ঢাকা ১০:৪৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৪ অগাস্ট ২০২৫

কোভিড কোলাজ

  • আপডেট সময় : ১২:০২:২৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩ জুলাই ২০২১
  • ১২৫ বার পড়া হয়েছে

মামুন আল মাহতাব : শুরু হয়েছে কঠোর লক ডাউন। শেষমেষ কি দাঁড়াবে জানিনা, তবে সকালে বাসা থেকে আমার কর্মস্থল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে যানবাহন আর পথচারী দেখলাম হাতে গোনা কয়জনা। পুলিশের চেকপোস্ট চোখে পড়েছে একটা তেজগাঁওয়ে পুরাতন বিমানবন্দরের ওখানে। কোন বিজিবি বা সেনা টহল চোখে পড়েনি, তবে যেহেতু বলা হয়েছে ধারণা করছি টহল চলছে পুরোদমে। তাছাড়া গণমাধ্যমেও খবর আসছে তাদের টহলের। প্রথমদিনের সকালটা যদি অনাগত দিনের প্রতিচ্ছবি হয় তাহলে বলতেই হবে এবারের কঠোর লকডাউনটা সম্ভবত কার্যকর হতে যাচ্ছে। এ দফায় লকডাউনটা অবশ্য শুরু হওয়ার কথা ছিল আরও কটা দিন আগে। তবে এবারও শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে তিনটা দিন পেছানো হয়েছে লকডাউন। কারণটা অবশ্য যৌক্তিক। অর্থ বছরের শেষে এসে সহসা লকডাউন নানা রকম উটকো ঝামেলার সৃষ্টি করতো বলাই বাহুল্য। তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই বিষয়টি যেহেতু নির্ধারিত হয়েই আছে, কাজেই এবারের অর্থবছরও যে জুনের ৩০শে শেষ হবে তাতো জানাই ছিল। কাজেই লক ডাউনটা যে জুলাইয়ের প্রথম কর্মদিবস থেকে শুরু হবে তা শুরুতেই বলে দেওয়া যেতে পারতো। প্রথমে সোম আর পরে বৃহস্পতিবারে লক ডাউনের পরিবর্তিত সিদ্ধান্ত আসায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটা কমেন্ট খুব চাউর হয়েছে – ‘চাঁদ দেখা যায়নি, পবিত্র লকডাউন বৃহস্পতিবার থেকে’।

দুই .আমার এক পরিচিত ভদ্রলোকের সম্প্রতি করোন রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। ভালই আছেন, রোগের লক্ষণ নেই বললেই চলে। বাসায় বসেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত করোনাভাইরাস সংক্রমিত রোগীর খোঁজ খবর নেওয়াটা নিও নরমাল শিষ্টাচারের মধ্যে পরে। খবরটা পেয়ে ফোন করেছিলাম ভদ্রলোকের ভালো মন্দ খবর নিতে। ভালই আছেন। জানালেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে ইভিনিং ওয়াকে বের হয়েছেন। অন্য সবার থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটছেন ইদানিং।

