ড. মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ : মানব ইতিহাসের সঙ্গে ধর্মের ইতিহাস যেমন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, তেমনিভাবে কোরবানির ইতিহাসও ধর্ম ও মানুষের সঙ্গে প্রাচীন কাল থেকে সম্পৃক্ত। আদি পিতা আদমের (আ.) দুই পুত্রের কোরবানির ঘটনা আমাদের তা স্মরণ করিয়ে দেয়। পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে: “এবং তাদের আদমের দুই পুত্রের কাহিনি ঠিকমতো শুনিয়ে দাও। যখন তারা দুই জন কোরবানি করলো, একজনের কোরবানি কবুল হলো এবং অপরজনের হলো না।” (সুরা আল মায়েদাহ: ৫:২৭)
ঐতিহাসিক, মুফাস্সির ও ইসলামি চিন্তাবিদগণ এ ব্যাপারে একমত যে হাবিলের (আ.) কোরবানি কবুল হয়েছিল। কারণ, তিনি ঐকান্তিক আগ্রহ ও আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে অতি সুন্দর একটি পশু কোরবানি করেছিলেন। অপরপক্ষে কাবিলের কোরবানি কবুল হয়নি। কারণ, সে দায় সারার জন্যে খাবার অনুপযোগী কিছু খাদ্যসামগ্রী আল্লাহর রাহে পেশ করেছিল।
এ ঘটনায় তিনটি বিষয় পরিষ্কার হয়।
১। কোরবানির মৌলিক উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন প্রত্যাশা করা; ২। সঠিক নিয়ত ও আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ করা এবং ৩। কোরবানির জন্যে অতি উত্তম ও সুন্দর জিনিস নির্বাচন করা।
ইতিহাসে যে কোরবানিটি মানব সভ্যতার সাথে কুরবানিকে অনন্তকাল পর্যন্ত জড়িয়ে রাখার কারণ হয়ে উঠেছে তা হলো মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম (আ.) কর্তৃক তাঁর আদরের পুত্রকে আল্লাহর আদেশে কোরবানি করার স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করা। স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে পিতা ইবরাহিম (আ.) যখন পুত্র ইসমাঈলকে (আ.) কোরবানির কথা জানালেন তখন পুত্র বললেন, আল্লাহ আপনাকে যেভাবে নির্দেশ দিয়েছেন আপনি সেভাবেই করুন। নিশ্চয়ই আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্গত পাবেন। পিতা পুত্রকে শুইয়ে দিলেন এবং তাঁর গলায় ছুরিও চালালেন। কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা একটি দুম্বার কোরবানির মধ্য দিয়ে ইসমাঈলকে রক্ষা করলেন এবং ইবরাহিমের (আ.) প্রতি সন্তুষ্টও হলেন। শুধু তাই নয়, এ কোরবানিকে ভবিষ্যতের জাতিদের জন্যে বিধান হিসেবে স্মরণীয় করে রাখলেন। (বিস্তারিত দেখুন: আল-কুরআন, সুরা আস-সাফফাত: ৩৭: ১০২-১১১)। এ ঘটনা থেকে যেসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয় তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ১। নবীদের স্বপ্ন সত্য ওহি। ২। কোরবানির জন্যে প্রিয় বস্তু হওয়া জরুরি। ৩। সন্তানের পরিবর্তে পশুর কোরবানি এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্যে বিশেষ অনুগ্রহ। ৪। কোরবানির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল পর্বে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই চূড়ান্ত লক্ষ্য। ৫। আল্লাহ কাজটিকে নয়, বরং আন্তরিকতাকে দেখেন। ৬। কোরবানির জন্যে সর্বোত্তম জিনিস হওয়া জরুরি। ৭। আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ক্ষতি থেকে যেমন রক্ষা করেন তেমনি উত্তম প্রতিদানও দেন। ৮। বিশেষ কিছু কাজকে আল্লাহ সব মানুষের জন্যে পছন্দ করেন এবং আল্লাহ চান যে সব বান্দাগণ এ থেকে উপকৃত হোক; উত্তম প্রতিদান লাভ করুক। ৯। পরীক্ষা শুধু পিতার জন্যে না, বরং পুত্রের জন্যেও ছিল। পিতা নবী ছিলেন কিন্তু পুত্র ছিলেন বালক। আল্লাহ তাঁর সব প্রিয় বান্দাকে পরীক্ষা করেন। এবং ১০। পরীক্ষা যত বড় প্রতিদানও তত বেশি।
