লাইফস্টাইল ডেস্ক : অন্তরে ক্ষোভের জ্বালা পুষে রেখে, মুখে ক্ষমা করলে নিজেরই ক্ষতি। কাউকে ক্ষমা করে দেওয়াটা শুধু মহত্ত্বের পরিচয়ই নয়, অপরজনকে মানসিক স্বস্তিও দেয়। তবে সেটা তখনই হয় যদি সত্যিই তাকে ক্ষমা করা যায়। শুধু বিরোধ এড়াতে ‘ক্ষমা করে দিলাম’ বলা, আর সত্যিকার অর্থে ক্ষমা করা, অপরপক্ষের দোষগুলো জেনে নিজের পরিণতিকে মেনে নেওয়ার মধ্যে অনেক তফাৎ। বিবাদ এড়ানোর জন্য ‘ক্ষমা করে দিলাম’ বলে দিয়ে মনে অভিমান পুষে রাখাই হলো ক্ষমার বিষাক্ত রূপ।
ওয়েলঅ্যান্ডগুড ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সাইকোথেরাপিস্ট’, ‘কিপ থেরাপি’র ‘অ্যাসোসিয়েট ক্লিনিকাল ডিরেক্টর’ পিটার শ্মিট বলেন, “কাউকে ক্ষমা করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত না হয়েই ক্ষমা করতে চাওয়ার পেছনে মূলত দায়ী আমাদের সমাজ।”
সমাজ আমাদের শেখায় মানুষের সঙ্গে বিবাদ এড়ানোর আদর্শ উপায় হল ক্ষমা করা এবং ভুলে যাওয়া। তবে সবক্ষেত্রে এটা আদর্শ নয়। ক্ষমা তখনই করা যায় যখন দোষী তার দোষ এবং তার পরিণতি হিসেবে অপরজনের ক্ষতি স্বীকার করে এবং তারপরও দুপক্ষের মধ্যে আলোচনার পর ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি তার ক্ষতি মেনে নিয়ে, ভুলে গিয়ে দোষীকে ক্ষমা করা কথা বলতে পারেন এবং তাদের দুজনার মধ্যে একটা সম্পর্ক বজায় থাকে। এই পুরো প্রক্রিয়াটাই জরুরি।
শ্মিট বলেন, “কারণ দোষী ব্যক্তির সঙ্গে একটা সম্পর্ক বজায় থাকলেই কেবল বলা যায় যে তাদের প্রকৃত অর্থেই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ক্ষমা করেছেন।”
আরেক ‘সাইকোলজিস্ট’ অ্যালিসন নারেনবার্গ বলেন, “দোষী ব্যক্তি কী ক্ষতি করেছে সেটার ওপরে সকল মনযোগ দেওয়াটাও সুস্থ আচরণ নয়। নিজের জন্য শুধু গুণ দেখবেন আর অন্যের বেলায় শুধু দোষটাকেই প্রাধান্য দেবেন এমনটা হওয়া ঠিক নয়।”
এই মনোভাব পুষে রাখলে নিজেকে সবসময়ই মনে হবে ক্ষতির শিকার এবং নিজের আক্ষেপের জালে নিজেই আটকে থাকবেন। আর এই আটকে থাকতে যাতে না হয় সেজন্যই ক্ষমা করে দেওয়াকে এত বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।
ওয়াশিংটনের আত্মমর্যাদাপূর্ণ মানসিকতার প্রশিক্ষক এবং ‘থেরাপিস্ট’ ডন্টি মিচল হান্টার বলেন, “কাউকে সত্যিকার অর্থে ক্ষমা করে দিতে পারলে মানসিক ও শারীরিকভাবে নিজেকে হালকা মনে হবে, প্রশান্তি অনুভব করবেন শরীর ও মনে। মানসিক চাপ কমায় এই ক্ষমা করে দেওয়া এবং দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমাশীল ওই ব্যক্তি মানসিক সুস্বাস্থ্য বজায় থাকে। তবে এসবই পাওয়া যাবে যদি প্রকৃত অর্থেই ক্ষমা করা হয়।”
