ঢাকা ০৪:২৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কুয়াশার চাদর মুড়িয়ে হেমন্ত আসে

  • আপডেট সময় : ১০:৩৭:২৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১১ নভেম্বর ২০২১
  • ৫১ বার পড়া হয়েছে

রফিকুল ইসলাম : শরতের সাদা কাশফুল আর শিশির ভেজা দূর্বাঘাস মাড়িয়ে প্রকৃতির মাঝে স্নিগ্ধ হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে আসে হেমন্ত ।হেমন্ত আসে হিম কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে শিশির ঝরার টুপটাপ শব্দে।
ভেজা ভেজা সন্ধ্যা,মেঘমুক্ত আকাশ,জ্যোৎস্নায় ডুবানো আলোকিত রাত প্রকৃতিতে নিয়ে আসে এক অন্যরকম ভিন্ন মাত্রা। হেমন্তের প্রথম ভাগ থাকে শরতের দিতীয় ভাগ থাকে মিঠে মিঠে শীতের আমেজ। যেমন সবাই বলছে, শীত এসে গেছে। দুই ঋতুকে আলাদা করা কঠিন হয়। আগে নাকি হেমন্তকে বলা হতো হিমঋতু আর শীত কালকে বলা হতো শিশির। এর পরে আসে শীত,তাই হেমন্তকে বলা হয় শীতের পূর্বাভাস। হেমন্তে শুরু হয় নানা ধরণের উৎসব-পার্বণে, গ্রামবাংলার জীবন হয়ে উঠে মুখরিত। গ্রামেগঞ্জে মানুষের জীবনে আসে নবান্নের উৎসব। (নবান্ন মানে নতুন অন্ন) নবান্ন মানেই চারিদিকে পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধ, ঘরে ঘরে শুরু হয় নবান্ন উৎসব। হেমন্ত গ্রামবাংলার উৎসব আনন্দের প্রধান মৌসুম। ঘরে ঘরে ফসল তোলার আনন্দ, গৃহস্থ বাড়িতে নতুন ধানের তৈরী পিঠাপুলির সুগন্ধে বাতাসে ভেসে বেড়ায় হেমন্তের সুরভী।দুই ঋতুর সমাহার “
ঋতুর বিচিত্র রূপ মানুষকে মুগ্ধ করে। সব ঋতুর মধ্যেই বাঙ্গালী তার আপন সত্তা খুঁজে পায়। জীবন আর প্রকৃতি হয়ে উঠে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তার মধ্যে হেমন্ত ” হিম হিম কুয়াশায় মিশে মিষ্টি রোদের ভীতর দিয়ে গুটি গুটি পায়ে নেমে আসে প্রকৃতির মাঝে। ভরিয়ে দেয় প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের মন। বিশেষ করে হেমন্ত প্রকৃতির রূপ একটু ভিন্ন। কবি হৃদয় জেগে উঠে, হেমন্তের মনোরম প্রকৃতিতে বিদীর্ণ হয় কবি। হেমন্তের প্রকৃতি বিশেষ রূপ পেয়েছে— কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় । তিনি হেমন্তের উদ্দেশ্য করে লিখেছেন—
” আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে
এই বাংলায় , হয় তো মানুষ নয় ,হয় তো বা
শঙ্খচিল শালিখের বেশে।
হয় তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের
নবান্নের দেশে ।
কবি নজরুল নবান্নকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন —
” হাসিতে হাসিতে দিতেছে স্বামীরে ,
খুশিতে কাঁপিছে হাত ,
শিরনি রাঁধেন বড় বিবি ,বাড়ির গন্ধে
