ঢাকা ১১:১৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৪ মার্চ ২০২৫
বিদেশি সহায়তা বন্ধের নির্দেশ

কাজলদের বেঁচে থাকার লড়াই

  • আপডেট সময় : ০৭:০৮:৩২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৪ মার্চ ২০২৫
  • ৮ বার পড়া হয়েছে

যক্ষ্মা আক্রান্ত কাজল- ছবি সংগৃহীত

প্রত্যাশা ডেস্ক: গেল জানুয়ারিতে কাজল যখন যক্ষ্মা আক্রান্ত হন, তখন তার পাশে দাঁড়ায় যুক্তরাষ্ট্রের দাতা সংস্থা ইউএসএআইডি। তবে ট্রাম্প প্রশাসন বেশিরভাগ মার্কিন সহায়তা বন্ধের নির্দেশ দেওয়ার পর তিনি ও তার পরিবার পড়েছেন বিপদে।

এক বিশেষ প্রতিবেদনে বিবিসি লিখেছে, চিকিৎসা না হলে টিবি মারাত্মক হতে পারে। ব্যাকটেরিয়াজনিত অত্যন্ত সংক্রামক রোগটিতে সাধারণত ফুসফুস আক্রান্ত হয়; তবে ধনী দেশে এই রোগের ব্যাপকতা নেই, কারণ এর চিকিৎসা খরচ তুলনামূলক কম। কিন্তু রোগটি দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশে।

বিশেষ করে ঢাকার মোহাম্মদপুরের মতো এলাকায়-যেখানে বস্তিতে থাকেন ১৭ বছর বয়সী কাজল। তিনি বলছিলেন, আমরা গরিব মানুষ। মা, ছোট ভাইসহ তিন সদস্যের পরিবারে কাজলই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। পোশাক কারখানায় কাজ করে তিনি যা আয় করেন তাই দিয়ে চলে পরিবারে সবাই।

এ কারণে জানুয়ারিতে যখন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন পরিবারের অবস্থা খুবই খারাপ হতে পারত। সেই সময় সহায়তার হাত বাড়িয়েছিলেন দীপা হালদার, যিনি গত তিন বছর ধরে মোহাম্মদপুরের বাসিন্দাদের মধ্যে যক্ষ্মা সম্পর্কে প্রচার চালিয়ে আসছিলেন এবং বিনামূল্যে তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিচ্ছিলেন।

এই উদ্যোগটি পরিচালিত হয় স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা নারী মৈত্রীর মাধ্যমে। মার্কিন সরকারের কাছ থেকে তহবিল বন্ধের চিঠি পাওয়ার আগে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সংস্থাটিতে অর্থায়ন করেছিল ইউএসএআইডি। এ পরিস্থিতিতে কাজলের চিকিৎসা সম্পন্ন হওয়ার আগেই বন্ধ হয়ে যায়। তিনি বলেন, এখন নিজের ওষুধ আনতে আমাকে যেতে হবে। আমি অনেক কষ্ট করছি।

বিবিসি লিখেছে, চিকিৎসার মাঝখানে ওষুধ বন্ধ করে দেওয়ার ফলে যক্ষ্মার ওষুধ-প্রতিরোধী হওয়ার শঙ্কা থাকে। আর তাতে রোগটির বিরুদ্ধে লড়াই করা আরো কঠিন হয়ে পড়ে এবং রোগীর গুরুতর অসুস্থতা ও মৃত্যু ঝুঁকি তৈরি হয়।

২১ বছর বয়সী দীপা বলেন, এখানকার মানুষ বেশ ঝুঁকিতে রয়েছেন। আমি তাদের একজন ডাক্তারের কাছে যেতে বলতে পারি, যাতে তাদের কিছু পয়সা বাঁচে। অথবা চেষ্টা করি, আমাদের সংস্থা থেকে তাদের কিছু আর্থিক সহায়তা দিতে, যাতে তারা তাদের চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পারফরম্যান্স রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ইউএসএআইডির সহায়তায় বাংলাদেশে আড়াই লাখেরও বেশি নতুন যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। একই বছরে ইউএসএআইডির সহায়তায় নতুন বা পুনরায় সংক্রমিত দুই লাখ ৯৬ হাজার ৪৮৭ জন নিরাময় হয়েছে বা তাদের চিকিৎসা সম্পন্ন হয়েছে। এই প্রতিবেদনটি বিবিসি দেখেছে।

