে দহনকৃত পৌর কঠিন বর্জ্যে পরিণত করা হয়, যার পরিমাণ প্রায় ২২ শতাংশ। এসব খাদ্যবর্জ্য থেকে প্রতি বছর প্রায় ৪ দশমিক ৪ গিগা টন কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হয়; যা মানবসৃষ্ট গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের প্রায় ৮ শতাংশ।

ওই অতিরিক্ত খাদ্য অপচয় ও বর্জ্য টেকসই পরিবেশ ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের পথে একটি বড় বাধা। আমাদের যতটুকু খাদ্য দরকার বা যতটুকু আমরা গ্রহণ করতে পারি, শুধু যদি হিসাব কষে কোনো খাদ্যের অপচয় না করে উৎপাদন করতে পারতাম তাহলে শুধু খাদ্য খাওয়ার পরে না, খাওয়ার আগেও পরিবেশদূষণ অনেক কমে যেত।

প্রতি বছর পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই প্রচুর খাদ্য সরবরাহের জন্য প্রচুর পরিমাণে খাদ্য উৎপাদন করতে হয়। ফসল ফলাতে কৃষককে বিপুল পরিমাণে প্রাকৃতিক সম্পদ; যেমন- মাটি ও পানি ব্যবহার করতে হয়। এতে একদিকে যেমন প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর চাপ পড়ে, অন্যদিকে তেমনি এর প্রভাব পড়ে অর্থনীতি ও পরিবেশের ওপর। ফসল চাষ তথা খাদ্য উৎপাদন করতে গিয়ে এর সঙ্গে যুক্ত হয় সার ও বালাইনাশকের মতো পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য।

অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ যেমন বিশ্বব্যাপী স্থূলতা ও অসুস্থতা বাড়াচ্ছে, তেমনি পরিবেশের ক্ষতিও বাড়ছে। খাদ্যের অপচয় কমিয়ে আনা গেলে এসব ক্ষতির পরিমাণ অবশ্যই কমানো যেত। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সূত্র মতে, মোট ফসলি জমি, পানি ও সারের ২৩ থেকে ২৪ শতাংশ ব্যবহৃত হয় অপচয় করা খাদ্য উৎপাদনে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া ও চীনের পরিসংখ্যানও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আলাদা কিছু নয়। চীনে প্রতি টন গৃহস্থালি বর্জ্য থেকে ২৫০০ কেজি সমতুল্য কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপাদিত হচ্ছে, ইউরোপে খাদ্য অপচয়ের কারণে বার্ষিক আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৬০ বিলিয়ন ডলার এবং অস্ট্রেলিয়ায় অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদনের কারণে বছরে প্রায় ৫৭ হাজার ৫০৭ গিগাগ্যালন কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হচ্ছে। ডেনমার্কে বছরে প্রায় ৭ লাখ টন খাদ্যের অপচয় হয়। এশিয়ার অবস্থা ওসব দেশের চেয়েও খারাপ। বিশ্বে মোট খাদ্য অপচয়ের ২৫ শতাংশ ঘটে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে। শুধু সিঙ্গাপুর থেকেই বছরে প্রায় ৮০ লাখ টন খাদ্যবর্জ্য তৈরি হয়, মালয়েশিয়া থেকে প্রতিদিন হয় ৩৮ হাজার টন। খাদ্যবর্জ্য থেকে শুধু যে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নির্গমন হচ্ছে তা নয়। সেখান থেকে নির্গমন ঘটছে মিথেন, হাইড্রোজেন ও অন্যান্য গ্যাস; যা পরিবেশের ক্ষতি করছে। এগুলোয় দূষিত হচ্ছে বায়ু, পানি, মাটি ইত্যাদি। তাই যেকোনোভাবে হোক না কেন, খাদ্য অপচয় ও খাদ্যবর্জ্য উৎপাদন কমানোর ব্যাপারে আমাদের সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে।
খাদ্যের অপচয় কমাতে আমরা যে কাজগুলো করতে পারি, তা হলো-

