ঢাকা ০২:০২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কায়কোবাদ বাংলা সাহিত্যের মহাকবি

  • আপডেট সময় : ১১:০২:২১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ নভেম্বর ২০২১
  • ৯৮০ বার পড়া হয়েছে

শওকত এয়াকুব : মহাকবি কায়কোবাদ বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র।তাঁর পৈত্রিক নাম মোহাম্মদ কাজেম আল কোরেশি,এ নাম চাপা পড়েছে তার লিখিয়ে নাম কায়কোবাদের আড়ালে।১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ থানার আগলা পূর্ব পাড়া গ্রামে,পিতা শাহমত উল্লাহ আল কোরেশি ও মাতা জরিফ উন্নেসার কোল আলো করে কবি জন্মগ্রহণ করেন। কবি ছিলেন তাঁর পিতামাতার জ্যোষ্ঠ সন্তান।তাঁর শৈশব কাটে গ্রামের অসাধারণ নৈসর্গিক সবুজ প্রকৃতি আর খরস্রোতা ইছামতী নদীর উত্তাল ঢেউ দেখে,বালক কবির হৃদয় হয়েছিল বিমুগ্ধ।কবির প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয়েছিল পিতার ইচ্ছে মতো পরিবারে,আরবি ও ফারসি শিক্ষার মধ্যে দিয়ে।এরপর তিনি জগন্নাথ স্কুল, পগোজ স্কুল, কোর্ট গ্রেগরি স্কুল এবং মায়ের মৃত্যুর পরে ভর্তি হন মুসলিম হাইস্কুলে। কবির শেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল ঢাকা মাদ্রাসা। কবি জীবনের কঠিন বাস্তবতার কারণে বাধ্য হয়ে ছাড়তে পয় লেখাপড়া।তাই আর দেওয়াই হয়নি এন্ট্রান্স পরীক্ষাও। কবি বাল্যকালে পিতামাতা কে হারিয়েছে, ভাইবোনদের মাঝে বড়ো হওয়ায় সংসার চালনার দায়িত্ব আসে কবির কাদে।এই কারণে কর্মজীবনে প্রবেশের জোর প্রচেষ্টা চালান।ভাগ্যের নির্মম পরিহাস,সেসময় মুসলমান হওয়াতে চাকরি পাওয়া ছিল দুঃসাধ্য।আল্লাহর অশেষ কৃপায়,কবির প্রিয় শিক্ষক ও বক্ত ঢাকা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ওবায়দুল্লাহ সাহেবের সুপারিশে সৈয়দ আমজাদ আলীর সহযোগিতায় কায়কোবাদ অস্থায়ী ভিত্তিতে ডাক বিভাগে কেরানি পদে কুড়ি টাকা বেতনে কর্মজীবন শুরু করেন।এরপর ১৮৮৭ সালে একই পদে স্থায়িত্ব লাভ করেন। অবসর প্রাপ্তের সময় কবির বেতন ছিল সাইত্রিশ টাকা,কেরানি পদ থেকে উন্নতি পেয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন পোস্ট মাস্টারের।
কায়কোবাদ শৈশব থেকে কবিতা চর্চা করেছেন তা কবি নিজে’অশ্রুমালা’ কাব্য গ্রন্থের উৎসর্গে বলেন ‘আমি শৈশব থেকে কবিতা দেবীর সেবা করে আসছি’ কায়কোবাদ ছিলেন প্রেমের কবি, প্রেমিকার কবি,তাঁর কবির উপজীব্য ছিল প্রেম,হোক সেটা গিরিবালার প্রতি, বা আধ্যাত্মিকতার,মানব,ও ফুল পাখির প্রতি।কায়কোবাদের কাব্য জগতে আবির্ভাব হয়েছেন গীতিকবিতার মাধ্যমে। কাব্য জগতে উন্মেষ ঘটে ‘বিরহ বিলাপ’ কাব্যের মাধ্য দিয়ে।তাঁর গীতিকাব্য গুলোর মধ্যে সার্থক দুটি গীতিকাব্য হচ্ছে ‘অমিয় ধারা’ ও ‘প্রেমের ফুল’।১৮৯৬ সালে ‘অশ্রুমালা’ কাব্য প্রকাশের মাধ্যদিয়ে কবির সুনাম ছড়িয়ে পড়ে চারদিক,তিনি আবিভূত হন সমকালীন শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে।এরপর রচনা করেন কাহিনীকাব্য।১৯০৫ সালে প্রকাশিত হলো কবির শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ও অমর গ্রন্থ ‘মহাশ্মশান’ যে গ্রন্থ কবিকে হাতধরে নিয়ে যান বাংলা সাহিত্যের সর্বোচ্চ স্থানে।এরপর এঁকে একে প্রকাশিত হলো ‘শিব মন্দির বা জীবন্ত সমাধি কাব্য’ ‘মহরম শরিফ বা আত্মবিসর্জন কাব্য’ শ্মশান ভষ্ম’ ‘প্রেমের বাণী’ ও ‘পারিজাত’ ‘অমিয় ধারা’ ‘প্রেমের ফুল’ও’অশ্রুমালা’এর মতো কাব্য গ্রন্থ গুলো।
