ঢাকা ০৫:৩৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৭ জুন ২০২৫

কোরবানির অর্থনীতি ও সমাজনীতি

  • আপডেট সময় : ০৯:৫৯:২০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৫ জুন ২০২৪
  • ১০১ বার পড়া হয়েছে

আলী রেজা : ঈদ-উল আজহা মুসলিম সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড়ো ধর্মীয় উৎসব। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে মুসলিম বিশ্বে চলে নানা আয়োজন। এ উপলক্ষ্যে পশু ও পণ্য ক্রয়-বিক্রয় থেকে শুরু করে সামাজিকতার ক্ষেত্রে যুক্ত হয় নতুন মাত্রা। ধর্মীয় গুরুত্বের পাশাপাশি এ উৎসবের আর্থ-সামাজিক গুরুত্বও কম নয়। ঈদ-উল আজহার প্রধান পর্ব হলো কোরবানি। কোরবানিকে কেন্দ্র করে সারা দেশে কোরবানিযোগ্য পশুর ক্রয়-বিক্রয় বছরের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক গুণ বেড়ে যায়। অস্থায়ী পশুর হাট বসে গ্রাম ও শহরের বিভিন্ন স্থানে। এক সময় গ্রামীণ এলাকায় কৃষকের ঘরে ঘরে গরু-ছাগল পালন করা হতো। সচ্ছল কৃষকেরা পালের গরু বা ছাগল দিয়েই কোরবানি করতে পারতেন। কোরবানির জন্য নির্বাচন করা পশুটির আদর-যতœও বেড়ে যেত।
আমরা ছোটোবেলায় দেখেছি কোরবানির নিয়ত করা পশুটি কারো ক্ষেতের ফসল নষ্ট করলে বা খেয়ে ফেললে তা নিয়ে তেমন কিছু বলা হতো না। পশুটিকে সবাই চিনে রাখতো এবং কেউ পারতপক্ষে কষ্ট দিত না। মায়া-মমতায় জড়িয়ে থাকা এই পশুটিকে ঈদের দিন কোরবানির জন্য মিনা বাজারে নিয়ে যাওয়ার সময় একটি শোকের আবহ তৈরি হতো। পরিবারের সবাই মিলে পশুটিকে এমনভাবে বিদায় জানাতো যে, মনে হতো পরিবারের একজন সদস্যকেই চিরবিদায় জানানো হচ্ছে। কালের বিবর্তনে কোরবানিকেন্দ্রিক সে সময়ের চিত্র এখন পুরোটাই পাল্টে গেছে। কোরবানিকে ঘিরে মানুষের আবেগ আর আগের মতো নেই। এখন কোরবানির পশুকে কেন্দ্র করে সেই শোকাবহ পরিবেশ সৃষ্টি হতে দেখা যায় না।
প্রায় সবাই ঈদের দু’চার দিন আগে কোরবানির পশু কিনে থাকেন। সম্ভব হলে বিক্রেতার জিম্মায় রেখে দেন ঈদের দিন সকাল পর্যন্ত। কেউ কেউ ঈদের নামাজ আদায় করে কোরবানির পশু কিনতে যান এবং কিনে এনে সঙ্গে সঙ্গেই কোরবানি করে দেন। এ কারণে কোরবানির পশুর প্রতি মায়া-মমতা সৃষ্টি হওয়ার পরিবেশ-পরিস্থিতি এখন আর নেই। লালন-পালন ও রাখার জায়গার অভাবেই যে এমনটা হয়ে থাকে সে বাস্তবতা অস্বীকার করছি না। যাহোক, ঈদ-উল আজহা ও কোরবানির পশু ক্রয়-বিক্রয়কে কেন্দ্র করে সারা দেশে যে বিপুল পরিমাণ আর্থিক লেনদেন ঘটে তা দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এরকম হাজার হাজার কোটি টাকার পশু ক্রয়-বিক্রয় বছরের অন্য কোনো সময়ে কল্পনাও করা যায় না। এ সময় পশু আমদানি অনেক বেড়ে যায়। ঈদ উপলক্ষ্যে বিক্রির জন্য দেশি খামাড়িরা সারা বছর পশুপালন করেন। ব্যক্তিপর্যায়ে অনেকে পশুপালন করেন ঈদ উপলক্ষ্যে বিক্রির জন্য। শুধু পশু ব্যবসায়ীরাই নয়, পশুর হাটের ইজারাদারেরাও