নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশে করোনার অ্যান্টিবডি পরীক্ষা চালু করতে বারবার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ মেনে পরীক্ষা চালু করার ঘোষণাও দিয়েছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। এরপর সরকার সরকারি ও বেসরকারিভাবে অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করার নির্দেশিকায়ও অনুমোদন দেয়। তারপরও দেশে করোনার অ্যান্টিবডি পরীক্ষা চালু হয়নি। কিন্তু কেন হয়নি সেই প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, ‘এটা মন্ত্রণালয়ের বিষয়’।
প্রসঙ্গত, মহামারির শুরু থেকেই বিশেষজ্ঞরা করোনা শনাক্তসহ মহামারি নিয়ন্ত্রণে পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নিতে আরটি-পিসিআরসহ অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি টেস্ট শুরু করার ওপর গুরুত্বারোপ করে এসেছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা চালু করার ঘোষণা দেয় সরকার। এরপর গত ২৪ জানুয়ারি সচিবালয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানান, ‘অনেক দিনের দাবি ছিল অ্যান্টিবডি টেস্টের। আজ আপনাদের যখন বললাম তখন থেকেই এটা চালু হয়ে গেলো’।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এ ঘোষণার পর গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সরকারি হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা যাচাইয়ের জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতর ও ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরকে চিঠি দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এরপর গত ১১ মার্চ সরকারি ও বেসরকারিভাবে অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করার নির্দেশিকাও অনুমোদন করা হয়। এরপর এখন পর্যন্ত চালু হয়নি অ্যান্টিবডি টেস্ট।
অ্যান্টিবডি টেস্ট কি আদৌ হবে? প্রসঙ্গত, দেশে এখন কেবল গবেষণা কাজের জন্য অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, আইইডিসিআরের সঙ্গে যৌথভাবে আইসিডিডিআর,বি-সহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। তবে সেটা পুরোটাই গবেষণা কাজের জন্য। ব্যক্তিপর্যায়ে অ্যান্টিবডি পরীক্ষা এখনও হচ্ছে না। কারও শরীরে নির্দিষ্ট কোনও রোগের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (অ্যান্টিবডি) তৈরি হয়েছে কিনা সেটা স্বল্প সময়ে দেখা যায় এই টেস্টের মাধ্যমে। এ কারণে শুরু থেকেই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা অ্যান্টিবডি টেস্টের ওপর গুরুত্বারোপ করে আসছিলেন।
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটিসহ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা একাধিকবার বলেছিলেন, করোনার টিকা দেওয়ার আগে অ্যান্টিবডি টেস্ট চালু করা দরকার। এতে যাদের শরীরে আগেই অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে তাদের বাদ দিয়ে বাকিদের টিকা দেওয়া যেতো। টিকার অপচয় হতো না। শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে এমন মানুষের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। করোনা থেকে যারা সুস্থ হয়েছেন বা করোনার টিকা নিয়েছেন, তাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কিনা, তা পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায়। অ্যান্টিবডি পরীক্ষায় নমুনা হিসেবে ব্যবহৃত হয় রক্ত। এতে সময় লাগে ১০ থেকে ৩০ মিনিট। দেশে বর্তমানে সীমিত পরিসরে শুধু গবেষণার কাজে অ্যান্টিবডি পরীক্ষা হচ্ছে।
গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি তাদের সভায় অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি টেস্টের ওপর গুরুত্বারোপ করে। কমিটি মনে করে, তিন পদ্ধতিতে (পিসিআর, অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি টেস্ট) কোভিড-১৯ পরীক্ষা কার্যক্রম পাশাপাশি থাকলে তা মহামারি মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
অ্যান্টিবডি টেস্টকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং অবশ্যই এখন সময়ের দাবি উল্লেখ করে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরকে জিজ্ঞেস করা উচিত অ্যান্টিবডি টেস্ট তারা সাধারণ মানুষের জন্য কবে চালু করবে? বর্তমান সময়ে অ্যান্টিবডি টেস্ট অবশ্যই করা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন এই কমিটির আরেক সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, দেশে টিকা দেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে অনেক মানুষ সাব-ক্লিনিক্যালি (উপসর্গহীন থেকেও আক্রান্ত) করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তারা সুস্থও হয়ে উঠেছেন, অথচ সেই সংখ্যাটা কত আমরা জানিই না। তাহলে আমরা কী করে বুঝবো কত মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে সেরে উঠেছেন?
