ঢাকা ১০:১৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৩ জুলাই ২০২৫

কম্বল পেটাতে হয় লুকানো ধুলোর বিরুদ্ধে

  • আপডেট সময় : ০৯:১০:৩৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৩০ অক্টোবর ২০২২
  • ৮৩ বার পড়া হয়েছে

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম : সামনে শীতকাল আসছে। সযতনে বেঁধে তুলে রাখা লেপ-কম্বলের কদর বেড়ে যাবে ক’দিন পর। আমাদের দেশে শীতকালের পরিধি খুব স্বল্প। শীতের তীব্রতা গ্রামের মানুষ কিছুটা অনুভব করলেও শহরের মানুষ শীতের আমেজ পেতে শুরু করার আগেই ঠান্ডা বিদায় নিয়ে নেয়। তাই ধনী ব্যক্তিরা যত দামি কম্বল-লেপ কিনুন না কেন তার ব্যবহার খুব কম।
কভার খুলে ৯-১০ মাস পলিথিন দিয়ে বেঁধে চ্যাপ্টা করে রাখাটাই লেপ-কম্বলের কপালের নিয়তি। তবুও প্রতি বছর শীতের আগমনে সাথে সাথে বেঁধে রাখা লেপ-কম্বল বের করে রোদে শুকিয়ে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ধুলোবালি ঝেড়ে নতুন কভার লাগিয়ে শীত নিবারণের মহাপ্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় প্রায় সবার বাড়িতে।
আগেকার দিনে শরৎকাল শেষ হওয়ার পর হেমন্তের আগমনে শুষ্ক মৌসুম শুরু হলে ধুলো-বালির প্রকোপ বেড়ে যেত। এখন সারা বছর নির্মাণকাজ চলে এবং বর্ষাকালে অনাবৃষ্টি থাকায় বছরের সবসময় ধুলো-বালির সঙ্গে মাখামাখি করে বসবাস করতে হয়।
রাজনীতির মাঠেও তেমটি ঘটে চলেছে এখন। আগে ভোট হতো কৃষকদের ফসল ঘরে ওঠার পর শুষ্ক ও অলস দিনে। কারণ তখন দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ কৃষিজীবী ছিল। তারা মিলেমিশে গ্রামে বাস করতো। এখন মানুষ গ্রামে থাকতে চায় না। কারণ শুধু স্বল্প জমি চাষাবাদ করে সংসার চলে না। সঙ্গে বাড়তি খরচ মেটানোর জন্য বাড়তি আয় করতে হয়। তাই কিছু একটা করতে গিয়ে শহরের সাথে নিত্য যোগাযোগ রাখতে হয়। এজন্য শহরায়ণের গতি বেড়ে গেছে। যোগাযোগ বেড়েছে বহুগুণ। মুঠোফোন ও অন্যান্য গণমাধ্যমের সাথে দ্রুত সংযোগ নেওয়ার সুযোগে যে কোনো তথ্যপ্রাপ্তির ব্যাপ্তি ঘটেছে ব্যাপকভাবে। এখন নানা পর্যায়ে সারা বছর ভোট গ্রহণ করা হয়। ভোট নিয়ে মানুষের কৌতূহল অনেকগুণ বেড়ে গেছে। বিশেষ করে সরকারি দলের নমিনেশন পেলে বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়া যায় এবং দ্রুত অনেক কিছু অর্জন করা সহজ হয়। সেজন্য মানুষের মধ্যে কিছু অর্থ জমা হলেই ভোটে অংশগ্রহণ করার জন্য নমিনেশন পেতে মরিয়া হতে দেখা যায়। কারণ হলো প্রতিযোগিতাবিহীন