বিদেশের খবর ডেস্ক: ওয়াশিংটনে পা রাখেন ২১ বছরের সুন্দরী তরুণী মনিকা লিউনস্কি। ইন্টার্ন হিসেবে যোগ দেন হোয়াইট হাউসে। তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। দেশজুড়ে তুমুল জনপ্রিয়তা তার। সংকটের মূলে ছিল বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক। তাও আবার ২৮ বছরের ছোট মনিকার সঙ্গে। দুজনের শারীরিক সম্পর্কও হয়েছিল। সবকিছু ঘটেছিল হোয়াইট হাউসেই।
মনিকার সঙ্গে ক্লিনটনের প্রণয় হয়েছিল প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার প্রথম মেয়াদে। দ্বিতীয় মেয়াদে ১৯৯৮ সালে তা চাউর হয়। যুক্তরাষ্ট্রে ঘরে-বাইরে, অফিস-আদালতে তখন আলোচনার যেন একটিই বিষয় ছিল—ক্লিনটন-মনিকা প্রেম। নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট ও টাইমের মতো নামীদামি পত্রিকায় দিনের পর দিন শিরোনাম হয়েছিল দুজনের এই সম্পর্কের খবর। দুজনের প্রেম পরিচিতি পায় ‘ক্লিনটন-মনিকা স্ক্যান্ডাল’ বা ‘ক্লিনটন-মনিকা কেলেঙ্কারি’ নামে। এই কেলেঙ্কারি ঘিরে ১৯৯৮ সালের আজকের এই দিনে (৮ অক্টোবর) ক্লিনটনের অভিসংশনের জন্য তদন্ত শুরু করার প্রস্তাব পাস হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদে। সে বছরের ১৯ ডিসেম্বর পরিষদে অভিশংসিত হন প্রেসিডেন্ট। যদিও শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা ছাড়তে হয়নি তাকে।
সহকর্মীর সঙ্গে গল্পেই ‘সর্বনাশের’ সূত্রপাত: মনিকা লিউনস্কির জন্ম ১৯৭৩ সালের ২৩ জুলাই- ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকো শহরে। ১৯৯৫ সালে অরেগনের লুইস অ্যান্ড ক্লার্ক কলেজ থেকে মনোবিদ্যায় স্নাতক শেষ করে সে বছরেই ইন্টার্ন হিসেবে হোয়াইট হাউসে চাকরি শুরু করেন। সেখানে ছিলেন ১৯৯৬ সালের এপ্রিল পর্যন্ত। এই সময়ে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের সঙ্গে তার বেশ কয়েকবার শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল। মনিকা-লিন্ডা বন্ধুত্ব এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, ব্যক্তিগত খুঁটিনাটি বিষয় নিয়েও আলাপ করতেন। ১৯৯৭ সালে এমনই এক আলাপে ভুল করে বসেন মনিকা। লিন্ডার কাছে নিজের প্রেমকাহিনি ফাঁস করেন তিনি। ক্লিনটনের সঙ্গে শারীরিক সর্ম্পকের সময় পরনে থাকা একটি নীল পোশাকের কথাও বলেন। লিন্ডা আবার সে কথা জানান লুসিয়ান গোল্ডবার্গ নামে তার পরিচিত এক লেখিকাকে।
গোল্ডবার্গ ছিলেন ক্লিনটনবিরোধী, এরপর আবার ক্লিনটনের দল ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রতিপক্ষ রিপাবলিকান পার্টির সমর্থক। তার পরামর্শেই ক্লিনটনকে নিয়ে মনিকার সঙ্গে নিজের ফোনালাপ রেকর্ড শুরু করেন লিন্ডা। এভাবে মোটমুটি ২০ ঘণ্টার ফোনালাপ রেকর্ড করেছিলেন তিনি। পাশাপাশি মনিকাকে পরামর্শ দেন, ওই নীল পোশাক যেন পরিষ্কার না করা হয়। এভাবেই ক্লিনটন-মনিকা কেলেঙ্কারির তথ্য বাইরের মানুষদের মধ্যে প্রথম কানে গিয়েছিল লিন্ডার। ২০০১ সালে ক্লিনটনের ক্ষমতা ছাড়ার দিনই তাকে পেন্টাগনের চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হয়। চাকরি হারানোর পর ভার্জিনিয়ায় স্বামীর সঙ্গে একটি দোকান খোলেন। ২০২০ সালে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় তার।
