ক্যাম্পাস ক্যারিয়ার ডেস্ক : চিকিৎসক, প্রকৌশলী কিংবা পাইলট হতে চাইলে এ–সংক্রান্ত বিষয়ে পড়ালেখার সুযোগ আছে। কিন্তু যদি উদ্যোক্তা হতে চাই, ব্যবসা করতে চাই, তাহলে কোথায় পড়ব? কী পড়ব? কিংবা উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য আদৌ কি বিশেষায়িত পড়ালেখার প্রয়োজন আছে?
দেশে-বিদেশে এ সময়ের স্বনামধন্য উদ্যোক্তা যাঁরা, তাঁদের কারও কিন্তু ‘এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ’ বা উদ্যোগসংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি নেই। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ-িই পেরোতে পারেননি, এমন সফল উদ্যোক্তার উদাহরণও ঢের আছে। তাহলে উদ্যোক্তা হওয়ার লক্ষ্য যদি থাকে, তাহলে কেন এ–সংক্রান্ত বিষয়ে পড়ব? ঢাকার ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইনোভেশন অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ বিভাগের প্রধান মো. কামরুজ্জামান বললেন, প্রয়োজন তৈরি হয়েছে বলেই বিশ্বের নামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপের কোর্স চালু হচ্ছে, এ বিষয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। বাজার যাচাই, বিপণন, বিজনেস ডেভেলপমেন্ট, প্রতিযোগিতা বিশ্লেষণ, ঝুঁকি বিশ্লেষণ, ফান্ডিং, ব্যবসার আইনি প্রক্রিয়া, এসব বিষয়ে শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে শিখছে। বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ফিল্ড ট্রিপের মাধ্যমে কিংবা পাঠ্যক্রমের অংশ হিসেবে ছোট ছোট উদ্যোগ গ্রহণ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করছে। এ অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই তাঁর উদ্যোক্তা হওয়ার পথ সহজ করবে।
অন্যদিকে, উদ্যোক্তা হতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয় নিয়েই পড়তে হবে, এমন ধারণার সঙ্গে একমত নন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) সহযোগী অধ্যাপক সাইফ নোমান খান। তাঁর মতে, কোনো নির্দিষ্ট পেশার জন্য শিক্ষার্থীকে তৈরি করা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ নয়। বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হলো একজন শিক্ষার্থীকে আরও পরিণত করা, চিন্তার ক্ষমতা বাড়ানো। সাইফ নোমান খান বলেন, ‘ব্যবসার মূল কথাই হলো “আইডিয়া”; কোনো একটি সমস্যার সমাধান করা। যেকোনো বিষয়ে পড়েই কারও মাথায় একটা ব্যবসার আইডিয়া আসতে পারে। সে জন্য এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ পড়ার প্রয়োজন নেই। ব্যবসা শুরু করার পর মানুষ ঠেকে ঠেকে শেখে। প্রয়োজনে কিছু শর্ট কোর্স করে নেওয়া যেতে পারে।’
পড়তে যদি চাই
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকসে আছে ‘উদ্যোক্তা অর্থনীতি’ বিষয়ে পড়ার সুযোগ। উদ্যোক্তা হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে ২০১৯ সালের শেষের দিকে এ বিষয়ে ভর্তি হয়েছেন তারেক রহমান। ২০২০ সালের মার্চ মাসে করোনাভাইরাসের প্রকোপে ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে যায়, তাই খুব বেশি দিন ক্লাস করার সুযোগ তারেক পাননি। তবে বিষয় নির্বাচন নিয়ে তিনি খুশি। বলছিলেন, ‘মাত্র আড়াই মাস ক্লাস করেছি। এর মধ্যেই আমরা বেশ কয়েকটা ফিল্ড ট্রিপে গিয়েছি। বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম কাছ থেকে দেখেছি।’ তারেক জানালেন, ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকস থেকে উদ্যোক্তা অর্থনীতিতে স্নাতক করতে খরচ হয় প্রায় চার লাখ টাকা।
প্লাবন শেখের গল্পটা আবার একটু অন্য রকম। শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল (সিএসই) বিষয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। ক্যাম্পাসজীবনেই বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে ‘রক্ষী’ নামে ভবনের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত একটি তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান চালু করেন। কিন্তু সিএসইতে স্নাতক তাঁর সম্পন্ন করা হয়নি। প্লাবন এখন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ইনোভেশন অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ বিভাগে পড়ছেন। তরুণ এই উদ্যোক্তা বলছিলেন, ‘ঢাবি থেকে ড্রপ আউট হওয়ার পর আমি খুঁজছিলাম কোথায় এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ নিয়ে পড়া যায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ড্যাফোডিলের এই বিভাগটি আমার জন্য মানানসই মনে হলো। এখানে নবীন উদ্যোক্তাদের জন্য “আর ইউ দ্য নেক্সট স্টার্টআপ” নামে একটি প্রকল্প আছে। এই প্রকল্পের আওতায় বৃত্তিসহ পড়া যায়।’