কায়কোবাদের কাব্য সমূহ তিনটি ধারায় বিভক্ত।গীতিকাব্য,কাহিনীকাব্য,শ্রেণীহীন কবিতা।তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা মোট তেরোটি।এর মধ্যে পাঁচটি গীতিকাব্য।বিরহ বিলাপ, কুসুম কানন,অশ্রুমালা,অমিয় ধারা,ও প্রেমের ফুল।’বিরহ বিলাপ’ কবির প্রথম গীতিকাব্য গ্রন্থ।এটা প্রকাশিত হয় কবির কৈশোর জীবনের সূচনালগ্নে,মাত্র বারো বা তেরো বছর বয়সে।গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৭০ সালে।প্রকাশের পর তৎকালীন সুধী সমাজে বালক কবির কাব্য প্রতিভা আলোড়ন সৃষ্টি করে।প্রথম গ্রন্থ প্রকাশের তিন বছর পরে ‘কুসুম কানন’ নামে আরও একটি গীতিকাব্য গ্রন্থ প্রকাশ করে। এই গ্রন্থটি কবির ষোল বছর বয়সে প্রকাশিত হয়। ‘সঙ্গীত’ শীর্ষক কবিতাটি ছাড়া এ সংকলনে ছিল মোট বত্রিশটি কবিতা। ‘কুসুন কানন’ কবির কাঁচা হাতের লেখা। তথাপি,একজন পরিপূর্ণ কবির মতোই প্রেম ও বিরহকে ফুটিয়ে তুলেছেন। অতিরিক্ত আবেগ ও উচ্ছ্বাস এ কাব্যে লক্ষ্যণীয়।বিষয় বৈচিত্রেও ছিল ভরপুর।এখানে কবি প্রেমে কাতর,বিরহ যন্ত্রণায় ব্যথিত,মানব প্রেমে অগ্রগামী,নারীর মুক্তি,আল্লার প্রতি অনুগত,স্বাধীনতায় সোচ্চার।কবির দ্বিতীয় গ্রন্থ প্রকাশের পর দীর্ঘ তেইশ বছর কবির আী কোন কাব্য প্রকাশিত হয়নি।কিন্তু, এদীর্ঘ সময় কাব্য সাধনায় কোন বিরতি ছিলোনা শত দুঃখের মাঝে-ও।অতঃপর ১৩০২ বঙ্গাব্দ মোতাবেক ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে কবির তৃতীয় গীতিকাব্য ‘অশ্রুমালা’ প্রকাশিত হয়।এ গ্রন্থ প্রকাশের পর পর কবির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তদানিন্তন হিন্দু-মুসলিম সাহিত্য সমাজে তিনি কবি হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের আসেন সমাসীন হন।তিনি সমকালীন মুসলিম কবিদের অর্গল ভেঙ্গে বিশুদ্ধ বাংলা ভাষায় কবিতা রচনা শুরু করেন। কায়কোবাদের সমকালীন কোন কবি তাঁর পূর্বে আধুনিক ভাষায় উল্লেখযোগ্য কোন কাব্য রচনা করতে সক্ষম হননি। ‘অশ্রুমালা’ গ্রন্থে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন, আল্লাহভক্তি বা ধর্মানুভুতি,এগুলোকে আধ্যাত্মিক চেতনামূলক কবিতা ও বলা যায়।নারীর প্রেম ও বিরহ,প্রকৃতির নয়নাভিরাম সৌন্দর্য জাতীয় জাগরণ ও চেতনা, দেশপ্রেম, ও শ্রেণিহীন কবিতা।গ্রন্থটি কবির জীবদ্দশায় পাঁচটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়।কবির চতুর্থ গীতিকাব্য ‘অমিয় ধারা’ প্রথম প্রকাশে একশোটি কবিতা সংকলিত হয়।এরপর আরও তিনবার অল্প অল্প কবিতা সংযুক্ত করে প্রকাশিত হয়।এ গ্রন্থে কবিতা গুলোতে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন স্বদেশে প্রেম, জগতের সুখ দুঃখ, ফুল,পাখি, প্রভৃতি বিষয়।শাশ্বত প্রেমের কাব্য ‘প্রেমের ফুল’ ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত হয়। কবি এগ্রন্থকে দুই ভাগে বিভক্ত করেন। প্রথম ভাগে আটটি কবিতা। এগুলো আধ্যাত্মিক প্রেম বিষয়। দ্বিতীয় ভাগে পার্থিব প্রেম বিষয়ক চুয়ান্নটি কবিতা রয়েছে। তাছাড়া কাব্যের প্রারম্ভে ‘সঙ্গীত’ ‘কায়কোবাদ জীবন সঙ্গীত’ ‘উৎসর্গ’ ও ‘কায়কোবাদ প্রশস্তি’ শিরোনামে চারটি কবিতা রয়েছে। এগ্রন্থের ও মুখ্য বিষয় প্রেম।এগ্রন্থের ভূমিকায় কবি বলেছেন..”প্রেমে বিধাতার অমূল্য দান।প্রেম স্বর্গের পবিত্র জিনিস। প্রেম পরকে আপন করিয়া তোলে-স্বার্থপরতার দুর্গন্ধ পুরীষ দুরীভূত করিয়া মানবকে দেবতায় পরিণত করে।হিংসাদ্বেষ ভুলাইয়া দেয়। আমি কবি।আমি প্রেমের সন্ন্যাসী। আমি যাহাকে ভালোবাসি তাহাকে ভুলিবনা আজীবন।মৃত্যুর সময়ে ও তাঁহারই স্মৃতি হৃদয়ে লইয়া এই পৃথিবী হইতে চিরকালের জন্য বিদায় গ্রহণ করিব।মৃত্যুর পূর্ব মূহুর্তে পর্যন্ত তাঁহারই মুখখানি হৃদয়ে অঙ্কিত থাকিবে”।
কায়কোবাদের কাব্য জগতে তাঁর কাহিনীকাব্য গুলো অধিক পরিচিত।সকলের মতো তিনিও কাহিনিকাব্য গুলো লিখেছেন কাহিনি বা ঘটনাকে মূখ্য বিষয়।
