মাহমুদ আহমদ
সম্প্রতি সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ সংলগ্ন রাস্তায় পাথর মেরে নৃশংসভাবে একজন মানুষকে হত্যা আইয়ামে জাহেলিয়াতের সামাজিক অস্থিরতার চিত্রই যেন ফুটে উঠেছে। আধুনিক যুগে এসেও পাথর নিক্ষেপে মানুষ হত্যার পৈশাচিক দৃশ্য আমাদের দেখতে হচ্ছে!
মানুষ কতটা হিংস্র হলে এমন আচরণ করতে পারে। মৃত্যুর আগে সেই যুবকবে পিটিয়ে প্রায় বিবস্ত্র করে শরীরের ওপর উঠে লাফানো হয়। এমনকি মৃত্যুর পর লাশকেও নিস্তার দেওয়া হয়নি। হায়! কতই না মর্মান্তিক ও পৈশাচিক সেই দৃশ্য; যা প্রত্যেক হৃদয়বান মানুষকে কাঁদিয়েছে। আমরা এমন নৃশংসতা আর দেখতে চাই না। সমাজ ও দেশে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা এবং নৈরাজ্য সৃষ্টির অনুমতি ধর্মে নেই।
নৈরাজ্যের মাধ্যমে দেশে কেবল বিশৃঙ্খলাই দেখা দিতে পারে, শান্তি নয়। এ ছাড়া সারা বিশ্বে যে সহিংসতা হচ্ছে; তা শুধু ইসলাম কেন, কোনো ধর্মই সমর্থন করে না। আপনি-আমি যে দলের বা মতের বা ধর্মের অনুসারী হই না কেন, কোনোভাবেই দেশে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারি না।
ধর্মের নামে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরিরও অনেক উদাহরণ আমাদের দেশে রয়েছে। অথচ সমগ্র বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যই ইসলাম নামক ধর্মকে মহান আল্লাহতাআলা এ পৃথিবীতে তাঁর প্রিয় নবি, বিশ্বনবি, সর্বজাতির নবি এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবি হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শান্তির অমিয় বাণী দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। বিশ্ব নিয়ন্ত্রণকর্তা সব সময়ই মানুষকে শান্তির পথে আহ্বান করে থাকে। প্রকৃত শান্তির ধারক ও বাহক ইসলাম ধর্মের নিষ্ঠাবান, শান্তিপ্রিয়-অনুসারী মুসলমান কখনো সমাজ ও দেশের অশান্তির কারণ হতে পারে না। আল্লাহতাআলা ইসলামকে পূর্ণাঙ্গীন দ্বীন হিসেবে মনোনীত করেছেন আর রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বানিয়েছেন সবার জন্য অনুসরণীয় আদর্শ। তার (সা.) অনুসরণের মাধ্যমে যে কোনো ব্যক্তির জীবন শান্তিময় হতে পারে, হোক সে ইহুদি, খ্রিষ্টান বা যে কোনো ধর্মের অনুসারী।
শান্তির ধর্ম ইসলামে কোনোভাবেই দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করার অনুমতি দেয় না; বরং যারা নৈরাজ্য সৃষ্টি করে তাদের জন্য ভয়াবহ শাস্তির কথাও রয়েছে। যেমন- পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যারা আল্লাহ ও তার রাসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চালায়, নিশ্চয় তাদের সমুচিত শাস্তি হলো নৃশংসভাবে তাদের হত্যা করা বা ক্রুশে দিয়ে মারা অথবা তাদের হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলা কিংবা তাদের নির্বাসিত করা। এটা হলো তাদের জন্য ইহকালের লাঞ্ছনা এবং পরকালেও রয়েছে তাদের জন্য এক মহা আজাব (সুরা আল মায়েদা: ৩৩)।
