ক্যাম্পাস ও ক্যারিয়ার ডেস্ক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মনজুরুল করিমের নেতৃত্বে একদল গবেষক কালাজ্বর ব্যাধি শনাক্তকরণে দ্রুত ও কার্যকরী একটি নতুন মলিকিউলার ডায়াগনস্টিক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। ফলে এই রোগ শনাক্তকরণে গতানুগতিকভাবে অনুসৃত বোন ম্যারো, স্পিন এসপিরেট কিংবা লিভার বায়োপসির পরিবর্তে মূত্র নমুনা ব্যবহার করে গবেষকদল এই মলিকিউলার ডায়াগনস্টিক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। যা সম্পূর্ণ নির্ভুল এবং নিখুঁতভাবে কালাজ্বর শনাক্তকরণের জন্য একটি রোগীবান্ধব পদ্ধতি। সোমবার (২ জানুয়ারি) দুপুরে প্রফেসর আব্দুল মতিন চৌধুরী ভার্চুয়াল ক্লাসরুমে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠেয় এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য তুলে ধরেন গবেষক দলের নেতৃত্ব দেওয়া অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মনজুরুল করিম। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের একটি উপেক্ষিত রোগ কালা আজার বা কালাজ্বর, যা লেশমানিয়াসিসের ৩টি রূপের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ এবং প্রাণঘাতি। বিশ্বের ৬০টিরও বেশি দেশে কালাজ্বরের প্রকোপ আছে। যদিও এটি লেশমানিয়া গোত্রের একাধিক পরজীবীর মাধ্যমে ঘটে থাকে। বাংলাদেশে একমাত্র পরজীবীর অস্তিত্বই পাওয়া গেছে। কালাজ্বরের সংক্রমণ এতটাই গুরুতর ও মারাত্মক হয়ে থাকে যে এ রোগে মৃত্যুহার শতকরা ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত বর্ধিত হতে পারে যদি চিকিৎসা করানো না হয়।
এই রোগ নির্ণয়ে পূর্বের পদ্ধতি ও উদ্ভাবিত পদ্ধতির কথা তুলনা করে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এর আগে এ রোগ নির্ণয়ে রক্তের ইমিউনোক্রোমাটোগ্রাফিক পরীক্ষা এবং অস্থি- মজ্জা, যকৃত, প্লীহা, লিম্ফ নোডের টিস্যু অণুবিক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হতো, যার প্রথমটির রোগ নির্ণয়ে নির্দিষ্টতা কম আর অন্যটিতে টিস্যু সংগ্রহের সময় মারাত্মক রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বিদ্যমান।
গত দশকে, বেশ কিছু পলিমারেজ চেইন রিএকশন (পিসিআর) ভিত্তিক কালাজ্বর নির্ণয় প্রক্রিয়া প্রচলিত হয়েছে। যদিও এই প্রক্রিয়া পূর্বে ব্যবহৃত পদ্ধতি হতে রোগ নির্ণয়ে অধিক কার্যকারী, এসব প্রক্রিয়ায় রক্ত, অস্থি-মজ্জা, যকৃত, সীথ, লিম্ফ নোডের টিস্যুর নমুনা ব্যবহার করা হয়। যেহেতু এরই মধ্যে একাধিক গবেষণায় কিডনিতে লেশম্যানিয়ার দেহের উপস্থিতি প্রমাণিত হয়েছে, তাই আমরা প্রস্রাবের নমুনা ব্যবহার করে এবং রিয়েল টাইম পিসিআর প্রযুক্তির সাহায্যে কালাজ্বর শনাক্ত করার চেষ্টা করেছি। ক্লিনিক্যালি নির্ণয়কৃত কালাজ্বর রোগীদের থেকে সংগ্রহ করা প্রস্রাবের নমুনা ব্যবহার করে তাতে পরজীবীর অস্তিত্ব রিয়েল টাইম পিসিআরের মাধ্যমে নির্ণয় করা হয়েছিল। রোগীদের একই সেট থেকে রক্তের নমুনা তুলনা করে পরীক্ষার ফলাফলগুলো বাছাই করা হয়েছিল। সেই সঙ্গে এই রিয়েল টাইম পিসিআরভিত্তিক কালাজ্বর নির্ণয় পরীক্ষাটি, পূর্বের এক গবেষণায় অংশগ্রহণকারী কালাজ্বর রোগীদের থেকে সংগৃহীত অস্থি-মজ্জার নমুনার ওপর প্রয়োগ করা হয়।
