নিজস্ব প্রতিবেদক : শারদীয় দুর্গোৎসব ঘিরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। একই সঙ্গে পূজার আগামী দিনগুলোতেও সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। গতকাল শুক্রবার (১১ অক্টোবর) বিকেলে রাজধানীর রমনা কালীমন্দিরে পূজামণ্ডপ পরিদর্শনে গিয়ে সেনাপ্রধান এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, শতাব্দীর পর শতাব্দী আমরা একসঙ্গে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান বসবাস করে আসছি এ দেশে। এটা আমাদের সহাবস্থান। একজনের প্রতি অন্যজনের যে সহমর্মিতা, এটা অতীতে ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, আপনাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিচ্ছি। এতদিন ভালোভাবে সম্পন্ন হয়েছে, বাকি যে সময়টা রয়েছে সুন্দরভাবে উদ্যাপন করতে পারবেন বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। তিনি আরও বলেন, সবাই ভালো থাকবেন। সবাইকে শারদীয় শুভেচ্ছা। শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশেই যে যেখানে এই উৎসব পালন করছেন, সবার জন্যই থাকবে আমার শারদীয় শুভেচ্ছা।
এদিকে প্রতি বছরের মতো এবারও রাজধানীর মন্দিরগুলোতে চলছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। সাধারণত সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত প্রতিদিনই সকাল থেকে শুরু হয় পূজা। তবে এবারই প্রথম তিথির (পূজা দিন সময়) কারণে অষ্টমী ও নবমী আলাদা দিনে না হয়ে একদিনেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। যদিও অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার পূজার আনুষ্ঠানিকতা একদিন কম হয়েছে, তবুও পুরোহিতরা নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী পূজা পরিচালনা করেছেন। ভক্তদের অনেকেই বলছেন, পূজার আনুষ্ঠানিকতা যতই কম হোক না কেন, ভক্তদের মনে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস ও ভক্তি অটুট রয়েছে। নিরাপত্তা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি সন্তুষ্ট সংশ্লিষ্টরা। গতকাল শুক্রবার (১১ অক্টোবর) দুপুর থেকে রাজধানীর রমনা কালী মন্দির, জগন্নাথ হলের উপাসনালয়, ঢাকেশ্বরীসহ আশপাশের মন্দির ও পূজামণ্ডপগুলোতে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, ভক্তরা মন্দিরে এসে পূজা-অর্চনা করছেন। অনেকে আবার শুধু পূজামণ্ডপ ঘুরে দেখছেন। এদিকে মন্দিরের দায়িত্বে থাকা ভলান্টিয়াররা ভক্তদের ও দর্শনার্থীদের মাঝে পূজার প্রসাদ বিলি করছেন। প্রতিটি মন্দিরে ভক্তরা ঢাক-ঢোল বাজিয়ে আনন্দ-উল্লাস করছেন। এদিকে পূজাকে কেন্দ্র করে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য আইনশৃঙ্খলার রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে প্রতিটি মন্দিরে সতর্ক অবস্থানে দেখা গেছে। দর্শনার্থীরা পুলিশের কঠোর নিরাপত্তা তল্লাশি শেষ করে মন্দিরে প্রবেশ করছেন। সকালে অষ্টমীর পূজা শেষ হওয়ার পর, বিকেলে রমনা কালীমন্দিরে সবাইকে শারদীয় শুভেচ্ছা জানাতে ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পরিদর্শনে আসেন বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রধান ওয়াকার-উজ-জামানসহ বিমান ও নৌবাহিনীর প্রধানরা। এবারের পূজার আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে রমনা কালী মন্দিরের পূজা উদ্যাপন কমিটির পরিচালনা পর্ষদের সদস্য মৃণাল মজুমদার বলেন, এবারের পূজায় নিরাপত্তাজনিত কোনো ধরনের সমস্যা নেই। গেলবারের থেকে এবারের লোকও অনেক বেশি। মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মন্দিরে আসছেন। আমাদের সব কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবেই চলছে। তিনি বলেন, এবারই প্রথম পূজায় অষ্টমী এবং নবমী একদিনে পড়ে গেছে, তিথির কারণে। সকালে অষ্টমী পূজা হয়ে গেছে এবং শেষ রাতে নবমীর পূজা অনুষ্ঠিত হবে। দশমীর মাধ্যমে পূজার সমাপ্তি হবে। অন্যান্য সময় দুর্গাপূজায় সাধারণত একদিন বাড়তি সময় পেতাম, এবার এটা না পাওয়ায় পূজার আনুষ্ঠানিকতা কমে যাওয়ায় আনন্দ কিছুটা কমে গেছে। পরিবার নিয়ে জগন্নাথ হলের মণ্ডপ ঘুরতে আসেন তেজগাঁও এলাকার বাসিন্দা জয়ন্ত কুমার দাস। তিনি বলেন, আজ পরিবারের সঙ্গে মন্দিরে এসেছি। সবাই মিলে মায়ের দর্শন করছি। আমি ছোটবেলা থেকেই দুর্গাপূজায় প্রতিটি মণ্ডপ ও মন্দিরে আসি। ছোটবেলার মতো আজও সেই আনন্দ পাই। দুর্গাপূজা শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, এটা আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আজ আমরা সবাই মিলে মিশে এই উৎসব উদ্যাপন করছি, এটা আমাদের একতা প্রদর্শন। আমি চাই, এই উৎসব সবার জন্য শান্তিপূর্ণ হোক।