তাঁর কাহিনীকাব্যের সংখ্যা ছয়টি। যতা..’মহাশ্মশান'(১৯০৫)’শিব মন্দির বা জীবন্ত সমাধি কাব্য'(১৯২২)’মহরম শরিফ বা আত্মবিসর্জন কাব্য'(১৯৩৩)’শ্মশান ভষ্ম'(১৯৩৮)’প্রেমের বাণী'(১৯৭০)ও ‘প্রেম পারিজাত'(১৯৭০)।অশ্রুমালা কাব্য প্রকাশিত হওয়ার দশ বছর পর ১৩১১ বঙ্গাব্দ মোতাবেক ১৯০৫ সালে।কবির অমর কীর্তি ‘মহাশ্মশান’ প্রকাশিত হয়।এর প্রথম কয়েক সর্গ কোহিনূর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কবির আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো না হওয়ায় অনেকের সহায়তায় গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।কায়কোবাদ তখন ময়মনসিংহের পিঙ্গল পোস্ট অফিসে কর্মরত ছিলেন।পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের পটভূমিতে রচিত মহাশ্মশান কাব্য প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথে সাহিত্য মহলে আলোড়ন সৃষ্টি হয়।মুসলিম সাহিত্য বোদ্ধাদের মধ্যে সৃষ্টি হয় দলাদলি।ঝড় উঠে প্রশংসা এবং নিন্দার।ফজলুর রহমান খাঁ,মুনশি মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহমদ, সৈয়দ এমদাদ আলী,মহাশ্মশানের নেতিবাচক সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেন।
মহাশ্মশান কাব্যে মোট তিনটি খন্ড রয়েছে।প্রথম খন্ড ১৯ সর্গ, দ্বিতীয় খন্ড ২৪ সর্গ এবং তৃতীয় খন্ড ৭ সর্গে সমাপ্ত। কাব্যের প্রারম্ভে আছে ‘কবির বীণা ও কল্পনা’ এবং ‘আল্লাহু আকবর’ নামক বন্দনা অংশ।কাব্যটি পানিপথের যুদ্ধের পটভূমি নিয়ে রচনা হলেও প্রেমে থেকে বাহির হতে পারে নি।এই কাব্যে পাঁচটি প্রেম কাহিনী রয়েছে। চরিত্র গুলো ইব্রাহিম কার্দ্দী ও জোহরা বেগম, হিরণ ও আতা খাঁ,লবঙ্গ ও রত্মজী সুজাউদ্দৌলা, সেলিনা ও বিশ্বনাথ কৌমুদির প্রেম। এর মধ্যে হিরণ ও আতা খাঁর প্রেম সবচেয়ে উজ্জ্বল।কবির দ্বিতীয় কাহিনিকাব্য ‘শিবমন্দির বা জীবন্ত সমাধি কাব্য’ ২০ জানুয়ারি ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক অগ্রহায়ণ ১৩২৮ বঙ্গাব্দে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থটি বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে কাব্য গ্রন্থটি রচিত।এই গ্রন্থের আলাদা বৈশিষ্ট্য হলো এটা অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা।এ গ্রন্থের পর্ব সংখ্যা চারটি। প্রতিটি পর্বে রয়েছে একটি করে খন্ড, প্রতি খন্ডে রয়েছে একাধিক সর্গ।প্রথম খন্ডে তেরোটি,দ্বিতীয় খন্ডে বারোটি,তৃতীয় খন্ডে পাঁচটি এবং চতুর্থ খন্ডে পাঁচটি সর্গ রয়েছে। ‘শিবমন্দির বা জীবন্ত সমাধি কাব্য’ জমিদার বদরুদ্দীন ও জমিদার মোহিউদ্দীন হায়দারের বংশধর এবং তাদের দেওয়ান সুধীর চন্দ্রের জীবনের সত্যি ঘটনা অবলম্বনে লেখা। কায়কোবাদের সত্যি কাহিনী নির্ভর এ কাব্যটি রচনা করে তাঁর কবি মানসের মানবিক দিকটি তুলে ধরেছেন। কাব্যটি কবির সহৃদয়মন এবং নিষ্ঠুর আচরণের বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষেভ ও প্রতিদিন পরিলক্ষিত হয়েছে।শিবমন্দির বা জীবন্ত সমাধি কাব্য অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা হলেও মহাশ্মশান কাব্য গ্রন্থকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি।মুসলিম সমাজের সবচেয়ে বেদনাবিধুর ঐতিহাসিক ঘটনা কারবালার কাহিনীকে উপজীব্য করে মহাকবি কায়কোবাদ রচনা করেছেন ‘মহরম শরীফ বা আত্মবিসর্জন কাব্য’ এটা ২২ নভেম্বর ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ১৩৪০ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়।কাব্যটি তিন খন্ডের। প্রথম খন্ডে তেরোটি,দ্বিতীয় খন্ডে বারোটি, এবং তৃতীয় খন্ডে চারটি সর্গ আছে। এটি কবির বন্ধু মনুশী রেয়াজ উদ্দীন আহমদের অনুরোধে লিখিত। এক সময় মাইকেল মধুসূদন মহরম শরীফ নিয়ে মহাকাব্য লেখার কল্পনা জেগেছিল। মাইকেল মধুসূদন দত্তের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেছেন আমাদের মহাকবি কায়কোবাদ। মহরম শরীফের কাব্য পরবর্তী কাহানীকাব্য হচ্ছে শ্মশান ভষ্ম। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ৩০ জৈষ্ঠ্য ১৩৪৫ বঙ্গাব্দ মোতাবেক ২০ জুলাই ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দ। এটা কবির জীবদ্দশায় প্রকাশিত শেষ কাব্য গ্রন্থ। ত্রিভূজ প্রেমের কাহিনীনিয়ে লেখা বিয়োগান্তক করুন রসাত্মক কাব্য এটি।কবির চারপাশের সমাজের ঘটে যাওয়া কাহিনী নিয়েই এ কাব্য রচিত।গ্রন্থেটি বাইশটি সর্গে লেখা। একাব্যের প্রধান চরিত্র হেমলতা দেবী।সে ব্রজেন্দ্র কিশোর ব্রক্ষচারী ও বিজান বা সিনী দেবীর কন্যা।