১. শুরু করতে হবে নিজের ও পরিবারের কাছ থেকেই। খাওয়ার সময় এমনভাবে থালায় খাবার নেওয়া উচিত যতটুকু আমরা খেতে পারি ও যে খাদ্য যতটুকু খেলে আমরা সুস্থ থাকব, সেটুকু নেওয়া। অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ অসুস্থতা ও খাদ্যবর্জ্য তৈরির অন্যতম কারণ। প্রতিটি পরিবারের উচিত হবে এক সপ্তাহের একটি চমৎকার সঠিক খাদ্য-চাহিদার পরিকল্পনা তৈরি করে অতিরিক্ত খাদ্য কেনা ও রান্না করা থেকে বিরত থাকা।

২. খাবার বা মুদিদোকানে খাদ্য কিনতে যাওয়ার আগে নির্দিষ্ট খাদ্যের চাহিদা এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী তালিকা ও পরিমাণ ঠিক করে কিনতে যেতে হবে, অতিরিক্ত খাদ্য কিনে ঘরে রেখে পচানোর পর ফেলে দেওয়া কোনো বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না। এমনকি খাদ্য কিনতে যাওয়ার আগে রেফ্রিজারেটরে বা ভাড়ার ঘরে খাদ্যের মজুত পরীক্ষা করে সে অনুযায়ী কেনার পরিমাণ ও পণ্য সমন্বয় করতে হবে।

৩. কেনার পর সেগুলো যাতে নষ্ট না হয় সে জন্য উপযুক্ত স্থানে ভালোভাবে মজুত করতে হবে। মাঝে মাঝে সেগুলো পরীক্ষা করে দেখতে হবে। মনে রাখা উচিত যে এক থোকা আঙুরের মধ্যে দুটি আঙুর পচলে পরদিন তা আরও অনেক আঙুর পচার কারণ হতে পারে।

৪. এসব বিষয়ে সমাজভিত্তিক আলোচনা ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি নিতে হবে। এক্ষেত্রে তরুণ সম্প্রদায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

৫. খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা ও পরিবেশকেরা প্রায় এক-তৃতীয়াংশ খাদ্যবর্জ্য উৎপাদনের জন্য দায়ী, এমনকি রেস্তোরাঁ ও হোটেলগুলোও। খাদ্য ও শিল্প প্রশাসন এ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ ও প্রয়োজনে আইন ও নীতি প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে পারে। রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়ার পর রয়ে যাওয়া অতিরিক্ত খাবার নষ্ট না করে বা ফেলে না দিয়ে ক্রেতাদেরই প্যাকেট করে দিলে তার সদ্ব্যবহার হতে পারে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াসহ এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রায় ৫৩৬ মিলিয়ন মানুষ ঠিকমতো খাবার পায় না। কিছু অভুক্ত মানুষকে খেতে দিলে সেগুলো অন্তত খাদ্যবর্জ্যে পরিণত হবে না।

৬. সমাজবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও গবেষকরা এ বিষয়ে একটি টেকসই মডেল ও উপায় নির্ধারণে কাজ করতে পারেন। সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তর, খাদ্য অধিদপ্তর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, সমাজসেবা অধিদপ্তর ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান এ কাজে সমন্বিতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আগে দরকার যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি সাম্প্রতিক সময়ের গবেষণা, যার মাধ্যমে আমাদের বর্তমান বাস্তব চিত্রটি ফুটে উঠবে, আমরা বুঝতে পারব যে আসলে আমাদের খাদ্য উৎপাদন ও অপচয়ের অবস্থাটা কী এবং কী কী পদক্ষেপ আমাদের নিতে হবে। সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত ছাড়া কোনো কার্যকর পরিকল্পনা করা যায় না। উৎপাদক, ব্যবসায়ী বা বিক্রেতা, ক্রেতা বা ভোক্তাদের আচরণগত পরিবর্তন না হলে শুধু পরামর্শে খুব একটা কাজ হবে না। সেটা কীভাবে করা যায়, সে রোডম্যাপ ও সুনির্দিষ্ট সময়সীমা আমাদেরই ঠিক করতে হবে।