বিয়েল টাইম পিসিআরভিত্তিক পরীক্ষণটি প্রস্রাবে রক্ত এবং আগের অস্থি মাজার নমুনাগুলো থেকে পরজীবী শনাক্ত করার ক্ষেত্রে শতভাগ সংবেদনশীলতা প্রদর্শন করে। পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ গ্রুপগুলোতে অর্থাৎ গবেষণায় অংশগ্রহণকারী সুস্থ ব্যক্তি এবং কালাজ্বরের মতো অন্যান্য রোগ যেমন, মালেরিয়া, ডেঙ্গু এবং যক্ষ্মা আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রস্রাব এবং রক্তের নমুনায় কোনোরূপ সংবেদনশীলতা পরিলক্ষিত হয়নি। রিয়েল টাইম পিসিআরভিত্তিক এই মলিকুলার ডায়াগনস্টিক পদ্ধতিটি সম্পূর্ণ নির্ভুল এবং নিখুঁতভাবে কালাজ্বর শনাক্তকরণের জন্য একটি রোগীবান্ধব পদ্ধতি। এই পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে কালাজ্বর দ্রুত ও নির্ভুলভাবে শনাক্ত করা সম্ভব বলে দাবি করেছেন গবেষক দল। গবেষকরা বলছেন, এ পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে দ্রুততার সঙ্গে কালাজ্বর শনাক্ত করা সম্ভব যা রোগীর দ্রুত চিকিৎসা এবং রোগ নিরাময়ের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই পদ্ধতির ব্যবহার বাংলাদেশকে কালাজ্বর নির্মূলের দিকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০৩০ সালের মধ্যে উপেক্ষিত গ্রীষ্মমন্ডলীয় রোগ নির্মূলের জন্য নির্ধারিত কার্যপ্রণালীর অন্যতম লক্ষ্য। প্রস্রাবের নমুনা ব্যবহার করে এই পদ্ধতিতে যে উল্লেখযোগ্য সংবেদনশীলতা এবং নির্দিষ্টতা পাওয়া গিয়েছে, তা রক্ত বা আরও জটিল নমুনা যেমন অস্থি-মজ্জা বা প্লীহার নমুনাভিত্তিক কালাজ্বর নির্ণয় পদ্ধতিকে প্রতিস্থাপন করতে পারবে। প্রচলিত পিসিআর এবং নেস্টেড পিসিআর-ভিত্তিক কৌশলগুলির সঙ্গে তুলনা করলে, রিয়েল টাইম-পিসিআর-এর একটি ধাপেই রোগকে অধিক নির্ভুলতা এবং নিশ্চয়তার সঙ্গে শনাক্তকরণে সক্ষম, যা প্যাথলজিস্টদের জন্য কাজের চাপ কমিয়ে দেবে। এই পদ্ধতিটি একইসঙ্গে চিকিৎস্যপ্রতি রোগী ও জীবাণুর প্রতিক্রিয়া মূল্যায়ন, আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে পরজীবীর গতিবিধি, পরিবেশে সংক্রমণের গতিবিধি নিরূপণ এবং মহামারি সংক্রান্ত জরিপ পর্যবেক্ষণেও ব্যবহার করা যেতে পারে। এ গবেষণা বিশ্বখ্যাত জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে জানিয়ে গবেষকরা বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগে করা কালাজ্বরের ক্লিনিকাল নমুনা হিসাবে প্রস্তাব ব্যবহার করার দৃষ্টান্ত ভারতীয় উপমহাদেশে এই প্রথম এবং এর ফলাফল বিশ্বখ্যাত একটি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
কালাজ্বর শনাক্তকরণে নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করলো ঢাবি
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