যক্ষ্মার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থাটিকে অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেই দেখা হচ্ছিল।

বাংলাদেশে ইউএসএআইডির একটি প্রকল্পের একজন পরিচালক বলেন, আপনি রাস্তায় লোকজনকে জিজ্ঞাসা করবেন, তারা বলবেন হ্যাঁ, এটি (যক্ষ্মা) যুক্তরাষ্ট্রই নিয়ন্ত্রণে রাখছে।

সংবাদমাধ্যমে কথা বলার অনুমতি না থাকায় তিনি নাম প্রকাশ করতে চাননি। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ বলেন, এশিয়ায় ইউএসএআইডির সবচেয়ে বড় কর্মসূচি ছিল বাংলাদেশ।
প্রভাবের দিক থেকে- বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবায় এর ব্যাপক প্রভাব হয়েছে। বিশেষত টিকাদান, শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যু কমাতে ইউএসএআইডি এ দেশে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে।

বিবিসি লিখেছে, বাংলাদেশ ২০২৪ সালে ৫০ কোটি ডলারের বিদেশি সহায়তা পেয়েছে। এ বছর তা কমে নেমেছে ৭ কোটি ১০ লাখ ডলারে। এর আগে ইউএসএআইডি ২০২১-২০২৩ মেয়াদে বাংলাদেশে যক্ষ্মা মোকাবেলাসহ কেবল স্বাস্থ্য খাতে বছরে গড়ে ৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার ব্যয় করেছে।

ইউএসএআইডির অর্থায়ন বন্ধের অর্থ হচ্ছে নারী মৈত্রী আর ‘যক্ষ্মা থামান’ কর্মসূচি চালাতে পারছে না, তার মানে দীপার চাকরিও নেই। অথচ তাকে বৃদ্ধ মা-বাবা ও ছোট বোনের ভরণপোষণও চালাতে হয়।

চাকরি চলে যাওয়ায় আমি এখন পুরোপুরি ভেঙে পড়েছি। আমি পরিবারের ভার বহন করছি। বেকার থাকা একটা ভয়াবহ ব্যাপার, বিবিসিকে বলছিলেন দীপা।

বিবিসির দেখা এক নথি অনুযায়ী, ইউএসএআইডি বাংলাদেশ কার্যালয়ের অর্থায়নে পরিচালিত ১১৩টি কর্মসূচি বন্ধ হয়ে গেছে। ওয়াশিংটন থেকে মার্কিন সংস্থাগুলোর সরাসরি অর্থায়ন করা বিপুল সংখ্যক কর্মসূচি এই তালিকায় রাখা হয়নি।

আসিফ সালেহ বলেন, (বাংলাদেশে) এনজিও খাতে কমপক্ষে পাঁচ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। এটা অনেক। হাজার হাজার চাকরি বন্ধ হবে।

বিবিসি লিখেছে, কেবল যুক্তরাষ্ট্রই যে বিদেশি সহায়তা থেকে সরে আসছে তা নয়। যুক্তরাজ্য বিদেশি সহায়তা কমানোর ঘোষণা দিয়েছে, যেমনটা সুইজারল্যান্ডও করেছে। অন্য দেশও একই পথে হাঁটতে পারে।

এটি বাংলাদেশের জন্য কঠিন বাস্তবতা। এখানকার সরকার গত বছর উৎখাত হয়েছে এবং অর্থনীতি নড়বড়ে অবস্থায় রয়েছে। মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি এবং তরুণরা কর্মসংস্থান সংকটের মধ্যে রয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, সহায়তা কমার পর কীভাবে টিকে থাকা যায় তা নিয়ে বাংলাদেশ একটি নতুন কৌশল আনবে। তবে কীভাবে হবে তা তিনি বলেননি।

ইউএসএআইডির ঘাটতি বাংলাদেশ কীভাবে পুষিয়ে নেবে? বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমন প্রশ্নের উত্তরে ইউনূস বলেন, এটা ছোট একটা ব্যাপার, বড় কোনো বিষয় নয়। তার মানে এই নয় যে, বাংলাদেশ মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে।

আসিফ সালেহ বলেন, যেভাবে সহায়তা বন্ধ করা হয়েছে তা অপ্রত্যাশিত ও নৈরাজ্যকর। বাংলাদেশের মতো দেশে এর প্রভাব অপরিসীম।

পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ তা সবচেয়ে বেশি ফুটে উঠেছে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের উপকূলীয় জেলা কক্সবাজারে। সেখানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী ক্যাম্প রয়েছে। রয়েছেন মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা।

একদিকে তাদের দেশে ফেরার সুযোগ নেই, অন্যদিকে ক্যাম্পের বাইরে কাজ করাও উপায় নেই। সেই কারণে জীবিকার জন্য তাদের নির্ভর করতে হয় আন্তর্জাতিক সহায়তার ওপর।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য মোট সহায়তার প্রায় অর্ধেকই দেয় যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের বাংলাদেশ প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার বলেন, আমাদের সাবান শেষ হয়ে গেছে। আমাদের এখন ট্রাকে করে ক্যাম্পে পানি নিতে হচ্ছে। এটা খুবই সংকটময় সময়। ৫৮০ জনেরও বেশি মানুষের মধ্যে কলেরা প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে এবং সেই সঙ্গে খোস-পাঁচড়ারও প্রাদুর্ভাব রয়েছে।

ক্যাম্পের ওয়াটার স্যানিটেশন কর্মসূচিতে অর্থায়ন করত ইউএসএআইডি। তাদের কাজ বন্ধের আদেশ জানুয়ারির শেষ দিকে কার্যকর হয়। তারপর থেকে কক্সবাজারে রেডক্রস হাসপাতালের মতো স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কেবল জরুরি চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ইউএসএআইডির যত কর্মসূচি রয়েছে, তার ৮০ শতাংশেরও বেশি চলতি সপ্তাহে বাতিল করে ট্রাম্প প্রশাসন। তার ফলে পুনঃঅর্থায়নের আশা এখন গুড়েবালি।

উচ্চ রক্তচাপের জন্য নিয়মিত চিকিৎসা নিতে হয় হামিদা বেগমকে। পরিবর্তিত বাস্তবতায় চিকিৎসার জন্য তার খুব কমই বিকল্প রয়েছে। তিনি বলেন, আমার বয়স হয়ে গেছে এবং আমাকে সাহায্য করার মতো কেউ নেই। গেল বছর স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে তাকে একাই চার সন্তানের দেখভাল করতে হয়। তাদের মধ্যে ১২ বছর বয়সী একটি মেয়ে রয়েছে- যে হাঁটতে পারে না। হামিদা বলেন, আমার মেয়ের কারণে বাড়ি থেকে দূরের কোনো হাসপাতালে যেতে পারছি না।

সেখান থেকে অদূরে জাতিসংঘের একটি খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রে দুটি বড় বস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন রেহানা বেগম। তিনি বলেন, ভেতরে ছয় লিটার রান্নার তেল এবং ১৩ কেজি চাল রয়েছে। আরো রয়েছে পেঁয়াজ, রসুন এবং শুকনা মরিচের মতো নিত্যপণ্য। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) তাকে যে রেশন দিয়েছে- তা দিয়ে রেহানা ও তার পরিবারকে এক মাস চলতে হবে।

বিবিসি তার কাছে প্রশ্ন রেখেছিল, আগামী মাস থেকে রেশন অর্ধেক হলে কীভাবে চলবেন? এ কথা শুনে তিনি হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। এরপর তিনি কাঁদতে শুরু করেন। ৪৭ বছর বয়সী রেহানা বলতে থাকলেন, এত অল্প জিনিস নিয়ে আমরা কেমন করে বাঁচব? এখনই (বর্তমান রেশনেই) সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যায়। স্বামী ও পাঁচ সন্তানকে নিয়ে রেহানাকে এক ঘরে থাকতে হয়।

ডব্লিউএফপি বলছে, তহবিল সংকটের কারণে জরুরি সাড়াদান কার্যক্রমে ব্যাপক কাটছাঁট করতে তারা বাধ্য হয়েছে।

বিবিসি লিখেছে, রোহিঙ্গাদের জন্য এখন যে রেশন বরাদ্দ করা হচ্ছে তা কেবল তাদের দৈনন্দিন খাদ্য চাহিদা পূরণ করে। আশঙ্কা জাগছে, কাটছাঁটের ফলে বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট খাবার থাকবে কি থাকবে না।

ইউনিসেফের রানা ফ্লাওয়ার বলেন, একটি চরম বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। হতাশাগ্রস্ত লোকজনের কারণে ক্যাম্পের ভেতরে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হবে। যদি পরিস্থিতি তীব্রতর হয়, তাহলে সহায়তার জন্য আমরা ক্যাম্পে যেতে পারব না।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