তিন. এই সেদিনের কথা। গভীর রাতে চেম্বার যখন গোটানোর পালা, এসে হাজির এক রোগী। সাত মাস আগে তার ফলোআপে আসার কথা ছিল। লিভারে সামান্যই সমস্যা, কাজেই প্যান্ডেমিক বিবেচনায় ফলোআপে বিলম্বে আসাটা সমস্যা নয়, সমস্যাটা অন্যখানে। মাত্রই তার কোভিড রিপোর্টটা পজিটিভ এসেছে। তাই দ্রুত তিনি লিভারের দু-চারটে পরীক্ষা করে সেই কোন্ সন্ধ্যা থেকে চেম্বারে এসে অপেক্ষা করছেন আমাকে দেখাবেন বলে। সময় নিয়ে দেখাবেন বলে অপেক্ষায় ছিলেন শেষ রোগীটি শেষ না হওয়া পর্যন্ত। আমার চেম্বার সহকারী তাকে বিনয়ের সাথে পরামর্শ দিল একটি কোভিড হাসপাতালে যোগাযোগের জন্য। পরামর্শটি যে তার একেবারেই পছন্দ হলো না সেটি সিসিটিভিতে তার অভিব্যক্তি দেখেই বুঝলাম। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার চেম্বারের ওয়েটিং এরিয়ায় তখনও যে দু-চারজন রোগী বসে আছেন, তারা সুপারিশ করছেন ভদ্রলোককে দেখে দেওয়ার জন্য। হাজার হোক ভদ্রলোক করোনা নিয়ে সেই কোন সন্ধ্যা থেকে আমার অল্প একটু সাক্ষাতের জন্য অপেক্ষা করছেন বলে কথা।
চার . লকডাউনের আগের দিন গিয়েছিলাম পুরান ঢাকায় মিটফোর্ড হাসপাতালে। সেখানকার লিভার বিভাগে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হলো ইআরসিপি পরিষেবার। লিভার বিশেষজ্ঞদের জাতীয় সংগঠনটির মহাসচিব হিসেবে দাওয়াত ছিল অনুষ্ঠানে দু-চারটি কথা বলার। সুযোগ হাতছাড়া করার প্রশ্নই ওঠেনা। একেতো আমি মোটেও ‘অ-মাইক’ নই, তার উপর বাংলাদেশের লিভার বিশেষজ্ঞদের জন্য এটি একটি ল্যান্ডমার্ক ঘটনাও বটে। ফেরার পথে নয়া বাজারে প্রচ- জ্যামে ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি’ দশা। কথায় আছে, অলস মস্তিস্ক ‘ক্রিয়েটিভিটির’ আখড়া। অলস জ্যামে বসে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিলাম, ‘লকড ডাউন ইন লকডাউন’।
পাঁচ . বাংলাদেশের পরম সৌভাগ্য আমরা অসাধারণ একজন প্রধানমন্ত্রী পেয়েছি যিনি দেশটাকে নিজের সংসারের চেয়ে আর দেশের মানুষগুলোকে নিজ পরিবারের চেয়ে বেশি আপন করে নিয়েছেন। দফায় দফায় তিনি ঝুঁকি নিয়েছেন বাঙালি আর বাংলাদেশের জন্য। অসংখ্যবার চেষ্টা হয়েছে তার প্রাণনাশের। এসব কোন কিছুর পরোয়া তিনি কখনই করেননি। করছেন না এই অতিমারীকালেও। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন জাতিকে কোভিড বিরোধী লড়াইয়ে। গর্বিত কণ্ঠে জাতীয় সংসদে ঘোষণা করেছেন দেশের প্রতিটি নাগরিককে তিনি বিনামূল্যে কোভিড ভ্যাকসিন প্রদান করবেন।
ছয় . বাংলাদেশে সম্ভবত দশ শতাংশ মানুষ কর দেন। ভারতে এটি বিশ শতাংশের কোঠায় আর নেপালে সম্ভবত ত্রিশ ছুঁই ছুঁই। মাঝে মাঝে ভাবি, যদি এদেশের মানুষ ভারত বা নেপালের মত কর দিতেন তাহলে এই মহিয়ষী নারীর নেতৃত্বে দেশটা আজ কোথায় গিয়ে ঠেকতো। স্রষ্টা বোধ করি যা কিছু ভালো তার সবটুকু এক পাত্রে রাখেন না।
লেখক : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগের চেয়ারম্যান এবং সম্প্রীতি বাংলাদেশ- এর সদস্য সচিব।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

কোভিড কোলাজ

আপডেট সময় : ১২:০২:২৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩ জুলাই ২০২১

মামুন আল মাহতাব : শুরু হয়েছে কঠোর লক ডাউন। শেষমেষ কি দাঁড়াবে জানিনা, তবে সকালে বাসা থেকে আমার কর্মস্থল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে যানবাহন আর পথচারী দেখলাম হাতে গোনা কয়জনা। পুলিশের চেকপোস্ট চোখে পড়েছে একটা তেজগাঁওয়ে পুরাতন বিমানবন্দরের ওখানে। কোন বিজিবি বা সেনা টহল চোখে পড়েনি, তবে যেহেতু বলা হয়েছে ধারণা করছি টহল চলছে পুরোদমে। তাছাড়া গণমাধ্যমেও খবর আসছে তাদের টহলের। প্রথমদিনের সকালটা যদি অনাগত দিনের প্রতিচ্ছবি হয় তাহলে বলতেই হবে এবারের কঠোর লকডাউনটা সম্ভবত কার্যকর হতে যাচ্ছে। এ দফায় লকডাউনটা অবশ্য শুরু হওয়ার কথা ছিল আরও কটা দিন আগে। তবে এবারও শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে তিনটা দিন পেছানো হয়েছে লকডাউন। কারণটা অবশ্য যৌক্তিক। অর্থ বছরের শেষে এসে সহসা লকডাউন নানা রকম উটকো ঝামেলার সৃষ্টি করতো বলাই বাহুল্য। তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই বিষয়টি যেহেতু নির্ধারিত হয়েই আছে, কাজেই এবারের অর্থবছরও যে জুনের ৩০শে শেষ হবে তাতো জানাই ছিল। কাজেই লক ডাউনটা যে জুলাইয়ের প্রথম কর্মদিবস থেকে শুরু হবে তা শুরুতেই বলে দেওয়া যেতে পারতো। প্রথমে সোম আর পরে বৃহস্পতিবারে লক ডাউনের পরিবর্তিত সিদ্ধান্ত আসায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটা কমেন্ট খুব চাউর হয়েছে – ‘চাঁদ দেখা যায়নি, পবিত্র লকডাউন বৃহস্পতিবার থেকে’।