এ সময় কোটি কোটি টাকা উপার্জন করে থাকে। সুতরাং ঈদকে কেন্দ্র করে পোশাক ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে পরিবহণ ব্যবসায়ী ও চামড়া ব্যবসায়ী পর্যন্ত- সবাই অতিরিক্ত আয়-উপার্জনের পথ তৈরি করে নেয়। ঈদকে কেন্দ্র করে কিছু ছোটোখাটো স্থানীয় ব্যবসাও চলে। মৌসুমি এ ব্যবসায় যুক্ত হয়ে অনেকে বাড়তি কিছু উপার্জন করে নেয়। ঈদ চলে গেলে সবকিছু আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। ঈদের এই বিশেষ অর্থনৈতিক কর্মকা- কিছুদিনের জন্য হলেও জাতীয় অর্থনীতির সম্পূরক হয়ে ওঠে। সামর্থ্যবানদের একটি পশু কোরবানি করা মূল উদ্দেশ্য হলেও তার সঙ্গে আনুষঙ্গিক অন্য খরচগুলোও একেবারে কম নয়। ঈদ উপলক্ষ্যে তাই যেকোনো ধরনের খরচই ঈদ অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল করে। ঈদ উপলক্ষ্যে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিদেশে যারা আছেন তাদের অনেকেই দেশে আসেন এ সময়। তারা দেশে আসলে রেমিটেন্সসহ অনেক আর্থিক ইতিবাচক দিকই দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হয়। আর যারা ঈদ উপলক্ষ্যে দেশে আসতে পারে না তারাও তাদের স্বজন-পরিজনের মাধ্যমে কোরবানির ব্যবস্থা করেন। সামগ্রিকভাবেই এসব আমাদের জাতীয় অর্থনীতিকে চাঙা করে তোলে নিশ্চয়ই। আর এটা সম্পূর্ণরূপে ঈদকে কেন্দ্র করেই। সুতরাং ঈদের একটি অর্থনৈতিক গুরুত্ব আছে। আর কোরবানি পশু ক্রয়-বিক্রয়ের বিষয়টি যুক্ত থাকার কারণে ঈদ-উল আজহার অর্থনৈতিক গুরুত্ব আরো অনেক বেড়ে যায়।
অর্থনৈতিক গুরুত্বের পাশাপাশি ঈদ-উল আজহার সামাজিক গুরুত্বও কম নয়। এ সময়ে সারা বছরের ঝিমিয়ে থাকা সমাজ সক্রিয় হয়ে ওঠে। কে কোন সমাজের লোক তা চিহ্নিত হয়। সমাজবদ্ধ কেউ নিজেদের সামাজিক গ-ির বাইরে যান না। এ সমাজব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে চল আসছে। বর্তমানে সমাজের গুরুত্ব আগের মতো নেই। তবে কোরবানি উপলক্ষ্যে গ্রামাঞ্চলে সমাজের গুরুত্ব বেড়ে যায়। কারণ গ্রামাঞ্চলে সমাজবদ্ধ হয়ে কোরবানি করার প্রথা এখনো বিধিববদ্ধ নিয়মের মতোই প্রচলিত আছে। প্রত্যেক সমাজে কোরবানিকেন্দ্রিক তিনটি শ্রেণি দেখতে পাওয়া যায়। সমাজে যারা প্রভাবশালী ও বিপুল পরিমাণে অর্থবিত্তের অধিকারী তারা সাধারণত এককভাবে কোরবানি দেন। সমাজের মধ্যবর্গে যারা আছেন তাদের বেশিরভাগ এককভাবে কোরবানি দিতে পারেন না। তারা যৌথভাবে (সর্বোচ্চ সাত ভাগে) কোরবানি দেন। আর একটি শ্রেণি আছে যাদের কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য নেই। যাদের কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য নেই তারা সামাজিকভাবে বণ্টনকৃত মাংসের ভাগ পেয়ে থাকে। ঈদ-উল আজহাকে কেন্দ্র করে এভাবে প্রতিটি সমাজ নিজেদের সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করে তোলে। এটি কোরবানির সবচেয়ে বড়ো সামাজিক গুরুত্ব। কোরবানিকে কেন্দ্র করে কখনো কখনো বৃহৎ সমাজে ভাঙন দেখা দেয়। কখনো বাড়তি সুবিধা বা অভিমান থেকে এক সমাজের মানুষ আর সমাজে চলে যায়। এতে কোথাও কোথাও সামাজিক সংকট চরম আকার ধারণ করে। কারণ গ্রামাঞ্চলে সামাজিক পরিচয় একটি বড়ো বিষয়।