ছিনতাইয়ের শিকার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের বাসায় আসামির ছেলে

বিদেশি সহায়তা বন্ধের নির্দেশ

কাজলদের বেঁচে থাকার লড়াই

আপডেট সময় : ০৭:০৮:৩২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৪ মার্চ ২০২৫

প্রত্যাশা ডেস্ক: গেল জানুয়ারিতে কাজল যখন যক্ষ্মা আক্রান্ত হন, তখন তার পাশে দাঁড়ায় যুক্তরাষ্ট্রের দাতা সংস্থা ইউএসএআইডি। তবে ট্রাম্প প্রশাসন বেশিরভাগ মার্কিন সহায়তা বন্ধের নির্দেশ দেওয়ার পর তিনি ও তার পরিবার পড়েছেন বিপদে।

এক বিশেষ প্রতিবেদনে বিবিসি লিখেছে, চিকিৎসা না হলে টিবি মারাত্মক হতে পারে। ব্যাকটেরিয়াজনিত অত্যন্ত সংক্রামক রোগটিতে সাধারণত ফুসফুস আক্রান্ত হয়; তবে ধনী দেশে এই রোগের ব্যাপকতা নেই, কারণ এর চিকিৎসা খরচ তুলনামূলক কম। কিন্তু রোগটি দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশে।

বিশেষ করে ঢাকার মোহাম্মদপুরের মতো এলাকায়-যেখানে বস্তিতে থাকেন ১৭ বছর বয়সী কাজল। তিনি বলছিলেন, আমরা গরিব মানুষ। মা, ছোট ভাইসহ তিন সদস্যের পরিবারে কাজলই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। পোশাক কারখানায় কাজ করে তিনি যা আয় করেন তাই দিয়ে চলে পরিবারে সবাই।

এ কারণে জানুয়ারিতে যখন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন পরিবারের অবস্থা খুবই খারাপ হতে পারত। সেই সময় সহায়তার হাত বাড়িয়েছিলেন দীপা হালদার, যিনি গত তিন বছর ধরে মোহাম্মদপুরের বাসিন্দাদের মধ্যে যক্ষ্মা সম্পর্কে প্রচার চালিয়ে আসছিলেন এবং বিনামূল্যে তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিচ্ছিলেন।

এই উদ্যোগটি পরিচালিত হয় স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা নারী মৈত্রীর মাধ্যমে। মার্কিন সরকারের কাছ থেকে তহবিল বন্ধের চিঠি পাওয়ার আগে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সংস্থাটিতে অর্থায়ন করেছিল ইউএসএআইডি। এ পরিস্থিতিতে কাজলের চিকিৎসা সম্পন্ন হওয়ার আগেই বন্ধ হয়ে যায়। তিনি বলেন, এখন নিজের ওষুধ আনতে আমাকে যেতে হবে। আমি অনেক কষ্ট করছি।

বিবিসি লিখেছে, চিকিৎসার মাঝখানে ওষুধ বন্ধ করে দেওয়ার ফলে যক্ষ্মার ওষুধ-প্রতিরোধী হওয়ার শঙ্কা থাকে। আর তাতে রোগটির বিরুদ্ধে লড়াই করা আরো কঠিন হয়ে পড়ে এবং রোগীর গুরুতর অসুস্থতা ও মৃত্যু ঝুঁকি তৈরি হয়।

২১ বছর বয়সী দীপা বলেন, এখানকার মানুষ বেশ ঝুঁকিতে রয়েছেন। আমি তাদের একজন ডাক্তারের কাছে যেতে বলতে পারি, যাতে তাদের কিছু পয়সা বাঁচে। অথবা চেষ্টা করি, আমাদের সংস্থা থেকে তাদের কিছু আর্থিক সহায়তা দিতে, যাতে তারা তাদের চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পারফরম্যান্স রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ইউএসএআইডির সহায়তায় বাংলাদেশে আড়াই লাখেরও বেশি নতুন যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। একই বছরে ইউএসএআইডির সহায়তায় নতুন বা পুনরায় সংক্রমিত দুই লাখ ৯৬ হাজার ৪৮৭ জন নিরাময় হয়েছে বা তাদের চিকিৎসা সম্পন্ন হয়েছে। এই প্রতিবেদনটি বিবিসি দেখেছে।

যক্ষ্মার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থাটিকে অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেই দেখা হচ্ছিল।