কায়কোবাদ কতৃক ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে লিখিত হয় প্রেমের বাণী।এটা প্রকাশিত হয় ১৩৭৬ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে। কাব্যটি চার খন্ডে বিভক্ত। প্রতিটি খন্ডের নিচে একটি করে নিচে একটি করে শিরোনাম দেওয়া আছে। প্রথম খন্ড অধর্ম্মের তান্ডব নৃত্য,দ্বিতীয় খন্ড জগদীশ্বরের শক্তির বিরুদ্ধে,তৃতীয় খন্ড পাপ-পীণ্যের সংঘাত, ধর্মের সহিত অর্ধমের যুদ্ধ এবং চতুর্থ খন্ড ধর্মের জয় অর্ধমের পতন।এই কাব্যগ্রন্থের শুরুতে যথারীতি কবির ভূমিকা রয়েছে। এতে কবি লিখেছেন…”রুগ্ন অবস্থায় বহু কষ্ট করিয়া এই কাব্যখানা শেষ করিলাম এখনও মহাকাব্য;এ যুগে মহাকাব্যের আদর নেই”কবির একথা দ্বারা বুঝা যায় এটা কবির শেষ বয়সের রচনা। কায়কোবাদ গবেষক ফাতেমা কাওসার একে কবির মৃত্যুর তিন বছর আগের রচনা বলে উল্লেখ করেছেন।কবির পরবর্তী কাব্য গ্রন্থ ‘প্রেম-পারিজাত’ এর অপর নাম হেমলাত ও বীণাপানি বা যোবেদা মহল কাব্য। এটা একটি কাহিনী কাব্য। কবির মৃত্যুর পর কাব্যটি ১৩৭৫ বঙ্গাব্দ প্রথম প্রকাশিত হয়। এতে মোট চার খন্ড আছে। প্রথম খন্ডে একত্রিশটি, দ্বিতীয় খন্ডে আটটি, তৃতীয় খন্ডে আটটি এবং চতুর্থ খন্ডে দুইটি সর্গ আছে। এটি একটি সত্যি কাহিনী অবলম্বনে রচিত হলেও এখানে কিছু রংঢং দেওয়া হয়েছে বলেছেন কায়কোবাদ। কাব্যটির মূল বিষয়বস্তু প্রেম। কিন্তু বারবার শ্বাশত প্রেম ক্ষত বিক্ষত হয়েছে। নায়ক-নায়িকার জীবনে নেমে এসেছে করুন পরিণতি।
গদ্য ও পদ্য মিশ্রিত এক শ্রেণীর কবিতাকে চম্পুকাব্য বলাহয়। এসব কাব্য কতটুকু গদ্য কতটুকু পদ্য থাকবে এবিষয়ে তেমন কিছুই জানা যায় না।এজাতীয় কাব্য গদ্যের বলিষ্ঠতা ও ওজস্বিতা এবং কাব্যের মাধুর্য কোনটাই প্রকাশ পায় না। কায়কোবাদ লিখিত চম্পু কাব্য গ্রন্থ ‘গওছ পাকের প্রেমের কুঞ্জ’ এটা ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত এটা কবির সর্বশেষ প্রকাশিত রচনা।কবির অন্যতম কাব্যগ্রন্থ মন্দাকিনী ধারা ১৩৭৭ বঙ্গাব্দ মোতাবেক ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়।এ কাব্যে মোট চল্লিশটি কবিতা ও চারটি গদ্য রচনা স্থান করে নিয়েছে। কবিতার বিষয়সমূহ ভিন্নতা রয়েছে। কবিতাগুলো গীতি কবিতার পর্যায়ে পড়ে। মন্দাকিনী ধারা চম্পু কাব্যে স্থান পাওয়া চারটি গদ্য হলো।(১) সংক্ষিপ্ত রামায়ণ (২) দানবীর মহাত্মা আলী মিয়া ও স্যার নবাব আব্দুল গণি বাহাদুর ও তার বংশধর গণ,(৩) মহাত্মা হাজী মোহাম্মদ মোহসীন হোসেন,(৪) মোহাম্মদ হাদী চৌধুরী ও তাঁর পুত্র গরীব হোসেন চৌধুরীর পাপের প্রায়শ্চিত্ত। কবির প্রিয় মুর্শিদের নির্দেশেই নব্বই উর্ধ্ব বয়সে ‘গওছ পাকের প্রেমের কুঞ্জ’ কাব্য গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দ। কবি বড়পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ) এর ভক্ত ছিলেন।কবি বড়পীর (রহঃ) এর সুযোগ্য বংশধর হযরত সাইয়েদ এরশাদ আলী সাহেবের মুরিদ ছিলেন। বড়পীর (রাহঃ) এর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা,অনুগত্যের সঙ্গে এটি রচনা করেন। এসময় কবি নিজের আত্মজীবনী লেখাশুরু করেন, কিন্তু বার্ধক্যজনিত নানা রোগ তাকে পেয়ে বসে।শরীর নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছিল।সেই সাথে দৃষ্টিহীনতা তাকে আরো কাবু করে ফেলে। ফলে আত্মজীবনী আরশেষ করা পক্ষে সম্ভবপর হয়নি।অবশেষে ১৮ জুন ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে আগলা পূর্ব পাড়া নিজ বাড়ীতে রক্ত আমাশয় তিনি আক্রান্ত হন।শারীরিক অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠলে তাকে ৩ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।তাঁর ব্রঙ্কো নিউমোনিয়া ধরা পড়ে। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের ২১ জুলাই মোতাবেক ৪ শ্রাবণ ১৩৫৮ বঙ্গাব্দে শনিবার সোয়া তিনটায় মহাকবি কায়কোবাদ মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

