ঢাকা ১১:৪৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

ক্ষমতার অপব্যবহার কৃষিজমি জবরদখল করে রিসোর্ট ও স্পা!

  • আপডেট সময় : ০৮:১৯:০৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫
  • ১৬ বার পড়া হয়েছে

মানিকগঞ্জ সংবাদদাতা : পতিত স্বৈরাচার সরকারের সময়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে গ্রামের খেটে খাওয়া সাধারণ কৃষকদের ফাঁদে ফেলে ডেইরি ফার্ম করার কথা বলে জমি কিনতে শুরু করে এশিউর গ্রুপ। দীর্ঘ ১৫ বছরে কৃষকদের ফসলি জমি, কবরস্থানসহ সরকারি খাস জমি দখল করে ৩৩ একর জমির ওপর সাইনবোর্ড পাল্টে তৈরি করা হয়েছে পাঁচ তারকামানের ডেরা রিসোর্ট ও স্পা সেন্টার। রিসোর্টের মালিকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও দখল হওয়া জমির ন্যায্যমূল্য পাননি কৃষকরা।

উল্টো মামলার আসামি হয়ে এক যুগ আদালতে হাজিরা দিতে হয়েছে। গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর স্থানীয় লোকজন ও ভুক্তভোগী কৃষকদের দাবি আদায়ে রাস্তায় নামেন জেলার আলেম ওলামা এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা। কৃষকদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে ডেরা রিসোর্টের অসামাজিক কর্যাকলাপ বন্ধে জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি দেওয়াসহ মানববন্ধন করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট প্রশাসক বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করেছেন। আর রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ বলছেন, কৃষকদের বকেয়া টাকা শিগগিরই পরিশোধ করা হবে। মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলায় বালিয়াখোড়া ইউনিয়নের পুরান গ্রাম এলাকায় নির্মাণ করা হয় ডেরা রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা সেন্টার। প্রথম দিকে এটি এশিউর এগ্রো কমপ্লেক্স (এগ্রিকালচার ফার্ম) নামের সাইনবোর্ড দিয়ে স্থানীয় কৃষকদের প্রলোভন দেখিয়ে জমি কিনা ও দখল শুরু করে।

ঘিওর উপজেলার বালিয়াখোড়া ইউনিয়নের পুরান গ্রামের বাসিন্দা কৃষক ইসমাইল হোসেন। কৃষি প্রধান এলাকা হওয়ায় ছোটবেলা থেকে বাবার সঙ্গে কৃষিকাজ শেখেন। তিনি ক্ষোভ নিয়ে বলেন, আমরা কৃষক মানুষ, লেখাপাড় করিনি, সহজ সরলভাবে জীবনযাপন করছি। ওদের (ডেরা রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ) ছলচাতুরী আগে বুঝতে পারিনি। ওই রিসোর্টের ভেতরে আমার ১৩ শতক জমি ছিল, সেখানে প্রায় ১০০টির মতো ইউক্যালিপটাস গাছও ছিল।

আমাকে একটা গাছও কাটতে দেয়নি। গাছসহ জমি দখল করে নেয়। ওই সময়ে গাছগুলোর বাজারমূল্য ছিল প্রায় সাত লাখ টাকা। আমি জমি ও গাছের কোনো টাকাই পাইনি। জমি দখলকারী এশিউর গ্রুপ কর্তৃপক্ষের কাছে অনেকবার যাওয়ার চেষ্টা করেও তাদের সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। উল্টো আমিসহ এই এলাকার অনেক কৃষকের নামে মামলা দিয়েছিল। সেই মামলায় আমি এক যুগ (১২ বছর) আদালতে হাজিরা দিয়েছি। হাজিরা দিতে দিতে আমি এখন নিঃস্ব। কৃষক ইসমাইলের মতো ওই গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক, হয়রত আলী, সত্তার মিয়াসহ অনেক কৃষকের একই অবস্থা। কৃষক হযরত আলী বলেন, ‘ওইটার (ডেরা রিসোর্ট) ভেতরে কবরস্থানও আছে।