অনলাইনে উদ্যোগ ও উদ্ভাবনসংক্রান্ত নানা ধরনের কোর্স করার সুযোগ আছে। চাইলে হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের অনলাইন কোর্সগুলোও আপনি করতে পারেন। চার থেকে আট সপ্তাহব্যাপী এসব কোর্সের খরচ ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৭৫০ ডলার (১ লাখ ২০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনোভেশন, ক্রিয়েটিভিটি অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ সেন্টার (রপব.ফঁ.ধপ.নফ) কিংবা ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ডেভেলপমেন্ট (পবফ.নৎধপঁ.ধপ.নফ) নিয়মিত বিভিন্ন ওয়েবিনার, কর্মশালা, কোর্সের আয়োজন করে। আগ্রহীরা চাইলে ওয়েবসাইটে চোখ রাখতে পারেন।
ইনোভেশন, ক্রিয়েটিভিটি অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ সেন্টার (আইসিই) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী পরিচালক ও সহযোগী অধ্যাপক মো. রাশেদুর রহমান মনে করেন, সফল উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ ও পরামর্শের পাশাপাশি বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানও সমান গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘যদি চারুকলা, সমাজবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান অথবা গণিতের শিক্ষার্থীরা তাঁদের জন্য নির্ধারিত কোর্সের পাশাপাশি কিছু উদ্যোক্তা উন্নয়ন সংক্রান্ত কোর্স পড়ার সুযোগ পায়, আবার ব্যবসায় শিক্ষা বা অর্থনীতির ছাত্রছাত্রীরাও যদি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল বা গণিতের কিছু কোর্স করতে পারে, তাহলে তাঁদের উদ্যোগ আরও সময়োপযোগী, সফল ও সার্থক হবে।’ জানালেন, সেই ভাবনা থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিই করা হচ্ছে টিএসসিতে । ‘টিএসসি শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, সারা দেশের মানুষের একটি মিলনস্থল। পড়ার বিষয় পদার্থবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি—যা-ই হোক, সবার জন্যই যেন আইসিই একটা প্ল্যাটফর্ম হয়ে ওঠে, এটাই আমাদের চাওয়া,’ বলছিলেন তিনি।
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ডেভেলপমেন্টের সহকারী প্রকল্প ব্যবস্থাপক মো. মোফাজ্জল করিম জানালেন, উদ্যোক্তাদের উন্নয়নের জন্য নিয়মিতই তাঁরা বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করেন। শিক্ষার্থী কিংবা তরুণ উদ্যোক্তা—যে কেউ এসব কার্যক্রম থেকে উপকৃত হতে পারেন।
আছে উচ্চশিক্ষার সুযোগ
ফ্রান্সের গ্রিনোবল ইকোল ডি ম্যানেজমেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্লিন ক্যাম্পাসে ইনোভেশন স্ট্র্যাটেজি এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ বিষয়ে পড়েছেন শাকিলা সাত্তার। তিনি বিজি বি নামে একটি সামাজিক উদ্যোগের প্রতিষ্ঠাতা। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য জার্মানিতে পাড়ি জমান তিনি। শাকিলা মনে করেন, স্নাতকোত্তর করতে গিয়ে উদ্যোগসংক্রান্ত তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক জ্ঞানের পাশাপাশি তাঁর বড় পাওয়া হলো নেটওয়ার্কিংয়ের সুযোগ।
শাকিলা বলেন, ‘আমি এমন একটা ক্লাসরুম পেয়েছি, যেখানে সহপাঠীদের সবারই একটা উদ্যোগী মনোভাব আছে। বড় ব্যবসায়ী কিংবা বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে নেটওয়ার্কিংয়ের সুযোগ আমি পেয়েছি। এটাও একটা বড় পাওয়া। উদ্যোক্তা হতে হলে এ–সংক্রান্ত বিষয়েই পড়তে হবে, তা বলব না। প্রকৌশল নিয়ে পড়েও তো অনেকে ব্যাংকার হয় কিংবা ব্যবসায় শিক্ষায় পড়েও কেউ ভালো প্রোগ্রামার হতে পারে। কিন্তু আমার জীবনের লক্ষ্য যদি হয় উদ্যোক্তা হব, এ বিষয়েই পড়লে ক্ষতি কী?’
কোথায় পাব উদ্যোক্তা হওয়ার পাঠ?
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