খুরশিদ জামান কাকন : দীর্ঘ দিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। নেই পড়াশোনার অতিরিক্ত চাপ। হাতে এখন অফুরন্ত সময়। এসময়টা কাজে লাগিয়ে অনেক শিক্ষার্থীই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হিসেবে আবির্ভাব হয়েছেন৷ শিক্ষাজীবনে স্বাবলম্বী হয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তেমনি একজন লুৎফুন নাহার লুনা।
তার করোনার আগ পর্যন্ত কিছু করার ভাবনা ছিল না। অন্য সবার মতো তিনিও পড়াশোনায় ব্যস্ত ছিলেন। এর বাইরে অনলাইনে অযথাই অবসর সময় কাটাতেন। এই করোনাকালীন সময় কাজে লাগানোর প্রয়াস হিসেবে তিনি হস্তশিল্পের কাজ শিখে আলোর মুখ দেখেছেন।
নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার শিক্ষার্থী লুৎফুন নাহার লুনা। বাড়ি সৈয়দপুরের গোলাহাটে। পড়াশোনা করছেন দিনাজপুর আদর্শ কলেজে। করোনার কারণে কলেজ বন্ধ। ঘরবন্দি সময় কাটছে। দীর্ঘ দিন শুয়ে-বসে থাকতে থাকতে তিনি তিক্ত হয়ে উঠছিলেন। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে লকডাউনের শুরুর দিকে বাড়িতে মায়ের কাছ থেকে কারুকাজ শেখেন।
একদিন শখের বশে নিজের জন্য একটি জামায় হাতের কাজ করেন। প্রথমবারের মতো নিজের হাতের কাজ করা জামা পরে ফেসবুকে ছবি পোস্ট করেন। সঙ্গে সঙ্গেই ফেসবুক ফ্রেন্ডের দুই-একজন কৌতুহলী হয়ে লুনার কাছে বিভিন্ন ডিজাইনের জামা বানিয়ে নেওয়ার বায়না ধরেন। মূলত তাদের আবদার পূরণের মাধ্যমেই সৈয়দপুরের খুদে এই নারীর ব্যবসায়ী জীবনে পথচলা শুরু।
শূন্য পুঁজি দিয়ে শুরু করা লুনার ব্যবসায় লাভের মুখ দেখতে খুব বেশি সময় লাগেনি। ২০২০ সালের আগস্টে যাত্রা শুরু করার পর থেকেই একটার পর একটা অর্ডার পেতে থাকেন। প্রথমদিকে তার এই কাজে পরিবারের সদস্যদের খুব একটা আগ্রহ না থাকলেও পরবর্তী সময়ে লুনার এগিয়ে যাওয়ার পথে পরিবারই ছিল সবচেয়ে বড় প্রেরণা। লুনা তার ব্যবসায়িক কাজের প্রচার-প্রচারণার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করেন। ফেসবুকে ‘শখ’ নামে একটি পেজ খুলে অনলাইনে অর্ডার গ্রহণ করেন। মাত্র কয়েক মাসে তিনি ৪০০টিরও বেশি অর্ডার ডেলিভারি দিতে সক্ষম হন। তিনি সাধারণত থ্রি-পিস, পাঞ্জাবি, ফতুয়া ও শিশুদের জামায় কারুকাজ করে থাকেন।
বাংলাদেশের উদ্যোমী নারীদের সবচেয়ে বড় অনলাইন প্ল্যাটফর্ম উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স (উই) থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখা লুনা ব্যবসার শুরু থেকেই ক্রেতাদের চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করে আসছেন। এ কারণে ক্রেতাদের চাহিদা সাপেক্ষে বর্তমানে তিনি সেলাই করার জন্য ৬ জন কারিগর নিযুক্ত করেছেন। সেইসঙ্গে আশেপাশের নারীদেরও নিজ উদ্যোগে হাতের কাজ শিখিয়ে যাচ্ছেন। শুধু তিনি নিজে নন, বরং পিছিয়ে পড়া প্রতিবেশী নারীরাও আয়ের পথ খুঁজে পাচ্ছেন।
অল্প দিনের পথচলায় সাফল্য পাওয়া শিক্ষার্থী লুৎফুন নাহার লুনা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে চান। জীবন চলার পথে একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চান। আর এজন্য তিনি মনস্থির করে পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। ধীরে ধীরে নিজের স্বপ্নের পথে হাঁটছেন। অদূর ভবিষ্যতে তিনি নিজস্ব কারখানা ও শো-রুম প্রতিষ্ঠা করতে চান। সেইসঙ্গে নারীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে ঘরকুনো নারীদের স্বাবলম্বী করতে চান। লুৎফুন নাহার লুনা বলেন, এই করোনাকালে ঘরবন্দি সময়টা শুয়ে-বসে কাটাতে চাইনি। প্রথম থেকেই কিছু একটা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কী করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। একদিন শখের বশে নিজের জন্য একটি জামায় কারুকাজ করি। পরে ব্যাপক সাড়া পাওয়ায় এই কাজটাকেই বেছে নেই এবং ধীরে ধীরে কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের দেখা পাই। সৈয়দপুরের এই নারী আরও বলেন, প্রথমদিকে ব্যবসা নিয়ে আমার সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা ছিল না। কিন্তু এখন পড়াশোনার সাথে সাথে আমার ব্যবসাটাকেও বড় করার চেষ্টায় আছি। এখন আমার ভাইবোনদের ছোট ছোট আবদারগুলোও পূরণ করতে পারি। সত্যি বলতে শিক্ষাজীবনেই উপার্জন করাটা আমার কাছে অনেক বড় একটা প্রাপ্তি।