সামাজিক সমর্থন ও সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে সামাজিক পরিচয় বিবেচনা করা হয়। গ্রামের মতো শহরাঞ্চলে কাঠামোবদ্ধ সমাজ নেই। ফলে শহরাঞ্চলে সামাজিক বন্ধন অনেকটা শিথিল। বেশিরভাগ মানুষ জীবিকার তাগিদে শহরে অবস্থান করে। অস্থায়ী এই লোকদের মাঝে মাঝেই ঠিকানা পরিবর্তন করার প্রয়োজন হয়। তাদের সমাজবদ্ধ হওয়ার সুযোগ নেই খুব একটা। তাদের অবশ্য সমাজবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনও পড়ে না। কারণ গ্রামের স্থায়ী ঠিকানায় তারা কোনো একটি সমাজের অন্তর্ভুক্ত থাকে। শহরে অস্থায়ীভাবে বসবাসকারী এ শ্রেণির বেশিরভাগ মানুষ ঈদ উপলক্ষ্যে গ্রামে চলে যান এবং উক্ত সমাজভুক্ত হয়ে কোরবানি করেন। যারা শহরে থেকে যান, তারা নিজেদের মতো করে কোরবানি করেন। সামাজিক বিভাজন প্রবল নয় বলে যে কেউ যে কারো সঙ্গে মিলে কোরবানি করতে পারে। স্থায়ী সমাজকাঠামো নেই বলে এতে কোনো সামাজিক সংকট সৃষ্টি হতে দেখা যায় না।
কোরবানি ছাড়াও ঈদের আর একটি সামাজিক গুরুত্ব আছে। জীবিকার তাগিদে শহরে যারা অস্থায়ীভাবে বসবাস করেন তাদের বেশিরভাগই ঈদ উপলক্ষ্যে গ্রামের স্থায়ী ঠিকানায় চলে আসে। নাড়ির টানে শহর থেকে গ্রামে আসার আনন্দটা অকৃত্রিম। ঈদ উপলক্ষ্যে গ্রামে এলে শৈশব, কৈশোর ও প্রথম যৌবনের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়। দীর্ঘ বিরতির পর এ দেখায় আনন্দ-উচ্ছ্বাস যেমন থাকে, তেমনি থাকে স্মৃতিকাতরতার আবেগ। এ আবেগকে আশ্রয় করেই বন্ধুদের মধ্যে ঈদ পুনর্মিলনীর আয়োজন করা হয়। ঈদ পুনর্মিলনী বর্তমান সময়ের একটি সামাজিক সংস্কৃতি। অতীতে বাঙালি সমাজে এ সংস্কৃতির চর্চা ছিল না। অনানুষ্ঠানিক দেখা-সাক্ষাৎ ও ঘুরে বেড়ানোর মধ্য দিয়েই পেরিয়ে যেত ঈদ উৎসব। ঈদ পুনর্মিলনী নামক আনুষ্ঠানিক এ আয়োজনে স্মৃতিচারণ ছাড়াও একটি বড়ো পর্ব হিসেবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে দেখা যায়। ফলে এর সঙ্গে শিল্পী, বাদ্যযন্ত্র ও ডেকোরেশনের ব্যবসাও যুক্ত হয়ে যায়, যেটিকে ঈদ পুনর্মিলনীর অর্থনৈতিক দিক হিসেবে বিবেচনা করা যায়। তবে ঈদ পুনর্মিলনীর সামাজিক গুরুত্বই প্রধান।
এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, ঈদ-উল আজহার এই আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট ঈদ উৎসবে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। কালের বিবর্তনের ঈদুল-উল আজহার আর্থ-সামাজিক হিসাব-নিকাশে আরো অনেক পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে বড়ো ও স্বাস্থ্যবান পশু কেনার এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। প্রদর্শনবাদী মনোভাব