রাষ্ট্র বা সমাজের সামগ্রিক স্বার্থে ও প্রয়োজনে বিপজ্জনক সর্বনাশা দুষ্কৃতকারীকে কঠোরতম শাস্তি প্রদানে ইসলাম ইতস্তত করে না। স্বপ্নবিলাসীদের আবেগ-উচ্ছ্বাস ইত্যাদির তোয়াক্কা না করে যুক্তি ও বিচারের মাপকাঠি অনুসরণ করে ইসলাম রাষ্ট্রের বা জনগণের বিরুদ্ধে অপরাধকারীর শাস্তি নির্ধারণ করে। এই আয়াতে যে নির্বাসিত করার কথা বলা হয়েছে- ইমাম আবু হানিফার (রহ.) মতে, এর তাৎপর্য হলো কারাদণ্ড। কোনো একটা ইস্যুকে কেন্দ্র করে যারা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা নিলে তা কখনো ইসলামপরিপন্থী হবে না, কেননা ইসলামেই দেশে নৈরাজ্যকারীদের শাস্তি নির্ধারণ করে দিয়েছে।
আমাদের এই দেশ একটি শান্তিপূর্ণ দেশ। এ দেশে শত শত বছর ধরে বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠীর মানুষ একত্রে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছে। এখানে যারা অশান্তি সৃষ্টি করবে, তাদের সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিহত করতে হবে।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহতাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘আর পৃথিবীতে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তোমরা এতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করো না’ (সুরা আল আরাফ: ৫৬)।
সমাজে বিশৃঙ্খলা করার কোনো শিক্ষা ইসলামে পাওয়া যায় না। যারা দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করে, তারা শুধু শান্তিকামী মানুষেরই শত্রু নয়; বরং মহান আল্লাহতাআলারও শত্রু। ইসলাম আমাদের উচ্ছৃঙ্খল জীবন পরিহার করে বিনয়ী ও নম্র হয়ে চলার শিক্ষা দেয়। পৃথিবীর সর্বত্রই যেন আজ অশান্তি বিরাজ করছে। এসব নৈরাজ্যকারীর জন্য পুরো বিশ্বই আজ রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সর্বোপরি নৈতিকভাবে চরম অধঃপতনে নিপতিত।
ইসলাম কাউকে হত্যা করার শিক্ষা দেয় না। হত্যার ব্যাপারে ইসলামের শিক্ষা হলো- ‘আর কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মুমিনকে হত্যা করলে এর প্রতিফল হবে জাহান্নাম। সেখানে সে দীর্ঘকাল থাকবে। আর আল্লাহ তার প্রতি রাগান্বিত। তিনি তাকে অভিসম্পাত করেছেন এবং তার জন্য এক মহা আজাব প্রস্তুত করে রেখেছেন’ (সুরা নেসা: ৯৩)।
কাউকে হত্যার ব্যাপারে মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম যে মোকদ্দমার ফয়সালা করা হবে; তা হবে রক্তপাত অর্থাৎ হত্যা সম্পর্কিত’ (বুখারি)।
কাউকে হত্যা করাকে ইসলাম কঠোরভাবে শুধু নিষেধ করেই শেষ করেনি; বরং যারা এসব নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করে, তাদের শাস্তি কত ভয়াবহ- এ সম্পর্কেও অবহিত করা হয়েছে। বস্তুত ইসলামি শিক্ষা এক মুসলমানকে শান্তিপ্রিয়, বিনয়ী এবং মহৎ গুণাবলির অধিকারী হতে উদ্বুদ্ধ করে। এই শিক্ষা ভুলে পরস্পর হানাহানির নীতি কোনোক্রমেই ইসলাম সমর্থন করে না। ইসলামের অনুপম শিক্ষা আজ অনেকেই বাস্তব ক্ষেত্রে বেমালুম ভুলে বসেছে।
আমরা চাই না সন্ত্রাসীদের আক্রমণে আর কোনো মায়ের বুক খালি হোক। এ দেশ আমাদের সবার, আমরা সবাই এ দেশকে ভালোবাসি, দেশের সম্পদকে ভালোবাসি, সব ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠীর মানুষকে ভালোবাসি। তাই সবাই শান্তি ও সম্প্রীতির সাথে থাকবে এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও ইসলামি চিন্তাবিদ
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