মো. আবুসালেহ সেকেন্দার : বর্তমান উত্তর-পশ্চিম ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের পানিপাত জেলার একটি শহর পানিপথ। এখানে ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস খ্যাত তিনটি ভাগ্য নির্ধারণী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ১৫২৬ সালে মির্জা জহিরুদ দিন মুহাম্মদ বাবর ও সুলতান ইব্রাহিম লোদির মধ্যে প্রথম পানিপথের যুদ্ধে বাবর জয়ী হলে ভারতের ইতিহাসে নতুন যুগের সূচনা হয়।
ভারতে মুঘল শাসনের সূচনা হয়। ইতিহাসের নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে মুঘলরা ভারতে ৩৩১ বছর শাসন করেন। ১৮৫৭ সালে অসাম্প্রদায়িক ও বহুত্ববাদী ব্রিটিশবিরোধী প্রথম সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতীয়দের পরাজিত হওয়ার মধ্য দিয়ে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ সিলমোহর পড়ে। ওই যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে শেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরের মিয়ানমারের রেঙ্গুনে নির্বাসনের মধ্য দিয়ে ভারতে মুঘল শাসনের অবসান হয়। ভারতে মুঘল শাসনের অবসান হলেও তাদের সৃষ্টি-কৃষ্টি-সংস্কৃতি আজও আগ্রা-দিল্লি বাংলায় স্বমহিমায় টিকে আছে। মুঘলদের পরাটা থেকে শুধু করে শরবত-কাবাবের রকমারি পদ আজও চর্চা হয় ভারতজুড়ে। বাংলাদেশের পুরাতন ঢাকায় রোজার মাসে বিক্রেতারা মুঘল খাবারের পসরা সাজিয়ে বসে। মির্জা নাথানের বাহারিস্তানি গায়বির বিবরণে বাংলার মুঘল যুগের ইফতার ও সাহরির খাবারের রকমারি বিবরণ পাওয়া যায়।
মির্জা নাথানের লেখা বাহারিস্তানি গায়বির বিবরণ ছাড়াও মুঘল যুগে লেখা অন্য ঐতিহাসিক গ্রন্থেও মুঘল যুগের রোজার ইতিহাস পাওয়া যায়। মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবরের আত্মজীবনী তুজুকি বাবরি এবং গুলবদন বেগমের লেখা হুমায়ুননামা গ্রন্থ তার মধ্যে অন্যতম। আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ তুজুকি বাবরি থেকে জানা যায়, মুঘল সম্রাট বাবর ধর্মেও ছিলেন জিরাফেও ছিলেন। তিনি একদিকে যেমন মদ পান করতেন, অন্যদিকে তিনি ধর্মও পালন করতেন। তিনি নামাজ পড়তেন ও রোজা রাখতেন। তবে ইফতারের পর আবার মদের আসর জমাতেন।
রমজান মাসে পাইজাদীতে ইফতারের পরে আয়োজিত অমন একটি মদের আসর তিনি কাজীর সম্মানে বাতিল করেন। তার ভাষায়- ‘আমি সন্ধ্যায় পাইজাদীতে পৌঁছে কাজীর বাড়িতে ইফতার করলাম। ইফতারের পরে মদের আসর আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু কাজী নিষেধ করলেন। কাজীর প্রতি সম্মান দেখিয়ে আমি মদের আসর আয়োজনের সিদ্ধান্ত বাতিল করলাম।’ তার এই বিবরণ থেকে জানা যায় যে, তিনি রমজানের রোজা রাখলেও রোজার মাসে মদের আসর বসিয়ে সদল নিয়ে মদ পান করতেন। মদ পান করলেও সম্রাট বাবর ধর্মের প্রতি অনুগত ছিলেন। সেই কারণে তিনি নফল রোজাও পালন করতেন। তার লিখিত তুজুকি বাবরি গ্রন্থে তার নফল রোজা পালনের বিবরণ রয়েছে। মুঘল যুগের চিত্র থেকেও সম্রাট বাবরের রোজা পালনের ইতিহাস জানা যায়। ১৫৮৯ সালে প্রকাশিত একটি চিত্র থেকে দেখা যায় যে ১৫১৯ সালে শেষ রোজা পালনের পর সম্রাট বাবর মদ্যপ অবস্থায় ঘোড়ার পিঠে চড়ে সামরিক শিবিরে ফিরছিলেন।
সামরিক অভিযানের সময় মুঘল সম্রাটরা রাজপ্রাসাদ ছেড়ে সামরিক শিবিরে বসবাস করলেও মুঘল সেনাদের নিত্যদিনের বসবাস ছিল সামরিক শিবিরে। তাই রমজানের রোজাও তারা সামরিক শিবিরে পালন করতেন। রমজান মাস তাদের জন্য উৎসবের আমেজ নিয়ে আসতো। প্রতিদিনই এক সামরিক শিবিরের সঙ্গে অন্য সামরিক শিবির সাহরি ইফতারে খাবার বিনিময় হতো। সেনারা একে অপরের সামরিক শিবিরে খাবার পাঠাতেন। এর মধ্য দিয়ে মুঘল সৈন্যদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ববোধ মজবুত হতো। রমজানের শেষ দিনে সামরিক শিবিরে ভোজের আয়োজন করা হতো।
