ঢাকা ০১:০৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ অগাস্ট ২০২৫

কল্যাণরাষ্ট্রে সোনার বাংলা

  • আপডেট সময় : ১১:১০:২৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৬ অগাস্ট ২০২১
  • ১০৪ বার পড়া হয়েছে

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন : অর্ধশতাব্দী বয়সে বাংলাদেশের অর্থনীতি শূন্যের কোঠা থেকে (মাথাপিছু আয় ৮৫ মার্কিন ডলার, বিশ্বব্যাংক, ১৯৭২) এখন ১ হাজার ৯৮৭ মার্কিন ডলার (আইএমএফ)। সামাজিক রূপান্তরের সাক্ষী হিসেবে গড় আয়ু ৭৩ বছর, শিশুমৃত্যুর হার লাখে ৩০-এর কম, বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৩ শতাংশ (১৯৭২ সালে ৩.৩ শতাংশ), প্রাথমিকে ভর্তির হার ৯০ শতাংশের বেশি, ঝরে পড়ার হার ২৫-২৬ শতাংশ এবং নি¤œগামী। নারীর সার্বিক প্রজনন ক্ষমতা ১৯৭২ সালে ছিল ৫.২; এখন তা ২.২। বিদ্যুৎ এখন ৯৫ শতাংশ মানুষের ঘরে। সুপেয় পানির প্রাপ্যতা ৭০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। পরিবারের আকার ৬.২ থেকে ৪.২-এ নেমেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে ১৯৭২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছিলেন ৩০ হাজার, এখন ৩৮ লাখ। শিক্ষার হার ৬৫ শতাংশ, কিন্তু এর মান সম্পর্কে দেশে-বিদেশে জিজ্ঞাসার অন্ত নেই। ২০০৮ সালে শুরু করা ডিজিটাল বাংলাদেশ সুফল দিচ্ছে, ফলে কোভিড-১৯-এর লন্ডভন্ড পাঠদান বিষয়ে অনলাইন ব্যবস্থা ক্রমপ্রসারমাণ।
স্বাধীনতার স্বদেশ আগমন : ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ স্বাধীনতা অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমান বীরের বেশে জাতির পিতা হিসেবে স্বদেশে আসেন। দ্রুতগতিতে সাংবিধানিক পরিবর্তন এনে সরকারপ্রধান, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন তিনি। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হতোদ্যম বাংলাদেশে তখন প্রতিটি ক্ষেত্রে সমস্যার পাহাড় আর ৩০ লাখ নারী-পুরুষের শাহাদাত এবং ৩ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির আহাজারি। গুদামে খাদ্য নেই, কিষান-কিষানিরা স্বাধীনতাযুদ্ধে, তাই মাঠে ফসল নেই। ব্যাংক-বিমা, কলকারখানা, সদাগরি অফিস বন্ধ; কারণ (পশ্চিম) পাকিস্তানিরা এসবের মালিক ছিলেন; তারা পালিয়ে গেছেন নিজ দেশে। রেল, সেতু, রাস্তাঘাট, কালভার্ট, বন্দর, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ধ্বংসপ্রাপ্ত অথবা প্রাণসংহারী মাইনে ভরা। এদিকে পরাজিত শত্রু ও তাদের এদেশীয় অনুচর গোলাম আযম, জুলমত আলী খান, আব্দুল জব্বার খদ্দর, মৌলানা আব্দুল মান্নান, মৌলানা আতাহার আলী এমনকি একদা প্রগতিশীল মাহমুদ আলীরা প্রচারে নামলেন যে ইসলামি জমহুরি পাকিস্তান (মধ্যপ্রাচ্যের সখা) ভেঙে শেখ মুজিব একটি ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দু প্রভাবিত বাংলাদেশ বানিয়েছেন, যেটি ভারতের করদ রাজ্য ছাড়া আর কিছু নয়। শুধু গণচীন বা পাকিস্তান নয়, ইরাক ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের সব স্বৈরতান্ত্রিক রাজতন্ত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানাল। ১৯৭২ সালে জাতিসংঘে প্রবেশে গণচীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভেটো প্রয়োগ করল। হেনরি কিসিঞ্জার তো বটেই, নরওয়ের হিউস্ট ফ্যালান্ড এবং ইংল্যান্ডের অর্থনীতিবিদ জন হেন্ডারসন ফতোয়া দিলেন, ভৌগোলিক দিক থেকে টিকে গেলেও একটি সচল অর্থনীতি হিসেবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এত তমসাচ্ছন্ন যে এর বেঁচে থাকা অর্থনীতির পাঠ্যপুস্তকে ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে জায়গা করে নেবে। এসব প্রতিকূলতার মধ্যে জাতির পিতার প্রত্যাবর্তন সমগ্র জাতিকে উচ্চতম আলোর ঝলকানিতে উদ্বুদ্ধ করে।
দৃঢ় পদক্ষেপের সূচনা : বঙ্গবন্ধুর সরকার একে একে প্রায় যুগপৎভাবে অনেকগুলো কাজ শুরু করে। সংবিধান রচিত হয় নয় মাসে। ধর্মীয় ব্যবসা বন্ধের রাজনীতি আসে, তবে ইসলামিক ফাউন্ডেশন স্থাপিত হয়; বন্ধ হয় মদ, জুয়া, জিমখানা। সংকট মোকাবিলায় বঙ্গবন্ধু প্রথম দিকে গণখাতের (পাবলিক সেক্টর) ওপর নির্ভর করেন, তবে ব্যক্তিগত বাজার অর্থনীতির গতিময় দক্ষতার রাস্তাও খোলা রাখেন। স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের ঢাকা অফিসে রক্ষিত ১৮ মার্কিন ডলারের স্থিতি আয় আর কানাডা ও সুইডেনের নগদে বৈদেশিক অনুদানে শুরু হয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৩ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলারের সম্মানজনক স্থিতিতে উঠেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধকালে পলায়নপর পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞে সামষ্টিক অর্থনীতির পরিধি ১৯৭০-৭১ সালে আগের অর্থবছরের তুলনায় ৩৫ শতাংশ সংকুচিত হয়ে ৯০০ কোটি মার্কিন ডলারে ধসে যায় (এখন বাংলাদেশের সামষ্টিক আয়, জিডিপি ৩০ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার)। ‘সবার সাথে সখ্য কারও সাথে বৈরী নই’ নীতিতে যাত্রা শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির। তারই পরিম-লে সার্বভৌম স্বাধীনতা ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে বৃহৎ ও মহৎ প্রতিবেশী ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনসহ (১৫ মার্চ ১৯৭২) অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সহযোগিতা স্থাপিত হয়। ১৯৭৩ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের মর্যাদাপূর্ণ যোগদান এবং তার আগে পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি জাতিসংঘ এবং অন্য সব বিশ্ব সংস্থায় যোগদানের পথ উন্মুক্ত করে।
ভবিষ্যতের সু-আভাস : অত্যুক্তির নিন্দার ভয় ছাড়াই একমত হওয়া যাবে যে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্য: সিংহভাগ তরুণই ২০১৯ সালে অর্থনীতির পরিস্থিতিতে (৮০ শতাংশ) এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে (৫৩.৭ শতাংশ) সন্তুষ্ট (১২ পৌষ ২৭ ডিসেম্বর), যা ক্রমর্বর্ধমান। তবে নিরাপত্তা নিয়ে সবাই চিন্তিত। প্রতি পাঁচ তরুণের চারজনই জীবনের লক্ষ্য নিয়ে চিন্তিত। মনে রাখা প্রয়োজন যে ২০১৯ সালের প্রাক্কলন ছাড়িয়ে বাংলাদেশের সামষ্টিক আয় জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮.১৫ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে বলা হয়েছে যে ২০২৪ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্ক অর্থাৎ ১০ শতাংশে উন্নীত হবে। বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে আসা রেমিট্যান্স বহির্গামী রেমিট্যান্সের চেয়ে বেশি বলে মাথাপিছু জিএনআই মাথাপিছু জিডিপির চেয়ে বেশি হয়। ২০২৪ সালে মাথাপিছু জিএনআই ২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার হওয়ারই কথা, আর বার্ষিক নিট প্রবৃদ্ধি (বার্ষিক জিএনআই প্রবৃদ্ধি থেকে বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বাদ দিলে) ৯ শতাংশ হবে। একটি অব্যর্থ লগারিদমিক ফর্মুলা অনুসারে এই পরিস্থিতিতে মাথাপিছু আয় প্রতি ৭.৫ বছরে দ্বিগুণ হবে অর্থাৎ ২০৩১ সালের জুনে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিএনআই ৫ হাজার মার্কিন ডলার এবং ২০৩৯ সালে ১০ হাজার মার্কিন ডলারে উন্নীত হবে। সুতরাং ২০৪১ সালে পৃথিবীতে ২৩তম বৃহত্তম অর্থনীতি বাংলাদেশ একটি উন্নত সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক কল্যাণরাষ্ট্রে রূপান্তরিত হবে বলে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ অর্জনযোগ্য বটে।
কতিপয় সতর্কবার্তা : বাংলাদেশ সম্পর্কে যে আশাবাদ গত ১২ বছরে বিশেষ করে অর্থনীতি ক্ষেত্রে প্রবহমান, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণকাজ সমাপ্তির কাছাকাছি এসে দেশটি বিশেষ করে এর সরকারপ্রধান জনবন্ধু শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতম হয়ে উদ্ভাসিত। অন্যান্য বিশাল অবকাঠামো প্রকল্প মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল এবং পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন, টেকসই উন্নয়নের সোনার বাংলার স্বপ্ন রূপায়ণে বৃহৎ বৃহৎ পদক্ষেপ। কোভিড-১৯ ব্যবস্থাপনায় বিশ্বের সবচেয়ে সফল ২০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। আইএমএফ বলছে, সামষ্টিক অর্থনীতির বার্ষিক প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশে ৪.৪ শতাংশ, যেখানে ১৯টি বাদে সব দেশেরই নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের হিসাব বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার বাংলাদেশে হবে ৬.৮ শতাংশ। প্রশ্ন অবশ্যই থাকছে, যদি (ক) জুলাই-ডিসেম্বর ষাণ¥াসিকে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হয় ৩২ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা, লক্ষ্যমাত্রার ২৩ শতাংশ কম হয় (খ) ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ স্থবির হয়ে থাকে এবং (গ) মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমাদানি হ্রাস পায়, তাহলে বিনিয়োগ: জিডিপি বাড়বে কীভাবে ও কোথা থেকে। আর যদি খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের সুযোগ-সুবিধা বাড়তেই থাকে, কর ফাঁকিবাজদের দাপট উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায় (সাদা আয়ের করের হার যদি কালোটাকার সুদহারের চেয়ে বেশি হয়) এবং যদি মানি লন্ডারিং শনাক্তকরণ ও যথাবিহিত বিচারের অধীনে না আনা হয়, তাহলেও অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি অব্যাহতভাব ক্রমবর্ধমানে বাড়বে কীভাবে, তা বোধগম্য হচ্ছে না।
শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল সংস্কার জরুরি : সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থায় একটি আপাতদৃষ্টে অজনপ্রিয় হলেও আমূল সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উন্নত দেশের মতো অঞ্চল বা এলাকাভিত্তিক ভর্তি করা, স্কুল ইউনিফর্ম চালু করা, ব্যক্তিগত যানবাহন নয় বরং প্রয়োজন হলে স্কুল-কলেজের বাসে যাতায়াত, খেলাধুলা ও সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ, বেতন-ভাতা সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদা বৃদ্ধি করে শিক্ষকম-লীকে টিউশন থেকে ক্লাসমুখী করা, নোটবই, গাইড ও কোচিং সেন্টারের দৃঢ়হস্ত নিয়ন্ত্রণ তথা কালক্রমে বন্ধ করা না হলে দেশের দৃষ্টিনন্দন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং হৃদয় উষ্ণ করা সামাজিক অগ্রযাত্রা ধরে রাখা এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব না-ও হতে পারে। ভারতে আগামী বছর থেকে এসএসসি পরীক্ষা বোর্ড পর্যায়ে আর হবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আমাদের পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষা অভিভাবককে বিষাদময় করে তোলে; কোভিড-১৯-এর কারণে এটা এখন স্থগিত বা বাতিল করা যেতে পারে এবং ছাত্রছাত্রীদের তোতাপাখির মুখস্থবিদ্যার দিকে নিয়ে যাচ্ছে কি না, সে বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ নিরীক্ষা করানো প্রয়োজন। মাধ্যমিকে বৃত্তিমূলক এবং উচ্চশিক্ষায় প্রযুক্তি শিক্ষা বিষয়ে সদাশয় সরকারের যে সিদ্ধান্ত রয়েছে, তা কৃতসংকল্পতার সঙ্গে পিপিপি সহযোগে বাস্তবায়ন করা সমীচীন হবে। লেখাপড়াকে ব্যবহারিক প্রায়োগিক করতেই হবে এবং সে জন্য চাকরিদানকারী করপোরেট ও শিক্ষাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে নিবিড় যোগাযোগ ও মতবিনিময় করে পাঠ্যক্রম তৈরি করতে হবে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানে পালাক্রমে তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক হাতে-কলমে শিক্ষা গ্রহণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আদলে কো-অপারেটিভ শিক্ষার প্রচলন করা সঠিক হবে। শীতকালে উচ্চশিক্ষার বিদার্থীদের এক সেমিস্টারের জন্য পল্লিবাংলার কিষান-কিষানির তত্ত্বাবধানে পাঠানোর কথা ভাবা যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইনকিউবেটর স্থাপন করে একদিকে প্রকল্প প্রণয়নে প্রশিক্ষণ ও অন্যদিকে উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে হাতে-কলমে শিক্ষার ব্যবস্থা এখন সময়ের দাবি।
দুর্নীতি দমন ও নানাবিধ সংস্কার : দুর্নীতি ও দীর্ঘসূত্রতা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অনেককেই নিরুৎসাহিত করছে। আমরাও গভীরভাবে উৎকণ্ঠিত। বাংলাদেশ ২০১৭ সালে মাথাপিছু আয়ে পাকিস্তানকে টপকে গেছে। ২০২৯ সালে ভারতকেও স্থায়ীভাবে টপকে যেতে পারে বলে ব্লুমবার্গ, এইচএসবিসিসহ একাধিক পূর্বাভাস রয়েছে। তবে সম্প্রতি রপ্তানি আয়ে ধীরগতি চলছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থযুদ্ধের ফলে চৈনিক বহু কোম্পানি বাংলাদেশে স্থানান্তরের পরিবর্তে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানে চলে যাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারে অনমনীয়তা সৃষ্ট টাকার অতি মূল্যায়ন (যা বৈদেশিক মুদ্রায় রপ্তানি পণ্যের দাম অবমূল্যায়নকারী দেশের তুলনায় বাড়িয়ে দেয়) রপ্তানিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তৈরি পোশাকে এর প্রভাব বিশাল; যখনই ভিয়েতনাম তার মুদ্রার অবমূল্যায়ন করে তখনই বৈদেশিক মুদ্রায় ওই দেশের তৈরি পোশাকের মূল্য কমে যায়। ক্রেতারা সেই হ্রাসকৃত মূল্য বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের ওপর চাপিয়ে দেয়। শতকরা ০১ ভাগ আরএমজি ভর্তুকি ও রেমিট্যান্সে ২ শতাংশ প্রণোদনা মাল্টিপল এক্সচেঞ্জ রেটের ক্ষতিকারক দুর্বল সমাধানে না গিয়ে বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নে স্থানীয় মুদ্রায় বর্তমান গতির চেয়ে দ্রুততর অবমূল্যায়ন করা জরুরি। এতে ভোগের আমদানি (প্রায় ৩০ শতাংশ) কমতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, দ্রুত ও দৃঢ় পদক্ষেপে বস্ত্রশিল্পের প্রসার ঘটিয়ে (ব্যাপক সরকারি প্রণোদনার প্রয়োজন হবে) বছরে প্রায় ৬০০ কোটি মার্কিন ডলারের বস্ত্র আমদানি কমানো যাবে। লিড টাইম ৪২ দিন থেকে ২ দিনে হ্রাস পাবে। বাড়বে রুলস অব অরিজিন, যা বহির্বাণিজ্যে সুবিধা দেবে। রপ্তানি খাতে বহুমুখীকরণের বিরাট সুযোগ কাজে লাগানো যায়। বিশ্বমানে উন্নীত করে বিএসটিআইকে বিশ্বময় গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারলে পুনঃপরিদর্শনের সময় ও অর্থ অপচয় বাঁচানো যাবে। তা ছাড়া মানবসম্পদের সেবার মান যদি বিএসটিআই বিশ্বমানে করতে পারে, তাহলে রিক্রুটিং এজেন্টদের মধ্যে যারা দুর্বৃত্তায়িত মধ্যস্বত্বভোগী তাদের প্রতাপ কমানো যাবে। প্রামাণিত দক্ষতায় পাদুকা, ওষুধ, জাহাজ নির্মাণ, মোটরসাইকেল, প্লাস্টিক পণ্য, হিমায়িত কাঁচা মাছের বদলে রান্না করা আকর্ষণীয় মোড়কে মৎস্য ইত্যাকার ক্ষেত্রে উৎপাদন ও রপ্তানি বহুমুখীকরণ সম্ভব এবং উচিত। রপ্তানি পোশাকে উচ্চমূল্যের ডিজাইন ও বিক্রির বাজারে বহুমুখিতা আনতে হলে বেশ কিছু বিনিয়োগ করে নিজস্ব ডিজাইনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ দেশে যৌথ উদ্যোগে কয়েকটি দেশ মোটরযান বানাতে চায়; উপযুক্ত নীতি-কৌশলে এবং আমলাতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতা কমিয়ে এ ক্ষেত্রে বিপুল পদক্ষেপ সম্ভব।