সূত্র–অভিসন্দর্ভ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

কায়কোবাদ বাংলা সাহিত্যের মহাকবি

আপডেট সময় : ১১:০২:২১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ নভেম্বর ২০২১

শওকত এয়াকুব : মহাকবি কায়কোবাদ বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র।তাঁর পৈত্রিক নাম মোহাম্মদ কাজেম আল কোরেশি,এ নাম চাপা পড়েছে তার লিখিয়ে নাম কায়কোবাদের আড়ালে।১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ থানার আগলা পূর্ব পাড়া গ্রামে,পিতা শাহমত উল্লাহ আল কোরেশি ও মাতা জরিফ উন্নেসার কোল আলো করে কবি জন্মগ্রহণ করেন। কবি ছিলেন তাঁর পিতামাতার জ্যোষ্ঠ সন্তান।তাঁর শৈশব কাটে গ্রামের অসাধারণ নৈসর্গিক সবুজ প্রকৃতি আর খরস্রোতা ইছামতী নদীর উত্তাল ঢেউ দেখে,বালক কবির হৃদয় হয়েছিল বিমুগ্ধ।কবির প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয়েছিল পিতার ইচ্ছে মতো পরিবারে,আরবি ও ফারসি শিক্ষার মধ্যে দিয়ে।এরপর তিনি জগন্নাথ স্কুল, পগোজ স্কুল, কোর্ট গ্রেগরি স্কুল এবং মায়ের মৃত্যুর পরে ভর্তি হন মুসলিম হাইস্কুলে। কবির শেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল ঢাকা মাদ্রাসা। কবি জীবনের কঠিন বাস্তবতার কারণে বাধ্য হয়ে ছাড়তে পয় লেখাপড়া।তাই আর দেওয়াই হয়নি এন্ট্রান্স পরীক্ষাও। কবি বাল্যকালে পিতামাতা কে হারিয়েছে, ভাইবোনদের মাঝে বড়ো হওয়ায় সংসার চালনার দায়িত্ব আসে কবির কাদে।এই কারণে কর্মজীবনে প্রবেশের জোর প্রচেষ্টা চালান।ভাগ্যের নির্মম পরিহাস,সেসময় মুসলমান হওয়াতে চাকরি পাওয়া ছিল দুঃসাধ্য।আল্লাহর অশেষ কৃপায়,কবির প্রিয় শিক্ষক ও বক্ত ঢাকা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ওবায়দুল্লাহ সাহেবের সুপারিশে সৈয়দ আমজাদ আলীর সহযোগিতায় কায়কোবাদ অস্থায়ী ভিত্তিতে ডাক বিভাগে কেরানি পদে কুড়ি টাকা বেতনে কর্মজীবন শুরু করেন।এরপর ১৮৮৭ সালে একই পদে স্থায়িত্ব লাভ করেন। অবসর প্রাপ্তের সময় কবির বেতন ছিল সাইত্রিশ টাকা,কেরানি পদ থেকে উন্নতি পেয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন পোস্ট মাস্টারের।
কায়কোবাদ শৈশব থেকে কবিতা চর্চা করেছেন তা কবি নিজে’অশ্রুমালা’ কাব্য গ্রন্থের উৎসর্গে বলেন ‘আমি শৈশব থেকে কবিতা দেবীর সেবা করে আসছি’ কায়কোবাদ ছিলেন প্রেমের কবি, প্রেমিকার কবি,তাঁর কবির উপজীব্য ছিল প্রেম,হোক সেটা গিরিবালার প্রতি, বা আধ্যাত্মিকতার,মানব,ও ফুল পাখির প্রতি।কায়কোবাদের কাব্য জগতে আবির্ভাব হয়েছেন গীতিকবিতার মাধ্যমে। কাব্য জগতে উন্মেষ ঘটে ‘বিরহ বিলাপ’ কাব্যের মাধ্য দিয়ে।তাঁর গীতিকাব্য গুলোর মধ্যে সার্থক দুটি গীতিকাব্য হচ্ছে ‘অমিয় ধারা’ ও ‘প্রেমের ফুল’।১৮৯৬ সালে ‘অশ্রুমালা’ কাব্য প্রকাশের মাধ্যদিয়ে কবির সুনাম ছড়িয়ে পড়ে চারদিক,তিনি আবিভূত হন সমকালীন শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে।এরপর রচনা করেন কাহিনীকাব্য।১৯০৫ সালে প্রকাশিত হলো কবির শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ও অমর গ্রন্থ ‘মহাশ্মশান’ যে গ্রন্থ কবিকে হাতধরে নিয়ে যান বাংলা সাহিত্যের সর্বোচ্চ স্থানে।এরপর এঁকে একে প্রকাশিত হলো ‘শিব মন্দির বা জীবন্ত সমাধি কাব্য’ ‘মহরম শরিফ বা আত্মবিসর্জন কাব্য’ শ্মশান ভষ্ম’ ‘প্রেমের বাণী’ ও ‘পারিজাত’ ‘অমিয় ধারা’ ‘প্রেমের ফুল’ও’অশ্রুমালা’এর মতো কাব্য গ্রন্থ গুলো।