‘কাঠগড়ায়’ মনিকা: ক্লিনটন-মনিকা প্রেমকাহিনি যখন সবে একান-ওকান হওয়া শুরু করেছে, তখন কিন্তু ক্লিনটনের বিরুদ্ধে আরও একটি যৌন হয়রানির অভিযোগ ছিল। ১৯৯৪ সালে ওই অভিযোগ এনেছিলেন পলা জোনস নামের একজন সরকারি কর্মচারী। তখনো প্রেসিডেন্টের পদে বসেননি ক্লিনটন। দায়িত্বে ছিলেন আরকানসাসের গভর্নর হিসেবে। বিষয়টি আদালতে গড়িয়েছিল।
আদালতে পলা জোনস অভিযোগ করেছিলেন, ১৯৯১ সালের মে মাসে আরকানসাসের একটি হোটেলের কক্ষে তাকে যৌন হয়রানি করেছিলেন ক্লিনটন। এতে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তিনি। এ মামলায় পলা জোনসের আইনজীবীরা লিন্ডা ট্রিপের রেডর্ক করা সেই ফোনালাপগুলো আদালতে উপস্থাপন করেন। এর পেছনেও ছিলেন লিন্ডার পরিচিত ক্লিনটনবিরোধী লেখিকা লুসিয়ান গোল্ডবার্গ। এর জেরে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় মনিকাকে। তবে ১৯৯৮ সালের ৭ জানুয়ারি এক হলফনামায় তিনি জানান, ক্লিনটনের সঙ্গে কখনোই তার যৌন সম্পর্ক হয়নি। দিন দশেক পর আদালতে দেওয়া এক জবানবন্দিতে একই কথা বলেন ক্লিনটনও। সে মাসের শেষের দিকে পলা জোনসের মামলা থেকে ক্লিনটন-মনিকা কেলেঙ্কারির বিষয়টি বাদ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত।
আসল বিপদ: পলা জোনসের মামলাটি ক্লিনটন চাপা দিয়েছিলেন আদালতের বাইরে। মামলার রায় হওয়ার আগে ১৯৯৮ সালের নভেম্বরে ৮ লাখ ৫০ হাজার ডলারের বিনিময়ে জোনসের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছান তিনি। ফলে জোনস মামলাটি তুলে নেন। আর মনিকার সঙ্গে প্রেমের জেরে এই মামলায় তার জড়িয়ে পড়ার যে ঘটনা ঘটেছিল, তা আগেই খারিজ করে দিয়েছিলেন আদালত। তবে ক্লিনটনের বিপদ ঘনিয়ে আসছিল আরও একদিক দিয়ে। পলা জোনসের মামলা যখন চলছিল, তখন ‘হোয়াইটওয়াটার’ নামে একটি ব্যবসা উদ্যোগে ক্লিনটন ও হিলারির সংশ্লিষ্টতা নিয়ে তদন্ত করছিলেন স্বাধীন কাউন্সেল কেনেথ স্টার। তবে তেমন একটা সুবিধা করে উঠতে পারছিলেন না। তখন লিন্ডা ট্রিপের মাধ্যমে তার হাতে আসে ক্লিনটনকে নিয়ে মনিকার সেই কলরেকর্ডগুলো।
পলা জোনসের মামলায় আদালতে মনিকা মিথ্যা হলফনামা দিয়েছেন কি না, তা খতিয়ে দেখার অনুমতি চান। আদালতের সায় মেলে। তারিখটা ১৯৯৮ সালের ১৬ জানুয়ারি। এবার মনিকাকে বেশ আঁটসাঁট করে ধরার পরিকল্পনা করা হয়। তার মা মার্সিয়া লুইসকে টানা তিন দিন ধরে জেরায় জেরায় জেরবার করে ছাড়ে কেনেথ স্টারের দল। অভিযোগ তোলা হয়, পলা জোনসের মামলায় মনিকা যে মিথ্যা হলফনামা দিয়েছেন, তার জন্য লুইসই দায়ী। মনিকা ও তার মা–বাবাকে বিচারের মুখোমুখি করার হুমকিও দেয় কেনেথ স্টারের দল। এমন পরিস্থিতিতে স্টারের সঙ্গে একটি চুক্তিতে যান মনিকা। সে অনুযায়ী ক্লিনটনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলে পূর্ণ দায়মুক্তি পাবেন তিনি। ১৯৯৮ সালের ৬ আগস্ট থেকে আদালতে সাক্ষ্য দেওয়া শুরু করেন মনিকা।
