নিজস্ব প্রতিবেদক : ২০২০ সালের শুরুতেই মহামারি কোভিড-১৯ এর আঘাতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে দেশের অর্থনীতি। ফলে অর্থনীতির প্রতিটি সেক্টরই নড়বড়ে হয়ে পড়ে। সেই বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করতে সরকার বেশ কয়েকটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এসব প্রণোদনা প্যাকেজের উপর ভর করেই অর্থনৈতিক সংকট অনেকাংশে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তবে করোনার নতুন ধরণ ওমিক্রনের বিস্তার নিয়ে আবারও আতঙ্ক তৈরি হচ্ছে। এর ফলে অর্থনীতির এই পুনরুদ্ধার ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। নানাবিধ উত্থান-পতনের পর বছরের শেষে সামষ্টিক অর্থনীতির বেশিরভাগ সূচক ইতিবাচক হলেও কয়েকটি মৌলিক সূচক নেতিবাচক রয়ে গেছে। এসময় রিজার্ভ, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ, আমদানি-রফতানি বেড়েছে। তবে এখনো মূল্যস্ফীতি, রেমিট্যান্স, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ও রাজস্ব এসব খাতে চাপ রয়ে গেছে। এছাড়া করোনার প্রভাবে দেশে আয়-বৈষম্যও প্রকট আকার ধারণ করেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনার প্রভাবে সামগ্রিকভাবে আমাদের অর্থনীতির যে ক্ষতিটা হয়েছে, তা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে আমাদের আরও সময় লাগবে এবং আরও অনেক প্রস্তুতির প্রয়োজন আমাদের আছে। সরকারকে সেই লক্ষ্যেই কাজ করার পরামর্শ দেন তারা। এদিকে আমদানি ব্যয় বাড়ায় বাংলাদেশের রিজার্ভও কমছে, নেমে এসেছিল ৪৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে। তবে গত কয়েক দিনে তা আবার কিছুটা বেড়েছে। সর্বশেষ, ২৮ ডিসেম্বর রিজার্ভ ছিল ৪৫ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। প্রতি মাসে ৭ বিলিয়ন ডলার হিসেবে বর্তমানের এই রিজার্ভ দিয়ে ছয় মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রার মজুত থাকতে হয়। গত ৪ নভেম্বর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১১৩ কোটি ১০ লাখ ডলারের আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৪৪ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে, যা ছিল সাত মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম। বেশ কয়েক বছর ধরে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে। একের পর এক রেকর্ড হয়। করোনাকালের শুরুতে আমদানিতে ধীরগতি আর রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের ঊর্ধ্বগতির কারণে গত ২৪ আগস্ট বাংলাদেশের অর্থনীতির এই সূচক ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে, যা ছিল অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। করোনার ধকল কাটিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য আবার চাঙা হচ্ছে। ফলে বিনিয়োগকারীরা নতুন করে উৎপাদনে নামছেন। এতে প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি এবং শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানি অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র বা এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েছে ৫৩ দশমিক ২৩ শতাংশ। করোনার বৈশ্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় তৈরি পোশাক খাতের চাহিদাও আবার বাড়তে শুরু করেছে। মূলত তৈরি পোশাক খাতের উপর ভর করেই দেশের রফতানি আয়ও বাড়ছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে রফতানি আয় বেড়েছে ২৪ দশমিক ৩০ শতাংশ। যদিও লক্ষমাত্রার তুলনায় তা অনেক পিছিয়ে রয়েছে। গত জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত রফতানি আয় এক মাসে ৩৫০ কোটি ডলারের বেশি ওঠেনি। অক্টোবরে অবশ্য রফতানি আয় সর্বোচ্চ ৪৭২ কোটি ডলার হয়েছে। তবে নভেম্বরে তা কমে ৪০৫ কোটি ডলারে নেমেছে। আগস্ট থেকে রফতানি আয় বাড়তে থাকে। কারণ, ওই সময়ে শীত মৌসুমের তৈরি পোশাক ইউরোপ ও আমেরিকায় রফতানি শুরু হয়।
মহামারির কারণে গত বছর দেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ কমেছিল ১১ শতাংশ। তবে চলতি বছর করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় ফের বাড়ছে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) জানিয়েছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে প্রায় ২০ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকার দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে। যা গত অর্থবছরের তুলনায় ৪৬ শতাংশ বেশি। বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহও বাড়ছে। যা দেশের বিনিয়োগ বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিচ্ছে। সর্বশেষ নভেম্বর মাসে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি গত দুই বছর পর আবার দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছে ১০ দশমিক ১১ শতাংশ হয়েছে। বিনিয়োগ বাড়ায় করোনার কারণে কাজ হারানো মানুষও আবার কাজ পেতে শুরু করেছেন। করোনার ধাক্কা কাটিয়ে রাজস্ব আদায়ে গতি ফিরছে। আমদানি রফতানি বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারের রাজস্ব আদায়ও বেড়েছে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে অর্থাৎ জুলাই থেকে নভেম্বর সময়ে রাজস্ব আদায়ে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। এই সময়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আদায় করেছে ১ লাখ ২৬৭ কোটি টাকা। তবে লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে শুল্ক-কর আদায়ে এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছে এনবিআর। যদিও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি থাকায় অর্থনীতিতে কম রাজস্ব আদায়ের চাপ তেমন একটা নেই। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা থেকে প্রায় ৪১ হাজার কোটি টাকা কম রাজস্ব আদায় হয়েছিল। কিন্তু বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) পুরোটা বাস্তবায়ন না হওয়ায় তাতে সরকারের অর্থের ঘাটতি হয়নি। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের এনবিআরের শুল্ক-কর আদায়ের লক্ষ্য হলো ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু গত অক্টোবর পর্যন্ত পাঁচ মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছে মাত্র ৭৯ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যের মাত্র ২৪ শতাংশ।
বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন স্থায়ী খরচের বাইরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) খরচ করে। বেতনভাতার খরচ কমানো না গেলেও এডিপির খরচ কমানো সম্ভব। অর্থবছরের প্রথম চার মাস জুলাই-অক্টোবর পর্যন্ত মাত্র ১৩ শতাংশ টাকা খরচ হয়েছে। মোট এডিপির আকার ২ লাখ ৩৬ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। এটি কাঙ্খিত হারে বাস্তবায়ন না হওয়ায় রাজস্ব আদায়ের চাপ তুলনামূলক কম। করোনার শুরুতে অর্থনীতির এই সূচকটিই সবচেয়ে বেশি সচল ছিল। ফলে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে রেমিট্যান্স। তবে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সাথে সাথে বৈশ্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থাও সচল হতে থাকে। ঠিক সেই সময় থেকেই কমতে থাকে অর্থনীতির অন্যতম এই সূচকটি। অর্থাৎ ২০২০ সালকে প্রবাসী আয়ের উত্থান-পতনের বছর হিসেবে চিহ্নিত করেন সংশ্লিষ্টরা। গত জানুয়ারি মাসে ৫ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ মূল্যস্ফীতি নিয়ে বছর শুরু হয়। পরের ছয় মাস কখনো বেড়েছে, কখনো কমেছে। গত জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ। পরের পাঁচ মাস মূল্যস্ফীতি টানা বেড়েছে। সর্বশেষ নভেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ।
ক্ষয়ক্ষতি পুনরুদ্ধারের বছর ২০২২
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