ড. মো. রবিউল ইসলাম :‘লন্ডন স্কুল অব কলেজ’ অথবা ‘ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডন’ বা ‘ইম্পেরিয়াল কলেজ’ অথবা ‘কিংস কলেজ’- এগুলো তো নামে স্কুল ও কলেজ। কিন্তু শিক্ষায়, গবেষণা এগুলোর বিশ্ববিখ্যাত হতে বাধেনি। এরা পৃথিবীর তাবৎ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কান কেটেছে গুণগত শিক্ষা ব্যবস্থা চলমান রেখে। অথচ এ দেশে সবাই চায় নামকাওয়াস্তে এক একটা ‘হাঁটুভাঙা বিশ্ববিদ্যালয়’ (কৌতুক প্রসূত) চাই! এটা চায়, ওটা চায়, এই ধারাবাহিকতায় রাজধানীর কলেজগুলো বিশ্ববিদ্যালয় হতে চায়।
অনশন, সড়ক অবরোধ, সোশ্যাল মিডিয়ায় কন্ট্রোল, এসবের মাধ্যমে চলছে দাবি আদায়ের প্রতিযোগিতা। ন্যায্য হোক আর অন্যায্য! দাবি আদায় করতে হবে জোর করে হলেও! যেহেতু এই সরকার রাজনৈতিক সরকারের মতো জনদাবি বা জনরোষ নির্মূল করতে পেশিশক্তির মহড়া প্রদর্শন করছে না। তাই দলে দলে দাবির জনস্রোতে বাংলাদেশ আজ অনেকটাই প্লাবিত। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে যে ধরনের দাবির মহড়া চলছে তা শুধু অযৌক্তিক না; বরং সাংঘাতিক ক্ষতিকর এ দেশের উচ্চশিক্ষার জন্য। দেশ যখন তার সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার মান নিয়ে অস্বস্তিতে, তখন আবার মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো এসে দাঁড়িয়েছে সাত কলেজের বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি।
এর মধ্যে তিতুমীর কলেজ আবার সবার থেকে পৃথক হয়ে তীব্র আন্দোলনে রত। বিশ্ববিদ্যালয় হতে মরিয়া এই কলেজের শিক্ষার্থীরা। এমন একটা পরিস্থিতি যেন বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারলে বদলে যাবে ভাগ্যের চাকা। অথচ, এ দেশে নামসর্বস্ব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাষ্ট্রের উপকারে না এসে বরং গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষা হতে উচ্চশিক্ষা, যাবতীয় ক্ষেত্রকে তামাশায় রূপান্তর করেছে বিগত সরকার।
স্বেচ্ছাচারিতার চূড়ান্তে অবস্থান করেছে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাপনায়। দেশের শিক্ষাবিদ, গবেষকদের চিন্তাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, কোনো স্টাডি ছাড়াই শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় পাবলিক ইউনিভার্সিটি তৈরি করা হয়েছে জেলায় জেলায়। দলীয় নেতাকর্মীদের উদরপূর্তির এমন আয়োজন ছিল উৎকট ও বিভীষিকাময়। সরকারপ্রধান পরিবারের সদস্যদের নামে অযাচিতভাবে রাষ্ট্রীয় অর্থ খরচ করে এমন সব বিশ্ববিদ্যালয় বানিয়েছে, যেখানে প্রতিষ্ঠানগুলোতে দশজন অধ্যাপকও নেই। নেই ন্যূনতম গবেষণার ব্যবস্থা। অথচ নিয়োগ বাণিজ্য আর ভবনের টেন্ডারবাজি করে স্থানীয় নেতাদের পকেট ভরা হয়েছে দেদার।
এই হরিলুটগুলো ছিল দেশের নিত্য নিয়তি। এমন অযাচিত আয়োজনের পক্ষে বিগত সরকারের একমাত্র সাফাই ছিল যে তারা তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে নাকি লিখেছিল প্রতি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করবে। বিশ্ববিদ্যালয় যে সংখ্যার বিষয় নয়, বরং মানসম্মত শিক্ষার ক্ষেত্র, তা শাসকশ্রেণি কখনও বোঝার চেষ্টা করেনি। এভাবেই দেশের মানুষদের মেনে নিতে হয়েছে অসংখ্য অপশাসন। তবে, শিক্ষা ক্ষেত্রে এই ক্ষতি সুদূরপ্রসারী। যার চরম মূল্য দিতে হবে দেশের মানুষকে কয়েক প্রজন্ম ধরে।