কায়কোবাদের কাব্য সমূহ তিনটি ধারায় বিভক্ত।গীতিকাব্য,কাহিনীকাব্য,শ্রেণীহীন কবিতা।তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা মোট তেরোটি।এর মধ্যে পাঁচটি গীতিকাব্য।বিরহ বিলাপ, কুসুম কানন,অশ্রুমালা,অমিয় ধারা,ও প্রেমের ফুল।’বিরহ বিলাপ’ কবির প্রথম গীতিকাব্য গ্রন্থ।এটা প্রকাশিত হয় কবির কৈশোর জীবনের সূচনালগ্নে,মাত্র বারো বা তেরো বছর বয়সে।গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৭০ সালে।প্রকাশের পর তৎকালীন সুধী সমাজে বালক কবির কাব্য প্রতিভা আলোড়ন সৃষ্টি করে।প্রথম গ্রন্থ প্রকাশের তিন বছর পরে ‘কুসুম কানন’ নামে আরও একটি গীতিকাব্য গ্রন্থ প্রকাশ করে। এই গ্রন্থটি কবির ষোল বছর বয়সে প্রকাশিত হয়। ‘সঙ্গীত’ শীর্ষক কবিতাটি ছাড়া এ সংকলনে ছিল মোট বত্রিশটি কবিতা। ‘কুসুন কানন’ কবির কাঁচা হাতের লেখা। তথাপি,একজন পরিপূর্ণ কবির মতোই প্রেম ও বিরহকে ফুটিয়ে তুলেছেন। অতিরিক্ত আবেগ ও উচ্ছ্বাস এ কাব্যে লক্ষ্যণীয়।বিষয় বৈচিত্রেও ছিল ভরপুর।এখানে কবি প্রেমে কাতর,বিরহ যন্ত্রণায় ব্যথিত,মানব প্রেমে অগ্রগামী,নারীর মুক্তি,আল্লার প্রতি অনুগত,স্বাধীনতায় সোচ্চার।কবির দ্বিতীয় গ্রন্থ প্রকাশের পর দীর্ঘ তেইশ বছর কবির আী কোন কাব্য প্রকাশিত হয়নি।কিন্তু, এদীর্ঘ সময় কাব্য সাধনায় কোন বিরতি ছিলোনা শত দুঃখের মাঝে-ও।অতঃপর ১৩০২ বঙ্গাব্দ মোতাবেক ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে কবির তৃতীয় গীতিকাব্য ‘অশ্রুমালা’ প্রকাশিত হয়।এ গ্রন্থ প্রকাশের পর পর কবির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তদানিন্তন হিন্দু-মুসলিম সাহিত্য সমাজে তিনি কবি হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের আসেন সমাসীন হন।তিনি সমকালীন মুসলিম কবিদের অর্গল ভেঙ্গে বিশুদ্ধ বাংলা ভাষায় কবিতা রচনা শুরু করেন। কায়কোবাদের সমকালীন কোন কবি তাঁর পূর্বে আধুনিক ভাষায় উল্লেখযোগ্য কোন কাব্য রচনা করতে সক্ষম হননি। ‘অশ্রুমালা’ গ্রন্থে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন, আল্লাহভক্তি বা ধর্মানুভুতি,এগুলোকে আধ্যাত্মিক চেতনামূলক কবিতা ও বলা যায়।নারীর প্রেম ও বিরহ,প্রকৃতির নয়নাভিরাম সৌন্দর্য জাতীয় জাগরণ ও চেতনা, দেশপ্রেম, ও শ্রেণিহীন কবিতা।গ্রন্থটি কবির জীবদ্দশায় পাঁচটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়।কবির চতুর্থ গীতিকাব্য ‘অমিয় ধারা’ প্রথম প্রকাশে একশোটি কবিতা সংকলিত হয়।এরপর আরও তিনবার অল্প অল্প কবিতা সংযুক্ত করে প্রকাশিত হয়।এ গ্রন্থে কবিতা গুলোতে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন স্বদেশে প্রেম, জগতের সুখ দুঃখ, ফুল,পাখি, প্রভৃতি বিষয়।শাশ্বত প্রেমের কাব্য ‘প্রেমের ফুল’ ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত হয়। কবি এগ্রন্থকে দুই ভাগে বিভক্ত করেন। প্রথম ভাগে আটটি কবিতা। এগুলো আধ্যাত্মিক প্রেম বিষয়। দ্বিতীয় ভাগে পার্থিব প্রেম বিষয়ক চুয়ান্নটি কবিতা রয়েছে। তাছাড়া কাব্যের প্রারম্ভে ‘সঙ্গীত’ ‘কায়কোবাদ জীবন সঙ্গীত’ ‘উৎসর্গ’ ও ‘কায়কোবাদ প্রশস্তি’ শিরোনামে চারটি কবিতা রয়েছে। এগ্রন্থের ও মুখ্য বিষয় প্রেম।এগ্রন্থের ভূমিকায় কবি বলেছেন..”প্রেমে বিধাতার অমূল্য দান।প্রেম স্বর্গের পবিত্র জিনিস। প্রেম পরকে আপন করিয়া তোলে-স্বার্থপরতার দুর্গন্ধ পুরীষ দুরীভূত করিয়া মানবকে দেবতায় পরিণত করে।হিংসাদ্বেষ ভুলাইয়া দেয়। আমি কবি।আমি প্রেমের সন্ন্যাসী। আমি যাহাকে ভালোবাসি তাহাকে ভুলিবনা আজীবন।মৃত্যুর সময়ে ও তাঁহারই স্মৃতি হৃদয়ে লইয়া এই পৃথিবী হইতে চিরকালের জন্য বিদায় গ্রহণ করিব।মৃত্যুর পূর্ব মূহুর্তে পর্যন্ত তাঁহারই মুখখানি হৃদয়ে অঙ্কিত থাকিবে”।
কায়কোবাদের কাব্য জগতে তাঁর কাহিনীকাব্য গুলো অধিক পরিচিত।সকলের মতো তিনিও কাহিনিকাব্য গুলো লিখেছেন কাহিনি বা ঘটনাকে মূখ্য বিষয়।