১৬১১ সালে সম্রাট মির্জা নুরুদ দিন মুহাম্মদ সেলিম ওরফে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়ে রমজানের রোজা পূর্ণতা পায়। ওই বছর রোজা হয়েছিল ত্রিশটি। ওই ত্রিশ রোজা শেষে ইফতারে মুঘল সামরিক শিবিরে ভোজের আয়োজন করা হয়। কামান দেগে উৎসবের জানান দেওয়া হয়। মুঘল সেনাপতি মির্জা নাথান তার বাহারিস্তানি গায়বি গ্রন্থে ওই ধরনের তোপধ্বনি বা কামান দাগাকে ভূমিকম্পের সঙ্গে তুলনা করেছেন। মির্জা নাথান নিজেও রোজা পালন করতেন। তার বাহারিস্তানি গায়বি গ্রন্থ বাংলায় মুঘল যুগের রোজার ইতিহাসের অন্যতম প্রামাণিক উৎস। বাহরিস্তানি গায়বির মতো তুজকি জাহাঙ্গীরও মুঘল যুগের রমজানের ইতিহাসের অন্যতম উৎস গ্রন্থ।
তুজকি জাহাঙ্গিরি থেকে সম্রাট জাহাঙ্গীরের রোজা পালনের কথা জানা যায়। তিনি শুধু রোজা পালন করতেন না, বরং রমজান মাসে ব্যক্তিগতভাবে প্রচুর দান খয়রাত করতেন। এক্ষেত্রে তিনি সরাসরি জনগণের মাঝে দান করার বদলে উলামাদের মাধ্যমে দান-খয়রাত করতে বেশি পছন্দ করতেন। এক রমজানে তিনি ব্যক্তিগতভাবে প্রায় ৫০ হাজার রুপি, এক লাখ নব্বই বিঘা জমি, চৌদ্দটি গ্রাম এবং দরবেশদের মধ্যে চাল বহনকারী এগারো হাজার খচ্চর বিতরণ করেন। উলামাদের মাধ্যমে ও উলামাদের মধ্যে দান-খয়রাত করার ফলে মুঘল সাম্রাজ্যজুড়ে তার একটি অনুগত শ্রেণি তৈরি হয়েছিল। ওই উলামা শ্রেণি তার শাসনের খুঁটি হিসেবে কাজ করতো।
সম্রাট জাহাঙ্গীর ধর্মপ্রাণ হলেও তার পিতা সম্রাট আকবর অতটা ধর্মপ্রাণ ছিলেন না। তিনি প্রথম জীবনে নামাজ-রোজা পালন করলেও একসময় তিনি ধর্ম থেকে দূরে সরে যান। এক সময় আকবর নিজে আজান দিয়ে নামাজে ইমামতি করতেন। একনিষ্ঠ ধর্মের সেবক হিসেবে তিনি নিজ হাতে মসজিদ ঝাড়ু দিতেন। কিন্তু কালের পরিক্রমায় তিনি ধর্ম থেকে দূরে সরে যান এবং নামাজ-রোজা ত্যাগ করেন। তবে তার শাসনামলে অন্যরা নির্বিঘ্নে নামাজ-রোজা পালন করতে পারতেন।
হজ পালনসহ অন্য ধর্মীয় বিধিবিধান পালনের সুযোগও আমির-উমরাসহ সাধারণ মুসলিমদের জন্য স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। মুঘল সম্রাট শাহজাহান ও আওরঙ্গজেবের সময় রমজান পালন হতো নির্বিঘ্নে। মুঘল সম্রাটদের মধ্যে ধর্মপালনের জন্য আওরঙ্গজেব খ্যাতিলাভ করেন। তার সময়ে রোজা উৎসবে পরিণত হতো। তিনি রমজান মাসে সিংহাসনে বসেন। ফলে তার কাছে রমজান মাস বিশেষ গুরুত্ব বহন করতো। তিনি রমজান মাসজুড়ে উৎসবের আয়োজন করতেন। ইফতার উদযাপন করতেন। তিনি নিজে নামাজ পড়তেন, তারাবি পড়তেন এবং রমজানের শেষ দশ দিন ইতেকাফে বসতেন। একজন সম্রাটের ব্যস্ত রাজকীয় কাজের চেয়ে রমজানের শেষ দশদিন একটানা মসজিদে দিনরাত ইত্তেকাফে বসার ঘটনা তার ধর্ম অন্তঃপ্রাণ মনের সাক্ষ্য বহন করে। রমজানের রোজা ছাড়াও তিনি সপ্তাহে সোমবার, বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার রোজা রাখতেন।
মুঘল যুগে সেহেরি ডাকার প্রথা প্রচলন ছিল। রাতের দেড় ঘণ্টা বাকি থাকতেই রাজপ্রসাদে হাঁকডাক শুরু হতো। রাজপ্রাসাদের বাইরেও ডাকাডাকির প্রচলন ছিল। ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা সাহরি খাওয়ার জন্য একে অপরকে ডেকে তুলতেন। দস্তরখানা পেতে একত্রে সাহরি খেতেন। সাহরির মতো ইফতারও একত্রে হতো। ইফতারের সময় হয়েছে বোঝাতে কামান দাগা হতো। তোপধ্বনির আওয়াজে রোজাদাররা রোজা ভাঙতেন। ইফতার করতেন। তোপধ্বনির পাশাপাশি পতাকা দোলানো ও আজান দেওয়া হতো। ইফতারের মতো রোজার শেষ দিনও কামান দাগা হতো। ২৫ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে রমজান মাসের সমাপ্তিও ঈদের উৎসব শুরু হতো।
লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, নেপাল নিউজ; সহকারী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
ংধষধয.ংধশবহফবৎ@ড়ঁঃষড়ড়শ.পড়স