ক্ষমার বিষাক্ত রূপ কেনো সমস্যার কারণ : মিচল হান্টার বলছেন, “মন থেকে ক্ষমা না করে শুধু মুখে বলা, আসলে নিজেকেই প্রতারণা করা হল। মানসিকভাবে তৈরি না হয়েই যদি কেউ নিজের কোনো অনুভূতিকে ভুলে যেতে চায় তবে সে আসলে কষ্টটাকে অনুভব করাকে এড়িয়ে গেল। ফলে কষ্টটা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কী দরকার সেটাও তার বোঝা হল না।”
“আর দোষী ব্যক্তিকে প্রকৃত অর্থে ক্ষমা করে দেওয়ার আসলেই দরকার কি-না সেটাও আর জানা হল না। এই পরিস্থিতিতে দোষী ব্যক্তি যদি ক্ষমা চায়ও তাও আপনি তাকে আসলেই ক্ষমা করতে পারবেন না। ফলে আপনি বলছেন আপনি ভুলে গেছেন, ক্ষমা করেছেন কিন্তু ভেতরে ভেতরে সেটাই আপনাকে কুরে খাচ্ছে, রাগ বাড়ছে। একটা পর্যায়ে আপনি এটাও ভুলে যাবেন যে ওই ব্যক্তির ওপর আপনার কেনো ক্ষোভ, কী ঘটেছিল আপনাদের মাঝে। কিন্তু রাগ আর ক্ষোভটা ঠিকই রয়ে যাবে।”
কীভাবে বুঝবেন আপনার ক্ষমা বিষাক্ত : মিচল হান্টার বলেন, “অনেক সময় আপনি মানুষকে ক্ষমা করেন, কারণ আপনি চান ঝগড়া এড়িয়ে গিয়ে দোষী মানুষটাকে খুশি রাখতে। এর পেছনের কারণ হল, ওই দোষী ব্যক্তির আচরণে যে আপনি কষ্ট পেয়েছেন সেটাই আপনাকে নিজের কাছে অপরাধী করে তুলছে। তখন নিজের অপরাধবোধ ঢাকতে সবাইকে বোঝান যে, আপনি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।”
“কিন্তু বিষয়টি নিয়ে নিজের মনেই যুদ্ধ চলবে। ভাববেন আমার বিষয়টি নিয়ে রাগ করা উচিত না, তুচ্ছ এই বিষয় নিয়ে আমাদের সম্পর্কে ফাঁটল ধরতে দেওয়াটা আমারই উচিত হয়নি, আমারই ভুল। এখানেই ব্যাপারটা স্পষ্ট যে আপনার ক্ষমায় বিষ আছে যাতে আপনি নিজেই বিষক্রিয়ায় ভুগছেন।” একইভাবে যদি দেখেন, আপনি পরক্ষভাবে কাউকে কটাক্ষ করছেন তাহলে বুঝতে হবে ওই ব্যক্তির প্রতি আপনার কোনো অসমাপ্ত ক্ষোভ রয়ে গেছে। আপনার মনের গভীরে থাকা কোনো ক্ষত আপনাকে কুরে খাচ্ছে বলেই আপনি পরক্ষভাবে কুমন্তব্য করছেন।
সত্যিকার ক্ষমা করার জন্য যা করতে হবে : প্রথমত নিজেকে সামলাতে হবে, আবারও যাতে একইভাবে আঘাত না পান সেজন্য। যে আপনাকে কষ্ট দিয়েছে তার আর আপনার মাঝে সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করতে হবে। যখন বুঝতে পারবেন নিশ্চিত হবেন যে, ওই ব্যক্তি আপনার আর ক্ষতি করতে পারবে না তখনই আপনি আগের কথা ভুলে গিয়ে তাকে সত্যিই ক্ষমা করে দিতে পারবেন। শ্মিট বলেন, ‘এই পুরো প্রক্রিয়ার মাঝে আরও জানতে হবে, আপনাদের সম্পর্কের মাঝে এই ক্ষমার কী প্রভাব আপনি চান! এভাবেই কষ্ট দেওয়া ওই ব্যক্তির সঙ্গে আপনার সম্পর্কের ধরন এবং ভবিষ্যত নিশ্চিত হবে। মাঝে এটাও বুঝে যাবেন যে, ঠিক কেনো আপনি কষ্ট পেয়েছিলেন। আরও হতে পারে যে, আপনার কষ্ট পাওয়া কারণ শুধু অপর ব্যক্তির আচরণ নয়। হয়ত আরও গভীর কোনো কারণ তার পেছনে জড়িত।”
ক্ষমাও হতে পারে নিজের জন্য বিষাক্ত
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