লেখক: কৃষিবিদ ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

খাদ্যবর্জ্যও পরিবেশদূষণের কারণ

আপডেট সময় : ০৮:০৯:১৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫

মৃত্যুঞ্জয় রায়

প্রতি বছর খাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিতরণ, বিপণন, প্রস্তুত, পরিবেশন ও ভোগের ক্ষেত্রে বিশ্বে মোট উৎপাদিত খাদ্যের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ খাদ্য নষ্ট হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী বার্ষিক খাদ্য অপচয়ের পরিমাণ নিরূপিত হয়েছে প্রায় ৯৩১ মিলিয়ন টন, যা মাথাপিছু ১২১ কেজি খাদ্যের সমান। প্রধানত তিনটি পর্যায়ে খাদ্যের অপচয় ঘটছে- গৃহস্থালি পর্যায়ে ৬১ শতাংশ, খাদ্য পরিষেবা বা ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে ২১ শতাংশ ও খুচরা বিক্রির পর্যায়ে ১৩ শতাংশ। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য পরিমাণে খাদ্যের অপচয় ঘটছে খাওয়ার সময় বা পরে। খাদ্যের অপচয় ও খাদ্য-আবর্জনা বা বর্জ্য থেকে ঘটছে পরিবেশদূষণ। এ থেকে বছরে প্রায় ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নির্গত হয়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে মিশছে। কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে বৃদ্ধির অর্থ হলো বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে বিশ্বের জলবায়ুর ওপর। এ দেশে এত দীর্ঘ সময় ধরে কখনো বৃষ্টি দেখা যায়নি; যা হচ্ছে ওই জলবায়ু পরিবর্তনেরই প্রভাব।
গত বছর রয়্যাল সোসাইটি অব কেমিস্ট্রির সাসটেইনেবল ফুড টেকনোলজি জার্নালের একটি সংখ্যায় খাদ্যের অপচয় যে পরিবেশের ওপর কতা প্রভাব ফেলছে, সে সম্পর্কে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। সে গবেষণাপত্রটির শীর্ষ লেখক ও গবেষক ছিলেন কীর্তিকা কোহলিসহ আরও পাঁচজন। সাম্প্রতিক সে গবেষণায় তারা দেখেছেন যে প্রতি বছর শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই প্রায় ১০৮ বিলিয়ন পাউন্ড খাদ্যের অপচয় হয়; যার মূল্য প্রায় ৪০৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং যা দেশটির মোট বার্ষিক খাদ্য উৎপাদনের প্রায় ৪০ শতাংশ। শুধু যুক্তরাষ্ট্রের রেস্তোরাঁগুলোতেই বছরে ২২ থেকে ৩৩ বিলিয়ন পাউন্ড খাদ্যের অপচয় হয়। একই সময়ে সে দেশে ৩৮ মিলিয়ন মানুষ ক্ষুধায় ভুগছে। এসব খাদ্যবর্জ্য যায় কোথায়? সে দেশে এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ যায় ভূমি ভরাটে। মোট ভূমি ভরাটের প্রায় ২৪ শতাংশ ভরাট করা হয় এসব খাদ্যবর্জ্য দিয়ে; যেখান থেকে নির্গমন ঘটে মিথেন গ্যাসের। আর একটি অংশকে দহনকৃত পৌর কঠিন বর্জ্যে পরিণত করা হয়, যার পরিমাণ প্রায় ২২ শতাংশ। এসব খাদ্যবর্জ্য থেকে প্রতি বছর প্রায় ৪ দশমিক ৪ গিগা টন কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হয়; যা মানবসৃষ্ট গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের প্রায় ৮ শতাংশ।