থেকে এ ধরনের প্রতিযোগিতা দিন দিন বেড়েই চলছে। কত টাকা দাম এবং মাংস কেমন ও কী পরিমাণে হবেÑ কোরবানির পশুকে কেন্দ্র করে এ ধরনের আলোচনাই এখন মুখ্য হয়ে উঠতে দেখা যায়। এটা কোরবানির ধর্মীয় গুরুত্বকে খাটো করে দিচ্ছে। মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে নষ্ট করে দিচ্ছে। এখন কোরবানির জন্য যে যত বড়ো পশু ক্রয় করে কিংবা যে যত বেশি সংখ্যক পশু ক্রয় করে সাধারণ মানুষের কাছে তার সামাজিক মর্যাদা তত বেশি বৃদ্ধি পায়। ভোগবাদ ও পুঁজিবাদের প্রভাবেই এমনটা হচ্ছে। এতে সামাজিক বৈষম্যও বাড়ছে। ধর্মীয় দিক থেকে নেসাব পরিমাণ মালের অধিকারী ব্যক্তির ক্ষেত্রে একটিমাত্র পশু কোরবানি করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবু একাধিক পশু কোরবানি করে অনেকে সামাজিক প্রভাব ও মর্যাদা বৃদ্ধি করতে চায়। এই চাওয়াতে প্রদর্শনবাদী মনোভাব গুরুত্ব পায়। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ত্যাগের মহিমায় অন্তরের পশুপ্রবৃত্তিকে কোরবানি করা। প্রতিবছর ঈদ ও কোরবানি আসে ত্যাগের মহিমায় নিজেকে মহিমান্বিত করার জন্য। সুতরাং অন্তরের পশুপ্রবৃত্তি ও প্রদর্শনবাদী মনোভাব বর্জন করে সাম্য ও মানবিকবোধের শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমেই ঈদ উদ্যাপন সার্থক করে তুলতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট ও পিএইচডি গবেষক, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

 

 

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

কোরবানির অর্থনীতি ও সমাজনীতি

আপডেট সময় : ০৯:৫৯:২০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৫ জুন ২০২৪

আলী রেজা : ঈদ-উল আজহা মুসলিম সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড়ো ধর্মীয় উৎসব। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে মুসলিম বিশ্বে চলে নানা আয়োজন। এ উপলক্ষ্যে পশু ও পণ্য ক্রয়-বিক্রয় থেকে শুরু করে সামাজিকতার ক্ষেত্রে যুক্ত হয় নতুন মাত্রা। ধর্মীয় গুরুত্বের পাশাপাশি এ উৎসবের আর্থ-সামাজিক গুরুত্বও কম নয়। ঈদ-উল আজহার প্রধান পর্ব হলো কোরবানি। কোরবানিকে কেন্দ্র করে সারা দেশে কোরবানিযোগ্য পশুর ক্রয়-বিক্রয় বছরের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক গুণ বেড়ে যায়। অস্থায়ী পশুর হাট বসে গ্রাম ও শহরের বিভিন্ন স্থানে। এক সময় গ্রামীণ এলাকায় কৃষকের ঘরে ঘরে গরু-ছাগল পালন করা হতো। সচ্ছল কৃষকেরা পালের গরু বা ছাগল দিয়েই কোরবানি করতে পারতেন। কোরবানির জন্য নির্বাচন করা পশুটির আদর-যতœও বেড়ে যেত।