জোর কইরা ওই সময় কবরস্থানের জমি দখল করে। ওই সময় আওয়ামী লীগের নেতাদের ভয়ে আমরা কিছু কইতে পারি নাই। কবরস্থানের জন্য অন্যখানে জায়গা দিছে এটা ঠিক, কিন্তু কবরস্থান দখল নেওয়ার পরে আমাগোরে কোনো কার্ডও দেই নাই, আজ পর্যন্ত কেউ কবর জিয়ারতও করতে পারে নাই। খুব কষ্ট লাগে কবরস্থানের জায়গায় এখন হরিণ পালে, রিসোর্টে বানাইছে।’ একই গ্রামের কৃষক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমার নিজের ৩৯ শতকসহ পারিবারিকভাবে আরও ৪৫ শতক, মোট ৮৮ শতক জমি তারা (রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ) জোর করে দখল করে নিয়েছে।

১২ বছরের বেশি সময় পার হলেও এখনও কোনো টাকা দেয়নি। আবার মামলা দিয়া, আমাগো হয়রানি করছে। আমার মতো অনেকের জমি তারা দখল করেছে। জমি ফেরত পেতে অনেকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ তখন আওয়ামী লীগের নেতাদের ক্ষমতা দেখাইছে, এখন আবার শুনি মালিক নাকি বিএনপি করে। আমরা কই যামু কন, আমাগো ক্ষতিপূরণ কে দেবে।’
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, ২০০৮-০৯ সালের দিকে বালিয়াখোড়া গ্রামে এগ্রো ফার্ম করার জন্য জমি কেনা শুরু করে এশিউর এগ্রো কমপ্লেক্স নামের এগ্রিকালচার ফার্ম প্রতিষ্ঠানটি। এরপর ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর স্থানীয় সাবেক সংসদ সদস্য নাঈমুর রহমান দুর্জয় ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের সহযোগিতায় মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বালিয়াখোড়া ইউনিয়নে বালিয়াখোড়া গ্রামে অত্যাধুনিক এগ্রো ফার্ম করতে জমি দখলে নেওয়া শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। জমি কেনার পাশাপাশি কর্তৃপক্ষ গ্রামের অনেক কৃষকের জমিসহ সরকারি খাস জমিও দখলে নেয়।

এরপর মাটি ভরাট করে শুরু করে ডেইরি ফার্মের কার্যক্রম। বিগত ২০১২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এগ্রো ফার্মের সাইনবোর্ড ছিল। ডেইরি ফার্মের সাইনবোর্ড থাকা অবস্থায় চারদিকে নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে রিসোর্ট নির্মাণের কাজ করে কর্তৃপক্ষ। সে সময় বিষয়টি নিয়ে এলাকাবাসীর সমালোচনার মুখে পড়ে কিছুদিন নির্মাণ কাজও বন্ধ রেখেছিল কর্তৃপক্ষ।

পরে এলাকাবাসীকে দমাতে তাদের নামে হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। এরপর ওই সময়ে মানিকগঞ্জ-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের মদদে পুনরায় পুরোদমে চালু হয় রিসোর্ট নির্মাণের কাজ। দুই বছর কাজ শেষে বিগত ২০২২ সালের ৫ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয় পাঁচ তারকা মানের এই অবকাশযান কেন্দ্রটি।
রিসোর্টের তথ্যমতে, ডেরা রিসোর্ট ও স্পা সেন্টারের ভেতরে হেরিটেজ কটেজে ৩টি রুম, হাব কটেজে ৪টি রুম, সুপেরিয়র ফ্যামিলি কটেজে ২টি রুম, প্রেসিডেন্সিয়াল কটেজে ৩টি রুম, গল্ফ ভিউ ৫টি কটেজে মোট ১০টি রুম, ভিআইপি কটেজে ২টি রুম, লেকসাইড ৭টি কটেজসহ মোট ১৪টি রুম রয়েছে। এ ছাড়াও মিটিং অ্যান্ড কনফারেন্সের জন্য ৪ হাজার ৫০০ স্কয়ার ফিটের শোভা ব্যাংকুয়েট হল, সিনেপ্লেক্স, ট্রি হাউস, ওয়েভপুল, গ্রিন হল, সুইমিংপুল, গলফ গ্রাউন্ড, জিমনেশিয়াম, এভি সিস্টিমসহ মিটিং রুম, ছোট-বড় মিলে ৩৬টি হল রুম এবং কায়াকিং করার সুবিধা। তবে রিসোর্টটির সবচেয়ে বড় অ্যাডভেঞ্জার হল এখানকার স্পা সেন্টার।