ভোটে বিনা পরিশ্রমে জয়লাভ করার উদাহরণ চারদিকে তৈরি হয়ে কিছু স্বার্থপর মানুষের লোভের হাতছানিটা বাড়িয়ে তুলেছে। বিশেষ করে উঠতি ও নব্য টাকাওয়ালাদের মধ্যে এই প্রবণতা প্রবল। তারা নির্বাচন করার জন্য মরিয়া। জমি, ব্যবসায় জমানো টাকা সবকিছুর বিনিময়ে ভোট করতে আগ্রহী তারা। তারা ভালোভাবে জানে নমিনেশন পেয়ে ভোট করার অর্থ জিতে আসা। কারণ, প্রধান বিরোধী মাঠ ফাঁকা। এভাবে দেশের নির্বাচন পদ্ধতি একটি গণতন্ত্রবিহীন ভয়ংকর ব্যবস্থায় রূপ নিয়েছে। নির্বাচন একটি ব্যয়বহুল একমুখী হাস্যকর খেলায় পরিণত হয়ে পড়েছে। এসব নির্বাচনে বিনাভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জন-জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে থাকায় দেশে কোনো নির্মাণকাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করা যাচ্ছে না। কেউ কারও কথায় কর্ণপাত করছে না। দুর্ঘটনা বা বড় কোনো সমস্যা হলে একজন আরেকজনের ওপর দায় চাপিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করছে। তার কারণ হলো- সেখানেও নির্বাচনী কম্বলটার মতো ধূলো-বালি ঠিকমতো না পিটিয়ে ময়লাসহ গায়ে জড়িয়ে দেওয়ার কৌশল চালানো হচ্ছে। সেখানে জনসেবা ও জনকল্যাণের তাগিদে জনমতের ধার ধারার কোনো বালাই নেই। এই ঘৃণ্য কৌশল গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সুবাদে মানুষ ভিন্নভাবে জানতে পেরে দ্রুত নানাভাবে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। এসব ময়লা একশ্রেণির ধড়িবাজ মানুষের অস্থিমজ্জায় গেঁথে যাচ্ছে। যেসব মানুষ দৈনিক সুগন্ধি দিয়ে গোসল করে, পাঁচবার মুখ ধোয় অথচ তারা পাঁচ বছরে একবারও তাদের অন্তর ধৌত করে না। অন্যায় কাজের অবৈধ অর্থ দিয়ে ভালো কাজ করে সুনাম পেতে চায়। তাই তাদের অন্তরের কালিমা আরও বেশি শক্ত হয়ে যাচ্ছে। তারা অপরাধীদের চেনে, ধরেও আনে কিন্তু আসল সত্য আদায় করে না।
সত্যটাকে কেউ স্বীকার করলে নিজের গা বাঁচানোর জন্য সেই সত্যকে গোপন রেখে মুখ দিয়ে মিথ্যা বলিয়ে প্রমাণ রাখার জন্য আরও বেশি পেটায়। ফলে কম্বলের ধূলার মতো আর ধূলো-বালি বের না হয়ে কম্বলের লোম, পশম বা লেপের সেলাই-তুলো ছিঁড়ে যায়। রিমান্ডে নিয়ে জোর করে মিথ্যাটা স্বীকার করে প্রাণভয়ে, বাধ্য হয়ে। এজন্য চরম নির্যাতনের শিকার হতে হয়। পরে এসব ঘৃণ্য প্রচেষ্টার কথা অকপটে স্বীকার করে তারা আহাজারি করে। তাহলে আসল অপরাধীদের ময়লা-ধুলোর বিরুদ্ধে না হয়ে কার বিরুদ্ধে এসব পিটুনি ও নির্যাতন চলে?