আমরা ছোটোবেলায় দেখেছি কোরবানির নিয়ত করা পশুটি কারো ক্ষেতের ফসল নষ্ট করলে বা খেয়ে ফেললে তা নিয়ে তেমন কিছু বলা হতো না। পশুটিকে সবাই চিনে রাখতো এবং কেউ পারতপক্ষে কষ্ট দিত না। মায়া-মমতায় জড়িয়ে থাকা এই পশুটিকে ঈদের দিন কোরবানির জন্য মিনা বাজারে নিয়ে যাওয়ার সময় একটি শোকের আবহ তৈরি হতো। পরিবারের সবাই মিলে পশুটিকে এমনভাবে বিদায় জানাতো যে, মনে হতো পরিবারের একজন সদস্যকেই চিরবিদায় জানানো হচ্ছে। কালের বিবর্তনে কোরবানিকেন্দ্রিক সে সময়ের চিত্র এখন পুরোটাই পাল্টে গেছে। কোরবানিকে ঘিরে মানুষের আবেগ আর আগের মতো নেই। এখন কোরবানির পশুকে কেন্দ্র করে সেই শোকাবহ পরিবেশ সৃষ্টি হতে দেখা যায় না।
প্রায় সবাই ঈদের দু’চার দিন আগে কোরবানির পশু কিনে থাকেন। সম্ভব হলে বিক্রেতার জিম্মায় রেখে দেন ঈদের দিন সকাল পর্যন্ত। কেউ কেউ ঈদের নামাজ আদায় করে কোরবানির পশু কিনতে যান এবং কিনে এনে সঙ্গে সঙ্গেই কোরবানি করে দেন। এ কারণে কোরবানির পশুর প্রতি মায়া-মমতা সৃষ্টি হওয়ার পরিবেশ-পরিস্থিতি এখন আর নেই। লালন-পালন ও রাখার জায়গার অভাবেই যে এমনটা হয়ে থাকে সে বাস্তবতা অস্বীকার করছি না। যাহোক, ঈদ-উল আজহা ও কোরবানির পশু ক্রয়-বিক্রয়কে কেন্দ্র করে সারা দেশে যে বিপুল পরিমাণ আর্থিক লেনদেন ঘটে তা দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এরকম হাজার হাজার কোটি টাকার পশু ক্রয়-বিক্রয় বছরের অন্য কোনো সময়ে কল্পনাও করা যায় না। এ সময় পশু আমদানি অনেক বেড়ে যায়। ঈদ উপলক্ষ্যে বিক্রির জন্য দেশি খামাড়িরা সারা বছর পশুপালন করেন। ব্যক্তিপর্যায়ে অনেকে পশুপালন করেন ঈদ উপলক্ষ্যে বিক্রির জন্য। শুধু পশু ব্যবসায়ীরাই নয়, পশুর হাটের ইজারাদারেরাও এ সময় কোটি কোটি টাকা উপার্জন করে থাকে। সুতরাং ঈদকে কেন্দ্র করে পোশাক ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে পরিবহণ ব্যবসায়ী ও চামড়া ব্যবসায়ী পর্যন্ত- সবাই অতিরিক্ত আয়-উপার্জনের পথ তৈরি করে নেয়। ঈদকে কেন্দ্র করে কিছু ছোটোখাটো স্থানীয় ব্যবসাও চলে। মৌসুমি এ ব্যবসায় যুক্ত হয়ে অনেকে বাড়তি কিছু উপার্জন করে নেয়। ঈদ চলে গেলে সবকিছু আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। ঈদের এই বিশেষ অর্থনৈতিক কর্মকা- কিছুদিনের জন্য হলেও জাতীয় অর্থনীতির সম্পূরক হয়ে ওঠে। সামর্থ্যবানদের একটি পশু কোরবানি করা মূল উদ্দেশ্য হলেও তার সঙ্গে আনুষঙ্গিক অন্য খরচগুলোও একেবারে কম নয়। ঈদ উপলক্ষ্যে তাই যেকোনো ধরনের খরচই ঈদ অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল করে। ঈদ উপলক্ষ্যে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিদেশে যারা আছেন তাদের অনেকেই দেশে আসেন এ সময়। তারা দেশে আসলে রেমিটেন্সসহ অনেক আর্থিক ইতিবাচক দিকই দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হয়। আর যারা ঈদ উপলক্ষ্যে দেশে আসতে পারে না তারাও তাদের স্বজন-পরিজনের মাধ্যমে কোরবানির ব্যবস্থা করেন। সামগ্রিকভাবেই এসব আমাদের জাতীয় অর্থনীতিকে চাঙা করে তোলে নিশ্চয়ই। আর এটা সম্পূর্ণরূপে ঈদকে কেন্দ্র করেই। সুতরাং ঈদের একটি অর্থনৈতিক গুরুত্ব আছে। আর কোরবানি পশু ক্রয়-বিক্রয়ের বিষয়টি যুক্ত থাকার কারণে ঈদ-উল আজহার অর্থনৈতিক গুরুত্ব আরো অনেক বেড়ে যায়।