রিসোর্টটির ন্যূনতম ভাড়া শুরু হয় প্রতিরাতের জন্য ৮ হাজার টাকা। আর কক্ষের ধরন বা সুযোগ সুবিধা প্রতিরাতের জন্য মান ভেদে ৫০ হাজার টাকা ভাড়ার রুমও রয়েছে রিসোর্টটিতে। কনফারেন্স রুমের ভাড়া দৈনিক ২ লাখ টাকা।
আরেক কৃষক সত্তার মিয়া বলেন, ‘শুরুর দিকে গরুর ফার্ম করবো বইলা জমি কিনে। তবে জমির মূল্য পরিশোধ না করে দখল নিয়ে রিসোর্ট নির্মাণ করায় কৃষকদের সঙ্গে ডেরা রিসোর্টের দ্বন্দ্ব শুরু হয়।

তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাদের সখ্যতা থাকায় ও মামলার ভয়ে ওই সময় অনেকে আর তাদের বাধা দিতে পারেননি। সবার সামনে এগ্রোর বিষয়টি নিয়ে আসলেও তাদের মতলব ছিল রিসোর্ট করার। এখন কৃষকরা সব এক জোট হয়ে তাদের দাবি আদায়ে সোচ্চার হয়েছেন। শুধু জমির টাকা ফেরত নয়, কৃষকদের সঙ্গে যে অন্যায় করা হয়েছে তার শাস্তি চাই আমরা।’

এ বিষয়ে জানতে ডেরা রিসোর্টের মালিক ও এশিউর গ্রুপের চেয়ারম্যান শেখ সাদীর ব্যক্তিগত মুঠোফোনে কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
ডেরা রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা সেন্টারের ব্যবস্থাপক ওমর ফারুক বলেন, আমরা দেশের এগ্রো বেইজড রিসোর্টের জন্য একটা উদাহরণ। এখানে হাঁস, গরু, মাছ এবং বিভিন্ন অর্গানিক শাক-সবজির চাষ করা হয়। এগুলো আমরা নিজেরাও ব্যবহার করি এবং রিসোর্টে আসা আমাদের অতিথিরাও নিয়ে থাকেন।

শুরুর দিকে এটি একটি অত্যাধুনিক এগ্রো ফার্মের লাইসেন্স ছিল, যা পরে রিসোর্টের লাইসেন্সে রূপান্তর করা হয়েছে। কয়েকজন কৃষকের টাকা প্রক্রিয়াগত কারণে আংশিক পরিশোধ হয়নি। তবে দ্রুত তাদের বকেয়া টাকা পরিশোধ করা হবে। গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে ভয় দেখিয়ে জমি দখলে নেওয়াসহ সরকারি খাস জমি দখলের বিষয়ে বিষয়ে তিনি বলেন, দুই বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানে আমি কর্মরত আছি।

আগে কী হয়েছে সেটা আমার জানা নাই, তবে আমাদের হিস্ট্রিতে এই ধরনের কোনো ঘটনা নেই। আর গ্রামবাসী তো পাঁচ তারকা মানের রিসোর্ট সম্পর্কে তেমন জানেও না, বুঝেও না।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, ডেরা রিসোর্টের বিষয়ে স্থানীয়রা আমাদের বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন। আরও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্ট সকল সরকারি অফিসে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

ঢাকায় কাউন্টার থেকে চলবে ২১ কোম্পানির গোলাপী বাস

ক্ষমতার অপব্যবহার কৃষিজমি জবরদখল করে রিসোর্ট ও স্পা!