উন্নয়ন মডেলের বিকল্প চিন্তা: শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান, আয়-রোজগার বৃদ্ধি, দারিদ্র্য নিরসন ও বৈষম্য হ্রাস : উন্নয়ন অগ্রযাত্রার মডেলকে শিল্পায়ন তথা কর্মসংস্থানমূলক অর্থাৎ আয়-রোজগার বৃদ্ধি আনয়নে দারিদ্র্য নিরসন ও বৈষম্য দূরীকরণের স্থির নিশ্চিত যাত্রা পথে এগোতে হবে। এ ক্ষেত্রে গত বছর মন্ত্রিসভায় পাস হওয়া অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পবিষয়ক নীতিমালা এবং বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সংজ্ঞায়িত কটেজ, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ব্যাপক বিস্তার ঘটানো সম্ভব এবং উচিত। যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানে এসব খাতে কর্মসংস্থান হয় মোট কর্মজীবীর দুই-তৃতীয়াংশ। তাই আমাদেরও এ ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান বর্তমানের ২৫ শতাংশ (এডিবি) বা ৩৫ শতাংশ (পরিকল্পনা কমিশন) ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে মূলধন কম লাগে, বিনিয়োগ থেকে উৎপাদনে যাওয়ার সময় লাগে অতি স্বল্প, ব্যবহৃত হয় দেশি কাঁচামাল, প্রযুক্তি জানা আছে, আমদানি নেই, উৎপাদিত পণ্যের দেশে-বিদেশে বাজার আছে বিপুলভাবে আত্মকর্ম ও মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থানÑএটিই বাংলাদেশের মোক্ষম সুযোগ। সম্ভবত মাঝারি ক্যাটাগরিকে বাদ দিয়ে সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা এনে, এসএমই ফাউন্ডেশন বা বিসিককে শক্তিমান করে সরকারের আকর্ষণীয় প্রণোদনা ও নিবিড় প্রশিক্ষণ ও সংগঠন ২০২১ সালে এর শুভসূচনা হতেই পারে। কোভিড-১৯-এর ক্ষয়ক্ষতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুঃসাহসী এক লাখ ছয় হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজে যে ২০ হাজার কোটি টাকার এসএমই অংশটি রয়েছে (আরও ২ হাজার ৭০০ কোটি নতুনভাবে ঘোষিত) তা কিন্তু তেমন ব্যবহার হচ্ছে না। আমূল সংস্কারে কাঠামোগত পরিবর্তন করে কুটির, অতি ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র শিল্প ইউনিটগুলোকে কার্যকরভাবে ব্যাংকিং সেবাদান জরুরি। এটা ছাড়া কোভিড-১৯-এ চাকরিচ্যুত ও বিদেশফেরতদের কর্মসংস্থান তথা আয়-রোজগার বৃদ্ধি করে আয়, সম্পদ ও সুযোগ বৈষম্য হ্রাস করা যাবে না।
মধ্যস্বত্বভোগীদের শক্তিতে রাষ্ট্রশক্তির রাশ টানা জরুরি : বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বহুবিধ অর্জনের ফসলকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ধান-চাল, পেঁয়াজ ও আলুতে উৎপাদন ও বিপণন সমবায় ব্যবস্থা চালু করে মধ্যস্বত্বভোগী দুষ্টচক্র মিলমালিক অসাধু খাদ্য কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের আকাশছোঁয়া মুনাফা কমাতে হবে, নইলে কিষান-কিষানি তার উৎপাদনে ন্যায্য মূল্য পাবে না আর ভোক্তাদের গুনতে হবে অতিরিক্ত দাম। অনুরূপভাবে ব্যাংক-বিমা খাতে বিশেষ করে ব্যক্তিখাতে যে সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে, তার ফলে আমানতে ব্যাংক সুদের হার মূল্যস্ফীতি হারের চেয়ে কম। শক্তিধর মধ্যস্বত্বভোগীরা আইনের ফাঁকফোকর বের করে রাষ্ট্রকে ঠকিয়ে বিদেশে মুদ্রা পাচার করছে আমদানিতে, অভারইনভয়েসিং এবং রপ্তানিতে আন্ডারইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে। এরা রাষ্ট্রযন্ত্রের উল্লেখযোগ্য অংশকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে কেনাকাটায় সাগর চুরি করছে। এসব বিষয়ে বিশ্বনন্দিত রাষ্ট্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে এনে যথাবিহিত করা না হলে রাষ্ট্র ও জাতিকে তার লক্ষ্যে পৌঁছানোর গন্তব্য অনেক দূরে চলে যাবে। রাষ্ট্রীয় সম্পদে সব কেনাকাটা ই-টেন্ডারিংয়ে করার নীতি কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হোক। প্রতিটি ক্ষেত্রে, তা রাস্তা নির্মাণ হোক কিংবা বালিশ ক্রয় কিংবা ওষুধ কেনা। বিশেষজ্ঞ পরামর্শে অভিহিত মূল্য নির্ধারণ করে টেন্ডার করা হলে যেসব ঠিকাদার বা সরবরাহকারী ওই মূল্যের বেশি দামে টেন্ডার দেবে, তা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বাদ পড়ে যাবে। যারা সময়মতো প্রকল্পের কাজ শেষ করবেন না, তাদের জরিমানার বিধানে সজাগ ও সচেতন করে দুর্নীতি, অপচয় ও দীর্ঘসূত্রতা কমালেই বিনিয়োগ তার সঠিক উৎপাদনশীলতা দিয়ে প্রবৃদ্ধিকে সমৃদ্ধতর করবে।