অর্থনৈতিক গুরুত্বের পাশাপাশি ঈদ-উল আজহার সামাজিক গুরুত্বও কম নয়। এ সময়ে সারা বছরের ঝিমিয়ে থাকা সমাজ সক্রিয় হয়ে ওঠে। কে কোন সমাজের লোক তা চিহ্নিত হয়। সমাজবদ্ধ কেউ নিজেদের সামাজিক গ-ির বাইরে যান না। এ সমাজব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে চল আসছে। বর্তমানে সমাজের গুরুত্ব আগের মতো নেই। তবে কোরবানি উপলক্ষ্যে গ্রামাঞ্চলে সমাজের গুরুত্ব বেড়ে যায়। কারণ গ্রামাঞ্চলে সমাজবদ্ধ হয়ে কোরবানি করার প্রথা এখনো বিধিববদ্ধ নিয়মের মতোই প্রচলিত আছে। প্রত্যেক সমাজে কোরবানিকেন্দ্রিক তিনটি শ্রেণি দেখতে পাওয়া যায়। সমাজে যারা প্রভাবশালী ও বিপুল পরিমাণে অর্থবিত্তের অধিকারী তারা সাধারণত এককভাবে কোরবানি দেন। সমাজের মধ্যবর্গে যারা আছেন তাদের বেশিরভাগ এককভাবে কোরবানি দিতে পারেন না। তারা যৌথভাবে (সর্বোচ্চ সাত ভাগে) কোরবানি দেন। আর একটি শ্রেণি আছে যাদের কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য নেই। যাদের কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য নেই তারা সামাজিকভাবে বণ্টনকৃত মাংসের ভাগ পেয়ে থাকে। ঈদ-উল আজহাকে কেন্দ্র করে এভাবে প্রতিটি সমাজ নিজেদের সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করে তোলে। এটি কোরবানির সবচেয়ে বড়ো সামাজিক গুরুত্ব। কোরবানিকে কেন্দ্র করে কখনো কখনো বৃহৎ সমাজে ভাঙন দেখা দেয়। কখনো বাড়তি সুবিধা বা অভিমান থেকে এক সমাজের মানুষ আর সমাজে চলে যায়। এতে কোথাও কোথাও সামাজিক সংকট চরম আকার ধারণ করে। কারণ গ্রামাঞ্চলে সামাজিক পরিচয় একটি বড়ো বিষয়।
সামাজিক সমর্থন ও সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে সামাজিক পরিচয় বিবেচনা করা হয়। গ্রামের মতো শহরাঞ্চলে কাঠামোবদ্ধ সমাজ নেই। ফলে শহরাঞ্চলে সামাজিক বন্ধন অনেকটা শিথিল। বেশিরভাগ মানুষ জীবিকার তাগিদে শহরে অবস্থান করে। অস্থায়ী এই লোকদের মাঝে মাঝেই ঠিকানা পরিবর্তন করার প্রয়োজন হয়। তাদের সমাজবদ্ধ হওয়ার সুযোগ নেই খুব একটা। তাদের অবশ্য সমাজবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনও পড়ে না। কারণ গ্রামের স্থায়ী ঠিকানায় তারা কোনো একটি সমাজের অন্তর্ভুক্ত থাকে। শহরে অস্থায়ীভাবে বসবাসকারী এ শ্রেণির বেশিরভাগ মানুষ ঈদ উপলক্ষ্যে গ্রামে চলে যান এবং উক্ত সমাজভুক্ত হয়ে কোরবানি করেন। যারা শহরে থেকে যান, তারা নিজেদের মতো করে কোরবানি করেন। সামাজিক বিভাজন প্রবল নয় বলে যে কেউ যে কারো সঙ্গে মিলে কোরবানি করতে পারে। স্থায়ী সমাজকাঠামো নেই বলে এতে কোনো সামাজিক সংকট সৃষ্টি হতে দেখা যায় না।