বিশ্লেষকরা বলেন, ওরা নির্দোষীদের পিটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে টাকা আদায় করে। তারা যেসব টাকা গ্রহণ করে সেগুলো নিজেদের কম্বল ও বালিশের নিচে রেখে দেয় ও পাচার করে। পীড়নক হিসেবে পরিচিত কারও কারও বিরুদ্ধে এজন্য ঘৃন্য সংবাদ শিরোনাম বের হতে দেখা যায়। এসবের জন্য ঘৃণ্য রাজনীতি ও জনক্ষতিকর কৌশলগ্রহণকে দায়ী করা হচ্ছে। কিছুদিন আগে ময়মনসিংহে সরকারি ইঙ্গিতে সড়ক-পরিবহন হরতাল হলো। এর স্বল্পদিন পরই খুলনায় সড়ক, নদী, সমুদ্র, হাঁটাপথ সবকিছুই বন্ধ করে দিয়ে হরতাল পালিত হলো। কিন্তু মানুষ সেসব কিছুই গ্রাহ্য করেনি। সেখানে জরুরিভাবে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য রোগী ছিল, চাকরির ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য ঢাকায় যাওয়ার যাত্রী ছিল। তাদের জন্য কি কিছু চিন্তা করা হয়েছিল? তাহলে রাজার রাজনীতি কি অসহায় প্রজাদের পীড়ন করা?
রংপুরের বিভাগীয় সমাবেশ ঠেকাতে মোটর মালিক সমিতির ঘাড়ে চাপিয়ে আবারো একই ঘৃণ্য কাজ শুরু করা হয়েছে। এবার দুটি জেলার বাসমালিক সমিতির নেতারা হরতালর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ঘোষণা দিয়েছেন। তাদের একজন শীর্ষ নেতা বলেছেন, যেসব কারণে রংপুর বাসমালিক সমিতি পরিবহন ধর্মঘট ডেকেছে সেটা নয় বরং একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের জনসভা ভন্ডুল করার জন্য সেটা করা হচ্ছে। কিন্তু খুলনার জনসভার মতো এখানকার জনগণও সেটা মানেনি। ‘কুড়িগ্রাম বাসমালিক সমিতির সেটাতে একাত্মতা ছিল না।’
‘রংপুর জেলা মোটর মালিক সমিতির ডাকা পরিবহন ধর্মঘটের কারণ হিসেবে কুড়িগ্রাম জেলায় ‘প্রশাসনিক হয়রানির’ উল্লেখ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সম্পাদক লুৎফর রহমান বলেন, বুধবার কুড়িগ্রামের ত্রিমোহনীতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে কিছু মিনি বাসে জরিমানা করা হয়েছিল। সেই প্রসঙ্গ টেনে এটা (হয়রানি) বলা হয়েছে বলে জেনেছি। …মোবাইল কোর্টে জরিমানার সমালোচনা করে মোটর মালিক সমিতির এই নেতা বলেন, ‘হাইকোর্টের নির্দেশনা অমান্য করে সড়ক-মহাসড়কে অনেক অবৈধ যানবাহন চলাচল করছে। কিন্তু মোবাইল কোর্ট বসলে সেসব অবৈধ যানবাহনের কোনো জরিমানা করছে না। অথচ সেসব যান তাদের সামন দিয়েই চলাচল করে।’
প্রকাশিত এসব তথ্য থেকে বোঝা যায়, বিএনপির ডাকা ২৯ অক্টোবর শনিবারের জনসভা নস্যাৎ করার জন্য সরকারি ইঙ্গিতে এসব ঘৃণ্য তৎপরতা চালানো হয়েছে। কিন্তু মানুষ সে বাধা উপেক্ষা করে জনসভায় গেছে।