সর্বশেষ নবী ও রাসুলের (সা.) প্রতিও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এভাবে: “বলুন, হে মুহাম্মদ (স.), আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ সবকিছু আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিনের জন্যে। তাঁর কোনও শরিক নেই। আমাকে তাঁরই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং আমি সকলের আগে তাঁর প্রথম অনুগত্যশীল।” (সুরা আল-আন‘আম: ৬: ১৬২-১৬৩)
রাসুলের (সা.) তাঁর সকল উম্মত এ-ব্যাপারে আদিষ্ট হয়েছেন এভাবে : “অতএব আপনার পালন কর্তার উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করুন এবং কোরবানি করুন।” (সুরা আল-কাওছার: ১০৮: ২)
মানব ইতিহাসের শুরু থেকে সর্বশেষ নবী মুহাম্মদের (সা.) উম্মত পর্যন্ত যে কোরবানি প্রচলিত হয়ে আসছে। বিশেষ করে নবী ইব্রাহিমের (আ.) কোরবানিকে সকল সৎকর্মশীল বান্দার জন্যে আল্লাহ আবশ্যকীয় করেছেন। সে আমলটি আমরা সামর্থ্যবান সকল বিশ্বাসী পালন করি। হাজীগণ কোরবানির মাধ্যমে হজের কার্যক্রম শেষ করেন। কিন্তু মক্কার বাইরেও সারা পৃথিবীতে যারা হজে যেতে পারেন না তাদের জন্যেও কোরবানির এই মহৎ প্রতিদান থেকে বঞ্চিত করা হয়নি।
আজ আমরা আমাদের প্রিয় সন্তানকে কোরবানি করি না বটে কিন্তু যে পশুটি কোরবানি করি তা প্রতীকী। এর মাধ্যমে আল্লাহ যাচাই করেন আমাদের অন্তরকে। আন্তরিকতা, ভালোবাসা, ভয় এবং প্রতিদান পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা সেখানে মৌলিক বিবেচ্য বিষয়। আল্লাহ জানিয়ে দিচ্ছেন এভাবে: “এগুলোর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, কিন্তু তাঁর কাছে পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া।…” (সুরা আল-হজ, ২২: ৩৭)
সুস্পষ্টভাবে বিধিত এ বিষয়গুলো কেন যেন ফিকে হয়ে গেছে আমাদের কাছে। নিয়তের খুলুসিয়াতের পরিবর্তে প্রদর্শনের ইচ্ছা বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। আল্লাহর প্রতিদানের চেয়ে মানুষের বাহবা পাওয়ার নেশা আমাদের পেয়ে বসেছে। আল্লাহর দেওয়া বিধান পালনের ভয় থেকেও সামাজিকতার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাই তো, কোরবানির পশু ক্রয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে দামে, দর্শনে কিংবা সাইজে। পাশাপাশি বাসিন্দার সঙ্গে প্রতিযোগিতার মানসিকতা তুঙ্গে উঠে উপেক্ষিত হচ্ছে আল্লাহর বিধান। পশু ক্রয়ে লাভ-লালসার হিসেবটা তাই বার বার উঠে আসে পারিবারিক ও সামাজিক আলোচনায়। কোরবানির গোশতের স্বাদের বর্ণনা ও দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণের ব্যবস্থা আমাদের আরও নিচ হতে সাহায্য করেছে অজান্তেই। কোরবানির পশু নিয়ে গর্ব এবং লজ্জাবোধ আমাদের প্রকৃত স্বাদ থেকে বঞ্চিত করেছে পুরোটাই। আমরা বুঝিনি।
উপলব্ধি করতে পারিনি কোরবানির ইতিহাস, উদ্দেশ্য, করণীয় ও বর্জনীয়। ফলে, উৎসবমুখর পশু নিধন কিংবা গোশত খাবার এক সংস্কৃতি আমাদের ধীরে ধীরে কখন যে গ্রাস করে ফেলেছে তা বুঝে উঠতে পারিনি। স্পষ্টত দুর্বল কিংবা বেঠিক নিয়ত, আন্তরিকতার ঘাটতি কিংবা ত্রুটি, গর্ববোধ কিংবা হেয় করার মানসিকতা, দীনের বিধানের চেয়ে সামাজিকতা ভয় কিংবা তা রক্ষা করার প্রবণতা নিয়ে যে কোরবানি করা হবে তা আল্লাহর কাছে কখনোই কবুল হবে না। আর এ রকম রসিকতার জন্যে পেতে হবে নিশ্চিত শাস্তি। শাস্তি হবে, আল্লাহ দেওয়া বিধানকে পালন না করার জন্যে এবং হেয় করার জন্যে।
সুতরাং আসুন আমাদের সাধ্যমত কোরবানি করি সঠিক নিয়তে, সঠিক উদ্দেশ্য সাধনে এবং সঠিক কর্মপন্থায়। সেখানে পুরোটা জুড়ে থাকুক আল্লাহ ও তাঁর বিধানের প্রতি ভালোবাসা, উত্তম প্রতিদান পাওয়ার নেশা আর ত্রুটিপূর্ণ কাজের জন্যে লজ্জা ও ভয়। আল্লাহ আমাদের সকল ভালো কাজগুলো কবুল করুন আর ভুল-ত্রুটিগুলো ক্ষমা করে দিন। আমিন।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান, ইসলামী শিক্ষা বিভাগ, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।