মীর আব্দুর আলীম
দেশের বাতাসে কান পাতলেই শোনা যায় একটা চাপা কাঁপুনি। কারও মুখে উচ্চারিত, কারও মনে গভীর আতঙ্কে চেপে বসা- কী হচ্ছে? এক অস্থির প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে দেশ। ড. ইউনূস কি সত্যিই সরে যাচ্ছেন? প্রশ্নটা আর কৌতূহল নয়, এটি এখন একটা আশঙ্কা, কখনো ফিসফাস, কখনো সরাসরি- ‘উনি গেলে কে আসবে? এই প্রশ্নের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে এক রাষ্ট্রের রূঢ় অস্থিরতা। কারণ ড. মুহাম্মদ ইউনূস কেবল একজন ব্যক্তি নন- তিনি একটি আপাত অসম্ভব সমঝোতার রূপক। একটি দল তাকে মেনে নিয়েছিল অভিমান চাপা দিয়ে, আরেকটি দল তাকে গ্রহণ করেছিল সাহস করে। তাকে কেন্দ্র করে যে অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থার সূচনা, সেটি আমাদের সংবিধানের পরিচিত ধারায় পড়ে না। এটি এক খণ্ড আপস, এক রকমের আপাত প্রশমনের পথ। এখন যদি সেই মানুষটি নিজে সরে দাঁড়ান বা তাকে সরে যেতে হয়, তাহলে শুধু একটি চেয়ার খালি হবে না, খালি হবে আস্থার জায়গা।
আজ আমরা এমন একটি বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে দেশের অন্যতম গ্রহণযোগ্য ও নন্দিত এক ব্যক্তিত্ব, শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস- যিনি গত জুলাইয়ের রক্তাক্ত রাজনৈতিক সংকটের পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তিনি পদত্যাগের কথা বলছেন। তার এই ঘোষণা যেন এক কামানের গর্জন! দেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থা এক নতুন দোলাচলে নেমে পড়েছে। এখন যে সময়টা বাংলাদেশ পার করছে, তা ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণ। দেশের রাজনীতি যেন এক বারুদের স্তূপের ওপর রাখা নরম চেয়ারে বসে ধূমপান করার মতো, চাইলেই বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। দেশের পত্রিকাজুড়ে কেবল এই সংবাদ। নিউইয়র্ক টাইমস বাংলাদেশ নিয়ে এক সংবাদ পরিবেশন করেছে- ‘নির্বাচন নিয়ে চাপের মুখে অধ্যাপক ইউনূসের পদত্যাগের হুমকি’- তা নিছক সাংবাদিকতা নয়, বরং এক জাতির আতঙ্কের অনুবাদ। একজন ইউনূস পদত্যাগ করলে হয়তো প্রশাসনিক গঠন একটু কেঁপে উঠবে, কিন্তু গণতন্ত্রের ভিত কেঁপে যাবে তারচেয়েও বেশি। কারণ ড. ইউনূস আজ ব্যক্তি নন, একটি প্রতীকে পরিণত হয়েছেন- সুশাসনের, মধ্যস্থতার, আশার ও মানবিক সম্ভাবণার। তিনি নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রত্যাশিত সরকার তৈরি করবেন- এই আশা দেশবাসীর। তিনি এই সময়ে পদত্যাগ করেন তা আমজনতা এমনকি বিএনপিসহ অন্য দলগুলোও চায় না। তার পদত্যাগের গুঞ্জনে হতাশা তৈরি হয়েছে।
কী অদ্ভুত ও নির্মম বাস্তবতা! যিনি রাজনৈতিক সংঘাতের রক্তাক্ত মাঠে পা দিয়েছিলেন নিরপেক্ষতার মানদণ্ড নিয়ে, তাকেই আজ বাধা দেওয়া হচ্ছে কাজ করার অধিকারেই। আসলে সমস্যা এই নয় যে তিনি কাজ করতে পারছেন না। সমস্যা হলো- তাকে কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না। কে দিচ্ছে না? কেন দিচ্ছে না? কার স্বার্থে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে আমরা একটা অন্ধকার কুঠুরির মুখোমুখি হই, যেখান থেকে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের গন্ধ বেরিয়ে আসে। সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূইয়া অকপটে বলেছেন- ‘আরেকটি এক-এগারো যেন না হয়।’ কিন্তু বাস্তবতা হলো, সেই এক-এগারোর ছায়া আবারো আমাদের মাথার ওপর ঘনিয়ে আসছে। সেই গন্ধ মাটির ভেতরে লুকিয়ে ছিল, এখন তা বাতাসে। নাহিদ ইসলামও একই কথা বলছেন, ‘আরেকটি এক-এগারোর বন্দোবস্তের পাঁয়তারা চলছে।’ গণতন্ত্রের এই দেশে ‘বন্দোবস্ত’ শব্দটা শুনলেই শিউরে উঠতে হয়।