দেশে অসংখ্য শিক্ষিত বেকার রয়েছে। রাষ্ট্র যেখানে এদের কর্মসংস্থান করতে পারে না, সেখানে বিভিন্ন নন-টেকনিক্যাল বিষয়ে পড়ে; রাষ্ট্র এই বিপুল সংখ্যক সার্টিফিকেটধারীদের নিয়ে কী করবে, তার কোনো পরিকল্পনা না থাকলেও, ব্যাঙের ছাতার মতো বিশ্ববিদ্যালয় বানিয়ে এক বড় জনগোষ্ঠীকে জনবোঝায় রূপান্তরিত করেছে। এই ধারাবাহিকতায় এবার যোগ দিয়েছে ঢাকার সাত কলেজ, বিশেষ করে তিতুমীর কলেজ। এই কলেজগুলো মানসম্মত উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়েছে অনেকাংশেই। তাদের নিয়ন্ত্রণকারী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় দুর্নীতি আর অনিয়মের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। বিসিএস দিয়ে আসা শিক্ষকরাও এখানে এসে নিজেদের অধিকতর উচ্চশিক্ষায় ও গবেষণায় নিযুক্ত করতে অনীহা দেখায়। এর অন্যতম কারণ পদোন্নতিতে সময়কালের কঠিন শর্ত।
মূলত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ না পাওয়া শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই রাজ্যের হতাশা নিয়ে এসব কলেজে ভর্তি হয়। তবে এখানেও অনেক মেধাবীরা অধ্যয়ন করে, নিঃসন্দেহে। কিন্তু যথেষ্ট শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ না থাকায়, এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা শিক্ষাজীবন শেষ করে পেশা নির্বাচনকালে তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ে। অথচ রাষ্ট্র ইচ্ছা করলেই এই কলেজগুলোকে মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে পারতো। যথেষ্ট বাজেট, উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ আর গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারতো। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এসব কলেজকে স্বায়ত্তশাসন দিয়ে এগুলোর মানবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারতো। এমন ব্যবস্থার আইনি কাঠামো বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন আদেশ, ১৯৭৩-এর ধারা ৫(১)(জ)তেই রাখা আছে।
কিন্তু এমন ব্যবস্থার বাস্তবায়ন না ঘটিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো অদ্ভুত একটা প্রতিষ্ঠানকে কলেজগুলোর তদারকি করতে দিয়ে এক অদক্ষ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে দিনের পর দিন। পাশের দেশ ভারতে কলেজগুলোর মান বাড়ানো হয়েছে একই উপায়ে। তাদের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ২০২৩ সালের এপ্রিলে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কলেজগুলোকে স্বায়ত্তশাসন দিয়ে কলেজগুলোর মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থার বিকাশ ঘটিয়েছে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের পাশাপাশি ভারতের কলেজগুলো বা ইনস্টিটিউটগুলোতে পিএইচডি’র ব্যবস্থা রয়েছে। তারা সেগুলো মানসম্মতভাবে করার চেষ্টা করছে। অথচ আমাদের এখানে অবস্থা উল্টো। রাজনৈতিক বিবেচনায় নতজানু ও অদক্ষ ব্যক্তিদের দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও তার রেগুলেটরি বডিগুলোকে চালানো হয়, যারা শুধু ক্ষমতাসীন সরকারের ইচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটাতে থাকে ব্যস্ত।
নেই কোনো সুদূরপ্রসারী টেকসই পরিকল্পনা।
দেশপ্রেম না থাকলে আপনি সব ক্ষেত্রকেই নষ্ট করবেন। দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিক আর আমলানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থায় কোনো সুফল আসবে না। কলেজগুলো অযৌক্তিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় হতে চাইবে। অথচ যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই তাদের মান ধরে রাখতে পারেনি।
লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়