আপডেট সময় : ০৮:১৯:০৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫

মানিকগঞ্জ সংবাদদাতা : পতিত স্বৈরাচার সরকারের সময়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে গ্রামের খেটে খাওয়া সাধারণ কৃষকদের ফাঁদে ফেলে ডেইরি ফার্ম করার কথা বলে জমি কিনতে শুরু করে এশিউর গ্রুপ। দীর্ঘ ১৫ বছরে কৃষকদের ফসলি জমি, কবরস্থানসহ সরকারি খাস জমি দখল করে ৩৩ একর জমির ওপর সাইনবোর্ড পাল্টে তৈরি করা হয়েছে পাঁচ তারকামানের ডেরা রিসোর্ট ও স্পা সেন্টার। রিসোর্টের মালিকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও দখল হওয়া জমির ন্যায্যমূল্য পাননি কৃষকরা।

উল্টো মামলার আসামি হয়ে এক যুগ আদালতে হাজিরা দিতে হয়েছে। গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর স্থানীয় লোকজন ও ভুক্তভোগী কৃষকদের দাবি আদায়ে রাস্তায় নামেন জেলার আলেম ওলামা এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা। কৃষকদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে ডেরা রিসোর্টের অসামাজিক কর্যাকলাপ বন্ধে জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি দেওয়াসহ মানববন্ধন করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট প্রশাসক বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করেছেন। আর রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ বলছেন, কৃষকদের বকেয়া টাকা শিগগিরই পরিশোধ করা হবে। মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলায় বালিয়াখোড়া ইউনিয়নের পুরান গ্রাম এলাকায় নির্মাণ করা হয় ডেরা রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা সেন্টার। প্রথম দিকে এটি এশিউর এগ্রো কমপ্লেক্স (এগ্রিকালচার ফার্ম) নামের সাইনবোর্ড দিয়ে স্থানীয় কৃষকদের প্রলোভন দেখিয়ে জমি কিনা ও দখল শুরু করে।

ঘিওর উপজেলার বালিয়াখোড়া ইউনিয়নের পুরান গ্রামের বাসিন্দা কৃষক ইসমাইল হোসেন। কৃষি প্রধান এলাকা হওয়ায় ছোটবেলা থেকে বাবার সঙ্গে কৃষিকাজ শেখেন। তিনি ক্ষোভ নিয়ে বলেন, আমরা কৃষক মানুষ, লেখাপাড় করিনি, সহজ সরলভাবে জীবনযাপন করছি। ওদের (ডেরা রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ) ছলচাতুরী আগে বুঝতে পারিনি। ওই রিসোর্টের ভেতরে আমার ১৩ শতক জমি ছিল, সেখানে প্রায় ১০০টির মতো ইউক্যালিপটাস গাছও ছিল।

আমাকে একটা গাছও কাটতে দেয়নি। গাছসহ জমি দখল করে নেয়। ওই সময়ে গাছগুলোর বাজারমূল্য ছিল প্রায় সাত লাখ টাকা। আমি জমি ও গাছের কোনো টাকাই পাইনি। জমি দখলকারী এশিউর গ্রুপ কর্তৃপক্ষের কাছে অনেকবার যাওয়ার চেষ্টা করেও তাদের সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। উল্টো আমিসহ এই এলাকার অনেক কৃষকের নামে মামলা দিয়েছিল। সেই মামলায় আমি এক যুগ (১২ বছর) আদালতে হাজিরা দিয়েছি। হাজিরা দিতে দিতে আমি এখন নিঃস্ব। কৃষক ইসমাইলের মতো ওই গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক, হয়রত আলী, সত্তার মিয়াসহ অনেক কৃষকের একই অবস্থা। কৃষক হযরত আলী বলেন, ‘ওইটার (ডেরা রিসোর্ট) ভেতরে কবরস্থানও আছে।

