চিররঞ্জন সরকার : ‘বিশ্ব ক্ষুধা সূচক-২০২১’ এ ১১৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৬তম। সূচকে মোট ১০০ স্কোরের মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ১৯ দশমিক ১। এর অর্থ দেশে ক্ষুধা বেড়েছে। সূচকের স্কোর অনুযায়ী বাংলাদেশে ক্ষুধার মাত্রা গুরুতর পর্যায়ে রয়েছে। ২০২০ সালের বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১০৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৭৫তম। ২০১৯ সালে ১১৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৮৮তম এবং ২০১৮ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৬তম।
‘বিশ্ব ক্ষুধা সূচক ২০২১’ এ ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। সূচকে নেপাল ও বাংলাদেশ একই অবস্থানে রয়েছে। তবে সূচক ও স্কোর উভয় ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের চেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। অবস্থানের অগ্রগতি হলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ‘গুরুতর‘ ক্ষুধার সমস্যা রয়েছে।
মূলত চারটি বিষয়কে সামনে রেখে সেই মাপকাঠি অনুযায়ী তৈরি হয় এ সূচক। এগুলো হলো:
১. অপর্যাপ্ত পুষ্টি,
২. শিশুদের ক্ষয়, অর্থাৎ পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে ক্ষয়ের পরিমাণ (উচ্চতার তুলনায় কম ওজন, যার মূলে রয়েছে পুষ্টির অভাব),
৩. শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধি হ্রাস, অর্থাৎ পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে বয়সের তুলনায় কম উচ্চতার হার (যার অর্থ হলো দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টি) এবং
৪. পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে মৃত্যুর হার।
এ মাপকাঠিতে ১০০ পয়েন্টের ভিত্তিতে প্রতিটি দেশের স্কোর হিসেব করে বিশ্ব ক্ষুধা সূচক প্রকাশ করে থাকে ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট। সূচকে সেরা স্কোর হলো শূন্য। আগের বছরের তুলনায় স্কোর বাড়ার অর্থ হলো সেই দেশের ক্ষুধা পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। আর স্কোর কমে যাওয়ার অর্থ হলো সেই দেশের খাদ্য ও পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।
এবারের সূচকে পাঁচেরও কম স্কোর নিয়ে ক্ষুধা সূচকের শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে ১৮টি দেশ। এর মধ্যে রয়েছে চীন, বেলারুশ, ব্রাজিল, তুরস্ক, কিউবা ও কুয়েত। লক্ষ্যণীয়, তৃতীয় বিশ্বের দেশের পংক্তিতে থাকা ব্রাজিলেও কিন্তু ক্ষুধার জ্বালা নেই। অন্যদিকে কোভিড মহামারির শুরু যেই দেশে, সেই চীন মহামারির মধ্যেও দেশবাসীকে অনাহার থেকে রক্ষা করেছে। ক্ষুধা সূচক অনুযায়ী, বাংলাদেশের স্কোর ১৯ দশমিক ১। এর অর্থ বাংলাদেশে মাঝারি মানের ক্ষুধা রয়েছে। মিয়ানমার রয়েছে তালিকায় ৭১–এ, নেপাল ও বাংলাদেশ যৌথভাবে রয়েছে ৭৬ নম্বর স্থানে। পাকিস্তান তালিকায় স্থান পেয়েছে ৯২ নম্বরে।
