স্বাস্থ্য ও পরিচর্যা ডেস্ক : কিডনি রোগীর সংখ্যা দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। বিশ্বের প্রায় ৮৫ কোটি মানুষ বিভিন্ন ধরনের কিডনি রোগে আক্রান্ত। প্রতি বছর ২৪ লাখ মানুষ ক্রনিক কিডনি ডিজিজ বা দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। অন্যদিকে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ লোক আকস্মিক কিডনি রোগে আক্রান্ত হন। এদের মধ্যে ১৭ লাখ রোগী অকালে মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশে প্রায় পৌনে তিন কোটির মতো মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত। কিডনি সমস্যা এদেশে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এর পেছনে অ্যাকসেস টু ট্রিটমেন্ট বড় কারণ। কিডনি বিকলের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় এ দেশের শতকরা ১০ জনও এ রোগের চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারেন না। অর্থাভাবে চিকিৎসাহীন থেকে আক্রান্তদের সিংহভাগ প্রাণ হারান। দেশে ১৩০টি হাসপাতালে কিডনি ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থা রয়েছে। বছরে প্রায় ২৫ হাজার লোক এ সেবা নিয়ে থাকেন। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হয়েছে বিশ্ব কিডনি দিবস। কিডনির সমস্যাকে বলা হয় ‘নীরব ঘাতক’। আপনার অজান্তেই ভেতরে ভেতরে শেষ করে দিতে পারে এই নীরব ঘাতক। তবে আগে থেকে বুঝতে পারলে কিডনি সমস্যা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
শরীর থেকে বর্জ্য বের করা ছাড়াও রক্ত তৈরি করা, হাড় শক্তিশালী করার মতো আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে আমাদের কিডনি। সুতরাং, শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াকে সচল রাখতে কিডনির সম্পর্কে সচেতনতা খুব জরুরি। বিশেষজ্ঞদের মতে, কিডনির সমস্যা দেখা দিলে শরীরে আরও বেশ কিছু রোগের প্রকোপ বাড়ে। যার ফলে স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়ার পাশাপাশি প্রাণহানিও হতে পারে। তাই কী কী কারণে কিডনির সমস্যা দেখা দিতে পারে, কোন কোন লক্ষণ দেখে কিডনির সমস্যা বোঝা যাবে, সেগুলো জেনে রাখা খুব জরুরি।
ত্বকের সমস্যা
মানবদেহে প্রয়োজনীয় লবণ ও খনিজ পদার্থের ভারসাম্য বজায় রাখাও কিডনির অন্যতম প্রধান কাজ। ত্বকের সজীবতা বজায় রাখতে ও হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষায় এই উপাদানগুলির বড় ভূমিকা থাকে। ফলে শুষ্ক খসখসে ত্বক, ত্বকের ঘা ও হাড়ের সমস্যা কিডনির অসুখের অন্যতম লক্ষণ হতে পারে।
সব সময় ক্লান্ত লাগা
কাজকর্মের উদ্যম হারিয়ে ফেলা ব়়ৃক্কের সমস্যার অন্যতম প্রধান একটি লক্ষণ। বৃক্কের মূল কাজই হলো রক্তকে পরিশুদ্ধ করা। কাজেই কিডনি সঠিকভাবে কাজ না করলে রক্তে বিষাক্ত ও অপ্রয়োজনীয় উপাদান বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে ক্লান্ত লাগে আক্রান্তের। এমনকি দেখা দিতে পারে রক্তাল্পতার সমস্যাও। রক্তাল্পতার অন্যতম প্রধান লক্ষণই হলো স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি ক্লান্তি।