এসব অপতৎপরতার ফলে বৃহত্তর রংপুরে শাসক দলের বিরুদ্ধে মানুষ আরও ফুঁসে উঠছে। এমনিতেই এ অঞ্চলে বিরোধী দলগুলোর জনপ্রিয়তা ও প্রাধান্য বেশি। সেক্ষেত্রে জনসভাকে কেন্দ্র করে এধরনের হঠকারিতামূলক পরিবহন ধর্মঘট ডাকা শাসক দলে উন্নয়নকাজ করার জনপ্রিয়তা যতটুকু ছিল সেটুকুও ম্লান করে দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। জনসভার বিরুদ্ধে ডাকা এসব ধর্মঘট তাদের জনভীতিকে আরও প্রামাণ্য করে তুলছে এবং এটা তাদের জন্য আরও বুমেরাং হচ্ছে বৈ কিছু নয়।
সারাদেশে অনেক স্পর্শকাতর জায়গায় ময়লা-ধূলোর আস্তরণ পড়ে কল্কে জ্যাম লেগে গেলেও নেতাদের সেদিকে নজর নেই। তারা অহেতুক বিএনপির জনসভা বানচাল করার পেছনে লেগে গেছে। যেটাতে কোনো লাভ তো নেই বরং এসব অপতৎপরতা বিরোধী রাজনীতিকে আরও বেগবান করাতে ‘গিয়ার অয়েল’ হিসেবে কাজ করছে। এমনিতেই তাদের নেতাদের অজ্ঞতা, মোকারি ও ক্রমাগত উপহাসের জন্য সরব হয়েছে বিরোধী শক্তি, সাড়া ফেলেছে বিএনপির মাঠের রাজনীতি। তারা ভোটারদের উজ্জীবিত করে তুলছে জাতীয় নির্বাচনে ভোট চুরি ঠেকানোর জন্য। ভোটাররা এবার খুবই কৌতূহলী ও নিজেদের ভোট নিজের হাতে নিশ্চিতভাবে প্রদানের ব্যাপারে বদ্ধপরিকর।

জমে থাকা ময়লা পরিষ্কার করার জন্য কম্বল পেটাতে হয় তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা ময়লা-ধূলোর বিরুদ্ধে। ঘাম, ময়লা-ধুলো-কাদা শরীর থেকে ভালোমতো না ধুয়ে সুগন্ধি মাখলে যেমন আরও উৎকট গন্ধ বের হয় তেমনি মিথ্যা, চুরি-ডাকাতি, দুর্নীতির সাথে মাখামাখি করে ভালো থাকার চেষ্টা করলে নিজের বৈপরিত্য ও দৈন্যতাই প্রকাশ পায়। নিজের অবস্থান যাচাই না করে কাউকে অহেতুক আঘাত দিতে গিয়ে কম্বলের লোম উজাড় করে ফেললে ডিজিটাল যুগের অতি চালাক জনগণ সেই ছেঁড়া কম্বল কি আবার ব্যবহার করতে চাইবে?
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

কম্বল পেটাতে হয় লুকানো ধুলোর বিরুদ্ধে

আপডেট সময় : ০৯:১০:৩৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৩০ অক্টোবর ২০২২

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম : সামনে শীতকাল আসছে। সযতনে বেঁধে তুলে রাখা লেপ-কম্বলের কদর বেড়ে যাবে ক’দিন পর। আমাদের দেশে শীতকালের পরিধি খুব স্বল্প। শীতের তীব্রতা গ্রামের মানুষ কিছুটা অনুভব করলেও শহরের মানুষ শীতের আমেজ পেতে শুরু করার আগেই ঠান্ডা বিদায় নিয়ে নেয়। তাই ধনী ব্যক্তিরা যত দামি কম্বল-লেপ কিনুন না কেন তার ব্যবহার খুব কম।
কভার খুলে ৯-১০ মাস পলিথিন দিয়ে বেঁধে চ্যাপ্টা করে রাখাটাই লেপ-কম্বলের কপালের নিয়তি। তবুও প্রতি বছর শীতের আগমনে সাথে সাথে বেঁধে রাখা লেপ-কম্বল বের করে রোদে শুকিয়ে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ধুলোবালি ঝেড়ে নতুন কভার লাগিয়ে শীত নিবারণের মহাপ্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় প্রায় সবার বাড়িতে।