ওই অতিরিক্ত খাদ্য অপচয় ও বর্জ্য টেকসই পরিবেশ ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের পথে একটি বড় বাধা। আমাদের যতটুকু খাদ্য দরকার বা যতটুকু আমরা গ্রহণ করতে পারি, শুধু যদি হিসাব কষে কোনো খাদ্যের অপচয় না করে উৎপাদন করতে পারতাম তাহলে শুধু খাদ্য খাওয়ার পরে না, খাওয়ার আগেও পরিবেশদূষণ অনেক কমে যেত।

প্রতি বছর পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই প্রচুর খাদ্য সরবরাহের জন্য প্রচুর পরিমাণে খাদ্য উৎপাদন করতে হয়। ফসল ফলাতে কৃষককে বিপুল পরিমাণে প্রাকৃতিক সম্পদ; যেমন- মাটি ও পানি ব্যবহার করতে হয়। এতে একদিকে যেমন প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর চাপ পড়ে, অন্যদিকে তেমনি এর প্রভাব পড়ে অর্থনীতি ও পরিবেশের ওপর। ফসল চাষ তথা খাদ্য উৎপাদন করতে গিয়ে এর সঙ্গে যুক্ত হয় সার ও বালাইনাশকের মতো পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য।

অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ যেমন বিশ্বব্যাপী স্থূলতা ও অসুস্থতা বাড়াচ্ছে, তেমনি পরিবেশের ক্ষতিও বাড়ছে। খাদ্যের অপচয় কমিয়ে আনা গেলে এসব ক্ষতির পরিমাণ অবশ্যই কমানো যেত। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সূত্র মতে, মোট ফসলি জমি, পানি ও সারের ২৩ থেকে ২৪ শতাংশ ব্যবহৃত হয় অপচয় করা খাদ্য উৎপাদনে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া ও চীনের পরিসংখ্যানও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আলাদা কিছু নয়। চীনে প্রতি টন গৃহস্থালি বর্জ্য থেকে ২৫০০ কেজি সমতুল্য কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপাদিত হচ্ছে, ইউরোপে খাদ্য অপচয়ের কারণে বার্ষিক আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৬০ বিলিয়ন ডলার এবং অস্ট্রেলিয়ায় অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদনের কারণে বছরে প্রায় ৫৭ হাজার ৫০৭ গিগাগ্যালন কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হচ্ছে। ডেনমার্কে বছরে প্রায় ৭ লাখ টন খাদ্যের অপচয় হয়। এশিয়ার অবস্থা ওসব দেশের চেয়েও খারাপ। বিশ্বে মোট খাদ্য অপচয়ের ২৫ শতাংশ ঘটে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে। শুধু সিঙ্গাপুর থেকেই বছরে প্রায় ৮০ লাখ টন খাদ্যবর্জ্য তৈরি হয়, মালয়েশিয়া থেকে প্রতিদিন হয় ৩৮ হাজার টন। খাদ্যবর্জ্য থেকে শুধু যে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নির্গমন হচ্ছে তা নয়। সেখান থেকে নির্গমন ঘটছে মিথেন, হাইড্রোজেন ও অন্যান্য গ্যাস; যা পরিবেশের ক্ষতি করছে। এগুলোয় দূষিত হচ্ছে বায়ু, পানি, মাটি ইত্যাদি। তাই যেকোনোভাবে হোক না কেন, খাদ্য অপচয় ও খাদ্যবর্জ্য উৎপাদন কমানোর ব্যাপারে আমাদের সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে।
খাদ্যের অপচয় কমাতে আমরা যে কাজগুলো করতে পারি, তা হলো-