লেখক: সমাজকর্মী, শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

কল্যাণরাষ্ট্রে সোনার বাংলা

আপডেট সময় : ১১:১০:২৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৬ অগাস্ট ২০২১

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন : অর্ধশতাব্দী বয়সে বাংলাদেশের অর্থনীতি শূন্যের কোঠা থেকে (মাথাপিছু আয় ৮৫ মার্কিন ডলার, বিশ্বব্যাংক, ১৯৭২) এখন ১ হাজার ৯৮৭ মার্কিন ডলার (আইএমএফ)। সামাজিক রূপান্তরের সাক্ষী হিসেবে গড় আয়ু ৭৩ বছর, শিশুমৃত্যুর হার লাখে ৩০-এর কম, বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৩ শতাংশ (১৯৭২ সালে ৩.৩ শতাংশ), প্রাথমিকে ভর্তির হার ৯০ শতাংশের বেশি, ঝরে পড়ার হার ২৫-২৬ শতাংশ এবং নি¤œগামী। নারীর সার্বিক প্রজনন ক্ষমতা ১৯৭২ সালে ছিল ৫.২; এখন তা ২.২। বিদ্যুৎ এখন ৯৫ শতাংশ মানুষের ঘরে। সুপেয় পানির প্রাপ্যতা ৭০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। পরিবারের আকার ৬.২ থেকে ৪.২-এ নেমেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে ১৯৭২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছিলেন ৩০ হাজার, এখন ৩৮ লাখ। শিক্ষার হার ৬৫ শতাংশ, কিন্তু এর মান সম্পর্কে দেশে-বিদেশে জিজ্ঞাসার অন্ত নেই। ২০০৮ সালে শুরু করা ডিজিটাল বাংলাদেশ সুফল দিচ্ছে, ফলে কোভিড-১৯-এর লন্ডভন্ড পাঠদান বিষয়ে অনলাইন ব্যবস্থা ক্রমপ্রসারমাণ।
স্বাধীনতার স্বদেশ আগমন : ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ স্বাধীনতা অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমান বীরের বেশে জাতির পিতা হিসেবে স্বদেশে আসেন। দ্রুতগতিতে সাংবিধানিক পরিবর্তন এনে সরকারপ্রধান, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন তিনি। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হতোদ্যম বাংলাদেশে তখন প্রতিটি ক্ষেত্রে সমস্যার পাহাড় আর ৩০ লাখ নারী-পুরুষের শাহাদাত এবং ৩ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির আহাজারি। গুদামে খাদ্য নেই, কিষান-কিষানিরা স্বাধীনতাযুদ্ধে, তাই মাঠে ফসল নেই। ব্যাংক-বিমা, কলকারখানা, সদাগরি অফিস বন্ধ; কারণ (পশ্চিম) পাকিস্তানিরা এসবের মালিক ছিলেন; তারা পালিয়ে গেছেন নিজ দেশে। রেল, সেতু, রাস্তাঘাট, কালভার্ট, বন্দর, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ধ্বংসপ্রাপ্ত অথবা প্রাণসংহারী মাইনে ভরা। এদিকে পরাজিত শত্রু ও তাদের এদেশীয় অনুচর গোলাম আযম, জুলমত আলী খান, আব্দুল জব্বার খদ্দর, মৌলানা আব্দুল মান্নান, মৌলানা আতাহার আলী এমনকি একদা প্রগতিশীল মাহমুদ আলীরা প্রচারে নামলেন যে ইসলামি জমহুরি পাকিস্তান (মধ্যপ্রাচ্যের সখা) ভেঙে শেখ মুজিব একটি ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দু প্রভাবিত বাংলাদেশ বানিয়েছেন, যেটি ভারতের করদ রাজ্য ছাড়া আর কিছু নয়। শুধু গণচীন বা পাকিস্তান নয়, ইরাক ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের সব স্বৈরতান্ত্রিক রাজতন্ত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানাল। ১৯৭২ সালে জাতিসংঘে প্রবেশে গণচীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভেটো প্রয়োগ করল। হেনরি কিসিঞ্জার তো বটেই, নরওয়ের হিউস্ট ফ্যালান্ড এবং ইংল্যান্ডের অর্থনীতিবিদ জন হেন্ডারসন ফতোয়া দিলেন, ভৌগোলিক দিক থেকে টিকে গেলেও একটি সচল অর্থনীতি হিসেবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এত তমসাচ্ছন্ন যে এর বেঁচে থাকা অর্থনীতির পাঠ্যপুস্তকে ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে জায়গা করে নেবে। এসব প্রতিকূলতার মধ্যে জাতির পিতার প্রত্যাবর্তন সমগ্র জাতিকে উচ্চতম আলোর ঝলকানিতে উদ্বুদ্ধ করে।
দৃঢ় পদক্ষেপের সূচনা : বঙ্গবন্ধুর সরকার একে একে প্রায় যুগপৎভাবে অনেকগুলো কাজ শুরু করে। সংবিধান রচিত হয় নয় মাসে। ধর্মীয় ব্যবসা বন্ধের রাজনীতি আসে, তবে ইসলামিক ফাউন্ডেশন স্থাপিত হয়; বন্ধ হয় মদ, জুয়া, জিমখানা। সংকট মোকাবিলায় বঙ্গবন্ধু প্রথম দিকে গণখাতের (পাবলিক সেক্টর) ওপর নির্ভর করেন, তবে ব্যক্তিগত বাজার অর্থনীতির গতিময় দক্ষতার রাস্তাও খোলা রাখেন। স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের ঢাকা অফিসে রক্ষিত ১৮ মার্কিন ডলারের স্থিতি আয় আর কানাডা ও সুইডেনের নগদে বৈদেশিক অনুদানে শুরু হয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৩ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলারের সম্মানজনক স্থিতিতে উঠেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধকালে পলায়নপর পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞে সামষ্টিক অর্থনীতির পরিধি ১৯৭০-৭১ সালে আগের অর্থবছরের তুলনায় ৩৫ শতাংশ সংকুচিত হয়ে ৯০০ কোটি মার্কিন ডলারে ধসে যায় (এখন বাংলাদেশের সামষ্টিক আয়, জিডিপি ৩০ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার)। ‘সবার সাথে সখ্য কারও সাথে বৈরী নই’ নীতিতে যাত্রা শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির। তারই পরিম-লে সার্বভৌম স্বাধীনতা ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে বৃহৎ ও মহৎ প্রতিবেশী ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনসহ (১৫ মার্চ ১৯৭২) অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সহযোগিতা স্থাপিত হয়। ১৯৭৩ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের মর্যাদাপূর্ণ যোগদান এবং তার আগে পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি জাতিসংঘ এবং অন্য সব বিশ্ব সংস্থায় যোগদানের পথ উন্মুক্ত করে।
