প্রত্যাশা ডেস্ক : গানে গানে মুখরিত থাকত আফগানিস্তান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মিউজিক (এএনআইএম)। আফগানিস্তানের ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে গান শিখত সেখানে। দেশে–বিদেশে সংগীত পরিবেশন করত। সেই গানের স্কুলের দরজা এখন বন্ধ। স্তব্ধ হলরুমগুলো। পড়ে আছে বাদ্যযন্ত্র। স্কুলটিতে প্রায়ই ঘোরাফেরা করতে দেখা যায় তালেবানদের।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এএনআইএম নামে গানের স্কুলটির এমন অবস্থার চিত্র। স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক ড. আহমদ সরমাস্ট একজন আফগান। তিনিই প্রথম আফগান, যিনি অস্ট্রেলিয়ায় সংগীত বিষয় নিয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৯০ সালে তালেবান শাসনের সময় আফগানিস্তান ছেড়ে রাশিয়ার মস্কোতে পালিয়ে যান সরমাস্ট। পরে আবার আফগানিস্তানে ফেরেন। ২০১৪ সালে আফগানিস্তানে আত্মঘাতী বোমা হামলায় আহত হন সরমাস্ট। বেশ কিছুদিন তিনি বাক্প্রতিবন্ধী ছিলেন। আফগান শিক্ষার্থীদের গান শেখানো শুরু করেন। প্রথাগত ও পাশ্চাত্যধারার সংগীতের মিশেলে নতুন ঘরানা চালু করেন।
বিবিসিকে ড. সরমাস্ট বলেন, শিক্ষার্থীরা ভীত ও উদ্বিগ্ন। তাদের বুঝতে বাকি নেই যে গানের স্কুলে ফিরে গেলে তাদের শাস্তি দেওয়া হবে। তালেবানদের ক্ষমতা দখলের পরে কয়েকজন শিক্ষার্থী স্কুলে তাদের বাদ্যযন্ত্র ফেরত দিতে বাধ্য হয়েছে। ঘরে বাদ্যযন্ত্র রাখাকে তারা বিপজ্জনক মনে করেছে। আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের এই স্কুল সরমাস্টের নেতৃত্বে এক দশক আগে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবানের শাসনকালের পরে ওই গানের স্কুলে ক্লাস শুরু করেন সরমাস্ট। অনাথ ও রাস্তার আশ্রয়হীন শিশুদের সেখানে যোগ দিতে উৎসাহিত করতেন তিনি। এই স্কুল থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনকারীদের অনেকে এখানেই প্রথম আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন। এএনআইএম স্কুলের এমনই একজন শিক্ষার্থী জোহরা। তিনি আফগানিস্তানের প্রথম নারী অর্কেস্ট্রা শিল্পী। গানের স্কুলটি তাঁর কাছে ছিল নিজের বাড়ির মতো। এই স্কুলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। স্লোভাকিয়াতে এক উৎসবে আফগানিস্তানের প্রথম নারী শিল্পী হিসেবে যোগ দেন জোহরা। জোহরা স্বপ্ন দেখতেন নামকরা সংগীতশিল্পী হওয়ার। তবে তাঁর সেই স্বপ্ন ভেঙে গেছে। এখন আবার আফগানিস্তানে সেই অন্ধকার যুগ ফিরে এসেছে। দেশটি আবার তালেবানদের কবজায় চলে গেছে। আর এতে স্কুল ও সংগীতশিল্পীদের জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
গত জুলাইয়ে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন সফরে যান সরমাস্ট। সেখান থেকেই বিবিসির সঙ্গে কথা হয় তাঁর। সরমাস্ট বলেন, ‘এখন আমাদের স্বপ্ন, আশা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সব নষ্ট হতে বসেছে।’
সরমাস্ট জানেন, তাঁর গানের স্কুলের কর্মী ও শিক্ষার্থীরা তালেবানদের হামলার লক্ষ্যবস্তু হতে পারেন। সবাইকে ঘরে ফিরে যেতে হতে পারে। সরমাস্ট বলেন, গানের স্কুলের শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয় পাচ্ছেন। এই ভয় কেবল তাঁদের পড়াশোনা বা সংগীতশিক্ষা নিয়ে নয়। তাঁরা তাঁদের জীবন নিয়ে শঙ্কিত। আফগানিস্তানে তাঁরা নিজেদের নিরাপদ মনে করছেন না।
ড. সরমাস্ট তাঁর শিক্ষার্থীদের বলেন, তালেবানরা তাঁদের গানের স্কুলকে হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। তারা এখানে ঘোরাফেরা করছে। তবে স্কুলের কোনো ক্ষতি করেনি। তালেবানরা ড. সরমাস্টের খোঁজ করছে বলেও খবর ছড়িয়েছে। তিনি আফগানিস্তানের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন। তালেবানরা গানের স্কুলের শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তাদের কাছ থেকে স্কুলের দখল নিতে চাইছে। তবে সরমাস্ট বলেছেন, তিনি কেবল তালেবানদের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করতে চান। আশঙ্কা করা হচ্ছে, যারা গানবাজনার সঙ্গে জড়িত, তাদের কঠোর শাস্তি দিতে চায় তালেবানরা। গানের স্কুলে থাকা অনেক বাদ্যযন্ত্র নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। গীতশিল্পীদের অনেকে লুকিয়ে আছেন। তবে তালেবানরা বলছে, আফগানিস্তানের নতুন সরকার বেশি আধুনিক হবে। তারা নারী স্বাধীনতা ও সরকারি কর্মীদের সুরক্ষা দেবে বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ড. সরমাস্ট বলেন, তিনি আশাবাদী যে তালেবানরা অতীত থেকে শিক্ষা নেবে। কিন্তু কাবুলে এখন যা ঘটছে, তাতে তিনি অনেকটাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন বলে জানান।
তবে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে গানের চর্চা ছেড়ে না দিতে আহ্বান জানান সরমাস্ট। আফগান সংগীতশিল্পীদের তিনি গানের চর্চা চালিয়ে যেতে আহ্বান জানান। তিনি আফগানিস্তানের সংগীতশিল্পীদের প্রতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার জন্য আহ্বান জানান।
কাবুলের স্তব্ধ গানের স্কুলে এখন তালেবানের আনাগোনা
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