কুমারী পূজায় মাতৃবন্দনা
এদিকে প্রতি বছরের মতো এবারও সবচেয়ে বড় পরিসরে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে ঢাকার গোপীবাগে রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠে। শাস্ত্র মতে, মানববন্দনা, নারীর সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং ঈশ্বরের আরাধনাই কুমারী পূজার শিক্ষা। যে ত্রিশক্তিতে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি-স্থিতি ও লয়ের চক্রে আবর্তিত হচ্ছে, সেই শক্তি কুমারীতে বীজ আকারে আছে বলে বিশ্বাস করেন সনাতন ধর্মানুসারীরা। এই বিশ্বাসেই তারা কুমারীকে দেবীদুর্গা হিসেবে আরাধনা করেন। সাধক রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বহু বছর আগে নিজের স্ত্রী সারদা দেবীকে মাতৃজ্ঞানে যে পূজা করেছিলেন, তারই ধারাবাহিকতায় উপমহাদেশের মিশন ও মঠগুলোতে কুমারী পূজা হয়ে আসছে। পূজার আগে কুমারীকে স্নান করিয়ে নতুন লাল শাড়ি, গয়না, পায়ে আলতা, ফুলের মালা এবং অলঙ্কারে সাজানো হয় দেবীরূপে। পদ্মফুল হাতে দেবী পূজার আসনে বসার পর মন্ত্রপাঠ আর স্তুতিতে তার বন্দনা করা হয়। রামকৃষ্ণ মিশনে এবারের পূজায় কুমারী রূপে দেবীর আসনে ছিল সংহিতা ভট্টাচার্য। ২০১৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জন্ম নেওয়া এই কুমারীর বয়স আট বছর হওয়ায় শাস্ত্রমতে নাম ‘কুব্জিকা’। তার বাবার নাম সঞ্জয় ভট্টাচার্য, মাতার নাম অর্পিতা ভট্টাচার্য। ‘রামু কক্সবাজার’ স্কুলের কেজি শ্রেণিতে পড়ুয়া সংহিতার পরিবার ঢাকার রামপুরার বনশ্রীতে থাকেন বলে জানিয়েছেন রামকৃষণ মিশনের অধ্যক্ষ পূর্ণাত্মানন্দ। তিনি বলেন, “কুমারী পূজা মাতৃভাবে ঈশ্বরেরই আরাধনা। কুমারী কন্যাকে জীবন্ত প্রতিমা করে তাতে জগজ্জননীর উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন। দুর্গাপূজার অষ্টমী বা নবমীতে সাধারণত ৫ থেকে ৭ বৎসরের একটি কুমারীকে প্রতিমার পাশে বসিয়ে দেবীজ্ঞানে পূজা করা হয়।” যেকোনো জাতের মেয়েকেই কুমারী রূপে পূজা করা যেতে পারে উল্লেখ করে পূর্ণাত্মানন্দ বলেন, “তবে স্বত্ত্বগুণসম্পন্না, শান্ত, পবিত্র, সত্যশীল এসব দৈবী সম্পদের অধিকারিণী কুমারীই জগজ্জননীর প্রতিমারূপে গ্রহণের বিধি আছে।” গতকাল শুক্রবার সকাল থেকেই দেবীর ভক্তরা জড়ো হতে থাকেন রামকৃষ্ণ মিশনে। সকালে নবপত্রিকাস্নানসহ পূজার অন্যান্য রীতি পালনের পর বেলা সাড়ে ১০টায় যখন কুমারী পূজা শুরু হয়, তখন মণ্ডপের প্যান্ডেলে তিঁল ধারণের জায়গা ছিল না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তৎপর দেখা যায়। ঢাকের বাদ্য, কাঁসার ঘণ্টা, শঙ্খের আওয়াজ আর উলুধ্বনিতে মুখরিত হয় পূজা প্রাঙ্গণ, চলে ভক্তি গীতি। এছাড়া সকাল থেকেই দেবী দুর্গার আরাধনায় মণ্ডপে চলে পূজা আর চণ্ডীপাঠ। রামকৃষ্ণ মিশনে বেলা সাড়ে ১০টায় শুরু হয় কুমারী পূজা, বেলা সাড়ে ১১টায় অঞ্জলি প্রদান ও প্রসাদ বিতরণের মধ্য দিয়ে পূজার আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়। শুক্রবার সকালে কুমারী পূজার পাশাপাশি মহাঅষ্টমীর বিহিত পূজা এবং সন্ধিপূজাও হয়েছে। পূজা উদ্যাপন পরিষদ জানিয়েছে, দেশের ৩১ হাজার ৪৬১টি মন্দির ও মণ্ডপে এবার পূজা হচ্ছে। গতবছর এই সংখ্যা ছিল ৩২ হাজার ৪০৮টি। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরে এবার ২৫২টি পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, গত বছর হয়েছিল ২৪৮টিতে।
কুমারী পূজায় মাতৃবন্দনা ,পূজায় সব ধরনের নিরাপত্তা নেওয়া হয়েছে : সেনাপ্রধান
জনপ্রিয় সংবাদ