আগেকার দিনে শরৎকাল শেষ হওয়ার পর হেমন্তের আগমনে শুষ্ক মৌসুম শুরু হলে ধুলো-বালির প্রকোপ বেড়ে যেত। এখন সারা বছর নির্মাণকাজ চলে এবং বর্ষাকালে অনাবৃষ্টি থাকায় বছরের সবসময় ধুলো-বালির সঙ্গে মাখামাখি করে বসবাস করতে হয়।
রাজনীতির মাঠেও তেমটি ঘটে চলেছে এখন। আগে ভোট হতো কৃষকদের ফসল ঘরে ওঠার পর শুষ্ক ও অলস দিনে। কারণ তখন দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ কৃষিজীবী ছিল। তারা মিলেমিশে গ্রামে বাস করতো। এখন মানুষ গ্রামে থাকতে চায় না। কারণ শুধু স্বল্প জমি চাষাবাদ করে সংসার চলে না। সঙ্গে বাড়তি খরচ মেটানোর জন্য বাড়তি আয় করতে হয়। তাই কিছু একটা করতে গিয়ে শহরের সাথে নিত্য যোগাযোগ রাখতে হয়। এজন্য শহরায়ণের গতি বেড়ে গেছে। যোগাযোগ বেড়েছে বহুগুণ। মুঠোফোন ও অন্যান্য গণমাধ্যমের সাথে দ্রুত সংযোগ নেওয়ার সুযোগে যে কোনো তথ্যপ্রাপ্তির ব্যাপ্তি ঘটেছে ব্যাপকভাবে। এখন নানা পর্যায়ে সারা বছর ভোট গ্রহণ করা হয়। ভোট নিয়ে মানুষের কৌতূহল অনেকগুণ বেড়ে গেছে। বিশেষ করে সরকারি দলের নমিনেশন পেলে বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়া যায় এবং দ্রুত অনেক কিছু অর্জন করা সহজ হয়। সেজন্য মানুষের মধ্যে কিছু অর্থ জমা হলেই ভোটে অংশগ্রহণ করার জন্য নমিনেশন পেতে মরিয়া হতে দেখা যায়। কারণ হলো প্রতিযোগিতাবিহীন ভোটে বিনা পরিশ্রমে জয়লাভ করার উদাহরণ চারদিকে তৈরি হয়ে কিছু স্বার্থপর মানুষের লোভের হাতছানিটা বাড়িয়ে তুলেছে। বিশেষ করে উঠতি ও নব্য টাকাওয়ালাদের মধ্যে এই প্রবণতা প্রবল। তারা নির্বাচন করার জন্য মরিয়া। জমি, ব্যবসায় জমানো টাকা সবকিছুর বিনিময়ে ভোট করতে আগ্রহী তারা। তারা ভালোভাবে জানে নমিনেশন পেয়ে ভোট করার অর্থ জিতে আসা। কারণ, প্রধান বিরোধী মাঠ ফাঁকা। এভাবে দেশের নির্বাচন পদ্ধতি একটি গণতন্ত্রবিহীন ভয়ংকর ব্যবস্থায় রূপ নিয়েছে। নির্বাচন একটি ব্যয়বহুল একমুখী হাস্যকর খেলায় পরিণত হয়ে পড়েছে। এসব নির্বাচনে বিনাভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জন-জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে থাকায় দেশে কোনো নির্মাণকাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করা যাচ্ছে না। কেউ কারও কথায় কর্ণপাত করছে না। দুর্ঘটনা বা বড় কোনো সমস্যা হলে একজন আরেকজনের ওপর দায় চাপিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করছে। তার কারণ হলো- সেখানেও নির্বাচনী কম্বলটার মতো ধূলো-বালি ঠিকমতো না পিটিয়ে ময়লাসহ গায়ে জড়িয়ে দেওয়ার কৌশল চালানো হচ্ছে। সেখানে জনসেবা ও জনকল্যাণের তাগিদে জনমতের ধার ধারার কোনো বালাই নেই। এই ঘৃণ্য কৌশল গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সুবাদে মানুষ ভিন্নভাবে জানতে পেরে দ্রুত