তাঁর কাহিনীকাব্যের সংখ্যা ছয়টি। যতা..’মহাশ্মশান'(১৯০৫)’শিব মন্দির বা জীবন্ত সমাধি কাব্য'(১৯২২)’মহরম শরিফ বা আত্মবিসর্জন কাব্য'(১৯৩৩)’শ্মশান ভষ্ম'(১৯৩৮)’প্রেমের বাণী'(১৯৭০)ও ‘প্রেম পারিজাত'(১৯৭০)।অশ্রুমালা কাব্য প্রকাশিত হওয়ার দশ বছর পর ১৩১১ বঙ্গাব্দ মোতাবেক ১৯০৫ সালে।কবির অমর কীর্তি ‘মহাশ্মশান’ প্রকাশিত হয়।এর প্রথম কয়েক সর্গ কোহিনূর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কবির আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো না হওয়ায় অনেকের সহায়তায় গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।কায়কোবাদ তখন ময়মনসিংহের পিঙ্গল পোস্ট অফিসে কর্মরত ছিলেন।পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের পটভূমিতে রচিত মহাশ্মশান কাব্য প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথে সাহিত্য মহলে আলোড়ন সৃষ্টি হয়।মুসলিম সাহিত্য বোদ্ধাদের মধ্যে সৃষ্টি হয় দলাদলি।ঝড় উঠে প্রশংসা এবং নিন্দার।ফজলুর রহমান খাঁ,মুনশি মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহমদ, সৈয়দ এমদাদ আলী,মহাশ্মশানের নেতিবাচক সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেন।
মহাশ্মশান কাব্যে মোট তিনটি খন্ড রয়েছে।প্রথম খন্ড ১৯ সর্গ, দ্বিতীয় খন্ড ২৪ সর্গ এবং তৃতীয় খন্ড ৭ সর্গে সমাপ্ত। কাব্যের প্রারম্ভে আছে ‘কবির বীণা ও কল্পনা’ এবং ‘আল্লাহু আকবর’ নামক বন্দনা অংশ।কাব্যটি পানিপথের যুদ্ধের পটভূমি নিয়ে রচনা হলেও প্রেমে থেকে বাহির হতে পারে নি।এই কাব্যে পাঁচটি প্রেম কাহিনী রয়েছে। চরিত্র গুলো ইব্রাহিম কার্দ্দী ও জোহরা বেগম, হিরণ ও আতা খাঁ,লবঙ্গ ও রত্মজী সুজাউদ্দৌলা, সেলিনা ও বিশ্বনাথ কৌমুদির প্রেম। এর মধ্যে হিরণ ও আতা খাঁর প্রেম সবচেয়ে উজ্জ্বল।কবির দ্বিতীয় কাহিনিকাব্য ‘শিবমন্দির বা জীবন্ত সমাধি কাব্য’ ২০ জানুয়ারি ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক অগ্রহায়ণ ১৩২৮ বঙ্গাব্দে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থটি বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে কাব্য গ্রন্থটি রচিত।এই গ্রন্থের আলাদা বৈশিষ্ট্য হলো এটা অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা।এ গ্রন্থের পর্ব সংখ্যা চারটি। প্রতিটি পর্বে রয়েছে একটি করে খন্ড, প্রতি খন্ডে রয়েছে একাধিক সর্গ।প্রথম খন্ডে তেরোটি,দ্বিতীয় খন্ডে বারোটি,তৃতীয় খন্ডে পাঁচটি এবং চতুর্থ খন্ডে পাঁচটি সর্গ রয়েছে। ‘শিবমন্দির বা জীবন্ত সমাধি কাব্য’ জমিদার বদরুদ্দীন ও জমিদার মোহিউদ্দীন হায়দারের বংশধর এবং তাদের দেওয়ান সুধীর চন্দ্রের জীবনের সত্যি ঘটনা অবলম্বনে লেখা। কায়কোবাদের সত্যি কাহিনী নির্ভর এ কাব্যটি রচনা করে তাঁর কবি মানসের মানবিক দিকটি তুলে ধরেছেন। কাব্যটি কবির সহৃদয়মন এবং নিষ্ঠুর আচরণের বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষেভ ও প্রতিদিন পরিলক্ষিত হয়েছে।শিবমন্দির বা জীবন্ত সমাধি কাব্য অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা হলেও মহাশ্মশান কাব্য গ্রন্থকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি।মুসলিম সমাজের সবচেয়ে বেদনাবিধুর ঐতিহাসিক ঘটনা কারবালার কাহিনীকে উপজীব্য করে মহাকবি কায়কোবাদ রচনা করেছেন ‘মহরম শরীফ বা আত্মবিসর্জন কাব্য’ এটা ২২ নভেম্বর ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ১৩৪০ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়।কাব্যটি তিন খন্ডের। প্রথম খন্ডে তেরোটি,দ্বিতীয় খন্ডে বারোটি, এবং তৃতীয় খন্ডে চারটি সর্গ আছে। এটি কবির বন্ধু মনুশী রেয়াজ উদ্দীন আহমদের অনুরোধে লিখিত। এক সময় মাইকেল মধুসূদন মহরম শরীফ নিয়ে মহাকাব্য লেখার কল্পনা জেগেছিল। মাইকেল মধুসূদন দত্তের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেছেন আমাদের মহাকবি কায়কোবাদ। মহরম শরীফের কাব্য পরবর্তী কাহানীকাব্য হচ্ছে শ্মশান ভষ্ম। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ৩০ জৈষ্ঠ্য ১৩৪৫ বঙ্গাব্দ মোতাবেক ২০ জুলাই ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দ। এটা কবির জীবদ্দশায় প্রকাশিত শেষ কাব্য গ্রন্থ। ত্রিভূজ প্রেমের কাহিনীনিয়ে লেখা বিয়োগান্তক করুন রসাত্মক কাব্য এটি।কবির চারপাশের সমাজের ঘটে যাওয়া কাহিনী নিয়েই এ কাব্য রচিত।গ্রন্থেটি বাইশটি সর্গে লেখা। একাব্যের প্রধান চরিত্র হেমলতা দেবী।সে ব্রজেন্দ্র কিশোর ব্রক্ষচারী ও বিজান বা সিনী দেবীর কন্যা।