তেলেস মাত ।
শরতের শুভ্রতার শেষে হেমন্ত বাংলার জীবনে সমৃদ্ধ করেছে নানা ভাবে, হেমন্তের মায়াময় স্নিগ্ধ প্রকৃতি মধ্যে মানুষ যেন জীবনকে খুঁজে পায়—প্রেম, ইচ্ছা আকাংখ্যার এক নতুন মাত্রা। মনের মধ্যে জাগিয়ে তোলে বাঙালিয়ানা।
আজ প্রযুক্তির কল্যাণে সব হারিয়ে যেতে বসেছে। আগে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী নানা ধরণের সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। লাঠি খেলা, বাউল গান, নাগর দোলা, শখের চূড়ি,খৈ-মোয়ার পসরা নিয়ে বসতো গ্রামের মেলা।
ঘরে ঘরে ফসল তোলার আনন্দ আর ধান ভানার গান ভাসতো বাতাসে । ধান ভানা আর ভোর রাতে বাড়ি বাড়ি ঢেঁকিতে চিড়ে কোটার শব্দে মুখর হতো বাড়ি আঙ্গিনা। মনে পড়ে সেই দিনগুলির কথা—সন্ধ্যার পরে যখন মা-চাচিরা রান্নাঘরে পিঠা-পুলিতে ব্যস্ত হয়ে পড়তো তখন পড়া ফাকি দিয়ে চুপি চুপি উঠে যেতাম। পাড়ার সব ভাই-বোনদের চোরের মত ডেকে ডেকে জড়ো করে লুকোচুরি খেলতাম। হেমন্তে ধনের পোয়াল বাড়ি বাড়ি বাড়ির আঙ্গিনায় গাদা মারা থাকতো তার ভীতরে আমরা পলাতাম। যখন কাউকে খুঁজে পাওয়া যেত না, তখন তার লুকানো অবস্থান থেকে টুকরি-টুক দিতে হতো, (এই খেলার আর একটি নাম ছিল টুকরি-টুক খেলা) টুকরিটুক দিতে বলা মানে এক প্রকার হার স্বীকার , কিন্তু এটাকে হার মনে করা হতো না,তিনবার টুক দিতে পারবে, তারপর না খুঁজে পেলে হার স্বীকার করতে হতো।খেলা শেষে ভয়ে ভয়ে বাড়ি ফিরতাম। শাস্তিস্বরূপ মায়ের বকুনি আর ধানের পোয়ালে সারা শরির চিটপিট করে চুলকানোর অপরাধে সেই রাতে ধরে গোসল করিয়ে দিতো। আজ আর ছেলে মেয়েরা টুকরি-টুক খেলে না, সময় বদলে গেছে।
হেমন্তে মানুষের মন উজ্জ্বীবিত হয়ে আনন্দে মেতে উঠতো, চলতো গান, কবিতা,নাটক, যাত্রাপালা,বৈঠকী গান,পুতুল- নাচ,জারি-সারি, বাউল গান, কবির লড়াই, সব যেন আজ স্মৃতি।
মাছে-ভাতে বাঙালী। ভোর বেলা ধান গাছের ডগায় জমে থাকা শিশির বিন্দু শিশির ভেজা ধন ক্ষেতের আলপথ ধরে বিলে মাছ ধরতে যেতাম। এসময় খাল-বিলের পানি কমতে থাকে।কাদা পানিতে মাছ ধরার আনন্দই আলাদা। মাছ ধরে ডালিভর্তি মাছ নিয়ে বীরের বেশে বাড়িতে ফিরতাম। সবাই মিলে দল বেঁধে মাছ কুটার ধুম পড়তো। রান্নাঘর ভরে উঠতো মাছ ভাজা মাছের গন্ধে । আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে ..। এ যেন হেমন্তেরই আশির্বাদ।
★★★ আজ ভাটি বাংলার হৃদয় হতে সব মুছে যেতে বসেছে । হেমন্তের পাতা-ঝরার মত গ্রাম বাংলায় অনেক কিছুই ঝরে গেছে, আজ আর সেই সেই হেমন্তের উৎসব চোখে পড়ে না, একরকম শূন্যতা বিরাজ করে ।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