নীল পোশাকে মিলল হিসাব: চুক্তি মেনে ক্লিনটনের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের প্রমাণ হিসেবে সেই নীল পোশাকও কেনেথ স্টারের কাছে তুলে দেন মনিকা। সেটাও সাক্ষ্য শুরুর আগেই, ২৯ জুলাই। লিন্ডা ট্রিপের পরামর্শে ওই পোশাক একবারও পরিষ্কার করেননি মনিকা। ৩ আগস্ট ক্লিনটনের শরীর থেকে রক্তের নমুনা নিয়ে ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়। ওই ডিএনএ মিলে যায় নীল পোশাকের ওপর পাওয়া শুক্রাণুর ডিএনএর সঙ্গে। এরপর মনিকার সঙ্গে প্রেমের বিষয়টি অস্বীকার করার আর উপায় ছিল না ক্লিনটনের। ওই নীল পোশাক কেনেথ স্টারের দপ্তরেই ছিল। ১৯৯৯ সালে এক সাক্ষাৎকারে সংবাদমাধ্যম এবিসিকে মনিকা বলেছিলেন, পোশাকটিকে নিজের জন্য বড় অপমান হিসেবে দেখেন তিনি। কখনো যদি সেটি ফেরত পান, পুড়িয়ে ফেলবেন। ফিরে তিনি অবশ্য পেয়েছিলেন। সেটি ২০০১ সালের জুলাই মাসে। সঙ্গে পেয়েছিলেন আরো কিছু জিনিস।
‘বলির পাঁঠা’ মনিকা: নিজের মেয়াদের শেষ সময় ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন ক্লিনটন। ২০০৪ সালে সিবিএসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার এ কাজ (মনিকার সঙ্গে প্রেম) করার পেছনের কারণ ছিল খুবই বাজে। সুযোগ ছিল বলেই এমন কাজটি করেছি। মনে করি, কোনো কাজ করার সুযোগ আছে বলেই সেটি করে ফেলা সবচেয়ে বাজে কাজ।’ মনিকার সঙ্গে প্রেমের সময় ক্লিনটনের বয়স ছিল ৪৯ বছর। ৩০ বছর পর এখন বয়স ৭৯। বিংশ শতাব্দীতে দায়িত্ব পালন করা একমাত্র জীবিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট তিনি। এত বয়সেও নিজের প্রতিষ্ঠিত সংগঠন ক্লিনটন ফাউন্ডেশন ও ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভের পেছনে সময় দিয়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়া ‘সিটিজেন: মাই লাইফ আফটার দ্য হোয়াইট হাউস’ শিরোনামে গত বছর তার লেখা একটি বইও প্রকাশিত হয়েছে। আর মনিকার বয়স এখন ৫১ বছর। লেখিকা, চলচ্চিত্র প্রযোজক ও অধিকারকর্মী হিসেবে কাজ করছেন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ‘কল হার ড্যাডি’ শিরোনামে একটি পডকাস্টে কথা বলেছিলেন তিনি। সেখানে পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণা করে মনিকা বলেছিলেন, ক্লিনটনের সত্যবাদী হওয়া উচিত ছিল। স্বার্থপরভাবে তাকে বলির পাঁঠা না বানিয়ে অন্য একটি উপায় খুঁজে বের করা উচিত ছিল তৎকালীন প্রেসিডেন্টের। তথ্যসূত্র: টাইম সাময়িকী।
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