ভবিষ্যতের সু-আভাস : অত্যুক্তির নিন্দার ভয় ছাড়াই একমত হওয়া যাবে যে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্য: সিংহভাগ তরুণই ২০১৯ সালে অর্থনীতির পরিস্থিতিতে (৮০ শতাংশ) এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে (৫৩.৭ শতাংশ) সন্তুষ্ট (১২ পৌষ ২৭ ডিসেম্বর), যা ক্রমর্বর্ধমান। তবে নিরাপত্তা নিয়ে সবাই চিন্তিত। প্রতি পাঁচ তরুণের চারজনই জীবনের লক্ষ্য নিয়ে চিন্তিত। মনে রাখা প্রয়োজন যে ২০১৯ সালের প্রাক্কলন ছাড়িয়ে বাংলাদেশের সামষ্টিক আয় জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮.১৫ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে বলা হয়েছে যে ২০২৪ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্ক অর্থাৎ ১০ শতাংশে উন্নীত হবে। বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে আসা রেমিট্যান্স বহির্গামী রেমিট্যান্সের চেয়ে বেশি বলে মাথাপিছু জিএনআই মাথাপিছু জিডিপির চেয়ে বেশি হয়। ২০২৪ সালে মাথাপিছু জিএনআই ২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার হওয়ারই কথা, আর বার্ষিক নিট প্রবৃদ্ধি (বার্ষিক জিএনআই প্রবৃদ্ধি থেকে বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বাদ দিলে) ৯ শতাংশ হবে। একটি অব্যর্থ লগারিদমিক ফর্মুলা অনুসারে এই পরিস্থিতিতে মাথাপিছু আয় প্রতি ৭.৫ বছরে দ্বিগুণ হবে অর্থাৎ ২০৩১ সালের জুনে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিএনআই ৫ হাজার মার্কিন ডলার এবং ২০৩৯ সালে ১০ হাজার মার্কিন ডলারে উন্নীত হবে। সুতরাং ২০৪১ সালে পৃথিবীতে ২৩তম বৃহত্তম অর্থনীতি বাংলাদেশ একটি উন্নত সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক কল্যাণরাষ্ট্রে রূপান্তরিত হবে বলে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ অর্জনযোগ্য বটে।
কতিপয় সতর্কবার্তা : বাংলাদেশ সম্পর্কে যে আশাবাদ গত ১২ বছরে বিশেষ করে অর্থনীতি ক্ষেত্রে প্রবহমান, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণকাজ সমাপ্তির কাছাকাছি এসে দেশটি বিশেষ করে এর সরকারপ্রধান জনবন্ধু শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতম হয়ে উদ্ভাসিত। অন্যান্য বিশাল অবকাঠামো প্রকল্প মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল এবং পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন, টেকসই উন্নয়নের সোনার বাংলার স্বপ্ন রূপায়ণে বৃহৎ বৃহৎ পদক্ষেপ। কোভিড-১৯ ব্যবস্থাপনায় বিশ্বের সবচেয়ে সফল ২০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। আইএমএফ বলছে, সামষ্টিক অর্থনীতির বার্ষিক প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশে ৪.৪ শতাংশ, যেখানে ১৯টি বাদে সব দেশেরই নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের হিসাব বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার বাংলাদেশে হবে ৬.৮ শতাংশ। প্রশ্ন অবশ্যই থাকছে, যদি (ক) জুলাই-ডিসেম্বর ষাণ¥াসিকে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হয় ৩২ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা, লক্ষ্যমাত্রার ২৩ শতাংশ কম হয় (খ) ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ স্থবির হয়ে থাকে এবং (গ) মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমাদানি হ্রাস পায়, তাহলে বিনিয়োগ: জিডিপি বাড়বে কীভাবে ও কোথা থেকে। আর যদি খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের সুযোগ-সুবিধা বাড়তেই থাকে, কর ফাঁকিবাজদের দাপট উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায় (সাদা আয়ের করের হার যদি কালোটাকার সুদহারের চেয়ে বেশি হয়) এবং যদি মানি লন্ডারিং শনাক্তকরণ ও যথাবিহিত বিচারের অধীনে না আনা হয়, তাহলেও অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি অব্যাহতভাব ক্রমবর্ধমানে বাড়বে কীভাবে, তা বোধগম্য হচ্ছে না।
শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল সংস্কার জরুরি : সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থায় একটি আপাতদৃষ্টে অজনপ্রিয় হলেও আমূল সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উন্নত দেশের মতো অঞ্চল বা এলাকাভিত্তিক ভর্তি করা, স্কুল ইউনিফর্ম চালু করা, ব্যক্তিগত যানবাহন নয় বরং প্রয়োজন হলে স্কুল-কলেজের বাসে যাতায়াত, খেলাধুলা ও সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ, বেতন-ভাতা সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদা বৃদ্ধি করে শিক্ষকম-লীকে টিউশন থেকে ক্লাসমুখী করা, নোটবই, গাইড ও কোচিং সেন্টারের দৃঢ়হস্ত নিয়ন্ত্রণ তথা কালক্রমে বন্ধ করা না হলে দেশের দৃষ্টিনন্দন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং হৃদয় উষ্ণ করা সামাজিক অগ্রযাত্রা ধরে রাখা এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব না-ও হতে পারে। ভারতে আগামী বছর থেকে এসএসসি পরীক্ষা বোর্ড পর্যায়ে আর হবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আমাদের পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষা অভিভাবককে বিষাদময় করে তোলে; কোভিড-১৯-এর কারণে এটা এখন স্থগিত বা বাতিল করা যেতে পারে এবং ছাত্রছাত্রীদের তোতাপাখির মুখস্থবিদ্যার দিকে নিয়ে যাচ্ছে কি না, সে বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ নিরীক্ষা করানো প্রয়োজন। মাধ্যমিকে বৃত্তিমূলক এবং উচ্চশিক্ষায় প্রযুক্তি শিক্ষা বিষয়ে সদাশয় সরকারের যে সিদ্ধান্ত রয়েছে, তা কৃতসংকল্পতার সঙ্গে পিপিপি সহযোগে বাস্তবায়ন করা সমীচীন হবে। লেখাপড়াকে ব্যবহারিক প্রায়োগিক করতেই হবে এবং সে জন্য চাকরিদানকারী করপোরেট ও শিক্ষাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে নিবিড় যোগাযোগ ও মতবিনিময় করে পাঠ্যক্রম তৈরি করতে হবে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানে পালাক্রমে তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক হাতে-কলমে শিক্ষা গ্রহণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আদলে কো-অপারেটিভ শিক্ষার প্রচলন করা সঠিক হবে। শীতকালে উচ্চশিক্ষার বিদার্থীদের এক সেমিস্টারের জন্য পল্লিবাংলার কিষান-কিষানির তত্ত্বাবধানে পাঠানোর কথা ভাবা যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইনকিউবেটর স্থাপন করে একদিকে প্রকল্প প্রণয়নে প্রশিক্ষণ ও অন্যদিকে উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে হাতে-কলমে শিক্ষার ব্যবস্থা এখন সময়ের দাবি।
দুর্নীতি দমন ও নানাবিধ সংস্কার : দুর্নীতি ও দীর্ঘসূত্রতা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অনেককেই নিরুৎসাহিত করছে। আমরাও গভীরভাবে উৎকণ্ঠিত। বাংলাদেশ ২০১৭ সালে মাথাপিছু আয়ে পাকিস্তানকে টপকে গেছে। ২০২৯ সালে ভারতকেও স্থায়ীভাবে টপকে যেতে পারে বলে ব্লুমবার্গ, এইচএসবিসিসহ একাধিক পূর্বাভাস রয়েছে। তবে সম্প্রতি রপ্তানি আয়ে ধীরগতি চলছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থযুদ্ধের ফলে চৈনিক বহু কোম্পানি বাংলাদেশে স্থানান্তরের পরিবর্তে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানে চলে যাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারে অনমনীয়তা সৃষ্ট টাকার অতি মূল্যায়ন (যা বৈদেশিক মুদ্রায় রপ্তানি পণ্যের দাম অবমূল্যায়নকারী দেশের তুলনায় বাড়িয়ে দেয়) রপ্তানিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তৈরি পোশাকে এর প্রভাব বিশাল; যখনই ভিয়েতনাম তার মুদ্রার অবমূল্যায়ন করে তখনই বৈদেশিক মুদ্রায় ওই দেশের তৈরি পোশাকের মূল্য কমে যায়। ক্রেতারা সেই হ্রাসকৃত মূল্য বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের ওপর চাপিয়ে দেয়। শতকরা ০১ ভাগ আরএমজি ভর্তুকি ও রেমিট্যান্সে ২ শতাংশ প্রণোদনা মাল্টিপল এক্সচেঞ্জ রেটের ক্ষতিকারক দুর্বল সমাধানে না গিয়ে বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নে স্থানীয় মুদ্রায় বর্তমান গতির চেয়ে দ্রুততর অবমূল্যায়ন করা জরুরি। এতে ভোগের আমদানি (প্রায় ৩০ শতাংশ) কমতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, দ্রুত ও দৃঢ় পদক্ষেপে বস্ত্রশিল্পের প্রসার ঘটিয়ে (ব্যাপক সরকারি প্রণোদনার প্রয়োজন হবে) বছরে প্রায় ৬০০ কোটি মার্কিন ডলারের বস্ত্র আমদানি কমানো যাবে। লিড টাইম ৪২ দিন থেকে ২ দিনে হ্রাস পাবে। বাড়বে রুলস অব অরিজিন, যা বহির্বাণিজ্যে সুবিধা দেবে। রপ্তানি খাতে বহুমুখীকরণের বিরাট সুযোগ কাজে লাগানো যায়। বিশ্বমানে উন্নীত করে বিএসটিআইকে বিশ্বময় গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারলে পুনঃপরিদর্শনের সময় ও অর্থ অপচয় বাঁচানো যাবে। তা ছাড়া মানবসম্পদের সেবার মান যদি বিএসটিআই বিশ্বমানে করতে পারে, তাহলে রিক্রুটিং এজেন্টদের মধ্যে যারা দুর্বৃত্তায়িত মধ্যস্বত্বভোগী তাদের প্রতাপ কমানো যাবে। প্রামাণিত দক্ষতায় পাদুকা, ওষুধ, জাহাজ নির্মাণ, মোটরসাইকেল, প্লাস্টিক পণ্য, হিমায়িত কাঁচা মাছের বদলে রান্না করা আকর্ষণীয় মোড়কে মৎস্য ইত্যাকার ক্ষেত্রে উৎপাদন ও রপ্তানি বহুমুখীকরণ সম্ভব এবং উচিত। রপ্তানি পোশাকে উচ্চমূল্যের ডিজাইন ও বিক্রির বাজারে বহুমুখিতা আনতে হলে বেশ কিছু বিনিয়োগ করে নিজস্ব ডিজাইনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ দেশে যৌথ উদ্যোগে কয়েকটি দেশ মোটরযান বানাতে চায়; উপযুক্ত নীতি-কৌশলে এবং আমলাতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতা কমিয়ে এ ক্ষেত্রে বিপুল পদক্ষেপ সম্ভব।