ক্ষুধা ও দারিদ্র্র্য নিরসনের জন্য সব সরকারই কম-বেশি কাজ করছে। কিন্তু তারপরও দেশে দেশে ক্ষুধার্ত মানুষের ভিড় কমছে না। এটা স্বীকৃত যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের যোগসূত্র অত্যন্ত নিবিড়। অর্থাৎ দরিদ্র ব্যক্তিরাই ক্ষুধার্ত। সাধারণ ধারণা অনুযায়ী ক্ষুধার্ত ব্যক্তির সংজ্ঞা হলো, যে ব্যক্তি অনাহারে রয়েছে। কারণ খাদ্য ক্রয়ের কোনো সামর্থ্যই তার নেই। সাধারণ ধারণায় ক্ষুধা মানেই আহারের অভাব। অর্থাৎ এ অভাবের জন্যই জনমানুষ ক্ষুধার্ত হয়। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ক্ষুধার সংজ্ঞায় পুষ্টির অভাব বা অপুষ্টিকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ সংজ্ঞায় কোনো ব্যক্তি যদি প্রতিদিন এক হাজার ৮০০ ক্যালোরির মানসম্পন্ন খাবার না খেতে পারে, তাহলে সে অপুষ্টির শিকার হবে। অপুষ্টির অর্থ প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাব। অর্থাৎ নির্ধারিত পরিমাণের ক্যালরির ঘাটতি। এ সংজ্ঞায় খাদ্য গ্রহণের পরও মানুষ ক্ষুধার্ত হয়। এ প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য হলো অপুষ্টি সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা সৃষ্টি করা। এ সংস্থা আশা করে যে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। যদিও সেই উদ্যোগ খুব একটা লক্ষ্য করা যায় না।
কোভিডের কারণে দেশের অর্থনীতি ল-ভ- হয়ে গেছে। কাজ নেই, ব্যবসা ছত্রখান। মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কায় মানুষ নাজেহাল। ঘরে ঘরে তাই অনাহার তো বাড়বেই। যদিও বিষয়টি নিয়ে তেমন একটা আলোচনা নেই। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে আমরা ভারত–পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছি⎯ এই গর্বে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা গদগদ রয়েছেন।
ঢাকঢোল পিটিয়ে উন্নয়নের বাজনা বাজানো হচ্ছে। দেশ খাদ্যে স্বংসম্পূর্ণ, প্রবৃদ্ধিতে এগিয়ে, মাথাপিছু আয় বাড়ন্ত⎯এসব এখন নিয়মিত বুলি। কিন্তু যে কথাটা শোনা যায় না, তা হলো রেকর্ড ফসল উৎপাদনের পরেও গরিবের ঘরে এখনও ক্ষুধা আর অনাহারের জ্বলন্ত উদাহরণের কথা। দেশে সর্বোচ্চ শিক্ষা লাভের পরও মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলের কাজ না পাওয়ার কাহিনী। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় টাকা বিলানোর ঢালাও প্রচারের পরও অজ্ঞাত কারণে তা গরীবের উঠোনে গিয়ে শেষ পর্যন্ত পৌঁছয় না। বয়স্কভাতা, বিধবা ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, প্রতিবন্ধীভাতা⎯সরকারি প্রকল্পের শেষ নেই। বরাদ্দ টাকাও অঢেল। হাজার হাজার কোটির আয়োজন। কিন্তু স্থানীয় নেতা, তত্ত্বাবধানকারী অফিসার, দালাল আর উপরি কামাইয়ের সুযোগ নেওয়া ধান্দবাজদের সৌজন্যে কোথায় যেন আসল উদ্দেশ্য হাওয়া হয়ে যায়। কেন ও কীভাবে? এই রহস্যের পর্দা ফাঁস কোনও সরকারের আমলেই হয় না। এ আমলেও হবে না, এটাই যেন আমাদের রাজনীতির চিরন্তন চিত্র। ইদানিং আবার প্রশ্ন করতেই ভয় হয়, কি জানি, দেশবিরোধী কাজ আখ্যা দিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ফাঁসিয়ে দেওয়া হবে নাতো?