কোরবানি ছাড়াও ঈদের আর একটি সামাজিক গুরুত্ব আছে। জীবিকার তাগিদে শহরে যারা অস্থায়ীভাবে বসবাস করেন তাদের বেশিরভাগই ঈদ উপলক্ষ্যে গ্রামের স্থায়ী ঠিকানায় চলে আসে। নাড়ির টানে শহর থেকে গ্রামে আসার আনন্দটা অকৃত্রিম। ঈদ উপলক্ষ্যে গ্রামে এলে শৈশব, কৈশোর ও প্রথম যৌবনের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়। দীর্ঘ বিরতির পর এ দেখায় আনন্দ-উচ্ছ্বাস যেমন থাকে, তেমনি থাকে স্মৃতিকাতরতার আবেগ। এ আবেগকে আশ্রয় করেই বন্ধুদের মধ্যে ঈদ পুনর্মিলনীর আয়োজন করা হয়। ঈদ পুনর্মিলনী বর্তমান সময়ের একটি সামাজিক সংস্কৃতি। অতীতে বাঙালি সমাজে এ সংস্কৃতির চর্চা ছিল না। অনানুষ্ঠানিক দেখা-সাক্ষাৎ ও ঘুরে বেড়ানোর মধ্য দিয়েই পেরিয়ে যেত ঈদ উৎসব। ঈদ পুনর্মিলনী নামক আনুষ্ঠানিক এ আয়োজনে স্মৃতিচারণ ছাড়াও একটি বড়ো পর্ব হিসেবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে দেখা যায়। ফলে এর সঙ্গে শিল্পী, বাদ্যযন্ত্র ও ডেকোরেশনের ব্যবসাও যুক্ত হয়ে যায়, যেটিকে ঈদ পুনর্মিলনীর অর্থনৈতিক দিক হিসেবে বিবেচনা করা যায়। তবে ঈদ পুনর্মিলনীর সামাজিক গুরুত্বই প্রধান।
এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, ঈদ-উল আজহার এই আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট ঈদ উৎসবে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। কালের বিবর্তনের ঈদুল-উল আজহার আর্থ-সামাজিক হিসাব-নিকাশে আরো অনেক পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে বড়ো ও স্বাস্থ্যবান পশু কেনার এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। প্রদর্শনবাদী মনোভাব থেকে এ ধরনের প্রতিযোগিতা দিন দিন বেড়েই চলছে। কত টাকা দাম এবং মাংস কেমন ও কী পরিমাণে হবেÑ কোরবানির পশুকে কেন্দ্র করে এ ধরনের আলোচনাই এখন মুখ্য হয়ে উঠতে দেখা যায়। এটা কোরবানির ধর্মীয় গুরুত্বকে খাটো করে দিচ্ছে। মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে নষ্ট করে দিচ্ছে। এখন কোরবানির জন্য যে যত বড়ো পশু ক্রয় করে কিংবা যে যত বেশি সংখ্যক পশু ক্রয় করে সাধারণ মানুষের কাছে তার সামাজিক মর্যাদা তত বেশি বৃদ্ধি পায়। ভোগবাদ ও পুঁজিবাদের প্রভাবেই এমনটা হচ্ছে। এতে সামাজিক বৈষম্যও বাড়ছে। ধর্মীয় দিক থেকে নেসাব পরিমাণ মালের অধিকারী ব্যক্তির ক্ষেত্রে একটিমাত্র পশু কোরবানি করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবু একাধিক পশু কোরবানি করে অনেকে সামাজিক প্রভাব ও মর্যাদা বৃদ্ধি করতে চায়। এই চাওয়াতে প্রদর্শনবাদী মনোভাব গুরুত্ব পায়। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ত্যাগের মহিমায় অন্তরের পশুপ্রবৃত্তিকে কোরবানি করা। প্রতিবছর ঈদ ও কোরবানি আসে ত্যাগের মহিমায় নিজেকে মহিমান্বিত করার জন্য। সুতরাং অন্তরের পশুপ্রবৃত্তি ও প্রদর্শনবাদী মনোভাব বর্জন করে সাম্য ও মানবিকবোধের শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমেই ঈদ উদ্যাপন সার্থক করে তুলতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট ও পিএইচডি গবেষক, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়