লাইফস্টাইল ডেস্ক: মানুষের শরীরের ঘ্রাণ ঠিক কীভাবে বদলায়, কোন খাবার সুগন্ধ বাড়ায় আর কোন খাবারে বাড়ে দুর্গন্ধ—এসব নিয়ে বহুদিন ধরে গবেষণা চলছে। রসুন, মাংস, ফল-সবজির মতো খাবারই শুধু নয়, এমনকি উপবাস করলেও শরীরের গন্ধ পাল্টে যেতে পারে। আর সেই গন্ধই নির্ধারণ করতে পারে অন্য কারও কাছে আমরা কতটা আকর্ষণীয় মনে হব।
প্রতিটি মানুষের আঙুলের ছাপ যেমন আলাদা, শরীরের ঘ্রাণও তেমন অনন্য। মানুষের ব্যক্তিত্ব, মানসিক অবস্থা, স্বাস্থ্য, এমনকি হরমোন—সবই এই ঘ্রাণকে প্রভাবিত করে।
স্কটল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব স্টারলিং এর সোশাল সাইকোলজির অধ্যাপক ক্রেইগ রবার্টস বলেন, গত কয়েক দশকের গবেষণায় পরিষ্কার হয়েছে যে জিন, হরমোন, স্বাস্থ্য এবং পরিচ্ছন্নতার অভ্যাস মিলেই আমাদের শরীরের গন্ধ তৈরি হয়। তিনি বলেন, আমরা পুরুষ হই বা নারী, তরুণ বা বৃদ্ধ, সুস্থ বা অসুস্থ, সুখী বা দুঃখী—ঘ্রাণেই আমাদের সেই অবস্থার প্রতিফলন পাওয়া যায়।
এসবের অনেক কিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে হলেও খাদ্যাভ্যাস এমন একটি বিষয় যা চাইলে বদলানো যায়। আর খাবারই মানুষের শরীরের গন্ধকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। খাবার শরীরে দুইভাবে প্রভাব ফেলে। একটি হচ্ছে পাচনতন্ত্রের মাধ্যমে, আরেকটি ত্বকের ওপর দিয়ে বের হওয়া ঘামের মাধ্যমে।
নিউইয়র্কের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বিংহ্যামটনের সহকারী অধ্যাপক লিনা বেগডাসি জানান, খাবার হজমের সময় অন্ত্রে ব্যাকটেরিয়া খাবার ভেঙে নানা গ্যাস তৈরি করে। সেখান থেকেই মুখে দুর্গন্ধ বা হ্যালিটোসিস তৈরি হতে পারে। বিশ্বজুড়ে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ কমবেশি এই সমস্যায় ভোগেন।
দ্বিতীয় উপায়ে, খাবারের রাসায়নিক উপাদান রক্তে মিশে শরীরের বিভিন্ন অংশে গিয়ে ঘামের সঙ্গে বের হয়। ঘাম নিজে গন্ধহীন, কিন্তু ব্যাকটেরিয়ার সংস্পর্শে এলেই তৈরি হয় নানা গন্ধ। সালফারযুক্ত যৌগ সবচেয়ে তীব্র গন্ধ তৈরি করে। তবে অদ্ভুত বিষয় হলো—কিছু সালফার যৌগ আবার মানুষকে বেশি আকর্ষণীয় করেও তুলতে পারে।
ব্রোকলি, বাঁধাকপি, ব্রাসেলস স্প্রাউটস, ফুলকপি—এসব স্বাস্থ্যকর হলেও এতে সালফার বেশি থাকায় পচা ডিমের মতো গন্ধ তৈরি হতে পারে। রসুন ও পেঁয়াজও একই কারণে নিঃশ্বাস ও ঘামে তীব্র গন্ধ সৃষ্টি করে। রসুন হজম হলে ডায়ালাইল ডিসালফাইড ও অ্যালাইল মিথাইল সালফাইডের মতো যৌগ তৈরি হয়, যেগুলো শরীরে অনেকক্ষণ থাকে।
তবে গবেষণায় দেখা গেছে, রসুন মুখে দুর্গন্ধ করলেও ঘামে অনেক সময় মনোরম ঘ্রাণ সৃষ্টি করে। একটি গবেষণায় ৪২ জন পুরুষের ঘামের নমুনা সংগ্রহ করে ৮২ জন নারীকে ঘ্রাণ মূল্যায়ন করতে বলা হয়। দেখা যায়, যারা বেশি রসুন খেয়েছিলেন বা সাপ্লিমেন্ট নিয়েছিলেন, তাদের ঘামকে বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। গবেষক জ্যান হেভলক এবং সহকর্মীরা তিনবার এই গবেষণা পুনরাবৃত্তি করে একই ফল পেয়েছেন। গবেষকের মতে, রসুনের অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল গুণ হয়তো শারীরিক স্বাস্থ্যের উন্নতি করে, তাই ঘ্রাণ আরও পছন্দনীয় লাগে।