বাংলাদেশে ইউএসএআইডির একটি প্রকল্পের একজন পরিচালক বলেন, আপনি রাস্তায় লোকজনকে জিজ্ঞাসা করবেন, তারা বলবেন হ্যাঁ, এটি (যক্ষ্মা) যুক্তরাষ্ট্রই নিয়ন্ত্রণে রাখছে।

সংবাদমাধ্যমে কথা বলার অনুমতি না থাকায় তিনি নাম প্রকাশ করতে চাননি। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ বলেন, এশিয়ায় ইউএসএআইডির সবচেয়ে বড় কর্মসূচি ছিল বাংলাদেশ।
প্রভাবের দিক থেকে- বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবায় এর ব্যাপক প্রভাব হয়েছে। বিশেষত টিকাদান, শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যু কমাতে ইউএসএআইডি এ দেশে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে।

বিবিসি লিখেছে, বাংলাদেশ ২০২৪ সালে ৫০ কোটি ডলারের বিদেশি সহায়তা পেয়েছে। এ বছর তা কমে নেমেছে ৭ কোটি ১০ লাখ ডলারে। এর আগে ইউএসএআইডি ২০২১-২০২৩ মেয়াদে বাংলাদেশে যক্ষ্মা মোকাবেলাসহ কেবল স্বাস্থ্য খাতে বছরে গড়ে ৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার ব্যয় করেছে।

ইউএসএআইডির অর্থায়ন বন্ধের অর্থ হচ্ছে নারী মৈত্রী আর ‘যক্ষ্মা থামান’ কর্মসূচি চালাতে পারছে না, তার মানে দীপার চাকরিও নেই। অথচ তাকে বৃদ্ধ মা-বাবা ও ছোট বোনের ভরণপোষণও চালাতে হয়।

চাকরি চলে যাওয়ায় আমি এখন পুরোপুরি ভেঙে পড়েছি। আমি পরিবারের ভার বহন করছি। বেকার থাকা একটা ভয়াবহ ব্যাপার, বিবিসিকে বলছিলেন দীপা।

বিবিসির দেখা এক নথি অনুযায়ী, ইউএসএআইডি বাংলাদেশ কার্যালয়ের অর্থায়নে পরিচালিত ১১৩টি কর্মসূচি বন্ধ হয়ে গেছে। ওয়াশিংটন থেকে মার্কিন সংস্থাগুলোর সরাসরি অর্থায়ন করা বিপুল সংখ্যক কর্মসূচি এই তালিকায় রাখা হয়নি।

আসিফ সালেহ বলেন, (বাংলাদেশে) এনজিও খাতে কমপক্ষে পাঁচ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। এটা অনেক। হাজার হাজার চাকরি বন্ধ হবে।

বিবিসি লিখেছে, কেবল যুক্তরাষ্ট্রই যে বিদেশি সহায়তা থেকে সরে আসছে তা নয়। যুক্তরাজ্য বিদেশি সহায়তা কমানোর ঘোষণা দিয়েছে, যেমনটা সুইজারল্যান্ডও করেছে। অন্য দেশও একই পথে হাঁটতে পারে।

এটি বাংলাদেশের জন্য কঠিন বাস্তবতা। এখানকার সরকার গত বছর উৎখাত হয়েছে এবং অর্থনীতি নড়বড়ে অবস্থায় রয়েছে। মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি এবং তরুণরা কর্মসংস্থান সংকটের মধ্যে রয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, সহায়তা কমার পর কীভাবে টিকে থাকা যায় তা নিয়ে বাংলাদেশ একটি নতুন কৌশল আনবে। তবে কীভাবে হবে তা তিনি বলেননি।

ইউএসএআইডির ঘাটতি বাংলাদেশ কীভাবে পুষিয়ে নেবে? বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমন প্রশ্নের উত্তরে ইউনূস বলেন, এটা ছোট একটা ব্যাপার, বড় কোনো বিষয় নয়। তার মানে এই নয় যে, বাংলাদেশ মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে।

আসিফ সালেহ বলেন, যেভাবে সহায়তা বন্ধ করা হয়েছে তা অপ্রত্যাশিত ও নৈরাজ্যকর। বাংলাদেশের মতো দেশে এর প্রভাব অপরিসীম।

পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ তা সবচেয়ে বেশি ফুটে উঠেছে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের উপকূলীয় জেলা কক্সবাজারে। সেখানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী ক্যাম্প রয়েছে। রয়েছেন মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা।