কায়কোবাদ কতৃক ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে লিখিত হয় প্রেমের বাণী।এটা প্রকাশিত হয় ১৩৭৬ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে। কাব্যটি চার খন্ডে বিভক্ত। প্রতিটি খন্ডের নিচে একটি করে নিচে একটি করে শিরোনাম দেওয়া আছে। প্রথম খন্ড অধর্ম্মের তান্ডব নৃত্য,দ্বিতীয় খন্ড জগদীশ্বরের শক্তির বিরুদ্ধে,তৃতীয় খন্ড পাপ-পীণ্যের সংঘাত, ধর্মের সহিত অর্ধমের যুদ্ধ এবং চতুর্থ খন্ড ধর্মের জয় অর্ধমের পতন।এই কাব্যগ্রন্থের শুরুতে যথারীতি কবির ভূমিকা রয়েছে। এতে কবি লিখেছেন…”রুগ্ন অবস্থায় বহু কষ্ট করিয়া এই কাব্যখানা শেষ করিলাম এখনও মহাকাব্য;এ যুগে মহাকাব্যের আদর নেই”কবির একথা দ্বারা বুঝা যায় এটা কবির শেষ বয়সের রচনা। কায়কোবাদ গবেষক ফাতেমা কাওসার একে কবির মৃত্যুর তিন বছর আগের রচনা বলে উল্লেখ করেছেন।কবির পরবর্তী কাব্য গ্রন্থ ‘প্রেম-পারিজাত’ এর অপর নাম হেমলাত ও বীণাপানি বা যোবেদা মহল কাব্য। এটা একটি কাহিনী কাব্য। কবির মৃত্যুর পর কাব্যটি ১৩৭৫ বঙ্গাব্দ প্রথম প্রকাশিত হয়। এতে মোট চার খন্ড আছে। প্রথম খন্ডে একত্রিশটি, দ্বিতীয় খন্ডে আটটি, তৃতীয় খন্ডে আটটি এবং চতুর্থ খন্ডে দুইটি সর্গ আছে। এটি একটি সত্যি কাহিনী অবলম্বনে রচিত হলেও এখানে কিছু রংঢং দেওয়া হয়েছে বলেছেন কায়কোবাদ। কাব্যটির মূল বিষয়বস্তু প্রেম। কিন্তু বারবার শ্বাশত প্রেম ক্ষত বিক্ষত হয়েছে। নায়ক-নায়িকার জীবনে নেমে এসেছে করুন পরিণতি।
গদ্য ও পদ্য মিশ্রিত এক শ্রেণীর কবিতাকে চম্পুকাব্য বলাহয়। এসব কাব্য কতটুকু গদ্য কতটুকু পদ্য থাকবে এবিষয়ে তেমন কিছুই জানা যায় না।এজাতীয় কাব্য গদ্যের বলিষ্ঠতা ও ওজস্বিতা এবং কাব্যের মাধুর্য কোনটাই প্রকাশ পায় না। কায়কোবাদ লিখিত চম্পু কাব্য গ্রন্থ ‘গওছ পাকের প্রেমের কুঞ্জ’ এটা ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত এটা কবির সর্বশেষ প্রকাশিত রচনা।কবির অন্যতম কাব্যগ্রন্থ মন্দাকিনী ধারা ১৩৭৭ বঙ্গাব্দ মোতাবেক ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়।এ কাব্যে মোট চল্লিশটি কবিতা ও চারটি গদ্য রচনা স্থান করে নিয়েছে। কবিতার বিষয়সমূহ ভিন্নতা রয়েছে। কবিতাগুলো গীতি কবিতার পর্যায়ে পড়ে। মন্দাকিনী ধারা চম্পু কাব্যে স্থান পাওয়া চারটি গদ্য হলো।(১) সংক্ষিপ্ত রামায়ণ (২) দানবীর মহাত্মা আলী মিয়া ও স্যার নবাব আব্দুল গণি বাহাদুর ও তার বংশধর গণ,(৩) মহাত্মা হাজী মোহাম্মদ মোহসীন হোসেন,(৪) মোহাম্মদ হাদী চৌধুরী ও তাঁর পুত্র গরীব হোসেন চৌধুরীর পাপের প্রায়শ্চিত্ত। কবির প্রিয় মুর্শিদের নির্দেশেই নব্বই উর্ধ্ব বয়সে ‘গওছ পাকের প্রেমের কুঞ্জ’ কাব্য গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দ। কবি বড়পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ) এর ভক্ত ছিলেন।কবি বড়পীর (রহঃ) এর সুযোগ্য বংশধর হযরত সাইয়েদ এরশাদ আলী সাহেবের মুরিদ ছিলেন। বড়পীর (রাহঃ) এর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা,অনুগত্যের সঙ্গে এটি রচনা করেন। এসময় কবি নিজের আত্মজীবনী লেখাশুরু করেন, কিন্তু বার্ধক্যজনিত নানা রোগ তাকে পেয়ে বসে।শরীর নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছিল।সেই সাথে দৃষ্টিহীনতা তাকে আরো কাবু করে ফেলে। ফলে আত্মজীবনী আরশেষ করা পক্ষে সম্ভবপর হয়নি।অবশেষে ১৮ জুন ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে আগলা পূর্ব পাড়া নিজ বাড়ীতে রক্ত আমাশয় তিনি আক্রান্ত হন।শারীরিক অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠলে তাকে ৩ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।তাঁর ব্রঙ্কো নিউমোনিয়া ধরা পড়ে। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের ২১ জুলাই মোতাবেক ৪ শ্রাবণ ১৩৫৮ বঙ্গাব্দে শনিবার সোয়া তিনটায় মহাকবি কায়কোবাদ মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

সূত্র–অভিসন্দর্ভ