জোর কইরা ওই সময় কবরস্থানের জমি দখল করে। ওই সময় আওয়ামী লীগের নেতাদের ভয়ে আমরা কিছু কইতে পারি নাই। কবরস্থানের জন্য অন্যখানে জায়গা দিছে এটা ঠিক, কিন্তু কবরস্থান দখল নেওয়ার পরে আমাগোরে কোনো কার্ডও দেই নাই, আজ পর্যন্ত কেউ কবর জিয়ারতও করতে পারে নাই। খুব কষ্ট লাগে কবরস্থানের জায়গায় এখন হরিণ পালে, রিসোর্টে বানাইছে।’ একই গ্রামের কৃষক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমার নিজের ৩৯ শতকসহ পারিবারিকভাবে আরও ৪৫ শতক, মোট ৮৮ শতক জমি তারা (রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ) জোর করে দখল করে নিয়েছে।

১২ বছরের বেশি সময় পার হলেও এখনও কোনো টাকা দেয়নি। আবার মামলা দিয়া, আমাগো হয়রানি করছে। আমার মতো অনেকের জমি তারা দখল করেছে। জমি ফেরত পেতে অনেকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ তখন আওয়ামী লীগের নেতাদের ক্ষমতা দেখাইছে, এখন আবার শুনি মালিক নাকি বিএনপি করে। আমরা কই যামু কন, আমাগো ক্ষতিপূরণ কে দেবে।’
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, ২০০৮-০৯ সালের দিকে বালিয়াখোড়া গ্রামে এগ্রো ফার্ম করার জন্য জমি কেনা শুরু করে এশিউর এগ্রো কমপ্লেক্স নামের এগ্রিকালচার ফার্ম প্রতিষ্ঠানটি। এরপর ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর স্থানীয় সাবেক সংসদ সদস্য নাঈমুর রহমান দুর্জয় ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের সহযোগিতায় মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বালিয়াখোড়া ইউনিয়নে বালিয়াখোড়া গ্রামে অত্যাধুনিক এগ্রো ফার্ম করতে জমি দখলে নেওয়া শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। জমি কেনার পাশাপাশি কর্তৃপক্ষ গ্রামের অনেক কৃষকের জমিসহ সরকারি খাস জমিও দখলে নেয়।

এরপর মাটি ভরাট করে শুরু করে ডেইরি ফার্মের কার্যক্রম। বিগত ২০১২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এগ্রো ফার্মের সাইনবোর্ড ছিল। ডেইরি ফার্মের সাইনবোর্ড থাকা অবস্থায় চারদিকে নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে রিসোর্ট নির্মাণের কাজ করে কর্তৃপক্ষ। সে সময় বিষয়টি নিয়ে এলাকাবাসীর সমালোচনার মুখে পড়ে কিছুদিন নির্মাণ কাজও বন্ধ রেখেছিল কর্তৃপক্ষ।

পরে এলাকাবাসীকে দমাতে তাদের নামে হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। এরপর ওই সময়ে মানিকগঞ্জ-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের মদদে পুনরায় পুরোদমে চালু হয় রিসোর্ট নির্মাণের কাজ। দুই বছর কাজ শেষে বিগত ২০২২ সালের ৫ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয় পাঁচ তারকা মানের এই অবকাশযান কেন্দ্রটি।
রিসোর্টের তথ্যমতে, ডেরা রিসোর্ট ও স্পা সেন্টারের ভেতরে হেরিটেজ কটেজে ৩টি রুম, হাব কটেজে ৪টি রুম, সুপেরিয়র ফ্যামিলি কটেজে ২টি রুম, প্রেসিডেন্সিয়াল কটেজে ৩টি রুম, গল্ফ ভিউ ৫টি কটেজে মোট ১০টি রুম, ভিআইপি কটেজে ২টি রুম, লেকসাইড ৭টি কটেজসহ মোট ১৪টি রুম রয়েছে। এ ছাড়াও মিটিং অ্যান্ড কনফারেন্সের জন্য ৪ হাজার ৫০০ স্কয়ার ফিটের শোভা ব্যাংকুয়েট হল, সিনেপ্লেক্স, ট্রি হাউস, ওয়েভপুল, গ্রিন হল, সুইমিংপুল, গলফ গ্রাউন্ড, জিমনেশিয়াম, এভি সিস্টিমসহ মিটিং রুম, ছোট-বড় মিলে ৩৬টি হল রুম এবং কায়াকিং করার সুবিধা। তবে রিসোর্টটির সবচেয়ে বড় অ্যাডভেঞ্জার হল এখানকার স্পা সেন্টার।