নানাভাবে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। এসব ময়লা একশ্রেণির ধড়িবাজ মানুষের অস্থিমজ্জায় গেঁথে যাচ্ছে। যেসব মানুষ দৈনিক সুগন্ধি দিয়ে গোসল করে, পাঁচবার মুখ ধোয় অথচ তারা পাঁচ বছরে একবারও তাদের অন্তর ধৌত করে না। অন্যায় কাজের অবৈধ অর্থ দিয়ে ভালো কাজ করে সুনাম পেতে চায়। তাই তাদের অন্তরের কালিমা আরও বেশি শক্ত হয়ে যাচ্ছে। তারা অপরাধীদের চেনে, ধরেও আনে কিন্তু আসল সত্য আদায় করে না।
সত্যটাকে কেউ স্বীকার করলে নিজের গা বাঁচানোর জন্য সেই সত্যকে গোপন রেখে মুখ দিয়ে মিথ্যা বলিয়ে প্রমাণ রাখার জন্য আরও বেশি পেটায়। ফলে কম্বলের ধূলার মতো আর ধূলো-বালি বের না হয়ে কম্বলের লোম, পশম বা লেপের সেলাই-তুলো ছিঁড়ে যায়। রিমান্ডে নিয়ে জোর করে মিথ্যাটা স্বীকার করে প্রাণভয়ে, বাধ্য হয়ে। এজন্য চরম নির্যাতনের শিকার হতে হয়। পরে এসব ঘৃণ্য প্রচেষ্টার কথা অকপটে স্বীকার করে তারা আহাজারি করে। তাহলে আসল অপরাধীদের ময়লা-ধুলোর বিরুদ্ধে না হয়ে কার বিরুদ্ধে এসব পিটুনি ও নির্যাতন চলে?
বিশ্লেষকরা বলেন, ওরা নির্দোষীদের পিটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে টাকা আদায় করে। তারা যেসব টাকা গ্রহণ করে সেগুলো নিজেদের কম্বল ও বালিশের নিচে রেখে দেয় ও পাচার করে। পীড়নক হিসেবে পরিচিত কারও কারও বিরুদ্ধে এজন্য ঘৃন্য সংবাদ শিরোনাম বের হতে দেখা যায়। এসবের জন্য ঘৃণ্য রাজনীতি ও জনক্ষতিকর কৌশলগ্রহণকে দায়ী করা হচ্ছে। কিছুদিন আগে ময়মনসিংহে সরকারি ইঙ্গিতে সড়ক-পরিবহন হরতাল হলো। এর স্বল্পদিন পরই খুলনায় সড়ক, নদী, সমুদ্র, হাঁটাপথ সবকিছুই বন্ধ করে দিয়ে হরতাল পালিত হলো। কিন্তু মানুষ সেসব কিছুই গ্রাহ্য করেনি। সেখানে জরুরিভাবে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য রোগী ছিল, চাকরির ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য ঢাকায় যাওয়ার যাত্রী ছিল। তাদের জন্য কি কিছু চিন্তা করা হয়েছিল? তাহলে রাজার রাজনীতি কি অসহায় প্রজাদের পীড়ন করা?
রংপুরের বিভাগীয় সমাবেশ ঠেকাতে মোটর মালিক সমিতির ঘাড়ে চাপিয়ে আবারো একই ঘৃণ্য কাজ শুরু করা হয়েছে। এবার দুটি জেলার বাসমালিক সমিতির নেতারা হরতালর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ঘোষণা দিয়েছেন। তাদের একজন শীর্ষ নেতা বলেছেন, যেসব কারণে রংপুর বাসমালিক সমিতি পরিবহন ধর্মঘট ডেকেছে সেটা নয় বরং একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের জনসভা ভন্ডুল করার জন্য সেটা করা হচ্ছে। কিন্তু খুলনার জনসভার মতো এখানকার জনগণও সেটা মানেনি। ‘কুড়িগ্রাম বাসমালিক সমিতির সেটাতে একাত্মতা ছিল না।’