উন্নয়ন মডেলের বিকল্প চিন্তা: শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান, আয়-রোজগার বৃদ্ধি, দারিদ্র্য নিরসন ও বৈষম্য হ্রাস : উন্নয়ন অগ্রযাত্রার মডেলকে শিল্পায়ন তথা কর্মসংস্থানমূলক অর্থাৎ আয়-রোজগার বৃদ্ধি আনয়নে দারিদ্র্য নিরসন ও বৈষম্য দূরীকরণের স্থির নিশ্চিত যাত্রা পথে এগোতে হবে। এ ক্ষেত্রে গত বছর মন্ত্রিসভায় পাস হওয়া অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পবিষয়ক নীতিমালা এবং বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সংজ্ঞায়িত কটেজ, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ব্যাপক বিস্তার ঘটানো সম্ভব এবং উচিত। যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানে এসব খাতে কর্মসংস্থান হয় মোট কর্মজীবীর দুই-তৃতীয়াংশ। তাই আমাদেরও এ ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান বর্তমানের ২৫ শতাংশ (এডিবি) বা ৩৫ শতাংশ (পরিকল্পনা কমিশন) ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে মূলধন কম লাগে, বিনিয়োগ থেকে উৎপাদনে যাওয়ার সময় লাগে অতি স্বল্প, ব্যবহৃত হয় দেশি কাঁচামাল, প্রযুক্তি জানা আছে, আমদানি নেই, উৎপাদিত পণ্যের দেশে-বিদেশে বাজার আছে বিপুলভাবে আত্মকর্ম ও মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থানÑএটিই বাংলাদেশের মোক্ষম সুযোগ। সম্ভবত মাঝারি ক্যাটাগরিকে বাদ দিয়ে সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা এনে, এসএমই ফাউন্ডেশন বা বিসিককে শক্তিমান করে সরকারের আকর্ষণীয় প্রণোদনা ও নিবিড় প্রশিক্ষণ ও সংগঠন ২০২১ সালে এর শুভসূচনা হতেই পারে। কোভিড-১৯-এর ক্ষয়ক্ষতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুঃসাহসী এক লাখ ছয় হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজে যে ২০ হাজার কোটি টাকার এসএমই অংশটি রয়েছে (আরও ২ হাজার ৭০০ কোটি নতুনভাবে ঘোষিত) তা কিন্তু তেমন ব্যবহার হচ্ছে না। আমূল সংস্কারে কাঠামোগত পরিবর্তন করে কুটির, অতি ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র শিল্প ইউনিটগুলোকে কার্যকরভাবে ব্যাংকিং সেবাদান জরুরি। এটা ছাড়া কোভিড-১৯-এ চাকরিচ্যুত ও বিদেশফেরতদের কর্মসংস্থান তথা আয়-রোজগার বৃদ্ধি করে আয়, সম্পদ ও সুযোগ বৈষম্য হ্রাস করা যাবে না।
মধ্যস্বত্বভোগীদের শক্তিতে রাষ্ট্রশক্তির রাশ টানা জরুরি : বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বহুবিধ অর্জনের ফসলকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ধান-চাল, পেঁয়াজ ও আলুতে উৎপাদন ও বিপণন সমবায় ব্যবস্থা চালু করে মধ্যস্বত্বভোগী দুষ্টচক্র মিলমালিক অসাধু খাদ্য কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের আকাশছোঁয়া মুনাফা কমাতে হবে, নইলে কিষান-কিষানি তার উৎপাদনে ন্যায্য মূল্য পাবে না আর ভোক্তাদের গুনতে হবে অতিরিক্ত দাম। অনুরূপভাবে ব্যাংক-বিমা খাতে বিশেষ করে ব্যক্তিখাতে যে সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে, তার ফলে আমানতে ব্যাংক সুদের হার মূল্যস্ফীতি হারের চেয়ে কম। শক্তিধর মধ্যস্বত্বভোগীরা আইনের ফাঁকফোকর বের করে রাষ্ট্রকে ঠকিয়ে বিদেশে মুদ্রা পাচার করছে আমদানিতে, অভারইনভয়েসিং এবং রপ্তানিতে আন্ডারইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে। এরা রাষ্ট্রযন্ত্রের উল্লেখযোগ্য অংশকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে কেনাকাটায় সাগর চুরি করছে। এসব বিষয়ে বিশ্বনন্দিত রাষ্ট্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে এনে যথাবিহিত করা না হলে রাষ্ট্র ও জাতিকে তার লক্ষ্যে পৌঁছানোর গন্তব্য অনেক দূরে চলে যাবে। রাষ্ট্রীয় সম্পদে সব কেনাকাটা ই-টেন্ডারিংয়ে করার নীতি কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হোক। প্রতিটি ক্ষেত্রে, তা রাস্তা নির্মাণ হোক কিংবা বালিশ ক্রয় কিংবা ওষুধ কেনা। বিশেষজ্ঞ পরামর্শে অভিহিত মূল্য নির্ধারণ করে টেন্ডার করা হলে যেসব ঠিকাদার বা সরবরাহকারী ওই মূল্যের বেশি দামে টেন্ডার দেবে, তা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বাদ পড়ে যাবে। যারা সময়মতো প্রকল্পের কাজ শেষ করবেন না, তাদের জরিমানার বিধানে সজাগ ও সচেতন করে দুর্নীতি, অপচয় ও দীর্ঘসূত্রতা কমালেই বিনিয়োগ তার সঠিক উৎপাদনশীলতা দিয়ে প্রবৃদ্ধিকে সমৃদ্ধতর করবে।
লেখক: সমাজকর্মী, শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর