নিজস্ব প্রতিবেদক : মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে গড়ে শিক্ষণ ক্ষতি হয়েছে ২৭ শতাংশ। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে বলে জানিয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ।
গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে প্রাথমিক শিক্ষার উদ্যোগ ও অর্জন নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে সচিব এ তথ্য জানান। এ সময় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন উপস্থিত ছিলেন।
করোনার কারণে প্রাথমিকে কতটুকু শিক্ষণ গ্যাপ হয়েছে, সেটার কোনো মূল্যায়ন আছে কি না, জানতে চাইলে সচিব বলেন, ‘করোনার দুই থেকে আড়াই বছরে আমাদের শিক্ষণ গ্যাপ হয়েছে, এটি সত্য। এজন্য পিইডিপি-৪ (চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির) এর একটি কম্পোনেন্টের আওতায় এনসিটিবি আনুষ্ঠানিকভাবে একটি গবেষণা করেছে। ফলাফল আমাদের সঙ্গে শেয়ারও করেছে। তারা এটি আনুষ্ঠানিকভাবে জানাবে।’
তিনি বলেন, ‘ওইসময় আমরা শিক্ষণ গ্যাপ কমাতে সিএসএসআর নামে একটি প্রকল্প নিয়েছিলাম। এটি অত্যন্ত সফল প্রকল্প হিসেবে শেষ করেছি। মূল্যায়নে এসেছে, এটি ৯০ শতাংশের বেশি সফল হয়েছে। এনসিটিবি শিক্ষণ ক্ষতি নিয়ে যে স্টাডি করেছে, সেখান আমরা দেখেছি শিক্ষণ ক্ষতি গড়ে ২৭ শতাংশ, বিভিন্ন বিষয়ে এ ক্ষতি হয়েছে। কোনো বিষয়ে বেশি, কোনো বিষয়ে কম, গ্রামে এক রকম, শহরে আরেক রকম। এ ক্ষতিগুলো কীভাবে কাটাবো, তা চিহ্নিত করেছি।’
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব বলেন, ‘দুর্যোগকালে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা করেছি। সেই কর্মপরিকল্পনার আওতায় মাস্টার ট্রেইনারদের ট্রেনিং দেওয়া শুরু করা হয়েছে। তারা প্রধান শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেবেন, যাতে দুর্যোগকালে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারি।’
জুন থেকে চালু হবে ‘স্কুল ফিডিং’: প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন বলেন, ‘চলতি বছরের জুন থেকে স্কুল ফিডিং প্রকল্প চালু হবে। দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় স্কুল ফিডিং প্রকল্পটি ২০১০ সালে চালু হয়ে গত বছরের জুনে শেষ হয়। প্রকল্পটি দেশের ১০৪ উপজেলায় চালু ছিল। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের পুষ্টি ঘাটতি পূরণ, বিদ্যালয়ে শতভাগ ভর্তি, নিয়মিত বিদ্যালয়ে উপস্থিতি, ঝরে পড়া রোধ, যথাসময়ে শিক্ষাচক্র সমাপ্তকরণে প্রকল্পটি কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। তাই দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্কুল ফিডিং কার্যক্রম গ্রহণ করার জন্য সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছে।’
চলতি মাসেই প্রাথমিক শিক্ষকদের বিভাগ-জেলায় বদলি: দ্বিতীয় ধাপে চলতি মাসেই (ফেব্রুয়ারি) আন্তঃজেলা, আন্তঃসিটি করপোরেশন এবং আন্তঃবিভাগ পর্যায়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বদলি কার্যক্রম শুরু হবে বলে জানিয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব ফরিদ আহম্মদ। মঙ্গলবার সচিবালয়ে প্রাথমিক শিক্ষার উদ্যোগ ও অর্জন নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান তিনি। এসময় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন উপস্থিত ছিলেন। সচিব বলেন, ‘অনলাইন শিক্ষক বদলি নিয়ে অনেকদিন ধরে এ মন্ত্রণালয় পাইলটিং করছে। আমরা খুবই ডায়নামিক একটি সফটওয়্যার করেছি। এ সফটওয়্যারের কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যাগুলো চিহ্নিত ও শিক্ষকদের চাহিদাগুলো বিবেচনা করে গত বছরের ২২ ডিসেম্বর একটি সমন্বিত নীতিমালা জারি করেছি। এটার আলোকে প্রথমপর্যায়ে আন্তঃউপজেলা বদলি কার্যক্রম শুরু করেছি। এক সপ্তাহের মধ্যে ২৫ হাজার আবেদন নিষ্পত্তি হয়েছে।বিশ্বাস করি এর মাধ্যমে ৯৮ শতাংশ শিক্ষক সন্তুষ্ট হয়েছেন।’ তিনি বলেন, ‘দ্বিতীয় ধাপে এ মাসেই আন্তঃজেলা, আন্তঃসিটি করপোরেশন এবং আন্তঃবিভাগ পর্যায়ে শিক্ষক বদলিতে আরও কিছু কাজ করতে হবে। সেই কাজটা করছি।’