‘এই মানুষগুলোর যদি অ্যান্টিবডি টেস্ট হয় তাহলে বোঝা যাবে মোট জনসংখ্যার কত শতাংশ ইতোমধ্যে করোনার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি গ্রো করেছে’—বলেন তিনি। অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, টিকা দেওয়ার কারণে মানুষের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে। আবার যারা আক্রান্ত হয়েছেন কিন্তু উপসর্গ না থাকায় জানেন না, তাদের শরীরেও অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে। মোট এই হিসাব পাওয়ার পর মহামারির এই সময়ে পরিকল্পনা করতে সুবিধা হবে।
আমাদের হার্ড ইমিউনিটি হতে আর কত ইমিউনিটি দরকার হবে, কত মানুষের, কত পেশার কত মানুষের ইমিউনিটির দরকার হবে, সেটা হিসাব করা যাবে উল্লেখ করে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, যদি ৬০ শতাংশ মানুষের অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে যায় তাহলে আরও ২০ থেকে ২৫ শতাংশ মানুষের অ্যান্টিবডি তৈরি করতে হবে। কিন্তু এখনও যদি কিছুই না জানি, তাহলে আমরা কোথায় আছি-সেটাই তো বোঝা যাবে না। সরকারের উচিত এখন ব্যক্তিপর্যায়ে অ্যান্টিবডি পরীক্ষার অনুমোদন দেওয়া।
করোনা পরীক্ষা সম্প্রসারণ নীতিমালা কমিটির প্রধান ছিলেন চিকিৎসাবিজ্ঞানী অধ্যাপক লিয়াকত আলী। তিনি বলেন, দেশে এখন চার ধরনের টিকা দেওয়া হচ্ছে। কোন টিকাতে অ্যান্টিবডি কতদিন থাকছে, সেটা দেখা দরকার জানিয়ে অধ্যাপক লিয়াকত আলী বলেন, সেই সঙ্গে টিকা নেওয়ার পরও কতজন আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের মধ্যে কতজন সিভিয়ার পর্যায়ে যাচ্ছেন, সেটাও দেখার প্রয়োজন রয়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ঘোষণা ও সরকারের নির্দেশিকার পরেও কেন অ্যান্টিবডি পরীক্ষা চালু করা হচ্ছে না জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. ফরিদ হোসেন মিঞা বলেন, অ্যান্টিবডি পরীক্ষার জন্য ব্যক্তিকেন্দ্রিক অর্থাৎ সেলফ ডায়াগনোসিস করার জন্য কাউকে অনুমতি দেওয়া হয়নি।
কেন দেওয়া হচ্ছে না প্রশ্নে বলেন, ‘এটা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা।’
গত ১১ মার্চ সরকারি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে জানালে তিনি বলেন, ‘এটা গবেষণা করার জন্য দেওয়া হয়েছে’। কিন্তু নির্দেশনায় শুধু গবেষণার কথা লেখা ছিল না জানালে তিনি বলেন, ‘আমাদের চিঠি দেওয়া হয়েছে এটা জানিয়েই। যেসব প্রতিষ্ঠান অ্যান্টিবডি নিয়ে গবেষণা করার জন্য প্রটোকল অনুযায়ী আবেদন করেছে, তাদের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেটা ব্যক্তিপর্যায়ে নয়।’
অনুমতি কেন দেওয়া হচ্ছে না প্রশ্নে তিনি বলেন, সেটা মন্ত্রণালয় ভালো বলতে পারবে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশিকার প্রসঙ্গ তুললে ডা. ফরিদ হোসেন প্রতিবেদককে প্রশ্ন করেন, ‘আপনি অ্যান্টিবডি দিয়ে কী করবেন? না হলেই কী করবেন আর হলেই কী করবেন? আমাদের কাছে যখন মন্ত্রণালয়ের অনুমতি দেওয়া হবে, তখন আমরা অনুমোদন দিয়ে দেবো। এখনও অনুমতি দেয়নি।’ এ বিষয়ে জানতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব লোকমান হোসেন মিঞাকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
করোনার অ্যান্টিবডি টেস্ট কতদূর?
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