১. শুরু করতে হবে নিজের ও পরিবারের কাছ থেকেই। খাওয়ার সময় এমনভাবে থালায় খাবার নেওয়া উচিত যতটুকু আমরা খেতে পারি ও যে খাদ্য যতটুকু খেলে আমরা সুস্থ থাকব, সেটুকু নেওয়া। অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ অসুস্থতা ও খাদ্যবর্জ্য তৈরির অন্যতম কারণ। প্রতিটি পরিবারের উচিত হবে এক সপ্তাহের একটি চমৎকার সঠিক খাদ্য-চাহিদার পরিকল্পনা তৈরি করে অতিরিক্ত খাদ্য কেনা ও রান্না করা থেকে বিরত থাকা।

২. খাবার বা মুদিদোকানে খাদ্য কিনতে যাওয়ার আগে নির্দিষ্ট খাদ্যের চাহিদা এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী তালিকা ও পরিমাণ ঠিক করে কিনতে যেতে হবে, অতিরিক্ত খাদ্য কিনে ঘরে রেখে পচানোর পর ফেলে দেওয়া কোনো বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না। এমনকি খাদ্য কিনতে যাওয়ার আগে রেফ্রিজারেটরে বা ভাড়ার ঘরে খাদ্যের মজুত পরীক্ষা করে সে অনুযায়ী কেনার পরিমাণ ও পণ্য সমন্বয় করতে হবে।

৩. কেনার পর সেগুলো যাতে নষ্ট না হয় সে জন্য উপযুক্ত স্থানে ভালোভাবে মজুত করতে হবে। মাঝে মাঝে সেগুলো পরীক্ষা করে দেখতে হবে। মনে রাখা উচিত যে এক থোকা আঙুরের মধ্যে দুটি আঙুর পচলে পরদিন তা আরও অনেক আঙুর পচার কারণ হতে পারে।

৪. এসব বিষয়ে সমাজভিত্তিক আলোচনা ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি নিতে হবে। এক্ষেত্রে তরুণ সম্প্রদায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

৫. খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা ও পরিবেশকেরা প্রায় এক-তৃতীয়াংশ খাদ্যবর্জ্য উৎপাদনের জন্য দায়ী, এমনকি রেস্তোরাঁ ও হোটেলগুলোও। খাদ্য ও শিল্প প্রশাসন এ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ ও প্রয়োজনে আইন ও নীতি প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে পারে। রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়ার পর রয়ে যাওয়া অতিরিক্ত খাবার নষ্ট না করে বা ফেলে না দিয়ে ক্রেতাদেরই প্যাকেট করে দিলে তার সদ্ব্যবহার হতে পারে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াসহ এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রায় ৫৩৬ মিলিয়ন মানুষ ঠিকমতো খাবার পায় না। কিছু অভুক্ত মানুষকে খেতে দিলে সেগুলো অন্তত খাদ্যবর্জ্যে পরিণত হবে না।

৬. সমাজবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও গবেষকরা এ বিষয়ে একটি টেকসই মডেল ও উপায় নির্ধারণে কাজ করতে পারেন। সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তর, খাদ্য অধিদপ্তর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, সমাজসেবা অধিদপ্তর ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান এ কাজে সমন্বিতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আগে দরকার যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি সাম্প্রতিক সময়ের গবেষণা, যার মাধ্যমে আমাদের বর্তমান বাস্তব চিত্রটি ফুটে উঠবে, আমরা বুঝতে পারব যে আসলে আমাদের খাদ্য উৎপাদন ও অপচয়ের অবস্থাটা কী এবং কী কী পদক্ষেপ আমাদের নিতে হবে। সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত ছাড়া কোনো কার্যকর পরিকল্পনা করা যায় না। উৎপাদক, ব্যবসায়ী বা বিক্রেতা, ক্রেতা বা ভোক্তাদের আচরণগত পরিবর্তন না হলে শুধু পরামর্শে খুব একটা কাজ হবে না। সেটা কীভাবে করা যায়, সে রোডম্যাপ ও সুনির্দিষ্ট সময়সীমা আমাদেরই ঠিক করতে হবে।

লেখক: কৃষিবিদ ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