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপজেলাভিত্তিক নিয়োগ করা হয় এবং বিভিন্ন সময় আন্তঃজেলা, আন্তঃউপজেলা এবং আন্তঃবিভাগে যৌক্তিক প্রয়োজনে বদলি করা হয়ে থাকে। কিন্তু দেখা গেছে এ বদলিকে কেন্দ্র করে মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর থেকে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত একটি বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হতো, নানা জায়গা থেকে বদলির জন্য সুপারিশ, অনুরোধ, আবেদন, সাক্ষাৎ, যোগাযোগ এসব ছিল নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার।’
তিনি বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিপুল সংখ্যক শিক্ষককে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে দ্রুততার সঙ্গে অনলাইনে বদলির সিদ্ধান্ত হয়। পাইলটিং করে প্রায় ৪ লাখ শিক্ষককে দ্রুততম সময়ে বদলিতে গত ২২ ডিসেম্বর অনলাইন বদলি নীতিমালা জারি করা হয়েছে। প্রথমপর্যায়ে মাত্র সাতদিনের মধ্যে অনলাইনে বদলির জন্য করা ২৫ হাজার আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়েছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের কার্যক্রমের জন্য পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।’
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের প্রোফাইল প্রণয়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। শিক্ষার্থীদের যদি যাবতীয় তথ্য সম্বলিত প্রোফাইল যদি প্রণয়ন করতে পারি তবে এটা বহুমুখী কাজে লাগবে।’ ‘প্রকল্পটি দু-বছর আগে নেওয়া হয়েছিল। আমরা বরিশালের একটি জেলায় এর পাইলটিং করেছিলাম। সেখানে ৮০ শতাংশ তথ্য আমরা নিতে পেরেছি। কিন্তু মধ্যে আমাদের কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল। এবার আমরা কাজটি জোরেশোরে শুরু করেছি। আমাদের টার্গেট আগামী বছরের জুনের মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ের সরকারি-বেসরকারি সব শিক্ষার্থীর প্রোফাইল প্রণয়নের কাজ শেষ করবো।’ ফরিদ আহাম্মদ বলেন, ‘প্রথম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। কিন্তু শিক্ষক প্রশিক্ষণ এখনও শুরুই হয়নি। অন্যদিকে, শিক্ষক প্রশিক্ষণের মেয়াদ ১৮ মাস করা হয়। সেজন্য মডিউলও করা হয়। কিন্তু পরে দেখা গেছে প্রশিক্ষণের মেয়াদ কমানো হয়েছে। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সচিব বলেন, এ বিষয়ে আমরা জানাইনি তাই ভুল তথ্য পরিবেশন করা হচ্ছে। এবার প্রথম শ্রেণির নতুন পাঠ্যক্রম চালু হয়েছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির বইয়ের পা-ুলিপি প্রণয়নের কাজ শুরু হয়ছে। মার্চ মাসে এটা সম্পন্ন হবে।’ এবার নভেম্বরের মধ্যে প্রাথমিকের বই ছাপানোর কার্যক্রম সম্পন্ন করা হবে জানিয়ে সচিব বলেন, ‘এজন্য আমরা বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা হাতি নিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের কাজ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) করার কথা। কিন্তু তারা একা পারছে না। তারা গত ৩১ জানুয়ারি আমাদের চিঠি দিয়ে জানিয়েছে তারা একা এটা করতে পারছে না। আমরা গত ১৪ দিনে এক লাখ ৭১ হাজার শিক্ষককে অনলাইন বিস্তরণ কোর্স করানো হয়েছে। আমাদের টার্গেট মার্চের মধ্যে সরকারি প্রাথমিক, কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করবো।’
২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রাথমিক বৃত্তির ফল: প্রাথমিকের বৃত্তি পরীক্ষার ফল আগামী ২৫ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ। এবার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা গ্রহণ না করার কারণে সরাসরি বৃত্তি পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেওয়া হবে। বৃত্তি পরীক্ষায় প্রায় ৬ লাখ শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেছে। পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে ৮০ হাজার শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দেওয়া হবে। এর অর্ধেক ছাত্র, বাকি অর্ধেক ছাত্রী। প্রাথমিকের পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষা ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। ২ ঘণ্টার মধ্যে চার বিষয়ের মোট ১০০ নম্বরের বৃত্তি পরীক্ষা দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি প্রাপ্তরা ৩০০ টাকা ও সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি প্রাপ্তরা ২২৫ টাকা হারে মাসিক বৃত্তি পেয়ে থাকে।
করোনায় প্রাথমিকের শিক্ষণ ক্ষতি ২৭ শতাংশ
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