অনিদ্রা
কিডনি ঠিকঠাক না কাজ করলে মূত্রের মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় বর্জ্য পদার্থগুলো দেহের বাইরে বেরোতে পারে না। এটি অনিদ্রার অন্যতম কারণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিডনির সমস্যায় আক্রান্ত মানুষদের ঘুম না আসার সমস্যা সুস্থ মানুষদের তুলনায় অনেক বেশি।
মূত্রের সমস্যা
যদি আপনাকে বারবার মূত্রত্যাগ করতে হয় তবে তা কিডনির অসুস্থতার লক্ষণ হতে পারে। বিশেষত রাতে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি বার মূত্র ত্যাগ করতে হলে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। মূত্রের সঙ্গে রক্ত বার হওয়া বা মূত্রে অতিরিক্ত ফেনা হওয়াও কিডনির সমস্যার লক্ষণ। মূত্রে অ্যালবুমিন বেশি থাকলে অতিরিক্ত ফেনা তৈরি হয়।
পা ফুলে যাওয়া
কিডনির সমস্যায় সোডিয়ামের ভারসাম্য নষ্ট হয়। এর ফলে পা ফুলে যায়। অনেক সময় খনিজ লবণের ভারসাম্যের ফলে শরীরের পেশিতে টান লাগার সমস্যা তৈরি হয়। মূলত ক্যালশিয়াম ও ফসফরসের সমস্যায় এমন ঘটনা ঘটে।
শ্বাসকষ্টের সমস্যা
যখন কিডনি কাজ করা বন্ধ করতে শুরু করে, তখন শরীরের বর্জ্য পদার্থ রক্তে মিশতে শুরু করে। এই বর্জ্য পদার্থের বেশির ভাগই হচ্ছে অম্লীয় পদার্থ। তাই এই বর্জ্য যখন রক্তের সঙ্গে ফুসফুসে পৌঁছায় তখন ফুসফুস সেই বর্জ্য বের করার জন্য কার্বন ডাই-অক্সাইড ব্যবহার করা শুরু করে। এ কারণে পর্যাপ্ত অক্সিজেন ফুসফুসে ঢুকতে পারে না। এতে শ্বাসকষ্টের সমস্যা হতে পারে। কিডনি রোগ হলে গরম আবহাওয়ার মধ্যেও শীত শীত অনুভব হয়। আর কিডনিতে সংক্রমণ হলে জ্বরও আসতে পারে।
মানসিক অস্থিরতা
কিডনির সমস্যা আপনার চোখে ঝাপসা দেখা কিংবা মানসিক অস্থিরতার সৃষ্টি করতে পারে। কারণ শরীরের বর্জ্য পদার্থের একটি বড় অংশ হচ্ছে ইউরিয়া। কিডনির সমস্যার কারণে ইউরিয়া শরীর থেকে বের না হয়ে বরং রক্তে মিশে যায়। এই দূষিত রক্ত মস্তিষ্কে পৌঁছে মানসিক অস্থিরতা, ঝাপসা দেখা এই ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করে। যদি ইউরিয়ার পরিমাণ অত্যধিক হয় তাহলে তা মস্তিষ্কের ক্ষতি করতে পারে, যার ফলাফলে রোগী কোমাতে পর্যন্ত চলে যেতে পারেন।
কিডনি ভালো রাখতে যা করবেন
শরীর সুস্থ রাখার সিংহভাগই থাকে নিজের হাতের মধ্যে। কিডনি খারাপ হলে সহজেই যে কোনও অসুখ জাঁকিয়ে বসে। আর তাই কিডনি সুস্থ রাখতে বিশষেজ্ঞরা কিছু বিষয় মেনে চলতে বলেন। কিডনির অসুখ সহজে বোঝা যায় না। উপসর্গ বোঝার আগে কিডনির ৯০ শতাংশ খারাপ হয়ে যায়। তাই আগে থেকেই কিডনির ব্যাপারে সচেতন থাকা প্রয়োজন। সামান্যতম উপসর্গ দেখা গেলেই নিয়মিত কিডনির যাবতীয় পরীক্ষা করান। কিডনি ভালো রাখতে ডায়েট ঠিক রাখা দরকার। ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ কিডনির অসুখ ডেকে আনে। তাই স্বাস্থ্যকর এবং কম সোডিয়াম যুক্ত, কম কোলেস্টেরল যুক্ত খাবার খান। রক্তের ক্ষতিকর ও অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো বের করে দিয়ে ছাকনির কাজ করে কিডনি। অ্যালকোহল, ওষুধ ইত্যাদির ক্ষেত্রেও ছাকনির কাজ করে কিডনি। তাই প্রয়োজনের বেশি ওষুধ খাবেন না। ওষুধ সব সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে খান। প্রাকৃতিক উপায়ে সুস্থ থাকার চেষ্টা করুন। যাতে ওষুধ না খেতে হয়। মদ্যপানেও নিয়ন্ত্রণ আনুন।