দুই .আমার এক পরিচিত ভদ্রলোকের সম্প্রতি করোন রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। ভালই আছেন, রোগের লক্ষণ নেই বললেই চলে। বাসায় বসেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত করোনাভাইরাস সংক্রমিত রোগীর খোঁজ খবর নেওয়াটা নিও নরমাল শিষ্টাচারের মধ্যে পরে। খবরটা পেয়ে ফোন করেছিলাম ভদ্রলোকের ভালো মন্দ খবর নিতে। ভালই আছেন। জানালেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে ইভিনিং ওয়াকে বের হয়েছেন। অন্য সবার থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটছেন ইদানিং।

তিন. এই সেদিনের কথা। গভীর রাতে চেম্বার যখন গোটানোর পালা, এসে হাজির এক রোগী। সাত মাস আগে তার ফলোআপে আসার কথা ছিল। লিভারে সামান্যই সমস্যা, কাজেই প্যান্ডেমিক বিবেচনায় ফলোআপে বিলম্বে আসাটা সমস্যা নয়, সমস্যাটা অন্যখানে। মাত্রই তার কোভিড রিপোর্টটা পজিটিভ এসেছে। তাই দ্রুত তিনি লিভারের দু-চারটে পরীক্ষা করে সেই কোন্ সন্ধ্যা থেকে চেম্বারে এসে অপেক্ষা করছেন আমাকে দেখাবেন বলে। সময় নিয়ে দেখাবেন বলে অপেক্ষায় ছিলেন শেষ রোগীটি শেষ না হওয়া পর্যন্ত। আমার চেম্বার সহকারী তাকে বিনয়ের সাথে পরামর্শ দিল একটি কোভিড হাসপাতালে যোগাযোগের জন্য। পরামর্শটি যে তার একেবারেই পছন্দ হলো না সেটি সিসিটিভিতে তার অভিব্যক্তি দেখেই বুঝলাম। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার চেম্বারের ওয়েটিং এরিয়ায় তখনও যে দু-চারজন রোগী বসে আছেন, তারা সুপারিশ করছেন ভদ্রলোককে দেখে দেওয়ার জন্য। হাজার হোক ভদ্রলোক করোনা নিয়ে সেই কোন সন্ধ্যা থেকে আমার অল্প একটু সাক্ষাতের জন্য অপেক্ষা করছেন বলে কথা।
চার . লকডাউনের আগের দিন গিয়েছিলাম পুরান ঢাকায় মিটফোর্ড হাসপাতালে। সেখানকার লিভার বিভাগে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হলো ইআরসিপি পরিষেবার। লিভার বিশেষজ্ঞদের জাতীয় সংগঠনটির মহাসচিব হিসেবে দাওয়াত ছিল অনুষ্ঠানে দু-চারটি কথা বলার। সুযোগ হাতছাড়া করার প্রশ্নই ওঠেনা। একেতো আমি মোটেও ‘অ-মাইক’ নই, তার উপর বাংলাদেশের লিভার বিশেষজ্ঞদের জন্য এটি একটি ল্যান্ডমার্ক ঘটনাও বটে। ফেরার পথে নয়া বাজারে প্রচ- জ্যামে ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি’ দশা। কথায় আছে, অলস মস্তিস্ক ‘ক্রিয়েটিভিটির’ আখড়া। অলস জ্যামে বসে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিলাম, ‘লকড ডাউন ইন লকডাউন’।
পাঁচ . বাংলাদেশের পরম সৌভাগ্য আমরা অসাধারণ একজন প্রধানমন্ত্রী পেয়েছি যিনি দেশটাকে নিজের সংসারের চেয়ে আর দেশের মানুষগুলোকে নিজ পরিবারের চেয়ে বেশি আপন করে নিয়েছেন। দফায় দফায় তিনি ঝুঁকি নিয়েছেন বাঙালি আর বাংলাদেশের জন্য। অসংখ্যবার চেষ্টা হয়েছে তার প্রাণনাশের। এসব কোন কিছুর পরোয়া তিনি কখনই করেননি। করছেন না এই অতিমারীকালেও। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন জাতিকে কোভিড বিরোধী লড়াইয়ে। গর্বিত কণ্ঠে জাতীয় সংসদে ঘোষণা করেছেন দেশের প্রতিটি নাগরিককে তিনি বিনামূল্যে কোভিড ভ্যাকসিন প্রদান করবেন।
ছয় . বাংলাদেশে সম্ভবত দশ শতাংশ মানুষ কর দেন। ভারতে এটি বিশ শতাংশের কোঠায় আর নেপালে সম্ভবত ত্রিশ ছুঁই ছুঁই। মাঝে মাঝে ভাবি, যদি এদেশের মানুষ ভারত বা নেপালের মত কর দিতেন তাহলে এই মহিয়ষী নারীর নেতৃত্বে দেশটা আজ কোথায় গিয়ে ঠেকতো। স্রষ্টা বোধ করি যা কিছু ভালো তার সবটুকু এক পাত্রে রাখেন না।
লেখক : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগের চেয়ারম্যান এবং সম্প্রীতি বাংলাদেশ- এর সদস্য সচিব।