ঢাকা ১২:৫৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৪ জুন ২০২৫

কোটাবিরোধী আন্দোলন: নেপথ্যে কারা?

  • আপডেট সময় : ১১:০২:১২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১১ জুলাই ২০২৪
  • ৭৭ বার পড়া হয়েছে

ড. মিল্টন বিশ্বাস : ১০ জুলাই (২০২৪) সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা পদ্ধতি বাতিলের পরিপত্র ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের ওপর একমাসের স্থিতাবস্থা দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ফলে কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে সরকারের জারি করা পরিপত্রটি বহাল থাকছে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে ২০১৮ সালে আন্দোলনের মুখে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে নবম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত কোটা পদ্ধতি তুলে দেয় সরকার। ওই বছরের ৪ অক্টোবর কোটা বাতিল নিয়ে পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। পরিপত্রটির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে রিট করেন চাকরিপ্রত্যাশী ও বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুল দেন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে রুল অ্যাবসলিউট (যথাযথ) ঘোষণা করে গত ৫ জুন রায় দেন হাইকোর্ট। পরে হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদন চেম্বার আদালত হয়ে ৪ জুলাই আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য ওঠে। রিটকারী পক্ষের সময়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওইদিন আপিল বিভাগ নট টুডে (৪ জুলাই নয়) বলে আদেশ দেন। পাশাপাশি রাষ্ট্রপক্ষকে নিয়মিত লিভ টু আপিল করতে বলা হয়। এ অবস্থায় সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় স্থগিত চেয়ে ৯ জুলাই(২০২৪) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী আবেদন করে। ওই দুই শিক্ষার্থী ও রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদনের শুনানি নিয়ে হাইকোর্টের রায়ের ওপর ১০ জুলাই একমাসের স্থিতাবস্থা দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮ জুলাই অবধি চলা অবরোধ আন্দোলনের চেহারা ঠিক আজকের মতই ছিল। সেদিন যেমন বিএনপি-জামায়াত সুযোগ বুঝে শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল ঠিক তেমনি আজ প্রকাশ্যে সরকার বিরোধী আন্দোলনে সুযোগ বুঝে কোপ দিতে সচেষ্ট অপশক্তি। এজন্য কোটা বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা থাকা জরুরি। কারণ ২০১৮ সালে ২৬২ জন মারাত্মক জখম হয়েছিল। সেই পরিস্থিতি এখন আবার হোক আমরা কেউ-ই তা চাই না। ওবায়দুল কাদের(সাধারণ সম্পাদক, আওয়ামী লীগ) যথার্থই বলেছেন-‘তাদের আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি এখন শিক্ষক ও কোটা আন্দোলনের ওপর নির্ভর করছে। বিএনপির কাজ হচ্ছে অন্যের ইস্যুতে চড়া।’ ২০১৮ সালের বিক্ষোভের আগে বাংলাদেশ সরকারি নিয়োগ ব্যবস্থার অধীনে, ৫৬ শতাংশ সরকারি চাকরিতে প্রবেশের পদ নির্দিষ্ট শ্রেণির জন্য সংরক্ষিত ছিল- একাত্তরের “মুক্তিযোদ্ধা” এর সন্তান/নাতি-নাতনিদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারীদের জন্য ১০ শতাংশ, জেলাগুলির জন্য ১০ শতাংশ জনসংখ্যার ভিত্তিতে, জাতিগত সংখ্যালঘুদের জন্য ৫ শতাংশ, এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ১ শতাংশ । অন্যদিকে ৪৪ শতাংশ চাকরি প্রার্থীকে মেধার ভিত্তিতে অবস্থান নিশ্চিত করা হতো। এর আগে ২০১৩ ও ২০০৮ সালে একই ইস্যুতে আন্দোলন করা হলেও সরকারের কোটা নীতিতে পরিবর্তন আসেনি। সেসময় ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’ বিক্ষোভ ও পাল্টা সহিংসতায় ব্যাপকতা পায়। কোটা সংস্কার আন্দোলন ‘নাশকতা চালানোর উদ্দেশ্য নিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন’ হিসেবে চিহ্নিত হয়। আন্দোলন থেকে দাবি পেশ করা হয় এভাবে- কোটা ৫৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করতে হবে। কোটা থেকে যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্য পদগুলো অবশ্যই মেধা তালিকা থেকে পূরণ করতে হবে। কোটার জন্য কোনো বিশেষ পরীক্ষা নেই। বয়স-সীমা প্রত্যেক প্রার্থীর জন্য একই হতে হবে। কোনো প্রার্থী একাধিকবার কোটা সুবিধা ব্যবহার করতে পারবেন না। পরিস্থিতি সরকার বিরোধী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী হওয়ায় ২০১৮ সালের ২১ মার্চ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধা, তাদের সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি চালু রাখার ঘোষণা দেন।
অর্থাৎ গত পাঁচ বছর শেখ হাসিনার নেওয়া সিদ্ধান্তই বাস্তবায়িত হয়েছে। ২০২৪ সালে পুনরায় আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসীন হয়েছে। যুব শক্তিকে অগ্রাধিকার দিয়ে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য শুরু হয়েছে স্মার্ট বাংলাদেশের কর্মসূচি। এজন্য আদালতের বিপক্ষে যারা রাস্তা দখল করে জনগণের ভোগান্তী সৃষ্টি করছে তারা সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করছে। বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত শিক্ষার্থীরা ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে এবং সারা দেশে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন মহাসড়কগুলিতে অবরোধ বলবৎ করে মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। বরং বিষয়টি আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সমাধান হওয়া দরকার। অথচ আন্দোলনকারীরা বলছে, ‘আমাদের আন্দোলন এখন সরকার ও নির্বাহী শাখার দিকে পরিচালিত হয়েছে। আমাদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত বাংলা অবরোধ চলবে।’ সুযোগ পেয়ে আসলেই সরকার বিরোধী প্ল্যাটফর্মগুলো সক্রিয় হয়ে উঠেছে। মনে রাখা দরকার, এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৫ জুন(২০২৪) সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের নবম থেকে ত্রয়োদশ শ্রেণির ৩০ শতাংশ কোটা বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। কোটা’র বিষয়টি আইনি প্রক্রিয়ার অংশ হওয়ায় এখন অপেক্ষা করতে হবে চূড়ান্ত নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত। এজন্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন-‘হাইকোর্টের রায় সব সময়ই আমরা মেনে নিয়েছি। কিন্তু এখন আমরা কোটা বিরোধী আন্দোলনকে আবার জাগিয়ে তোলার চেষ্টা দেখতে পাচ্ছি। শিক্ষার্থীরা পড়ালেখায় মনোযোগ না দিয়ে কোটা বিরোধী আন্দোলনে লিপ্ত হচ্ছে। মেয়েরাও এতে জড়িত। আমার একটি প্রশ্ন আছে: আগে যারা কোটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল তাদের মধ্যে কতজন প্রকৃতপক্ষে সরকারি চাকরির পরীক্ষায় বসেছিল এবং কতজন পাস করেছিল?’
অনুরূপভাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন-‘কোটা পদ্ধতির সমাধান শুধুমাত্র আদালতে হতে পারে, রাস্তায় নয়। ২০১৮ সালে, শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে, সরকার কোটা পদ্ধতি বাতিল করেছে। হাইকোর্ট এটি পুনর্বহাল করেছে। এখানে সরকারের কিছু করার নেই। এটি আদালতের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে এবং তাই কোটা সমস্যাটি কেবল সেখানেই সমাধান করা যেতে পারে।’ রাজপথে অবস্থানরতরা যে বিএনপি-জামায়াতের ইন্ধনে নাশকতা সৃষ্টি করতে পারে কিংবা বিক্ষোভকারী অধিকাংশই সরকার বিরোধী- এ বাস্তবতা স্পষ্ট হয়েছে অনেকের কাছেই। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেছেন, ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন আমরা দেখেছি। সরকার বিষয়টি সমাধান করেছে। এখন কোটা পুনর্বহাল তো সরকার করেনি, করেছে আদালত। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন হচ্ছে আবার। বিষয়টি নিয়ে আমাদের নেত্রী তার অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। দলের সাধারণ সম্পাদকও বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন।
এখন কোটাবিরোধী আন্দোলনের নেপথ্যে বিএনপি কলকাঠি নাড়তে পারে। চলমান আন্দোলনে তারা সমর্থন দেওয়ায় সেই ধারণা প্রবল হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত যদি শিক্ষার্থীদের আন্দোলন রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে চায়, তবে পরিস্থিতি দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আন্দোলনের নামে দেশের শান্তি, স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে দেওয়া হবে না। কোনও ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত সফল হবে না, হতে দেওয়া হবে না। আমরা ঘটনাপ্রবাহের দিকে নজর রাখছি, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি।’ স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, কোটা সংস্কারের নামে নাশকতার আশঙ্কা রয়েছে রাজনীতিবিদদের মধ্যে। প্রকৃতপক্ষে যে আন্দোলনের কোনো ভিত্তি নেই, সেই কোটাবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছে বিএনপি-জামায়াত। এই আন্দোলনকে সন্ত্রাসী রূপ দিতেই যোগ দিয়েছে আরো নানান দল। মূলত কোটা সংস্কার ইস্যুতে যোগ দেওয়া শিক্ষার্থীরা ভুল পথে অগ্রসর হচ্ছে। কারণ চাকরি কিংবা কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির দাবি জানানো প্রথমেই দরকার ছিল। উপরন্তু নিজেদের যোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুযোগ সুবিধা বাড়ানোর দাবি করতে পারে তারা। নিজেদের দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করার জন্য যা যা দরকার তার ব্যবস্থা হওয়ার পরই তাদের কোটা ও চাকরির বিষয়ে ভাবনা আসা উচিত। একারণে সকলকে সতর্ক থাকতে হবে-এই আন্দোলন যেন হিংস্রতায় রূপ না নেয়। বিএনপি-জামায়াত তাদের লক্ষ অর্জনে মরিয়া হয়ে নাশকতা সৃষ্টি করতে পারে- সকলে সতর্ক থাকুন। আর কোটার ভাবনা আদালতকে ভাবতে দিন।

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

দেশে কোরবানির পশু পর্যাপ্ত, পাশের দেশের প্রয়োজন নেই: উপদেষ্টা

কোটাবিরোধী আন্দোলন: নেপথ্যে কারা?

আপডেট সময় : ১১:০২:১২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১১ জুলাই ২০২৪

ড. মিল্টন বিশ্বাস : ১০ জুলাই (২০২৪) সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা পদ্ধতি বাতিলের পরিপত্র ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের ওপর একমাসের স্থিতাবস্থা দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ফলে কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে সরকারের জারি করা পরিপত্রটি বহাল থাকছে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে ২০১৮ সালে আন্দোলনের মুখে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে নবম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত কোটা পদ্ধতি তুলে দেয় সরকার। ওই বছরের ৪ অক্টোবর কোটা বাতিল নিয়ে পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। পরিপত্রটির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে রিট করেন চাকরিপ্রত্যাশী ও বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুল দেন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে রুল অ্যাবসলিউট (যথাযথ) ঘোষণা করে গত ৫ জুন রায় দেন হাইকোর্ট। পরে হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদন চেম্বার আদালত হয়ে ৪ জুলাই আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য ওঠে। রিটকারী পক্ষের সময়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওইদিন আপিল বিভাগ নট টুডে (৪ জুলাই নয়) বলে আদেশ দেন। পাশাপাশি রাষ্ট্রপক্ষকে নিয়মিত লিভ টু আপিল করতে বলা হয়। এ অবস্থায় সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় স্থগিত চেয়ে ৯ জুলাই(২০২৪) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী আবেদন করে। ওই দুই শিক্ষার্থী ও রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদনের শুনানি নিয়ে হাইকোর্টের রায়ের ওপর ১০ জুলাই একমাসের স্থিতাবস্থা দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮ জুলাই অবধি চলা অবরোধ আন্দোলনের চেহারা ঠিক আজকের মতই ছিল। সেদিন যেমন বিএনপি-জামায়াত সুযোগ বুঝে শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল ঠিক তেমনি আজ প্রকাশ্যে সরকার বিরোধী আন্দোলনে সুযোগ বুঝে কোপ দিতে সচেষ্ট অপশক্তি। এজন্য কোটা বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা থাকা জরুরি। কারণ ২০১৮ সালে ২৬২ জন মারাত্মক জখম হয়েছিল। সেই পরিস্থিতি এখন আবার হোক আমরা কেউ-ই তা চাই না। ওবায়দুল কাদের(সাধারণ সম্পাদক, আওয়ামী লীগ) যথার্থই বলেছেন-‘তাদের আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি এখন শিক্ষক ও কোটা আন্দোলনের ওপর নির্ভর করছে। বিএনপির কাজ হচ্ছে অন্যের ইস্যুতে চড়া।’ ২০১৮ সালের বিক্ষোভের আগে বাংলাদেশ সরকারি নিয়োগ ব্যবস্থার অধীনে, ৫৬ শতাংশ সরকারি চাকরিতে প্রবেশের পদ নির্দিষ্ট শ্রেণির জন্য সংরক্ষিত ছিল- একাত্তরের “মুক্তিযোদ্ধা” এর সন্তান/নাতি-নাতনিদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারীদের জন্য ১০ শতাংশ, জেলাগুলির জন্য ১০ শতাংশ জনসংখ্যার ভিত্তিতে, জাতিগত সংখ্যালঘুদের জন্য ৫ শতাংশ, এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ১ শতাংশ । অন্যদিকে ৪৪ শতাংশ চাকরি প্রার্থীকে মেধার ভিত্তিতে অবস্থান নিশ্চিত করা হতো। এর আগে ২০১৩ ও ২০০৮ সালে একই ইস্যুতে আন্দোলন করা হলেও সরকারের কোটা নীতিতে পরিবর্তন আসেনি। সেসময় ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’ বিক্ষোভ ও পাল্টা সহিংসতায় ব্যাপকতা পায়। কোটা সংস্কার আন্দোলন ‘নাশকতা চালানোর উদ্দেশ্য নিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন’ হিসেবে চিহ্নিত হয়। আন্দোলন থেকে দাবি পেশ করা হয় এভাবে- কোটা ৫৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করতে হবে। কোটা থেকে যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্য পদগুলো অবশ্যই মেধা তালিকা থেকে পূরণ করতে হবে। কোটার জন্য কোনো বিশেষ পরীক্ষা নেই। বয়স-সীমা প্রত্যেক প্রার্থীর জন্য একই হতে হবে। কোনো প্রার্থী একাধিকবার কোটা সুবিধা ব্যবহার করতে পারবেন না। পরিস্থিতি সরকার বিরোধী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী হওয়ায় ২০১৮ সালের ২১ মার্চ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধা, তাদের সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি চালু রাখার ঘোষণা দেন।
অর্থাৎ গত পাঁচ বছর শেখ হাসিনার নেওয়া সিদ্ধান্তই বাস্তবায়িত হয়েছে। ২০২৪ সালে পুনরায় আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসীন হয়েছে। যুব শক্তিকে অগ্রাধিকার দিয়ে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য শুরু হয়েছে স্মার্ট বাংলাদেশের কর্মসূচি। এজন্য আদালতের বিপক্ষে যারা রাস্তা দখল করে জনগণের ভোগান্তী সৃষ্টি করছে তারা সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করছে। বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত শিক্ষার্থীরা ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে এবং সারা দেশে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন মহাসড়কগুলিতে অবরোধ বলবৎ করে মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। বরং বিষয়টি আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সমাধান হওয়া দরকার। অথচ আন্দোলনকারীরা বলছে, ‘আমাদের আন্দোলন এখন সরকার ও নির্বাহী শাখার দিকে পরিচালিত হয়েছে। আমাদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত বাংলা অবরোধ চলবে।’ সুযোগ পেয়ে আসলেই সরকার বিরোধী প্ল্যাটফর্মগুলো সক্রিয় হয়ে উঠেছে। মনে রাখা দরকার, এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৫ জুন(২০২৪) সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের নবম থেকে ত্রয়োদশ শ্রেণির ৩০ শতাংশ কোটা বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। কোটা’র বিষয়টি আইনি প্রক্রিয়ার অংশ হওয়ায় এখন অপেক্ষা করতে হবে চূড়ান্ত নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত। এজন্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন-‘হাইকোর্টের রায় সব সময়ই আমরা মেনে নিয়েছি। কিন্তু এখন আমরা কোটা বিরোধী আন্দোলনকে আবার জাগিয়ে তোলার চেষ্টা দেখতে পাচ্ছি। শিক্ষার্থীরা পড়ালেখায় মনোযোগ না দিয়ে কোটা বিরোধী আন্দোলনে লিপ্ত হচ্ছে। মেয়েরাও এতে জড়িত। আমার একটি প্রশ্ন আছে: আগে যারা কোটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল তাদের মধ্যে কতজন প্রকৃতপক্ষে সরকারি চাকরির পরীক্ষায় বসেছিল এবং কতজন পাস করেছিল?’
অনুরূপভাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন-‘কোটা পদ্ধতির সমাধান শুধুমাত্র আদালতে হতে পারে, রাস্তায় নয়। ২০১৮ সালে, শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে, সরকার কোটা পদ্ধতি বাতিল করেছে। হাইকোর্ট এটি পুনর্বহাল করেছে। এখানে সরকারের কিছু করার নেই। এটি আদালতের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে এবং তাই কোটা সমস্যাটি কেবল সেখানেই সমাধান করা যেতে পারে।’ রাজপথে অবস্থানরতরা যে বিএনপি-জামায়াতের ইন্ধনে নাশকতা সৃষ্টি করতে পারে কিংবা বিক্ষোভকারী অধিকাংশই সরকার বিরোধী- এ বাস্তবতা স্পষ্ট হয়েছে অনেকের কাছেই। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেছেন, ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন আমরা দেখেছি। সরকার বিষয়টি সমাধান করেছে। এখন কোটা পুনর্বহাল তো সরকার করেনি, করেছে আদালত। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন হচ্ছে আবার। বিষয়টি নিয়ে আমাদের নেত্রী তার অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। দলের সাধারণ সম্পাদকও বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন।
এখন কোটাবিরোধী আন্দোলনের নেপথ্যে বিএনপি কলকাঠি নাড়তে পারে। চলমান আন্দোলনে তারা সমর্থন দেওয়ায় সেই ধারণা প্রবল হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত যদি শিক্ষার্থীদের আন্দোলন রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে চায়, তবে পরিস্থিতি দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আন্দোলনের নামে দেশের শান্তি, স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে দেওয়া হবে না। কোনও ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত সফল হবে না, হতে দেওয়া হবে না। আমরা ঘটনাপ্রবাহের দিকে নজর রাখছি, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি।’ স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, কোটা সংস্কারের নামে নাশকতার আশঙ্কা রয়েছে রাজনীতিবিদদের মধ্যে। প্রকৃতপক্ষে যে আন্দোলনের কোনো ভিত্তি নেই, সেই কোটাবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছে বিএনপি-জামায়াত। এই আন্দোলনকে সন্ত্রাসী রূপ দিতেই যোগ দিয়েছে আরো নানান দল। মূলত কোটা সংস্কার ইস্যুতে যোগ দেওয়া শিক্ষার্থীরা ভুল পথে অগ্রসর হচ্ছে। কারণ চাকরি কিংবা কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির দাবি জানানো প্রথমেই দরকার ছিল। উপরন্তু নিজেদের যোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুযোগ সুবিধা বাড়ানোর দাবি করতে পারে তারা। নিজেদের দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করার জন্য যা যা দরকার তার ব্যবস্থা হওয়ার পরই তাদের কোটা ও চাকরির বিষয়ে ভাবনা আসা উচিত। একারণে সকলকে সতর্ক থাকতে হবে-এই আন্দোলন যেন হিংস্রতায় রূপ না নেয়। বিএনপি-জামায়াত তাদের লক্ষ অর্জনে মরিয়া হয়ে নাশকতা সৃষ্টি করতে পারে- সকলে সতর্ক থাকুন। আর কোটার ভাবনা আদালতকে ভাবতে দিন।