‘রংপুর জেলা মোটর মালিক সমিতির ডাকা পরিবহন ধর্মঘটের কারণ হিসেবে কুড়িগ্রাম জেলায় ‘প্রশাসনিক হয়রানির’ উল্লেখ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সম্পাদক লুৎফর রহমান বলেন, বুধবার কুড়িগ্রামের ত্রিমোহনীতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে কিছু মিনি বাসে জরিমানা করা হয়েছিল। সেই প্রসঙ্গ টেনে এটা (হয়রানি) বলা হয়েছে বলে জেনেছি। …মোবাইল কোর্টে জরিমানার সমালোচনা করে মোটর মালিক সমিতির এই নেতা বলেন, ‘হাইকোর্টের নির্দেশনা অমান্য করে সড়ক-মহাসড়কে অনেক অবৈধ যানবাহন চলাচল করছে। কিন্তু মোবাইল কোর্ট বসলে সেসব অবৈধ যানবাহনের কোনো জরিমানা করছে না। অথচ সেসব যান তাদের সামন দিয়েই চলাচল করে।’
প্রকাশিত এসব তথ্য থেকে বোঝা যায়, বিএনপির ডাকা ২৯ অক্টোবর শনিবারের জনসভা নস্যাৎ করার জন্য সরকারি ইঙ্গিতে এসব ঘৃণ্য তৎপরতা চালানো হয়েছে। কিন্তু মানুষ সে বাধা উপেক্ষা করে জনসভায় গেছে।
এসব অপতৎপরতার ফলে বৃহত্তর রংপুরে শাসক দলের বিরুদ্ধে মানুষ আরও ফুঁসে উঠছে। এমনিতেই এ অঞ্চলে বিরোধী দলগুলোর জনপ্রিয়তা ও প্রাধান্য বেশি। সেক্ষেত্রে জনসভাকে কেন্দ্র করে এধরনের হঠকারিতামূলক পরিবহন ধর্মঘট ডাকা শাসক দলে উন্নয়নকাজ করার জনপ্রিয়তা যতটুকু ছিল সেটুকুও ম্লান করে দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। জনসভার বিরুদ্ধে ডাকা এসব ধর্মঘট তাদের জনভীতিকে আরও প্রামাণ্য করে তুলছে এবং এটা তাদের জন্য আরও বুমেরাং হচ্ছে বৈ কিছু নয়।
সারাদেশে অনেক স্পর্শকাতর জায়গায় ময়লা-ধূলোর আস্তরণ পড়ে কল্কে জ্যাম লেগে গেলেও নেতাদের সেদিকে নজর নেই। তারা অহেতুক বিএনপির জনসভা বানচাল করার পেছনে লেগে গেছে। যেটাতে কোনো লাভ তো নেই বরং এসব অপতৎপরতা বিরোধী রাজনীতিকে আরও বেগবান করাতে ‘গিয়ার অয়েল’ হিসেবে কাজ করছে। এমনিতেই তাদের নেতাদের অজ্ঞতা, মোকারি ও ক্রমাগত উপহাসের জন্য সরব হয়েছে বিরোধী শক্তি, সাড়া ফেলেছে বিএনপির মাঠের রাজনীতি। তারা ভোটারদের উজ্জীবিত করে তুলছে জাতীয় নির্বাচনে ভোট চুরি ঠেকানোর জন্য। ভোটাররা এবার খুবই কৌতূহলী ও নিজেদের ভোট নিজের হাতে নিশ্চিতভাবে প্রদানের ব্যাপারে বদ্ধপরিকর।

জমে থাকা ময়লা পরিষ্কার করার জন্য কম্বল পেটাতে হয় তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা ময়লা-ধূলোর বিরুদ্ধে। ঘাম, ময়লা-ধুলো-কাদা শরীর থেকে ভালোমতো না ধুয়ে সুগন্ধি মাখলে যেমন আরও উৎকট গন্ধ বের হয় তেমনি মিথ্যা, চুরি-ডাকাতি, দুর্নীতির সাথে মাখামাখি করে ভালো থাকার চেষ্টা করলে নিজের বৈপরিত্য ও দৈন্যতাই প্রকাশ পায়। নিজের অবস্থান যাচাই না করে কাউকে অহেতুক আঘাত দিতে গিয়ে কম্বলের লোম উজাড় করে ফেললে ডিজিটাল যুগের অতি চালাক জনগণ সেই ছেঁড়া কম্বল কি আবার ব্যবহার করতে চাইবে?
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।