রিসোর্টটির ন্যূনতম ভাড়া শুরু হয় প্রতিরাতের জন্য ৮ হাজার টাকা। আর কক্ষের ধরন বা সুযোগ সুবিধা প্রতিরাতের জন্য মান ভেদে ৫০ হাজার টাকা ভাড়ার রুমও রয়েছে রিসোর্টটিতে। কনফারেন্স রুমের ভাড়া দৈনিক ২ লাখ টাকা।
আরেক কৃষক সত্তার মিয়া বলেন, ‘শুরুর দিকে গরুর ফার্ম করবো বইলা জমি কিনে। তবে জমির মূল্য পরিশোধ না করে দখল নিয়ে রিসোর্ট নির্মাণ করায় কৃষকদের সঙ্গে ডেরা রিসোর্টের দ্বন্দ্ব শুরু হয়।

তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাদের সখ্যতা থাকায় ও মামলার ভয়ে ওই সময় অনেকে আর তাদের বাধা দিতে পারেননি। সবার সামনে এগ্রোর বিষয়টি নিয়ে আসলেও তাদের মতলব ছিল রিসোর্ট করার। এখন কৃষকরা সব এক জোট হয়ে তাদের দাবি আদায়ে সোচ্চার হয়েছেন। শুধু জমির টাকা ফেরত নয়, কৃষকদের সঙ্গে যে অন্যায় করা হয়েছে তার শাস্তি চাই আমরা।’

এ বিষয়ে জানতে ডেরা রিসোর্টের মালিক ও এশিউর গ্রুপের চেয়ারম্যান শেখ সাদীর ব্যক্তিগত মুঠোফোনে কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
ডেরা রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা সেন্টারের ব্যবস্থাপক ওমর ফারুক বলেন, আমরা দেশের এগ্রো বেইজড রিসোর্টের জন্য একটা উদাহরণ। এখানে হাঁস, গরু, মাছ এবং বিভিন্ন অর্গানিক শাক-সবজির চাষ করা হয়। এগুলো আমরা নিজেরাও ব্যবহার করি এবং রিসোর্টে আসা আমাদের অতিথিরাও নিয়ে থাকেন।

শুরুর দিকে এটি একটি অত্যাধুনিক এগ্রো ফার্মের লাইসেন্স ছিল, যা পরে রিসোর্টের লাইসেন্সে রূপান্তর করা হয়েছে। কয়েকজন কৃষকের টাকা প্রক্রিয়াগত কারণে আংশিক পরিশোধ হয়নি। তবে দ্রুত তাদের বকেয়া টাকা পরিশোধ করা হবে। গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে ভয় দেখিয়ে জমি দখলে নেওয়াসহ সরকারি খাস জমি দখলের বিষয়ে বিষয়ে তিনি বলেন, দুই বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানে আমি কর্মরত আছি।

আগে কী হয়েছে সেটা আমার জানা নাই, তবে আমাদের হিস্ট্রিতে এই ধরনের কোনো ঘটনা নেই। আর গ্রামবাসী তো পাঁচ তারকা মানের রিসোর্ট সম্পর্কে তেমন জানেও না, বুঝেও না।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, ডেরা রিসোর্টের বিষয়ে স্থানীয়রা আমাদের বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন। আরও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্ট সকল সরকারি অফিসে চিঠি দেওয়া হয়েছে।