কুয়াশার চাদর মুড়িয়ে হেমন্ত আসে

আপডেট সময় : ১০:৩৭:২৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১১ নভেম্বর ২০২১

রফিকুল ইসলাম : শরতের সাদা কাশফুল আর শিশির ভেজা দূর্বাঘাস মাড়িয়ে প্রকৃতির মাঝে স্নিগ্ধ হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে আসে হেমন্ত ।হেমন্ত আসে হিম কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে শিশির ঝরার টুপটাপ শব্দে।
ভেজা ভেজা সন্ধ্যা,মেঘমুক্ত আকাশ,জ্যোৎস্নায় ডুবানো আলোকিত রাত প্রকৃতিতে নিয়ে আসে এক অন্যরকম ভিন্ন মাত্রা। হেমন্তের প্রথম ভাগ থাকে শরতের দিতীয় ভাগ থাকে মিঠে মিঠে শীতের আমেজ। যেমন সবাই বলছে, শীত এসে গেছে। দুই ঋতুকে আলাদা করা কঠিন হয়। আগে নাকি হেমন্তকে বলা হতো হিমঋতু আর শীত কালকে বলা হতো শিশির। এর পরে আসে শীত,তাই হেমন্তকে বলা হয় শীতের পূর্বাভাস। হেমন্তে শুরু হয় নানা ধরণের উৎসব-পার্বণে, গ্রামবাংলার জীবন হয়ে উঠে মুখরিত। গ্রামেগঞ্জে মানুষের জীবনে আসে নবান্নের উৎসব। (নবান্ন মানে নতুন অন্ন) নবান্ন মানেই চারিদিকে পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধ, ঘরে ঘরে শুরু হয় নবান্ন উৎসব। হেমন্ত গ্রামবাংলার উৎসব আনন্দের প্রধান মৌসুম। ঘরে ঘরে ফসল তোলার আনন্দ, গৃহস্থ বাড়িতে নতুন ধানের তৈরী পিঠাপুলির সুগন্ধে বাতাসে ভেসে বেড়ায় হেমন্তের সুরভী।দুই ঋতুর সমাহার “
ঋতুর বিচিত্র রূপ মানুষকে মুগ্ধ করে। সব ঋতুর মধ্যেই বাঙ্গালী তার আপন সত্তা খুঁজে পায়। জীবন আর প্রকৃতি হয়ে উঠে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তার মধ্যে হেমন্ত ” হিম হিম কুয়াশায় মিশে মিষ্টি রোদের ভীতর দিয়ে গুটি গুটি পায়ে নেমে আসে প্রকৃতির মাঝে। ভরিয়ে দেয় প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের মন। বিশেষ করে হেমন্ত প্রকৃতির রূপ একটু ভিন্ন। কবি হৃদয় জেগে উঠে, হেমন্তের মনোরম প্রকৃতিতে বিদীর্ণ হয় কবি। হেমন্তের প্রকৃতি বিশেষ রূপ পেয়েছে— কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় । তিনি হেমন্তের উদ্দেশ্য করে লিখেছেন—
” আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে
এই বাংলায় , হয় তো মানুষ নয় ,হয় তো বা
শঙ্খচিল শালিখের বেশে।
হয় তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের
নবান্নের দেশে ।
কবি নজরুল নবান্নকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন —
” হাসিতে হাসিতে দিতেছে স্বামীরে ,
খুশিতে কাঁপিছে হাত ,
শিরনি রাঁধেন বড় বিবি ,বাড়ির গন্ধে
তেলেস মাত ।
শরতের শুভ্রতার শেষে হেমন্ত বাংলার জীবনে সমৃদ্ধ করেছে নানা ভাবে, হেমন্তের মায়াময় স্নিগ্ধ প্রকৃতি মধ্যে মানুষ যেন জীবনকে খুঁজে পায়—প্রেম, ইচ্ছা আকাংখ্যার এক নতুন মাত্রা। মনের মধ্যে জাগিয়ে তোলে বাঙালিয়ানা।
আজ প্রযুক্তির কল্যাণে সব হারিয়ে যেতে বসেছে। আগে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী নানা ধরণের সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। লাঠি খেলা, বাউল গান, নাগর দোলা, শখের চূড়ি,খৈ-মোয়ার পসরা নিয়ে বসতো গ্রামের মেলা।
ঘরে ঘরে ফসল তোলার আনন্দ আর ধান ভানার গান ভাসতো বাতাসে । ধান ভানা আর ভোর রাতে বাড়ি বাড়ি ঢেঁকিতে চিড়ে কোটার শব্দে মুখর হতো বাড়ি আঙ্গিনা। মনে পড়ে সেই দিনগুলির কথা—সন্ধ্যার পরে যখন মা-চাচিরা রান্নাঘরে পিঠা-পুলিতে ব্যস্ত হয়ে পড়তো তখন পড়া ফাকি দিয়ে চুপি চুপি উঠে যেতাম। পাড়ার সব ভাই-বোনদের চোরের মত ডেকে ডেকে জড়ো করে লুকোচুরি খেলতাম। হেমন্তে ধনের পোয়াল বাড়ি বাড়ি বাড়ির আঙ্গিনায় গাদা মারা থাকতো তার ভীতরে আমরা পলাতাম। যখন কাউকে খুঁজে পাওয়া যেত না, তখন তার লুকানো অবস্থান থেকে টুকরি-টুক দিতে হতো, (এই খেলার আর একটি নাম ছিল টুকরি-টুক খেলা) টুকরিটুক দিতে বলা মানে এক প্রকার হার স্বীকার , কিন্তু এটাকে হার মনে করা হতো না,তিনবার টুক দিতে পারবে, তারপর না খুঁজে পেলে হার স্বীকার করতে হতো।খেলা শেষে ভয়ে ভয়ে বাড়ি ফিরতাম। শাস্তিস্বরূপ মায়ের বকুনি আর ধানের পোয়ালে সারা শরির চিটপিট করে চুলকানোর অপরাধে সেই রাতে ধরে গোসল করিয়ে দিতো। আজ আর ছেলে মেয়েরা টুকরি-টুক খেলে না, সময় বদলে গেছে।
হেমন্তে মানুষের মন উজ্জ্বীবিত হয়ে আনন্দে মেতে উঠতো, চলতো গান, কবিতা,নাটক, যাত্রাপালা,বৈঠকী গান,পুতুল- নাচ,জারি-সারি, বাউল গান, কবির লড়াই, সব যেন আজ স্মৃতি।
মাছে-ভাতে বাঙালী। ভোর বেলা ধান গাছের ডগায় জমে থাকা শিশির বিন্দু শিশির ভেজা ধন ক্ষেতের আলপথ ধরে বিলে মাছ ধরতে যেতাম। এসময় খাল-বিলের পানি কমতে থাকে।কাদা পানিতে মাছ ধরার আনন্দই আলাদা। মাছ ধরে ডালিভর্তি মাছ নিয়ে বীরের বেশে বাড়িতে ফিরতাম। সবাই মিলে দল বেঁধে মাছ কুটার ধুম পড়তো। রান্নাঘর ভরে উঠতো মাছ ভাজা মাছের গন্ধে । আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে ..। এ যেন হেমন্তেরই আশির্বাদ।
★★★ আজ ভাটি বাংলার হৃদয় হতে সব মুছে যেতে বসেছে । হেমন্তের পাতা-ঝরার মত গ্রাম বাংলায় অনেক কিছুই ঝরে গেছে, আজ আর সেই সেই হেমন্তের উৎসব চোখে পড়ে না, একরকম শূন্যতা বিরাজ করে ।