অ্যাসপারাগাসে থাকা অ্যাসপারাগাস অ্যাসিড হজমের পর মিথানেথিওল ও ডাইমিথাইল সালফাইড তৈরি করে, যেগুলো প্রস্রাব ও ঘাম—দুটোর গন্ধই পাল্টে দেয়। এগুলো অত্যন্ত উদ্বায়ী বলে সহজেই বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। কারও কারও ক্ষেত্রে এ গন্ধ হয় না, কারণ পুরোপুরি নির্ভর করে জেনেটিক্সের ওপর।
অস্ট্রেলিয়ার ২০১৭ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা বেশি ফল-সবজি খান, তাদের শরীর থেকে বেশি মনোরম ও মিষ্টি ঘ্রাণ পাওয়া যায়। ক্যারোটিনয়েড বেশি থাকায় ত্বক কিছুটা হলুদ হয়ে গেলে মানুষ আরও আকর্ষণীয় মনে হয়। যাদের খাদ্যতালিকায় পরিমিত চর্বি, ডিম, টফু ছিল—তাদের ঘ্রাণও বেশি মনোরম। বিপরীতে যারা কার্বোহাইড্রেট বেশি খেয়েছেন, তাদের ঘ্রাণকে কম আকর্ষণীয় মনে হয়েছে।
মাছ ও মাংসও শরীরের গন্ধকে প্রভাবিত করে। প্রাণিজ প্রোটিন ভেঙে আমিনো অ্যাসিড ও চর্বিতে পরিণত হয়, যা ঘামে বেরিয়ে ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে মিশে গন্ধ তৈরি করে। মাছ বা মটরশুঁটিতে থাকা ট্রাইমিথাইলামাইন নামের তীব্র গন্ধযুক্ত যৌগ কারও কারও শরীরে গন্ধ আরও বাড়িয়ে দেয়। এ অবস্থাকে বলা হয় ট্রাইমিথাইলামাইনুরিয়া বা মাছের সিনড্রোম, যদিও এটি খুবই বিরল।
২০০৬ সালে ভাইটামিন গবেষক জন হিউলিচেক একটি গবেষণায় দেখেন, ৩০ জন পুরুষকে দুই সপ্তাহ মাংসসহ ও মাংসবিহীন খাবার খাওয়ানো হয়। নারীরা তাদের ঘ্রাণ মূল্যায়ন করে জানান, মাংস না খাওয়া পুরুষদের ঘ্রাণই ছিল বেশি আকর্ষণীয় ও কম তীব্র। আশ্চর্যের বিষয়, গবেষক দেখেন মাংসখোরদের নিঃশ্বাসে কখনও কখনও কম দুর্গন্ধ থাকে। তিনি বলেন, আমাদের বিবর্তনের সময়ে মানুষ প্রতিদিন মাংস খেত না। তাই আধুনিক খাদ্যাভ্যাসের প্রভাব ভিন্ন।
অ্যালকোহলও শরীরের গন্ধ বাড়ায়। লিভার অ্যালকোহল ভেঙে অ্যাসিটালডিহাইড তৈরি করে, যেটির নিজস্ব তীব্র গন্ধ আছে। পুলিশ অনেক সময় নিঃশ্বাসের ঘ্রাণেই মদ্যপান শনাক্ত করতে পারেন। অ্যালকোহল শরীরকে পানিশূন্য করে, ফলে মুখে ব্যাকটেরিয়া বাড়ে এবং দুর্গন্ধ তৈরি হয়।
কফি ও চায়ে থাকা ক্যাফেইন অ্যাপোক্রাইন ঘামগ্রন্থিকে উদ্দীপিত করে, যা ত্বকের ভাঁজে বেশি ঘাম তৈরি করতে পারে। এতে ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি পেয়ে গন্ধ বাড়তে পারে। তবে ক্যাফেইন শরীরের গন্ধ কতটা প্রভাবিত করে—সে বিষয়ে স্পষ্ট প্রমাণ নেই।
ঘ্রাণ সামাজিক যোগাযোগেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বলে মনে করেন অধ্যাপক ক্রেইগ রবার্টস। তবে মানুষের চেহারা, আচরণ ও কথা বলার সঙ্গে ঘ্রাণের প্রভাব আলাদা করে দেখা প্রায় অসম্ভব। বিভিন্ন গবেষণা ভিন্ন ভিন্ন ফল দিয়েছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু নারী ৪৮ ঘণ্টা উপবাস করলে তাদের ঘ্রাণকে বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। কিন্তু অন্য অনেক ক্ষেত্রে ঘামে বা নিঃশ্বাসে উপবাসের কারণে তীব্র দুর্গন্ধও পাওয়া গেছে।
গবেষকরা মনে করেন, খাবার কিভাবে শরীরের গন্ধকে বদলায়—তার একক, নির্দিষ্ট উত্তর নেই। মানুষের শরীর, খাদ্যাভ্যাস, জিনগত বৈশিষ্ট্য—সব মিলেই তৈরি হয় এই পরিবর্তন। প্রচুর ধরনের সুগন্ধী যৌগ শরীরে তৈরি হয়, আর প্রত্যেকটির প্রভাব আলাদা।
সূত্র: বিবিসি
ওআ/আপ্র/০৮/১২/২০২৫

