শরীর হাইড্রেটেড রাখা প্রয়োজন। যথেষ্ট পরিমাণে পানি খাওয়ার পরামর্শ দেন অনেকেই। কিন্তু পানি কম খাওয়ার মতোই মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে পানি খেলেও কিছু ক্ষেত্রে বিপত্তি হতে পারে। কিডনি বিকল হলে অতিরিক্ত পরিমাণে পানি খাওয়াও বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাই দিনে ৮ গ্লাস পানি স্বাভাবিক বলে পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের যাতে মূত্রের রং হালকা হলুদ বা রঙহীন হয়। শরীরচর্চার কোনও বিকল্প নেই। তাই শরীরকে সুস্থ রাখতে নিয়মিত শরীরচর্চা করুন। ফলে ওজন, ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল এবং রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকবে। প্রত্যেকের শরীরের আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকে। তাই কারোর কিডনির রোগের সম্ভাবনাও বেশি থাকে। বিশেষ করে ডায়াবিটিস, উচ্চ রক্তচাপ এগুলি থাকলে কিডনির ঝুঁকি থাকে। এছাড়া যারা বেশি মাত্রায় ধূমপান ও মদ্যপান করেন, হার্টের অসুখ রয়েছে বা ওবেসিটির শিকার তাঁদের এই সমস্যা হয়।
এছাড়াও কিডনি ইলেকট্রোলাইটস এবং অন্যান্য তরলের ভারসাম্য রক্ষা করে। এমনই গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গকে সুস্থ রাখার জন্য সঠিক কিডনির জন্য উপকারী খাদ্যাভ্যাসও জরুরি। নিয়মিত সবুজ শাকসবজি খেতে হবে। নিয়মিত ক্যানবেরি জুস খেলে মূত্রথলির সংক্রমণ কমে যায়। সেই সঙ্গে এটি কিডনিও পরিষ্কার করে। এছাড়া কিডনিতে পাথর জমার ঝুঁকিও কমে যায়। নিয়মিত হলুদ খেলে ক্যানসারের ঝুঁকি কমে। সেই সঙ্গে কিডনিও পরিষ্কার হয়। এতে থাকা কারকুমিনে অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান কিডনি রোগ ও পাথর জমা হওয়া রোধ করে। সকালে খালি পেটে কাঁচা রসুন খাওয়া, এটি হার্ট ভাল রাখার পাশাপাশি কিডনিকেও ভালো রাখে।
প্রতিদিন লেবু মেশানো পানি খেলেও কিডনি পরিষ্কার হয়। লেবুতে যে এসিড উপাদান আছে তা কিডনিতে জমা হওয়া পাথর ভাঙ্গতে বেশ কার্যকর। লেবুতে যে সাইট্রাস উপাদান আছে তা কিডনিতে থাকা ক্রিস্টালদের পরস্পরের জোড়া লাগতে বাধা দেয়। কিডনিকে আরও কার্যকরী করতে আদা খাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ কিডনিকে ভাল রাখতে আদা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আদা কিডনিতে রক্তের চলাচল বাড়িয়ে কিডনিকে সচল ও সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। এর ফলে কিডনির কর্মক্ষমতা আরও বেড়ে যায়। কিডনির সমস্যা দেখা দিলে একেবারেই ফেলে রাখা ঠিক নয় বলে মত বিশেষজ্ঞদের। যতটা সম্ভব দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে চিকিৎসা শুরু করা দরকার।
কিডনি সুস্থ রাখতে যেসব নিয়ম মেনে চলবেন
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