আমাদের প্রশাসন কখনও কালো দিকটা দেখায় না, আমরাও তাই বাধ্য দেশবাসীর মতো তা সচরাচর দেখতে পাই না। এভাবেই আসল সত্যিটা কখন হারিয়ে যায় কালের গর্ভে। ওসব ছেড়ে আমরা নানা আমোদে–আহ্লাদে উদ্বাহু হই। চোখে পড়ে না গরীব শ্রমিক, কৃষক খেটে খাওয়া মানুষের ঘরের সংকট, ক্ষুধা, অনাহারের ইতিবৃত্ত। অথচ সরকার ঠা-া ঘরে বসে যাই দাবি করুন, প্রকৃত চিত্র কিন্তু আদৌ গরীবি–রেখা থেকে বেরিয়ে আসা মানুষের গৌরবময় উত্তরণের কথা বলছে না। গরীব আরও গরীব আর লুটপাটকারী ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে।
একথা ঠিক যে গোটা বিশ্বের ক্ষুধার সূচকের (গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স) প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় আমাদের উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মানদ-ে বাংলাদেশের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। দেশে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা কিছুতেই কমছে না। উল্টে অনাহার ও খাদ্যের হাহাকার বাড়ছে।
আমাদের দেশে ক্ষুধা সূচক নিয়ে সরকার কিংবা বিরোধী দল⎯কেউই খুব একটা মাথা ঘামায় না। গরীব মানুষ তো ক্ষুধা সূচক বোঝেই না। খাবারের জোগাড় করতেই তারা জেরবার। নইলে, ২০১৩ সালে জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন তৈরি হওয়ার পর থেকেও আমাদের দেশে অপুষ্টি সমস্যার মোকাবিলায় কোনও বড় পদক্ষেপ করা হয়নি দেখেও রাজনৈতিক সমাজে কোনও আলোড়ন তৈরি হয়নি কেন? কিছু কিছু মানুষের বাড়িতে খাবার উপচে পড়ে, অথচ অনেক মানুষ ন্যূনতম খাবার পায় না। সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প আছে। সেই প্রকল্পের সঠিক রূপায়ণ হলে গরীব মানুষের খাদ্যাভাব থাকারই কথা নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাস্তব ছবিটা অন্যরকম। বিশেষজ্ঞরা এর কারণ হিসেবে মনে করেন, দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, অবকাঠামোয় গলদ, অজ্ঞানতা আর প্রকল্প রূপায়ণে ত্রুটি। ফলে ক্ষুধা দূরীকরণে বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাচ্ছে না। অর্থাৎ উপকরণ থাকা সত্ত্বেও বহু মানুষ ক্ষুধার জ্বালায় কষ্ট পান।
রাজনীতিকরা আছেন তাদের তালে। তারা বিভিন্ন নন–ইস্যুকে ইস্যু করে রাজনীতির মাঠে ধুলা উড়ানোর চেষ্টা করেন। বাংলাদেশ যেখানে আর্থিকভাবে শক্তিধর হতে চাইছে, ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের কর্তাব্যক্তিরা সমানে উন্নয়নের খতিয়ান দিতে ব্যস্ত, সেখানে ক্ষুধা সূচকে কেন বাংলাদেশ পেছনে থাকবে? কেনই বা একপেট খিদে নিয়ে শুতে যাবেন বিপুল সংখ্যক মানুষ? আলোচ্য রিপোর্টেই আক্ষেপ করা হয়েছে, সামগ্রিকভাবে দেখা যাচ্ছে, খিদের সঙ্গে বিশ্বব্যাপী লড়াই মোটেই ঠিক পথে এগোচ্ছে না। আশঙ্কা, এই ভাবে চললে সারা বিশ্ব, বিশেষত ৪৭টি দেশ ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধার হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সফল হতে পারবে না। অর্থাৎ ক্ষুধার রাজ্যে বাংলাদেশের মতো পৃথিবীও ক্রমে গদ্যময় হয়ে উঠবে।
ক্ষুধা নিয়ে আমাদের প্রত্যেকেরই দায় আছে। আছে করণীয়। সুমনের গানের কথায় বলতে হয়: ‘‘কেউ যদি বেশি খাও, খাবার হিসেব নাও/কেননা অনেক লোক ভাল করে খায় না;/খাওয়া না খাওয়ার খেলা, যদি চলে সারাবেলা/হঠাৎ কি ঘটে যায় কিচ্ছু বলা যায় না।’
লেখক : কলামিস্ট।