মুফতি ফয়জুল করীম বলছেন- ‘আপনি (প্রধান উপদেষ্টা) ইচ্ছা করে ওই চেয়ারে বসেননি। জনগণ বসিয়েছে। পদত্যাগের এখতিয়ার আপনার নাই।’ এই বক্তব্য আপাতদৃষ্টিতে আবেগতাড়িত। কিন্তু গভীরে গেলে দেখা যায়- এখানে রাষ্ট্রীয় কাঠামো নিয়ে চরম এক দ্বন্দ্ব কাজ করছে। রাজনীতি এখন কেবল একটানা হর্ন বাজানো মিছিলের নাম নয়, ব্যানার আর সেøাগানের বাহার নয়, এখন এটি হয়ে গেছে ‘কে কার বিরুদ্ধে কী করে বলবে’- এই বাক্য দিয়ে গঠিত এক ষড়যন্ত্রের গ্রন্থ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও উদ্বিগ্ন- এ এক ব্যতিক্রম বার্তায়- বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভেরিফায়েড পেজ থেকে দেওয়া বিবৃতি- ‘গুজবে কান দেবেন না, বিভ্রান্ত হবেন না’- এই আহ্বান যেমন সাধারণ মানুষকে সচেতন করছে, তেমনি একটা ইঙ্গিতও দিচ্ছে। সেনাবাহিনী, যারা সাধারণত নীরব থেকে দায়িত্ব পালন করে, তারাও যদি প্রকাশ্যে বক্তব্য দেয়, তাহলে বুঝতে হবে পরিস্থিতি কেবল ঘোলাটে নয়, ঘূর্ণিঝড়ের মুখে।’
প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করলে সংবিধান কী বলে? এই প্রশ্নেরও উত্তর জটিল। সংবিধান বলে- হ্যাঁ, প্রধান উপদেষ্টা হতে হবে একজন নিরপেক্ষ নাগরিককে, যিনি অতীতে কোনো রাজনৈতিক পদে আসীন ছিলেন না, বিচারিক অভিজ্ঞতাও থাকুক। কিন্তু আমরা কি এখনো সেই পথে হাঁটছি? বাস্তবতা বলছে- এটি এক আপৎকালীন বাস্তবতা। এখানে সংবিধানের ভাষার চেয়ে অনেক বেশি কাজ করছে রাজনৈতিক ব্যাকরণের ভাষা। আর সেই ব্যাকরণেই প্রশ্ন উঠেছে- ড. ইউনূস যদি সরে যান, তাহলে কি তার মতো অরাজনৈতিক অথচ আদর্শগত গ্রহণযোগ্যতা সম্পন্ন আর কাউকে পাওয়া সম্ভব? কে সেই মানুষ হবেন, যাকে সব পক্ষ কিছুটা হলেও মেনে নেবে? রাষ্ট্রপতি কি এই ঘূর্ণিপাকে পড়ে নিজে কাউকে মনোনয়ন দেবেন? নাকি আবারো আলোচনার পর্দা খুলবে? রক্তের দাম যদি না বোঝে রাষ্ট্র, তাহলে ইতিহাস প্রতিশোধ নেয়। এই রাষ্ট্রের বুক অনেক রক্ত চেনে। ১৯৭১, ৭৫, ৮২, ৯০, এমনকি ২০০৭- প্রতিবারই সমঝোতার অভাবে রাজনীতির ঘূর্ণি গিয়ে ঠেকেছে রক্তস্রোতে। প্রতিবারই ইতিহাস সতর্ক করেছে, কিন্তু রাষ্ট্র তার পাঠ্যপুস্তক খুলে দেখে না।
এবার ব্যতিক্রম হবে, নাকি আবারো সেই চেনা পন্থা- আলোচনার বদলে হুমকি, সংলাপের বদলে সংঘর্ষ, শান্তির বদলে সড়কে বারুদের গন্ধ? কে হতে পারেন ‘পরবর্তী’? আদৌ কি কেউ পারেন? বাংলাদেশে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, যিনি রাজনৈতিকভাবে একেবারে নিরপেক্ষ, ব্যক্তিগতভাবে দাগহীন, আন্তর্জাতিকভাবেও গ্রহণযোগ্য। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি- উভয় রাজনৈতিক শিবিরের কাছে কিছুটা হলেও শ্রদ্ধাভাজন, তাকে যদি খুঁজে না পাওয়া যায়; তাহলে উপদেষ্টার পদে কে আসবে না আসবে, সেটি ততটা বড় প্রশ্ন নয়। তখন প্রশ্ন হবে রাষ্ট্রটাই কোন দিকে যাচ্ছে? প্রশ্ন হলো, এই জাতি কি আবার নিজেকেই গিলে খাবে? জাতি যদি নিজের ইতিহাস ভুলে যায়, তাহলে সে শুধু ভবিষ্যৎ হারায় না, নিজের অস্তিত্বও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ড. ইউনূস যদি সত্যিই বিদায় নেন, তাহলে দেশের রাজনৈতিক চুক্তির একটা স্তম্ভ ভেঙে পড়বে। এই পতনের আওয়াজ শুরু হবে পত্রিকার পাতায়, তারপর তা গিয়ে ঠেকবে রাজপথে, তারপর সেই শব্দ হবে- শব্দ নয়, বিস্ফোরণ। সিদ্ধান্ত দ্রুত চাই- না হলে কাল দেরি হয়ে যাবে এই মুহূর্তে প্রয়োজন- একটি জাতীয় সংলাপ, সর্বদলীয় অংশগ্রহণে একটি নতুন সমঝোতা এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তিকে দায়িত্বে আনার সাহসী সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশ এখন দাঁড়িয়ে আছে এক অনিবার্য প্রশ্নের মুখে- ড. ইউনূস চলে গেলে শূন্যতা কীভাবে পূরণ হবে? আর সেই উত্তরের ওপর নির্ভর করছে, এই জাতি আরো একটি রক্তপাত ঠেকাতে পারবে কি না।
আবার কি এক-এগারোর ছায়া? আবারো যেন এক-এগারোর ভূত ঘুরে বেড়াচ্ছে দেশের রাজনীতিতে। অস্থিরতা, গুজব, অনিশ্চয়তা- সব মিলিয়ে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। মুখে কেউ বলছে না, কিন্তু অদৃশ্য একটা শঙ্কা কাঁপাচ্ছে জাতিকে। একবার আমরা ট্যাংকের শব্দ শুনেছি, রাতারাতি সব রাজনৈতিক উচ্চারণ স্তব্ধ হয়ে যেতে দেখেছি, মিডিয়ার পর্দা কালো হয়ে গিয়েছিল। নেতারা গ্রেফতার হয়েছিলেন, কেউ ছিলেন অজ্ঞাতবাসে, কেউ বন্দি। সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা অনেকের মন থেকে এখনো যায়নি। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঘনিয়ে আসছে সেই পুরনো অজানা আতঙ্ক- এক-এগারো। প্রশ্ন হলো, এই অস্থিরতা থেকে উত্তরণের পথ কী? প্রথমত, ড. ইউনূস যদি সত্যিই পদত্যাগ করতে চান, তাহলে সেই সিদ্ধান্ত যেন দায়িত্বশীল হয়, কারণ এটি গোটা রাজনৈতিক কাঠামোকে নতুন করে নাড়িয়ে দিতে পারে। দ্বিতীয়ত, সরকার পুনর্গঠন যদি অনিবার্য হয়ে পড়ে, তাহলে তা যেন সাংবিধানিক ও আইনগত কাঠামোর মধ্যেই হয়। বিকল্প কোনো ‘পেছনের দরজা’ দিয়ে ক্ষমতার রদবদল হলে গণতন্ত্র আরো এক ধাক্কা খাবে। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলোকে অবিলম্বে সংলাপে বসতে হবে। মুখে মুখে সংলাপের কথা বলে কেউ দায় সারে না। বাস্তব পদক্ষেপ চাই। এখন আর সময় নেই দোষারোপের রাজনীতির।
কী করণীয়? আজ দরকার রাজনৈতিক দলগুলোর পরিণত আচরণ, আলোচনায় বসা এবং জাতির চেয়ে বড় কেউ নেই- এই সত্যটি মেনে নেওয়া। ড. ইউনূসকে টিকিয়ে রাখা কেবল একটি সরকারের প্রশ্ন নয়, এটি একটি জাতির সম্মান ও বিশ্বমঞ্চে গ্রহণযোগ্যতা বজায় রাখার প্রশ্ন। তিনি যদি পদত্যাগ করেন, তাহলে সেটা কেবল নিজের ব্যর্থতা নয়, আমাদের সমষ্টিগত ব্যর্থতা হিসেবে ইতিহাস লিখে রাখবে। আজ যখন লিখছি, মনে হচ্ছে- বাংলাদেশ এক চুপ করে থাকা অগ্নিগিরির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে লাভা ফুটছে, ওপরে আকাশ শান্ত। এই লাভা ফেটে গেলে কেবল শাসক নয়, জনগণ পুড়ে যাবে। এখনো সময় আছে, সমঝোতা হোক, আস্থা ফিরুক। গণতন্ত্র বাঁচুক।
আমরা চাই না আবার সেনানিয়ন্ত্রিত শাসন ফিরে আসুক, আমরা চাই না আবার গণতন্ত্রের গায়ে কাঁটাতারের বেড়া বসুক। দেশের জন্য, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সহনশীল ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়েই এখন সবাইকে পথ হাঁটতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও সমাজ গবেষক এবং মহাসচিব, কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