একদিকে তাদের দেশে ফেরার সুযোগ নেই, অন্যদিকে ক্যাম্পের বাইরে কাজ করাও উপায় নেই। সেই কারণে জীবিকার জন্য তাদের নির্ভর করতে হয় আন্তর্জাতিক সহায়তার ওপর।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য মোট সহায়তার প্রায় অর্ধেকই দেয় যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের বাংলাদেশ প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার বলেন, আমাদের সাবান শেষ হয়ে গেছে। আমাদের এখন ট্রাকে করে ক্যাম্পে পানি নিতে হচ্ছে। এটা খুবই সংকটময় সময়। ৫৮০ জনেরও বেশি মানুষের মধ্যে কলেরা প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে এবং সেই সঙ্গে খোস-পাঁচড়ারও প্রাদুর্ভাব রয়েছে।

ক্যাম্পের ওয়াটার স্যানিটেশন কর্মসূচিতে অর্থায়ন করত ইউএসএআইডি। তাদের কাজ বন্ধের আদেশ জানুয়ারির শেষ দিকে কার্যকর হয়। তারপর থেকে কক্সবাজারে রেডক্রস হাসপাতালের মতো স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কেবল জরুরি চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ইউএসএআইডির যত কর্মসূচি রয়েছে, তার ৮০ শতাংশেরও বেশি চলতি সপ্তাহে বাতিল করে ট্রাম্প প্রশাসন। তার ফলে পুনঃঅর্থায়নের আশা এখন গুড়েবালি।

উচ্চ রক্তচাপের জন্য নিয়মিত চিকিৎসা নিতে হয় হামিদা বেগমকে। পরিবর্তিত বাস্তবতায় চিকিৎসার জন্য তার খুব কমই বিকল্প রয়েছে। তিনি বলেন, আমার বয়স হয়ে গেছে এবং আমাকে সাহায্য করার মতো কেউ নেই। গেল বছর স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে তাকে একাই চার সন্তানের দেখভাল করতে হয়। তাদের মধ্যে ১২ বছর বয়সী একটি মেয়ে রয়েছে- যে হাঁটতে পারে না। হামিদা বলেন, আমার মেয়ের কারণে বাড়ি থেকে দূরের কোনো হাসপাতালে যেতে পারছি না।

সেখান থেকে অদূরে জাতিসংঘের একটি খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রে দুটি বড় বস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন রেহানা বেগম। তিনি বলেন, ভেতরে ছয় লিটার রান্নার তেল এবং ১৩ কেজি চাল রয়েছে। আরো রয়েছে পেঁয়াজ, রসুন এবং শুকনা মরিচের মতো নিত্যপণ্য। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) তাকে যে রেশন দিয়েছে- তা দিয়ে রেহানা ও তার পরিবারকে এক মাস চলতে হবে।

বিবিসি তার কাছে প্রশ্ন রেখেছিল, আগামী মাস থেকে রেশন অর্ধেক হলে কীভাবে চলবেন? এ কথা শুনে তিনি হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। এরপর তিনি কাঁদতে শুরু করেন। ৪৭ বছর বয়সী রেহানা বলতে থাকলেন, এত অল্প জিনিস নিয়ে আমরা কেমন করে বাঁচব? এখনই (বর্তমান রেশনেই) সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যায়। স্বামী ও পাঁচ সন্তানকে নিয়ে রেহানাকে এক ঘরে থাকতে হয়।

ডব্লিউএফপি বলছে, তহবিল সংকটের কারণে জরুরি সাড়াদান কার্যক্রমে ব্যাপক কাটছাঁট করতে তারা বাধ্য হয়েছে।

বিবিসি লিখেছে, রোহিঙ্গাদের জন্য এখন যে রেশন বরাদ্দ করা হচ্ছে তা কেবল তাদের দৈনন্দিন খাদ্য চাহিদা পূরণ করে। আশঙ্কা জাগছে, কাটছাঁটের ফলে বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট খাবার থাকবে কি থাকবে না।

ইউনিসেফের রানা ফ্লাওয়ার বলেন, একটি চরম বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। হতাশাগ্রস্ত লোকজনের কারণে ক্যাম্পের ভেতরে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হবে। যদি পরিস্থিতি তীব্রতর হয়, তাহলে সহায়তার জন্য আমরা ক্যাম্পে যেতে পারব না।